‘ভেবেছিলাম নোটায় দেবো, এখন ভাবছি আপনাদের কথাই’

 জেলায় জেলায় দলের হাজার হাজার কর্মী এপ্রিল মাসের তীব্র রোদ মাথায় নিয়ে সারা দিন রাস্তার মোড়ে, বাজারে, স্টেশনে, ট্রেনে সর্বত্র কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে মানুষের হাতে পৌঁছে দিচ্ছেন সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের ‘জনস্বার্থে নির্বাচনকে কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে হবে’ বইটি৷ ঘন্টার পর ঘন্টা অক্লান্ত পরিশ্রমে পথচলতি শত–সহস্র মানুষকে বুঝিয়ে কর্মীদের বইটি বিক্রি করতে দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছেন মানুষ৷ বই হাতে নিয়ে তাঁরা জিজ্ঞেস করছেন, কীসের জোরে এত পরিশ্রম আপনারা হাসিমুখে করতে পারেন আদর্শ প্রচারের জন্য আর কোনও দলকে তো এত পরিশ্রম করতে দেখি না৷ কী পান এতে আপনারা? কর্মীরা বিনয়ের সাথে উত্তর দিচ্ছেন, সত্য প্রতিষ্ঠার, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অংশগ্রহণের তৃপ্তি৷ তাঁরা বলছেন, সে তো স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবীরা করতেন৷ কর্মীরা আবার উত্তর দেন, স্বাধীনতা আন্দোলনে বিদেশি শাসনের হাত থেকে মুক্ত হয়েছে দেশ৷ এখন দেশীয় শাসক শ্রেণির দ্বারা শোষিত–লুন্ঠিত হচ্ছে৷ তখন শত্রু ছিল বিদেশি সাম্রাজ্যবাদ, তাকে চেনা যেত সহজে৷ আজ শাসক হিসাবে যারা শোষণ–লুণ্ঠন চালাচ্ছে তারা দেশেরই একদল মানুষ৷ শত্রু হিসাবে তাদের চেনা অনেক কঠিন৷ তাদের বিরুদ্ধে লড়াইটাও তাই কঠিন৷

পশ্চিম মেদিনীপুরে দলের কর্মীরা একটি স্কুলের স্টাফরুমে গিয়ে বইটি শিক্ষকদের পড়ে দেখার জন্য আবেদন করেন৷ একজন শিক্ষক একটি বই নিয়ে পড়তে শুরু করেন, অন্যেরা শুনতে থাকেন৷ কিছুক্ষণ পর একজন শিক্ষিকা বাকি অংশ পড়েন৷ প্রধান শিক্ষক সহ সব শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী বইটি কেনেন এবং বলেন, একমাত্র আপনারাই সারা বছর মানুষের মধ্যে থাকেন৷

ঝাড়গ্রামের এক যুবক বইটি পড়ার পর এক কর্মীকে ডেকে বলেন, রাজনীতির নামে চুরি–দুর্নীতি আর নোংরামি দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে এবার ভেবেছিলাম, কাউকে নয়, এবার ভোটটা নোটায় দেবো৷ কিন্তু প্রভাস ঘোষের লেখা বইটি পড়ার পর বহু জিনিস আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে৷ এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ভোটটা আপনাদেরই দেবো৷ একই রকম ভাবে আর একজন যুবক বইটি পড়ে বললেন, সিপিএম–তৃণমূলের প্রতি বিরক্ত হয়ে ভেবেছিলাম এবার ভোটটা বিজেপিকে দেবো৷ বইটি পড়ে আমার সিদ্ধান্ত পাল্টেছি৷ আমার সমর্থন আপনারাই পাবেন৷

কর্মীদের পরিশ্রম দেখে বহু মানুষ অবাক হচ্ছেন৷ তাঁদের ডেকে নিয়ে চা–টিফিন খাওয়াচ্ছেন৷ দক্ষিণ কলকাতার হরিদেবপুরে বই বিক্রি করছিলেন দলের কর্মীরা৷ দুই ভদ্রলোক চায়ের দোকানে বসে অনেকক্ষণ দেখছিলেন আর মাঝে মাঝে নানা প্রশ্ন করছিলেন৷ একজন এক–ছাত্রী কর্মীকে ডেকে বললেন, আচ্ছা বলুন তো, রাজ্যে কংগ্রেস সিপিএম তো প্রায় অস্তিত্বহীন৷ লড়াই তো প্রায় দ্বিমুখী৷ কী হবে বলে মনে হয়? কর্মীটি বললেন, দেখুন, এ বাংলা নবজাগরণের উদগাতা রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুলের বাংলা৷ ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা, বিনয়–বাদল–দীনেশ, নেতাজির কর্মভূমি৷ বামপন্থী আন্দোলনের দীর্ঘ ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ৷ এখানে একটা সাম্প্রদায়িক, ফ্যাসিস্ট দলের কখনও জায়গা হতে পারে না৷ মানুষ তাদের কোনও ভাবেই গ্রহণ করবে না৷ তিনি বললেন, তা হলে কাকে ভোটটা দেবো? পাশে বসা অপর ব্যক্তি বললেন, তুমি তো একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলে৷ ওনারা এ রাজ্যে ৪২টা আসনেই লড়ছেন৷ উনি তো চাইবেনই তুমি ওদেরই ভোটটা দাও৷ কর্মীটি উত্তর দিলেন, কাকু, আপনি তো এখনই বলছিলেন আপনি সব সময়ই কোথাও না কোথাও আমাদের দেখেন আন্দোলন করতে, পুলিশের মার খেতে৷ তা হলে যারা সারা বছর মানুষের জন্য লড়াই করে তারাই তো আপনার সমর্থনের সত্যিকারের দাবিদার৷ তিনি হেসে সবাইকে চা–টিফিন খেতে বললেন৷ কর্মীটি যখন বললেন, আমরা তো অনেকেই রয়েছি, আমরাও খরচের কিছুটা শেয়ার করি৷ তিনি হেসে বললেন, না, থাক৷ তোমরা জনগণকে দেখো, আমরা তোমাদের দেখি৷ তারপর বইটি নিয়ে ঠিকানা দিলেন৷ বাড়িতে যেতে বললেন৷

এক জায়গায় কর্মীরা বই বিক্রি করছিলেন৷ বাইকে চড়ে এক যুবক এসে দাঁড়ালেন৷ সামনের যুব–কর্মীটির দিকে তাকিয়ে বললেন, কী ভাবছেন আপনারা? লক্ষ্য কী আপনাদের? কর্মীটি হেসে জবাব দিলেন, বিপ্লব৷ তিনিও হাসলেন৷ বললেন, অবশ্যই, বামপন্থীদের তো এটাই উদ্দেশ্য হওয়া উচিত৷ বিপ্লবই তো স্বপ্ন হওয়া উচিত৷ কর্মীটি বললেন, কোনও বুর্জোয়া দলের লেজুড়বৃত্তি না করে, কটা সিটে জিতব এই ভাবনা না ভেবে, সমাজ পরিবর্তনটাই একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত৷ যুবক বললেন, এ ব্যাপারে আমি আপনার সাথে একমত৷ বইটি নিয়ে বাড়ির ঠিকানা দিয়ে বললেন, এক সময় কলকাতার চারুচন্দ্র কলেজে এসএফআই করতাম৷ বুঝেছি, ওরা কিছু করবে না৷ আপনারাই ঠিক৷

রানাঘাট স্টেশনে তীব্র রোদের মধ্যে দলের এক সংগঠক একাই বই বিক্রি করছেন৷ এক যুবককে বইটি নেওয়ার কথা বলতেই তিনি হাসলেন৷ বললেন, হাসি দেখে অন্য কিছু ভাববেন না৷ আমি আপনাকে আধ ঘন্টা ধরে লক্ষ করছি৷ আমি এক সময় শাসক বামপন্থী দলের কর্মী ছিলাম৷ কিন্তু আপনাদের সম্পর্কে শ্রদ্ধা ছিল৷ আজ সেই শ্রদ্ধা আরও অনেক বেড়ে গেল৷ বইটি নিয়ে দলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা বলে গেলেন৷

মধ্য কলকাতায় একটি বাজারের সামনে কর্মীরা বই বিক্রি শুরু করার একটু পরেই বাজার সমিতির সঙ্গে যুক্ত এক ভদ্রলোক একটি হিন্দি বই নিয়ে গিয়েছিলেন৷ ঘন্টা তিনেক পরে কর্মীরা যখন বইপত্র গোটাচ্ছেন, তখন সেই ব্যক্তি ফিরে এসে বললেন, আর বই আছে? কর্মীরা একটি বই এগিয়ে দিতেই বললেন, আমাকে চারটে বই দিন৷ এক কর্মী জিজ্ঞেস করলেন, বইগুলি কাদের দেবেন? উত্তরে বললেন, আমাদের খোঁজটোঁজ নিয়ে লাভ নেই৷ আমরা সব এখানকার পরিচিত লাল লোক৷ বইগুলো কিছু জনকে দেবো৷ বেশি কথা এখানে বলতে পারবো না৷ তারপর নাম, ফোন নম্বর দিয়ে গেলেন৷

এক শিক্ষিকা বইটি পড়ে দলের সঙ্গে যুক্ত অন্য এক শিক্ষককে ফোন করে বলেছেন, রাজনীতি বলতে এতদিন বুঝতাম শুধু ভোট৷ প্রভাসবাবুর বইটি পড়ে নতুন করে শিখলাম রাজনীতি কী৷ কলেজ স্ট্রিটের এক বইয়ের দোকানদার বললেন, খবরের কাগজ আর টিভিতে বড় বড় দল আর নেতাদের প্রচারে সব গুলিয়ে যাচ্ছিল৷ বইটি পড়ে একটি সঠিক গাইডলাইন পেলাম৷ বইটি বিভিন্ন ভাষায় লক্ষ লক্ষ কপি ছাপা হয়েছে শুনে বললেন, এই বই কোটি কোটি ছেপে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া দরকার৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৩৭ সংখ্যা)