ভারত দুটি – একটি শোষকের অপরটি শোষিতের

পুঁজিবাদবিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পতাকা বহন করতে আজ প্রয়োজন হাজার হাজার ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিং, আসফাকউল্লা খান, প্রীতিলতার মতো বীর বিপ্লবীর

জামশেদপুরের সমাবেশে কমরেড প্রভাস ঘোষ

২৬ নভেম্বর এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলের তৃতীয় পার্টি কংগ্রেসের প্রকাশ্য সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় জামশেদপুর শহরের জি টাউন ক্লাব ময়দানে৷ বিশাল সেই সমাবেশে প্রধান বক্তা হিসাবে সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ বাংলায় বক্তব্য রাখেন, যা পরে হিন্দিতে অনুবাদ করে শোনানো হয়৷ কমরেড প্রভাস ঘোষের বক্তব্য এখানে প্রকাশ করা হল৷

কমরেড প্রেসিডেন্ট, কমরেডস ও বন্ধুগণ,

আপনারা শুনেছেন, মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ প্রতিষ্ঠিত এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলের তৃতীয় কংগ্রেসের প্রতিনিধি সমাবেশ ২১–২৫ নভেম্বর ঘাটশিলায় অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ আজ (২৬ নভেম্বর) জামশেদপুরে তার প্রকাশ্য সমাবেশ৷ ভারতবর্ষের বৃহৎ বুর্জোয়া দল বিজেপি, কংগ্রেস, বামপন্থী দল সিপিআই, সিপিআই (এম) এবং অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলি ঝাঁপিয়ে পড়েছে আগামী নির্বাচনের লক্ষ্যে৷ কে দিল্লির কুর্সি দখল করবে, কে দিল্লির কুর্সি রক্ষা করবে, কে কোথায় কটা সিট পাবে এই নিয়েই জল্পনা–কল্পনা চলছে৷ প্রতিদিন খবরের কাগজে, টিভিতে এই সব দলের নেতাদের ভাষণ, নানা কাজের ফিরিস্তি, ভবিষ্যতে কী করবেন তার প্রতিশ্রুতি এইসব নিয়েই প্রচার চলছে৷ সেই পরিস্থিতিতে কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে আমরা আলোচনা করেছি ভারতবর্ষের শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত জনগণ যাঁরা শোষণে শোষণে জর্জরিত, অত্যাচারিত, তাঁদের নানান জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে কীভাবে শ্রেণি সংগ্রাম এবং গণআন্দোলন গড়ে তোলা যায় এবং আগামী দিনের পুঁজিবাদ বিরোধী বিপ্লবী প্রস্তুতি চালানো যায়৷ এই উদ্দেশ্যে আমাদের দলকে আদর্শগত, রাজনীতিগত, নীতি–নৈতিকতাগত সমস্ত দিক থেকে কীভাবে আরও শক্তিশালী করা যায়, এটাই ছিল আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু, নির্বাচন নয়৷ আমাদের দল নির্বাচনভিত্তিক দল নয়৷ আমাদের দল বিপ্লবী দল৷ আমাদের দল বিশ্বাস করে নির্বাচনের দ্বারা জনগণের কোনও মৌলিক সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়৷ এটা মার্কসবাদ–লেনিনবাদের শিক্ষা৷ এটা কমরেড শিবদাস ঘোষ চিন্তাধারার শিক্ষা৷

ভারতবর্ষে ১৯৫২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত বহু পার্লামেন্ট নির্বাচন হয়েছে, বহুদিন কংগ্রেস রাজত্ব করেছে ‘গরিবি হঠাও’ স্লোগান তুলে এবং বিজেপিও ক্ষমতায় এসেছে ‘আচ্ছে দিনে’র প্রতিশ্রুতি নিয়ে৷ তার ফল কী হয়েছে, কী হচ্ছে, আপনারা ভুক্তভোগী জনগণ প্রতিদিন দুঃসহ জ্বালায় বুঝছেন৷ এই দলগুলি সকলেই বলছে, তাদের শাসনে দেশের অনেক উন্নতি হয়েছে, অগ্রগতি ঘটেছে এবং আরও ঘটবে৷ কিন্তু গোটা দেশের চিত্র কী বলে? সেই সম্পর্কে আমি আপনাদের কিছু তথ্য প্রথম দিকে পড়ে শোনাব, যা আপনারা জানেন নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে, গোটা ভারতবর্ষের দিকে তাকালে যেটা বাস্তব৷ এগুলি আমাদের হিসাব নয়, নানা সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার হিসাব৷ বিশ্বের ১১৯টি ক্ষুধার্ত দেশের মধ্যে ভারতের স্থান আগে ছিল ১০০ নম্বরে৷ এখন  আরও পিছিয়ে হয়েছে ১০৩৷ এই হচ্ছে অগ্রগতি ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ভারতে অনেক বেড়েছে৷ এ দেশে প্রতিদিন ২০ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন কাটায়৷ বিশ্বে যত গরিব আছে, তার তিন ভাগের এক ভাগ গরিব রয়েছে ভারতে৷ এ দেশে এ পর্যন্ত ৩ লক্ষ ৫০ হাজার কৃষক, ঋণ শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন৷ প্রতিদিন ৭ হাজার লোক অনাহারে মারা যায়৷ প্রতিদিন ১০ হাজার লোক বিনা চিকিৎসায় মারা যায়৷ ৩ হাজার শিশু অপুষ্টিতে মারা যায় প্রতিদিন৷ আমাদের দেশে বেকার সংখ্যা এখন প্রায় ৭০ কোটির মতো৷ ১২৩ কোটির দেশ, ৭০ কোটি হচ্ছে বেকার৷ এই কিছু দিন আগে রেল কর্মখালির বিজ্ঞাপন দিয়েছিল৷ ৯০ হাজার পোস্টের জন্য আবেদন করেছিল ২ কোটি ৮০ লক্ষ বেকার যুবক৷ চিন্তা করুন ভারতের অবস্থা উত্তরপ্রদেশে ৩৬২ টি পিওনের পোস্টের জন্য আবেদন করেছিল ২৩ লক্ষ এবং তার মধ্যে ২৫৫ জন পিএইচ ডি ছাড়াও এম এ, এম এস সি এবং গ্র্যাজুয়েট আবেদন করেছেন৷ পশ্চিমবাংলায় ৫ হাজার ৪০০ গ্রুপ ডি পোস্টের জন্য আবেদন করেছেন ১৮ লক্ষ, এর মধ্যেও পিএইচডি, ডক্টরেট আছেন, ইঞ্জিনিয়ার আছেন৷ এই হচ্ছে এ দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা৷ এই হচ্ছে দেশের একটা চিত্র৷

অন্যদিকে ভারতের অগ্রগতি কি ঘটেনি? অগ্রগতি ঘটেছে বৃহৎ শিল্পপতিদের, বড় বড় ব্যবসায়ীদের৷ ২০১৬ সালে এক শতাংশ ধনী ভারতের মোট সম্পদের ৫১ শতাংশের মালিক ছিল৷ আর দু’বছর বাদে এক শতাংশ ধনীর সম্পদ বাড়তে বাড়তে ৭১ শতাংশ হয়েছে৷ এখন ভারতে ৯০ ভাগ মানুষের যা সম্পদ সেই পরিমাণ সম্পদ হয়েছে ৫৭ জন কোটিপতির৷ শিল্পপতি মুকেশ আম্বানির সম্পত্তির পরিমাণ ৩ লক্ষ ৭১ হাজার কোটি টাকা৷ দিলীপ সিংভির মুনাফা ১ লক্ষ ২৮ হাজার ১২২ কোটি টাকা৷ গৌতম আদানি ১ লক্ষ ৭০ হাজার ২৩০ কোটি, আজিম প্রেমজি ১ লক্ষ ৩০ হাজার ২৫১ কোটি, বিজেপির প্রেসিডেন্ট অমিত শাহের এই সময়ে সম্পদ বেড়েছে ৩০০ শতাংশ৷ আর তার ছেলের সম্পদ বেড়েছে ১৬ হাজার শতাংশ৷ এখন ৮০ লক্ষ কোটি টাকার মালিক হয়েছে অমিত শাহের ছেলে৷ এমন কী গেরুয়া বসনধারী বাবা রামদেবেরও সম্পদ বেড়েছে ১৭৩ শতাংশ৷ এঁরা সকলেই শত শত কোটি টাকার মালিক৷ এই হচ্ছে আর একটা চিত্র৷ এছাড়া মন্ত্রী, এমপি, এমএলএ সকলেই কোটি কোটি টাকার মালিক৷ তারা জনগণের সেবার নামে দু’হাতে টাকা লুটছে৷ শিল্পপতি, বড় বড় ব্যবসায়ী, মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতি করা এখন প্রায় বৈধ রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ করাপশন হ্যাজ বিকাম দি ল অফ দি ল্যান্ড৷ শুধু পার্থক্য, কে বেশি চুরি করেছে, কে কম করেছে, কে ধরা পড়েছে, কে ধরা পড়েনি৷ সরকার দেউলিয়া, বাজেটে বিপুল ঘাটতি, দেশি–বিদেশি ঋণে চলছে৷ আর যত ভাবে পারে ট্যাক্স বসিয়ে, জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে সরকার টাকা সংগ্রহ করছে৷ সম্প্রতি তেলের উপর ট্যাক্স বাবদ ১০ লক্ষ কোটি টাকা আয় করেছে৷ রিজার্ভ ব্যাঙ্কে সঞ্চিত পাবলিকের গচ্ছিত টাকাতে থাবা বসাতে চাইছে৷

টাকা নেই এই অজুহাত তুলে শিক্ষা–স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ছাঁটাই করছে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের টাকা লুটবার জন্য তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে৷ বন্যা–খরা প্রতিরোধে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না, সেচ ও পানীয় জলের বন্দোবস্ত করছে না৷ অন্যদিকে শিল্পপতিদের ব্যাঙ্ক থেকে ১০ লক্ষ ২৫ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করতে দিয়েছে৷ শুধু তাই নয়, তাদের ২ লক্ষ ৭২ হাজার কোটি টাকা সরকারি প্রাপ্য ট্যাক্স মকুব করে দিয়েছে৷ এ পর্যন্ত বিদেশে প্রায় ১০০ লক্ষ কোটি টাকা কালো টাকা হিসাবে সঞ্চয় করতে দিয়েছে৷ তাহলে এইসব দল কার হয়ে কাজ করছে, একবার ভেবে দেখুন৷

ফলে দুই ভারত৷ এক ভারত বৃহৎ শিল্পপতি, বড় বড় ব্যবসায়ীদের ভারত৷ তাদের কোটি কোটি টাকার সম্পদ বাড়ছে৷ আর এক ভারত নিরন্ন, ক্ষুধার্ত, বেকারদের, যারা আত্মহত্যা করছে, অনাহারে মারা যাচ্ছে, শিশু বিক্রি করছে৷ এই দলগুলি কোন ভারতের প্রতিনিধি, তা আপনারা বিচার করে দেখবেন৷

এ  ছাড়া ভারতের আরও খবর আছে৷ আজকের কাগজে বেরিয়েছে৷ নরেন্দ্র মোদি গত ভোটের আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কালো টাকা উদ্ধার করে প্রত্যেকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ করে টাকা পৌঁছে দেবে৷ ১৫ লক্ষ  টাকা কেন, ১৫ পয়সাও কেউ পায়নি৷ আজকের কাগজে বেরিয়েছে সরকার নিযুক্ত তথ্য কমিশন জানতে চেয়েছে কত কালো টাকা উদ্ধার হল? সরকার বলেছে জানাব না, জানানো যায় না৷ কমিশন জানতে চেয়েছে, কোন কোন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আছে তার লিস্ট দাও৷ সরকার বলেছে, সেটাও জানানো যাবে না৷ তথ্য কমিশন জানতে চেয়েছে, বড় বড় ব্যবসায়ীরা যে ব্যাঙ্কের টাকা লুঠ করেছে, তার লিস্ট কোথায়? মোদি বলেছেন, সে লিস্টও দেওয়া যাবে না৷ কারণ পরিষ্কার, সে লিস্টে বিজয় মাল্য, নীরব মোদি, মেহুল চোকসি প্রমুখ বিজেপি নেতাদের বন্ধু রাঘব বোয়ালরা, যারা ব্যাঙ্ক থেকে জনসাধারণের জমানো কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পালিয়েছে, তাদের নাম আছে৷ তা হলে এরা কাদের স্বার্থে কাজ করছে সেটা আপনাদের বিচার করে দেখতে হবে৷

আজ ভারতবর্ষে কোটি কোটি বেকার৷ কোটি কোটি শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে৷ নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে না৷ কল–কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ বলছে বাজার নেই৷ এখানে যতটুকু শ্রমিক নিয়োগ হচ্ছে, তাও স্থায়ী ভাবে নয়, চুক্তিভিত্তিক৷ যাদের কাজের সময় নির্দিষ্ট নেই, বেতন নির্দিষ্ট নেই৷ চুক্তিভিত্তিক কাজ– এই একটা নতুন জিনিস চালু হয়ে গেছে৷ কর্মক্ষেত্রে কোনও লেবার ল নেই, কোনও অধিকার নেই৷ গ্রামের দিকে তাকিয়ে দেখুন, গ্রামগুলি শ্মশান হয়ে গেছে৷ যুবক–যুবতীরা নেই৷ কারণ, গ্রামে কোনও কাজ নেই৷ তারা ছুটছে এই শহর থেকে সেই শহরে৷ বিদেশেও যাচ্ছে৷ এদের নাম হচ্ছে মাইগ্র্যান্ট লেবার৷ কোথাও স্থায়ী শ্রমিক হিসাবে তাদের কাজ নেই৷ আপনারা জানেন না, এই দেশের ৩ কোটি ছেলেকে চাকরি দেওয়ার নাম করে বিদেশে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে কিছু এজেন্ট৷ তারা হয়েছে স্লেভ লেবার, দাস শ্রমিক৷ তাদের দেশেও ফিরতে দিচ্ছে না৷ তাদের একটু রুটি দেয়৷ মজুরির কোনও ঠিক নেই, বেরোতে পর্যন্ত দেয় না৷ একদল ব্যবসায়ী প্রতিদিন হাজার হাজার মেয়েদের গ্রাম থেকে নিয়ে আসে চাকরি দেওয়ার নাম করে, কোথাও বিয়ে দেবে বলে, তারপর তাদের বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে৷ নারী বিক্রির একটা বাজার চলছে৷ এই ২৬ জানুয়ারি আসবে, মহা উৎসব হবে৷ নেতারা ভাষণ দেবেন৷ ১০ তারা, ২০ তারা হোটেলে বিরাট ভোজসভা হবে৷ সাজসজ্জা হবে, রঙিন আতসবাজি জ্বলবে৷ তারা খেয়ে উচ্ছিষ্ট ফেলবে ডাস্টবিনে, সেই উচ্ছিষ্ট নিয়ে কাড়াকাড়ি করবে ফুটপাতের শিশুরা, তারাও মানবসন্তান৷ লক্ষ লক্ষ শিশু ফুটপাতে জন্মে ফুটপাতেই মারা যায়, কেউ তাদের খোঁজ রাখে না৷ এরা জানেও না, এদের বাবা কে, মা কে৷ যখন অন্ধকার নামবে, তখন স্টেশনে, গঞ্জে, শহরে দেখা যাবে আর এক চিত্র৷ আমাদের বোনেরা, আমাদের মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে, বিক্রি করবে নিজের দেহ৷ ঘরে অসুস্থ স্বামী, অভুক্ত সন্তান, রোজগার নেই৷ এই হচ্ছে দেশের অগ্রগতি কংগ্রেস শাসন করেছে দীর্ঘ দিন৷ তারপর বিজেপির শাসন৷ এই দু’টি দল দেশের এই অগ্রগতি ঘটিয়েছে৷ কার অগ্রগতি ঘটিয়েছে? অগ্রগতি ঘটিয়েছে শিল্পপতিদের, বড় বড় ব্যবসায়ীদের৷ যারা গরিবের রক্ত–মাংস সব কিছুকে চুষে খায় আর মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলে৷ এই কি সেই স্বাধীনতা? যে স্বাধীনতার জন্য কিশোর ক্ষুদিরাম প্রাণ দিয়েছিলেন৷ শহিদ–ই–আজম ভগৎ সিং প্রাণ দিয়েছিলেন৷ হাজার হাজার ছেলেমেয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন৷ নেতাজি সুভাষচন্দ্র লড়াই করেছিলেন?

ইংরেজের শোষণের পরিবর্তে এসেছে এ দেশের পুঁজিবাদের শোষণ৷ এ কথাই বলেছেন আমাদের মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষ৷ তিনি বলেছেন, জনগণের স্বাধীনতা আসেনি, এসেছে পুঁজিপতিদের লুণ্ঠনের স্বাধীনতা,  শোষণের স্বাধীনতা৷ তিনি বলেছেন, সমাজ শ্রেণিবিভক্ত৷ একদিকে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি শ্রেণি, যাদের একমাত্র লক্ষ্য মুনাফা, আরও মুনাফা৷ আর একদিকে কোটি কোটি গরিব মানুষ, শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্ত৷ তারা শোষিত নির্যাতিত৷ বলেছেন, রাজনীতি দু’টি৷ একটি হল শিল্পপতিদের রাজনীতি, বড় বড় ব্যবসায়ীদের রাজনীতি, লুন্ঠনের পক্ষের রাজনীতি, তাদের রক্ষা করার রাজনীতি৷ আর একটা রাজনীতি যারা শোষিত জনগণের হয়ে লড়াই করবে, সংগ্রাম করবে, বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি নেবে৷ ফলে দেখতে দল অনেক, কিন্তু বাস্তবে রাজনীতি দু’টি৷ একটা হচ্ছে শোষণকে রক্ষা করার, শোষণকে চালিয়ে যাওয়ার, পুঁজিবাদকে টিকিয়ে রাখার রাজনীতি৷ এই রাজনীতির পক্ষে কংগ্রেস, বিজেপি সব৷ আর একটা রাজনীতি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের, লড়াইয়ের, বিপ্লবের৷ সেই রাজনীতির প্রতিনিধি এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)– একমাত্র বিপ্লবী দল৷ এই লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি৷

আজ বহু দিক থেকে আক্রমণ হচ্ছে৷ শিক্ষার সুযোগ, জ্ঞানের সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে৷ শিক্ষার নামে ধর্মীয় শিক্ষা, আধ্যাত্মিক শিক্ষা চালু করা হচ্ছে৷ অথচ নবজাগরণের সূচনাকারী রামমোহন রায়, তারপর বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, সংস্কৃত শিক্ষা নয়, বেদ–বেদান্ত শিক্ষা নয়, চাই বিজ্ঞান, চাই লজিক, চাই বৈজ্ঞানিক দর্শন৷ নতুন মানুষ গড়তে হলে এই ধরনের শিক্ষা চালু করা উচিত৷ কিন্তু তাঁদের এই শিক্ষা সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে আক্রমণ কংগ্রেস শুরু করেছিল, সেই পথে বিজেপি আরও কয়েক ধাপ এগিয়েছে– বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে, যুক্তির চর্চাকে,  তর্ক করার মনকে ধ্বংস করার জন্য, যাতে কেউ প্রশ্ন না করে, তর্ক না করে, বিরুদ্ধতা না করে, অন্ধের মতো নেতাদের মেনে নেয়৷ সে জন্য তারা ধর্মীয় শিক্ষা চালু করছে– যাতে মানুষের মধ্যে অন্ধবিশ্বাস থাকে৷ তারা ধর্মীয় উন্মাদনাও সৃষ্টি করছে৷

রাম নিয়ে কাড়াকাড়ি চলছে, কে রামের প্রকৃত উত্তরাধিকারী এই নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছে৷ রাম একটা পৌরাণিক চরিত্র, ঐতিহাসিক চরিত্র নয়৷ ইতিহাসে রামকে খুঁজে পাওয়া যাবে না৷ বুদ্ধদেবকে খুঁজে পাওয়া যায়, মহাবীরকে খুঁজে পাওয়া যায়, শঙ্করাচার্যকে খুঁজে পাওয়া যায়৷ রাম একটা লৌকিক কথা, কাল্পনিক কাহিনি৷ চার খণ্ড বেদ, ছয় খণ্ড উপনিষদ, গীতা, শংকরাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত– কোথাও রামের উল্লেখ নেই৷ ভোটের দিকে তাকিয়ে এই রাম নিয়ে লড়াই চলছে৷ এরা কি যথার্থ হিন্দু? কথিত আছে, রাম জন্মানোর আগেই বাল্মীকি নাকি রামায়ণ রচনা করে রামায়ণ কাহিনীতে ভবিষ্যতে কী কী হবে তা বলে যান৷ কই সেখানেও তো অযোধ্যায় রামমন্দির ধ্বংস করে বাবরি মসজিদ তৈরির কথা বলা নেই তুলসীদাসের রামায়ণকে তো ভিত্তি ধরা হয়৷ সেই সময় তো বাবরি মসজিদ ছিল৷ তুলসীদাস কি লিখেছেন যে বাবরি মসজিদ হয়েছে রামের জন্মস্থানের উপরে?

আমি প্রশ্ন করতে চাই, চৈতন্য, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ– হিন্দুরা যাঁদের অবতার হিসাবে মানে, তাঁরাও তো বাবরি মসজিদ দেখেছেন৷ এঁরা তো কেউ বলেননি রামের জন্মস্থানের উপর বাবরি মসজিদ হয়েছে তা হলে চৈতন্য রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ এঁরা কি কাপুরুষ ছিলেন? মন্দির–মসজিদ নিয়ে এই খেলা শুরু করেছিল প্রথম কংগ্রেস৷ রাজীব গান্ধী ১৯৮৬ সালে বাবরি মসজিদের তালা খুলে রাম পুজো শুরু করালেন৷ বিজেপি দেখল মহা বিপদ৷ রামকে কংগ্রেস হাতিয়ার করছে৷ অমনি বিজেপি রামচন্দ্র নিয়ে রথযাত্রা শুরু করে দিল, দেশে রক্তাক্ত দাঙ্গা বাধাল৷ স্লোগান তুলল, বাবরি মসজিদ ভাঙতে হবে৷ তারপর ১৯৯২ সালে কংগ্রেস প্রধানমন্ত্রীর সহায়তায় বাবরি মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল৷ এখন আবার ভোটের আগে ওখানে রামমন্দির তৈরির আওয়াজ তুলে খেলা শুরু করেছে৷

আমরা মার্কসবাদী, নিরীশ্বরবাদী৷ কিন্তু আমি বলতে চাই, ওরা কি হিন্দুধর্ম মানে? বিবেকানন্দ বলেছেন, আগে ক্ষুধার্ত মানুষকে রুটি দাও, তারপর ধর্মের কথা বলবে(১)৷  এই হচ্ছেন বিবেকানন্দ৷ দেশের কোটি কোটি ক্ষুধার্ত মানুষ, তাদের জন্য কী করছ? এমনকী মন্দির তৈরির বিরুদ্ধতাও করেছেন৷(২) বিবেকানন্দ বলেছেন, আমার যদি একটি ছেলে থাকত, সে বড় হলে বৌদ্ধ হতে পারে, আমার স্ত্রী খ্রিস্টান হতে পারে, আমি নিজে মুসলিম হতে পারি৷ তাতে ক্ষতি কী? বিবেকানন্দ বলেছেন, কোনও ধর্ম অন্য ধর্মকে আঘাত করে না(৩)৷ বিবেকানন্দের গুরু রামকৃষ্ণ নিজে মসজিদে নামাজ পড়েছেন, গির্জাতে প্রার্থনা করেছেন, আবার কালীপূজাও করেছেন৷ এঁরা কি হিন্দুধর্মের প্রতিনিধি, নাকি আজকের বিজেপি নেতারা হিন্দুধর্মের প্রতিনিধি? এদের প্রশ্ন করুন, এই উন্মাদনা কেন? স্রেফ ভোটের দিকে তাকিয়ে৷ যখনই ভোট আসে তখনই রামের ধ্বনি ওঠে, রামমন্দিরের স্লোগান ওঠে, তখনই সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি হয়৷ এ একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার৷

বিজেপির দু’টি লক্ষ্য এখানে কাজ করছে৷ একটা হল হিন্দু ভোটকে সংহত করা৷ এখন মোদি আর রাহুল গান্ধীর মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে, কে আগে কোন মন্দিরে ঢুকবে৷ কে কত বড় হিন্দু প্রমাণ করার জন্য এই প্রতিযোগিতা চলছে৷ আর একটা লক্ষ্য হচ্ছে, জনগণের ঐক্য ভেঙে দাও৷ গরিব শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্ত একে অপরকে ঘৃণা করুক৷ আমি হিন্দু, তুমি মুসলিম৷ আমি আপার কাস্ট, তুমি লোয়ার কাস্ট৷ তুমি দলিত, ও ট্রাইবাল৷ এই ভাবে জনগণকে বিভক্ত করে দাও, যাতে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে, পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে লড়তে না পারে৷ তাই ধর্মভিত্তিক, জাতপাতভিত্তিক বা ট্রাইবভিত্তিক বিদ্বেষের আগুন জ্বালানো হচ্ছে৷

আর একটা দিক হচ্ছে, মানুষের মধ্যে অন্ধ ধর্মবিশ্বাস জাগিয়ে দাও৷ তুমি গরিব কেন, বেকার কেন এই সব প্রশ্ণের উত্তরে বোঝাও– তোমার অদৃষ্ট খারাপ, কপালের দোষ, পূর্বজন্মের পাপের ফল৷ এই আম্বানি, আদানি প্রমুখ যারা হাজার হাজার কোটি টাকা লুটছে, শোষণ করছে, এরা পূর্বজন্মে এত পূণ্য করেছে যে ভগবান ওদের পাঠিয়েছে গরিবের রক্ত চুষে খাওয়ার জন্য৷ চুষে খেয়ে মারার জন্য৷ এই জন্য ওদের ভগবানের দরকার৷ আর গরিবকে বোঝানো, তুমি হাসি মুখে না খেয়ে মরো, বিনা চিকিৎসায় মরো, এ তোমার পাপের ফল৷ বিনা প্রতিবাদে হাসিমুখে সহ্য করলে পরজন্মে পরিত্রাণ পাবে৷ এইসব শয়তানি চলছে৷ শ্রশ্ন কোরো না, তর্ক কোরো না৷ কেন এই সব শোষণ–অত্যাচার হচ্ছে তার উত্তর খুঁজো না৷ কারণ এগুলি হচ্ছে ভগবানের মার৷ ভগবানের ইচ্ছাই কর্ম৷ খোদা কা মর্জি, নসিব কা খেল৷ তাই সকল দুঃখকষ্ট, অন্যায়–ত্যাচারের জন্য অন্য কাউকে দায়ী কোরো না, নিজের পূর্বজন্মের পাপ আর অদৃষ্টকে দায়ী করো এই সব গভীর ষড়যন্ত্র চলছে৷ এ সব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন থাকতে হবে৷

আর একটা ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র চলছে৷ এদেশে যখন ব্রিটিশ শাসকরা ছিল, তারা চেয়েছিল এ দেশের ছাত্র–যুবকরা নোকরি করুক, গোলাম হোক৷ সেই সময় ব্রিটিশের বিরুদ্ধে এগিয়ে এসেছিল অসংখ্য ছাত্র–যুবক–যুবতী, যারা হাসতে হাসতে শিক্ষা বর্জন করেছে, চাকরি বর্জন করেছে, ঘর–সংসারের দিকে তাকায়নি, জেলে গেছে, লাঠি খেয়েছে, গুলি খেয়েছে, প্রাণ দিয়েছে৷ সেই দিন ছিল যথার্থ যৌবন৷ আজ এ দেশের শাসকরা যৌবনকে ধ্বংস করছে৷ বলছে, মদ খাও, জুয়া খেল, সাট্টা খেল, ড্রাগের নেশায় মত্ত থাকো, আর নারীদেহ নিয়ে কুৎসিত নোংরামিতে মত্ত থাকো৷ ব্লু–ফিল্ম, টিভির মাধ্যমে নানা নোংরা জিনিস তারা প্রচার করছে৷ ভেবে দেখুন, ছ’মাসের শিশুকন্যা, দু’বছরের শিশুকন্যা, তাকেও ধর্ষণ করা হয়েছে৷ একবার ভেবে দেখুন, পশ্চিম বাংলার নদিয়ার একশো বছরের বৃদ্ধা মহিলাকে মত্ত অবস্থায় এক যুবক ধর্ষণ করেছে৷ জন্মদাতা বাবার বিরুদ্ধে মেয়ে অভিযোগ করছে, শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রী অভিযোগ করছে৷ কোন দেশে আমরা বাস করছি দয়ামায়া, প্রেম–প্রীতি–ভালবাস সব ধ্বংস করে দিচ্ছে, বৃদ্ধ বাবা–মাকে সন্তান ঘর থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে, খুন করে সম্পত্তি আত্মসাৎ করছে৷ এই তো দেশের অগ্রগতি ধর্ষণ, গণধর্ষণ পশুজগতও করে না৷ পুঁজিপতি শ্রেণি দেশের যুবকদের এই দিকে ঠেলছে কেন? যাতে যুবকদের যৌবন মরে যায়, বিবেক মরে যায়, মনুষ্যত্ব ধ্বংস হয়ে যায়, তারা অমানুষ হয় এবং যাতে তাদের টাকা দিয়ে কেনা যায়, যে কোনও অমানুষের কাজ করানো যায়৷ এই যে ভোট আসছে, বেকার যুবকরা মদ খাওয়ার জন্য, নেশা করার জন্য, ফূর্তি করার জন্য হয় বিজেপির ভলান্টিয়ার হবে, না হয় কংগ্রেসের ভলান্টিয়ার হবে৷ এরা প্রতিবাদ করবে না, সংগ্রাম করবে না৷ তাই আজ দেশে সুভাষচন্দ্র নিয়ে কোনও চর্চা শহিদ–ই–আজম ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ, আসফাকউল্লা নিয়ে কোনও চর্চা নেই, ক্ষুদিরামকে নিয়ে চর্চা শাসকেরা চায় না৷ এ দেশের বহু মানুষ রামমোহন বিদ্যাসাগরকে স্মরণ করে না, বিবেকানন্দকেও স্মরণ করে না, এ দেশের মানুষ রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, প্রেমচন্দ, সুব্রহ্মণিয়ম ভারতী প্রমুখকে স্মরণ করে না৷ শাসকরা এঁদের ভুলিয়ে দিয়েছে৷ এঁদের ভুলে যাও, অমানুষ হও, মনুষ্যত্বহীন হও৷ তা হলেই তারা নিশ্চিন্ত৷ এই হচ্ছে পুঁজিবাদের আক্রমণ৷ এ সম্পর্কেও আমাদের দল মানুষকে সজাগ করতে চায় আবার নতুন করে যৌবনকে জাগাতে৷

আজ দেশের যে পরিস্থিতি, গোটা দেশে যা হচ্ছে, একবার ভেবে দেখুন– আজ যদি বিদ্যাসাগর থাকতেন, আজ যদি জ্যোতিবারাও ফুলে থাকতেন, বিবেকানন্দ থাকতেন, যদি দেশবন্ধু, লালা লাজপৎ রাই থাকতেন, যদি সুভাষচন্দ্র, ভগৎ সিং থাকতেন, তা হলে তাঁরা দেশের মানুষকে কী বলতেন? বলতেন কি কংগ্রেস–বিজেপির গোলামি কর, মসজিদ ধ্বংস করে মন্দির তৈরি কর? বলতেন কি মদ খাও, নেশা কর? নারীদেহ নিয়ে নোংরামি কর? নাকি বলতেন, এর বিরুদ্ধে লড়াই কর, মনুষ্যত্ব নিয়ে দাঁড়াও৷ একমাত্র আমাদের দল মহান মার্কসবাদ–লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতে আবার এ দেশের মনুষ্যত্বকে যৌবনকে জাগাবার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে এইসব বড় মানুষ ও শহিদদের গৌরবময় স্মৃতিকে স্মরণ করিয়ে, যে স্মৃতিকে এই দলগুলি ও পুঁজিপতি শ্রেণি মুছে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে৷

আমরা নির্বাচনে নামব৷ কিন্তু বিপ্লবী আদর্শ ও বামপন্থাকে বিসর্জন দিয়ে নয়৷ আমরা সিপিআই–সিপিএমের মতো কংগ্রেসকে সেকুলার তকমা লাগাই না৷ সেকুলারিজম কথাটার একটা মানে আছে৷ দর্শনগত ভাবে সেকুলারিজম মানে হচ্ছে, পার্থিব জগৎই সত্য৷ এর বাইরে কোনও ঐশ্বরিক শক্তি নেই৷ রাজনৈতিক সেকুলারিজম হচ্ছে, সুভাষচন্দ্রে ভাষায় বলতে গেলে, রাজনীতির সাথে ধর্মের সম্পর্ক থাকবে না৷ রাজনীতি চলবে রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক যুক্তির দ্বারা৷ ভগৎ সিং এই সেকুলারিজমকে সমর্থন করেছিলেন৷ রবীন্দ্রনাথ–শরৎচন্দ্র-প্রেমচন্দ এই সেকুলারিজমের কথা বলেছিলেন৷ আর কংগ্রেস প্রথম থেকেই ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা বলেছে৷ গান্ধীজি এ কথা বলেছিলেন ভারতবর্ষের বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থে, যাতে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির চর্চা না হয়৷ এই ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ করতে গিয়ে তা হিন্দু ধর্মভিত্তিক, বিশেষত উচ্চবর্ণ হিন্দুভিত্তিক হয়ে গেল৷ তার সুযোগ নিয়ে ব্রিটিশ স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে মুসলিমদের বিচ্ছিন্ন করে পাকিস্তান সৃষ্টি করালো, না হলে এই সর্বনাশ হত না৷ ফলে, কংগ্রেস কোনওদিনই সেকুলার ছিল না, আজও নয়৷ ভোটের ময়দানে বিজেপির বিরোধিতা করছে বলেই কংগ্রেস সেকুলার– এগুলি মিথ্যা কথা, মানুষকে বিভ্রান্ত করা৷ সিপিএম–সিপিআই কংগ্রেসের লেজুড়বৃত্তি করছে নিছক ভোটের স্বার্থে, কয়েকটা সিট পাওয়ার জন্য৷ আমরা এই রাজনীতির চর্চা করি না৷ ওরা কংগ্রেসকে বলছে গণতান্ত্রিক৷ যে কংগ্রেস জরুরি অবস্থা জারি করেছে, টাডা–মিসা–এসমা চালু করেছে, সেই কংগ্রেসকে বলছে গণতান্ত্রিক বিজেপি যেমন দাঙ্গা বাধিয়ে দেশের মাটিকে বারবার রক্তাক্ত করেছে, গণহত্যা করেছে, তেমন কংগ্রেসও কি করেনি? ওড়িশার রাউরকেল্লায়, বিহারের ভাগলপুরে, আসামের নেলিতে, দিল্লিতে কে দাঙ্গা বাধিয়েছিল? কংগ্রেসই তো! ভোটের স্বার্থে আমরা মিথ্যাচার করি না৷ আমরা সব সময়ই বলেছি, সিপিআই–সিপিএম মার্কসবাদের কথা বললেও, ওরা যথার্থ মাকর্সবাদী দল নয়৷ ওদের অতীত ইতিহাস তা বলে না৷ স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় এদেশের বুর্জোয়া শ্রেণি গান্ধীজিকে সামনে রেখে ক্ষমতা দখল করার জন্য চেষ্টা করেছে৷ সেই জন্যই বৈজ্ঞানিক চিন্তা আসতে দেয়নি, ধর্মীয় চিন্তাকে উৎসাহ দিয়েছে৷ বিপ্লবী আন্দোলনকে আটকেছে শান্তিপূর্ণ পন্থার নামে৷ আরেকটা ধারা ছিল, সুভাষচন্দ্র, ভগৎ সিং, সূর্য সেন, ক্ষুদিরামের ধারা, চন্দ্রশেখর আজাদের ধারা– সশস্ত্র বিপ্লবের ধারা৷ এ দেশের বুর্জোয়া শ্রেণি, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এই ধারাকে বিপদের চোখে দেখেছিল৷ যার জন্য সুভাষচন্দ্রকে কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছিল, কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করেছিল৷ অনেকেই জানে না এই সব ইতিহাস৷ এখন সকলেই সুভাষচন্দ্রের ভক্ত বিজেপিও সুভাষচন্দ্রের কথা বলছে৷ আপনারা কি জানেন, এই বিজেপির গুরু গোলওয়ালকর স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বলেছিলেন, ভারতবর্ষে যারা ব্রিটিশ–বিরোধিতা এবং ভৌগোলিক সীমার ভিত্তিতে জাতীয় স্বাধীনতার কথা বলে তারা প্রতিক্রিয়াশীল, তারা দেশপ্রেমিক নয়৷(৪) এই বিচারে সুভাষচন্দ্র থেকে শুরু করে লালা লাজপৎ, দেশবন্ধু, নেহেরু এমনকী গান্ধীজিও দেশপ্রেমিক নন এই হলেন গোলওয়ালকর৷ কারণ, তাঁর দাবি ছিল, হিন্দু ভারতের কথা বলতে হবে৷ এখন আরএসএস–এর প্রধান মোহন ভাগবত বলছেন, গোলওয়ালকরের এই বক্তব্যটা ওই বই থেকে আমরা বাদ দিয়ে দিয়েছি৷ কারণ এখন তাদের মুশকিল হচ্ছে৷ কিন্তু বাদ দিলে কী হবে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় তো এই কথা বলেছিল৷ ইতিহাস মুছবে কী করে আরএসএস কোনওদিন স্বাধীনতা আন্দোলনে ছিল? কোনওদিন ছিল না৷ কোনও ভূমিকা তাদের ছিল না৷ আরএসএস–ই এই বিজেপিকে সৃষ্টি করেছে৷ এই হচ্ছে তাদের ইতিহাস৷ সেই সময় মহান স্ট্যালিন অবিভক্ত সিপিআই–কে বলেছিলেন, ভারতবর্ষে যাঁরা বিপ্লবী, তাঁদেরসমর্থন করো(৫)৷ কিন্তু ঐক্যবদ্ধ সিপিআই তা করেনি৷ সুভাষচন্দ্রের বিরোধিতা করে গান্ধীজিকে সমর্থন করেছে৷ এই হচ্ছে তাদের ইতিহাস৷ আরও বহু কাজ তারা করেছে যেগুলো মার্কসবাদ বিরোধী৷ সে দীর্ঘ আলোচনায় আমি আজ যাব না৷ শুধু বলছি, তারা ১৯৪২ সালের আগস্ট আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল, সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ বাহিনীর লড়াইকে জাপানের দালালি বলেছিল৷ এমনকী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় পুঁজিপতিদের ষড়যন্ত্রে গান্ধীবাদী কংগ্রেস নেতারা যখন সুভাষ বসুকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করাল, তখনও তারা সুভাষ বসুর পক্ষে দাঁড়ায়নি৷ কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর তিনি বিহারের রামগড়ে বামপন্থীদের সংহত করার আহ্বান নিয়ে সম্মেলন ডেকেছিলেন এবং বলেছিলেন, এর দ্বারা ভারতে মার্কসবাদী দল গঠনের পথ প্রশস্ত হবে৷ কিন্তু সেখানে আমন্ত্রিত হয়েও সিপিআই নেতারা যোগ দেননি৷ এ কথা মনে করা অসঙ্গত নয় যে, সুভাষ বসুকে যদি কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করানো ও বহিষ্কার করা না হত এবং সিপিআই যদি তাঁর বামপন্থাকে সংহত করার আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাঁকে শক্তিশালী করত, তাহলে তিনি হয়ত দেশের বাইরে যেতেন না৷ দেশের ভিতরে থেকে তিনিই তখন ১৯৪২ সালের আগস্ট অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিতেন৷ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিপ্লবী বামপন্থী ধারা প্রাধান্য পেত, ইতিহাস অন্যরকম হত৷

কিন্তু এই পথে পা না দিয়ে অবিভক্ত সিপিআই নেতৃত্ব হিন্দু ও মুসলিম আলাদা দুই জাতি– এই বিচিত্র তত্ত্ব খাড়া করে সেদিন হিন্দু মহাসভা, মুসলিম লিগ, আরএসএস–এর মতোই দেশভাগ সমর্থন করেছিল৷পশ্চিমবঙ্গ এক সময় বামপন্থার পীঠস্থান ছিল৷ সেই অবিভক্ত বাংলা সুভাষচন্দ্রের ঐতিহ্য বহন করেছে৷ এখানে কংগ্রেসের প্রভাব ছিল না বলতে গেলে৷ সিপিএম চৌত্রিশ বছরের শাসনে পুঁজিবাদের স্বার্থে, শোষণের স্বার্থে এত অত্যাচার করেছে যে, সেই পশ্চিমবাংলা সিপিএম বিরোধিতা করে এখন বামপন্থাকে বিরোধিতা করছে৷ সিপিএম বামপন্থার সর্বনাশ করেছে, মার্কসবাদের সর্বনাশ করেছে৷ এই তো ওদের ভূমিকা৷ সিপিএম–সিপিআই বহু দিন আগেই আন্দোলনের রাস্তা ছেড়ে দিয়েছে৷ তাদের একমাত্র লক্ষ্য ভোট৷ ভোটের স্বার্থে ১৯৭৭ সালে এই সিপিএম জনতা পার্টির সাথে ঐক্য করেছিল, যে জনতা পার্টির মধ্যে আরএসএস ছিল৷ অটলবিহারী বাজপেয়ী–জ্যোতি বোস একত্রে মিটিং করেছেন কলকাতার ময়দানে, ভোটের জন্যই৷ আবার, আজকে ভোটের স্বার্থে কংগ্রেসের সাথে ওরা হাত মেলাচ্ছে৷

আজ অর্থনৈতিক স্বার্থকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে আজ ভারতীয় বৃহৎ পুঁজিপতিরা বিভক্ত হয়ে এক অংশ বিজেপিকে, অপর অংশ কংগ্রেসকে মদত দিচ্ছে৷ পাশাপাশি জাতীয় পুঁজির সাথে আঞ্চলিক পুঁজির দ্বন্দ্ব চরমে উঠেছে এবং তার ফলে আঞ্চলিক পুঁজিবাদী দলগুলিও শক্তিশালী রূপে দাঁড়িয়েছে৷ দেশের পুঁজিপতিদের এই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে শ্রমিক শ্রেণির শক্তিশালী সংগ্রাম ও গণআন্দোলন গড়ে উঠতে পারত, যদি সিপিএম, সিপিআই সেই সংগ্রাম–আন্দোলনের রাস্তায় যেত৷ কিন্তু দুঃখের বিষয় তারা সেই পথে না গিয়ে দিল্লির কৃষক সমাবেশে রাহুল গান্ধী সহ অন্যান্য বুর্জোয়া নেতাদের হাজির করাল৷ কংগ্রেস শাসনে কি কৃষকরা আত্মহত্যা করেনি? কৃষকদের বিক্ষোভে গুলি চলেনি? এদের সহযোগী দল ‘লিবারেশন’ও পাটনায় তাদের দলীয় সমাবেশে দুর্নীতির মামলায় কারারুদ্ধ লালুপ্রসাদ যাদবের ছেলেকে সাদর আমন্ত্রণ জানিয়ে বক্তৃতা করালেন৷ এই ধরনের সুবিধাবাদী রাজনীতির দৌলতে ২/৫টা এমএলএ/এমপি–র আসন হয়তো পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু ইতিমধ্যেই দুর্বল হয়ে যাওয়া বামপন্থী আন্দোলন এসবের দ্বারা আরও দুর্বল হবে৷ বামপন্থার নামে এইসব সুবিধাবাদী রাজনীতির চর্চা আমরা করি না৷

কমরেডস ও বন্ধুগণ, গোটা বিশ্বেই প্রবল সংকট, সাম্রাজ্যবাদ–পুঁজিবাদের সংকট৷ শোষণে শোষণে জর্জরিত মানুষ, তাদের ক্রয়ক্ষমতা নেই, বাজার নেই৷ বিশ্বে পুঁজিবাদের ইঞ্জিন বলে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজকে প্রশান্ত মহাসাগরে ডুবছে৷ সে–ই এক সময় বিশ্বায়ন বা গ্লোবালাইজেশনের কথা বলেছিল, এখন বলছে বিশ্বায়ন চাই না৷ বলছে, আমেরিকা ফার্স্ট, তার স্বার্থই আগে দেখতে হবে৷ কারণ তার দেশে কোটি কোটি বেকার, চাকরি নেই৷ কিছু দিন আগে ওয়াল স্ট্রিট মুভমেন্ট হয়ে গেছে৷ তার সাথে টক্কর দিচ্ছে আজকের সাম্রাজ্যবাদী চিন, যে সমাজতন্ত্রকে ধ্বংস করে পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠা করেছে৷ তার সাথে টক্কর দিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়া, সাম্রাজ্যবাদী জাপান৷ তার সাথে টক্কর দিচ্ছে ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপ৷ ফলে, আমেরিকা সংকটে, ইউরোপ সংকটে, চিন সংকটে, জাপান সংকটে, রাশিয়া সংকটে৷ সকলেই চাইছে অন্য দেশের বাজার গ্রাস করতে, কিন্তু নিজের বাজারে ঢুকতে দেবে না৷ বাজার নিয়ে লড়াই শুরু হয়ে গেছে৷ সকলেই সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে৷ এই বাজারের দ্বন্দ্ব নিয়েই প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ বেধেছিল৷ এবার ট্রেড ওয়ার শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটাই উদ্বেগের বিষয়৷ আরেকটা বিষয়ও লক্ষণীয়, যে পুঁজিবাদ শিল্পবিপ্লবের যুগে জাতীয় বাজার সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে এগিয়েছিল, জাতীয় স্বার্থের স্লোগান তুলেছিল, সে পরবর্তীকালে একচেটিয়া পুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদের স্তরে এসে মাল্টিন্যাশনাল বা বহুজাতিক সংস্থার জন্ম দিয়েছে৷ সে এখন জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে যে দেশেই সস্তায় শ্রমিক ও কাঁচামাল পায়, সেখানেই ছুটছে, সেখানেই পুঁজি ইনভেস্ট করে সেখানকার পণ্য দিয়ে নিজের দেশেও বেশি মুনাফা করছে৷ ফলে আমেরিকার মাল্টিন্যাশনালের নিজস্ব আরও মুনাফার স্বার্থ ও মার্কিন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের সামগ্রিক স্বার্থের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছে৷ মার্কিন রাষ্ট্র গ্লোবালাইজেশনের বিপক্ষে আর মার্কিন মাল্টিন্যাশনালরা পক্ষে৷ অন্যান্য দেশেরও অবস্থা তাই৷ ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের মাল্টিন্যাশনাল ও কর্পোরেট সেক্টররাও দেশে না করে বিদেশে পুঁজি ইনভেস্ট করছে৷ পুঁজিবাদ আজ জনগণ, দেশ, জাতি– কোনও স্বার্থ দেখে না, যেখানেই বেশি লাভ পাবে সেখানেই ছুটবে৷ আবার প্রয়োজনে নিজের  রাষ্ট্রকেও ব্যবহার করবে৷ গোটা বিশ্বের পুঁজিবাদ চরম মন্দার মধ্যে ধুঁকছে৷ ভারতের অবস্থাও ঠিক তাই৷ পুঁজিবাদ থাকলে এই মন্দার হাত থেকে পরিত্রাণ নেই৷ কারণ পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতি অনিবার্য ভাবেই বাজার ধ্বংস করছে, ক্রমসংকুচিত করছে৷ যেখানে কোটি কোটি মানুষ বেকার, ছাঁটাই হয়ে আছে, রিক্ত, নিঃস্ব, সর্বস্বান্ত হচ্ছে, সেখানে ক্রয়ক্ষমতা কোথায়? ফলে মন্দা বাড়বেই৷ আজ পুঁজিবাদের প্রয়োজন সর্বোচ্চ মুনাফা৷ তার প্রয়োজন সর্বাপেক্ষা নৃশংস শ্রমিক শোষণ৷

এর একমাত্র বিকল্প হচ্ছে সমাজতন্ত্র৷ ১৯১৭ সালে মহান নভেম্বর বিপ্লব দেখিয়েছে যথার্থ পথ কোথায়৷ ৭০ বছর সমাজতন্ত্র ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নে বেকারত্ব বলে কিছু ছিল না, ছাঁটাই বলে কিছু ছিল না৷ সোভিয়েত ইউনিয়নে বিনামূল্যে শিক্ষা–চিকিৎসা ছিল৷ স্বল্প মূল্যে বাড়ি ভাড়া মিলত৷ সোভিয়েত ইউনিয়নে একমাত্র শ্রমিক–কৃষকরাই ভোটে দাঁড়াতে পারত৷ বহু দিক থেকে তারা অগ্রগতি ঘটিয়েছিল৷ তারা দেখিয়ে দিয়ে গেছে মার্কসবাদ কী করতে পারে, সমাজতন্ত্র কী করতে পারে৷ এই সমাজতান্ত্রিক সভ্যতা তাই রমাঁ রল্যাঁ, বার্নার্ড শ, আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, প্রেমচন্দ, সুব্রহ্মনিয়ম ভারতী, নজরুল, সুভাষচন্দ্র সকলকেই মুগ্ধ করেছিল৷ তাঁরা এই নতুন সভ্যতার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন৷ শহিদ–ই–আজম ভগৎ সিং তো নিজেকে মার্কসবাদী ও কমিউনিস্ট বলে ঘোষণা করেছিলেন৷ কিন্তু সেই সোভিয়েত সমাজতন্ত্র ধ্বংস হয়েছে৷ বাইরের সাম্রাজ্যবাদ আর সোভিয়েতের অভ্যন্তরে পরাজিত পুঁজিবাদ– উভয়ে হাত মিলিয়ে সমাজতন্ত্রকে ধ্বংস করেছে৷ আমরা জানি, এক দিন যখন ধর্ম মহৎ আন্দোলন ছিল, দাসপ্রথার যুগে, সেই সময় ধর্মের ভূমিকা ছিল প্রগতিশীল৷ প্রত্যেকটি ধর্ম দাবি করত তারা ঐশ্বরিক শক্তিতে বলীয়ান৷ হিন্দু ধর্ম, মুসলিম ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্ম প্রভৃতি প্রত্যেকটি ধর্ম কখনও এগিয়েছে কখনও পিছিয়েছে৷ কখনও পরাস্ত হয়েছে কখনও জয়লাভ করেছে৷ নবজাগরণ থেকে শুরু করে পার্লামেন্ট পর্যন্ত সময়কাল ধরলে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ইতিহাস সাড়ে তিনশো বছরের৷ আর বুর্জোয়া গণতন্ত্রকেও বার বার পরাজয়–জয়ের পথে চলতে হয়েছে৷ আর সোভিয়েত সমাজতন্ত্রকে লড়তে হয়েছে দাসপ্রথা থেকে শুরু করে সামন্ততন্ত্র, পুঁজিবাদ পর্যন্ত কয়েক হাজার বছরের শ্রেণিশোষণের বিরুদ্ধে, কয়েক হাজার বছরের শ্রেণিশোষণকে উচ্ছেদ করেছে ৭০ বছরের সোভিয়েত সমাজতন্ত্র, এই সময়টা কতটুকু? আমরা জানি, সমাজতন্ত্রই একমাত্র মুক্তির পথ৷

যে বুর্জোয়া ফরাসি বিপ্লব পতাকা তুলেছিল সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার, সেটা আজ ধূলায় লুন্ঠিত, পদদলিত৷ পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি দাঁড়িয়েছে পার্লামেন্টারি ঠাটবাটের আবরণে ফ্যাসিস্ট অটোক্রেসি৷ পুঁজিবাদ আজ মানবসভ্যতা ধ্বংসকারী চরম শত্রু৷ তাই পুঁজিপতি–শ্রমিক সম্পর্ক টিকিয়ে রেখে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রকে টিকিয়ে রেখে, মুনাফা লুণ্ঠন ও শ্রমিক শোষণ বজায় রেখে, ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করে জনজীবনের দুঃসহ যন্ত্রণার কোনও সমাধান হবে না৷ তাই চাই পুঁজিবাদ বিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব৷

এই যে ভোট হচ্ছে, এ সব কি জনগণ ঠিক করছে, ইজ ইট দি ভারডিক্ট অফ দি পিপল? বাই দি পিপল, অফ দি পিপল, ফর দি পিপল? জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণেরই? এই যে ভোটে কোটি কোটি টাকার খেলা– সে টাকা কে দেয়? মালিকরা দেয়৷ তাদের গোলাম হল বিজেপি, কংগ্রেস– যারা ক্ষমতায় বসে মালিকদের চাকরের মতো কাজ করে৷ ওরা ভোটে প্রচুর টাকা খরচ করছে৷ এখন ঘরে ঘরে মোবাইল দিচ্ছে, টিভি দিচ্ছে, সাইকেল এবং আরও কত কিছু দিচ্ছে৷ যদি পাবলিক বলে আকাশের চাঁদ দিন, তবে বলবে, হ্যাঁ তা–ও দেব, আমাদের ভোট দাও৷ এই যে এত টাকার খেলা, এ কোথা থেকে আসছে? পাবলিকের মানসিক অবস্থাও দাঁড়িয়ে গেছে– আর তো কিছু পাব না, ভোটের সময় যা পাই তাই ভাল৷ একটা সাইকেল পেলেই হল, একটা টিউবওয়েল কিংবা একটা শাড়ি বা জামা পেলেই হল– অন্তত কিছু তো পাচ্ছি৷ এই যে কিছু পাচ্ছি, এটা কে দিচ্ছে? এ তো আপনাকে ঘুষ দিচ্ছে৷ কে ঘুষ দিচ্ছে? দিচ্ছে মালিকরা৷ যা দিচ্ছে তার কয়েকশো গুণ আপনার থেকে নিচ্ছে শোষণ করে, জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে, ট্যাক্স বাড়িয়ে৷ এই হচ্ছে ইতিহাস৷ নির্বাচন একটা প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয়৷ ইলেকশন ইজ এ বিগ ডিসেপশন৷ এটা যে প্রহসন, ভোটের দ্বারা যে সমস্যার সমাধান হয় না, বিপ্লবই যে একমাত্র পথ, এ কথা বোঝানোর জন্য, এ নিয়ে জনগণকে সচেতন করার জন্য আমরা নির্বাচনে নামি এবং নামব যতদিন মানুষ বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত না হচ্ছে, এটাই হচ্ছে মহান লেনিনের শিক্ষা৷ বিপ্লবী দল হিসাবে আমাদের শক্তি নিয়ে জনগণকে সংগঠিত করে আমরা যেমন নানা দাবি–দাওয়ার ভিত্তিতে আন্দোলন করছি এবং করব, একই ভাবে আমরা নির্বাচনেও লড়ব৷ আমরা ভোটের সুবিধাবাদী স্বার্থে সিপিএম ও সিপিআই–এর মতো জাতীয় বুর্জোয়া দল ও আঞ্চলিক বুর্জোয়া দল ও কাস্টিস্ট পার্টিগুলির হাত ধরাধরি করে জনগণকে ঠকাব না৷ আমরা বাম–গণতান্ত্রিক দল ও শক্তিগুলির ঐক্য চাই নীতি–আদর্শভিত্তিক শ্রেণিসংগ্রাম ও গণআন্দোলনের স্বার্থে৷

কমরেডস ও বন্ধুগণ, আপনাদের কাছে আবেদন, স্বদেশি আন্দোলনে মধ্যবিত্ত ঘরের, গরিব ঘরের ছেলেমেয়েরা প্রাণ দিয়েছে, ক্ষমতা দখল করেছে শোষক শ্রেণি, পুঁজিপতি শ্রেণি৷ এই সর্বনাশ হল কেন? এ দেশের মানুষ রাজনীতি বুঝতে চায়নি৷ নেতারাও চেয়েছিল মানুষ অজ্ঞ থাকুক, অন্ধ থাকুক৷ জনগণও ভেবেছে আমরা মূর্খ মানুষ, রাজনীতি অত বুঝি না, নেতারাই যা হোক ঠিক করুক৷ এর সুযোগ তারা নিয়েছে৷ সেদিন মানুষ বুঝতে পারেনি, গান্ধীজির সাথে নেতাজির পার্থক্য কোথায়? সেদিন মানুষ বুঝতে পারেনি কেন নেতাজিকে কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল, কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করা হল৷ আজও যদি মানুষ অন্ধ থাকে, অজ্ঞ থাকে, আর খবরের কাগজ কী বলছে, টিভি কী বলছে, কে কত টাকা দেবে, এর ভিত্তিতে একে ভোট দেব, তাকে ভোট দেব ভাবে– তা হলে বার বার ঠকতে হবে৷ এই প্রবচন ঠিক নয়, যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ৷ রামায়ণের কাহিনি অনুযায়ী রাম লক্ষ্মণ সীতা হনুমান সবাই লঙ্কায় গিয়েছিল, কেউ রাবণ হয়নি৷ বরং রামায়ণের শিক্ষা হচ্ছে, সীতার সর্বনাশ হত না যদি সীতা রাবণকে চিনতে পারত৷ রাবণ এসেছিল সন্ন্যাসীর ভেক ধরে৷ সীতা লক্ষ্মণের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে লক্ষ্মণরেখা অতিক্রম করেছিল৷ আজও ভোটে এই সব নেতারা আসছে এরোপ্লেনে চড়ে, হেলিকপ্টারে চড়ে, গ্রামে গ্রামে শহরে শহরে ঘুরছে, আর বারবার জনগণের কাছে ভোট ভিক্ষা করছে– আমাদের একবার সুযোগ দিন, আমরা আপনাদের সেবক৷ আর পিছনে আছে টাকার থলি৷ এই মোহে আপনারা ভুলবেন না৷

জনগণকে রাজনীতি বুঝতে হবে৷ কে শত্রু, কে মিত্র চিনতে হবে৷ কোন দল শোষক শ্রেণির হয়ে কাজ করছে, কোন দল শোষিত জনগণের হয়ে কাজ করছে, এই দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে বিচার করতে হবে৷ তাই আমি আপনাদের বলতে চাই, মানুষ অনাহারে মরছে, বেকারত্বের জ্বালায়, ছাঁটাইয়ের যন্ত্রণায় ছটফট করছে৷ পরিবার ভাঙছে, সন্তান বৃদ্ধ বাবা–মাকে ঘর থেকে বের করে দিচ্ছে, দায়িত্ব অস্বীকার করছে, পণের জন্য স্ত্রীকে হত্যা করছে৷ হাজার হাজার নারী ধর্ষিত হচ্ছে, মেয়েরা বিক্রি হয়ে যাচ্ছে৷ এ জিনিস চলবে, না এর প্রতিকার চাই? এই প্রতিকারের একমাত্র পথ পুঁজিবাদ বিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব৷ সেই বিপ্লবের পতাকা বহন করছে আমাদের দল মহান মার্কসবাদ–লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতে৷ তাই আবারও আপনাদের আহ্বান জানাব, আপনারা রাজনীতি বুঝুন, সংঘবদ্ধ হোন৷ কাগজ রেডিও টিভির পিছনে ছুটবেন না৷ আজকের এই মিটিংয়ের খবর আপনারা কাগজ রেডিও টিভিতে বিশেষ পাবেন না৷ আমরা লক্ষ লোকের জমায়েত করি, কিন্তু সংবাদমাধ্যমে খবর দেয় না৷ কারণ তারা জানে, ভারতে এই একমাত্র দল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) হচ্ছে পুঁজিপতি শ্রেণির দুশমন৷ বিনা প্রচারে এই দল বাড়ছে৷ ২৫ টি রাজ্যের সংগ্রামী প্রতিনিধিরা এসেছেন এখানে৷ আমাদের কোনও এমএলএ–এমপি নেই, সংবাদমাধ্যমে প্রচার নেই৷ কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তার জোরে, আদর্শের জোরে আমাদের হাজার হাজার কর্মী কাজ করছে, গ্রামে শহরে মানুষকে উদ্বুদ্ধ, অনুপ্রাণিত করছে৷ আজ প্রয়োজন হাজার হাজার ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন, চন্দ্রশেখর আজাদ, ভগৎ সিং, আসফাকউল্লা খান, প্রীতিলতা– যারা পুঁজিবাদবিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পতাকা বহন করবে৷ এই উদ্দেশ্য নিয়েই আমরা শোষিত জনগণকে, বিশেষত ছাত্র–যুবকদের আজকের দিনের সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী মতবাদ মার্কসবাদ–লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত করছি৷ শ্রমিক–কৃষক–ছাত্র ও মধ্যবিত্তদের দাবিতে শ্রেণিসংগ্রাম ও গণআন্দোলন গড়ে তুলছি৷ এই লড়াইয়ে অন্যান্য বামপন্থী দল ও তাদের কর্মীদের সামিল করানোর চেষ্টা করছি৷ এই দলকে আপনারা শক্তিশালী করুন, মজবুত করুন যাতে আগামী দিনে আমরা আরও শক্তিশালী আন্দোলন করতে পারি, লড়াই করতে পারি৷ এই লড়াই করতে করতে আমরা ভোটে নামব৷ আবার ভোটের পরও আমরা লড়াই চালাব৷ এই কথা বলে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি৷

উদ্ধৃতি সূত্র : (১) বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘‘ভারতের কোটি কোটি দুঃস্থ মানুষ তৃষ্ণার্ত কণ্ঠে চাইছে রুটি …আমরা তাদের পাথর দিচ্ছি৷ অনাহারী মানুষকে ধর্ম শেখানো … তাদের অপমান করা’’ (বিবেকানন্দ, বাণী ও রচনা)৷

(২) বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘‘জীবন্ত ঈশ্বর তোমাদের সঙ্গে রহিয়াছেন তথাপি তোমরা মন্দির, গির্জা নির্মাণ করিতেছ আর সর্বপ্রকার কাল্পনিক মিথ্যা বস্তুতে বিশ্বাস করিতেছ৷ মানবাত্মা বা মানবদেহই একমাত্র উপাস্য ঈশ্বর৷ …মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ মন্দির– মন্দিরের মধ্যে তাজমহল’’ (ঐ,২য় খণ্ড, পৃঃ১৯১)৷

(৩) বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘‘ সকল ধর্মকে সত্য বলিয়া গ্রহণ, কেবল পরধর্ম সহিষ্ণুতা নহে – ইহাই আমরা প্রচার করি এবং কার্যেও পরিণত করি৷ বিশেষ সাবধান, যেন অপরের ক্ষুদ্রতম অধিকারও পদদলিত করিও না’’ (ঐ,৭ম খণ্ড, পৃ : ৩৭)৷

(৪) গোলওয়ালকার বলেছিলেন, ‘‘ব্রিটিশ বিরোধিতাকে ভাবা হচ্ছে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের সমার্থক৷ এই প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সমগ্র স্বাধীনতা আন্দোলন, তার নেতৃবর্গ ও সাধারণ মানুষের উপর বিনাশকারী প্রভাব ফেলেছিল’’ (চিন্তাচয়ন– ১ম খণ্ড, পৃ : ১২৫)৷

(৫) ‘‘ভারতের মতো উপনিবেশগুলির মৌলিক ও নতুন বৈশিষ্ট্য শুধু এটাই নয় যে, এখানকার জাতীয় বুর্জোয়ারা বিপ্লবী দল ও আপসকামী দল এই দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে, বরং প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই বুর্জোয়াদের আপসকামী অংশ ইতিমধ্যেই সাম্রাজ্যবাদের সাথে একটা বোঝাপড়া গড়ে তুলতে সফল হয়েছে৷ সাম্রাজ্যবাদের চেয়েও বেশি বিপ্লবের ভয় থেকে এরা নিজের দেশের শ্রমিক ও চাষির বিরুদ্ধেই সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ব্লক বা জোট গড়েছে … শহর ও গ্রামের পেটিবুর্জোয়া জনগণকে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য জাতীয় বুর্জোয়াদের আপসকামী অংশকে বিচ্ছিন্ন করার পর, বুর্জোয়াদের বিপ্লবী অংশের সঙ্গে অবশ্যই কমিউনিস্ট পার্টি প্রকাশ্যে জোট করতে পারে এবং তা করতেই হবে’’ (জে ভি স্ট্যালিন)৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ১৭ সংখ্যা)