ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতি ধ্বংসের চেষ্টা

দেশের বহু মানুষের মনেই আজ যেটা এক বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হল, ভারতের বহুত্ববাদের মধ্যে একতার যে মহান ঐতিহ্য, যা দেশের মানুষের জাতিগত, ভাষাগত এবং সম্প্রদায়গত ভিন্নতাকে একটা সুরে বেঁধে রেখেছিল, সেটা হয়ত ক্রমশ এক কেন্দ্রীভূত জাতিবাদী রাষ্টে্রর ভাবনায় রূপান্তরিত হচ্ছে।

কিন্তু কেন এই পরিবর্তন? ভারতে রাষ্ট্রীয় ভাষা, রাষ্ট্রীয় দল, রাষ্ট্রীয় ধর্ম বলে কিছু ছিল না। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে হিন্দি ভাষার আগ্রাসন যেমন বাড়ছে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মীয় আগ্রাসনও মাত্রাছাড়া হচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এনে একটা বিশেষ ধর্মের মানুষদের নাগরিকত্ব প্রদানের ঘৃণ্য প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে, যা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্যের পরিপন্থী। যদি ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদানের নীতি গৃহীত হয়, তবে সংখ্যালঘু শ্রেণি তার নাগরিকত্ব হারাবে। সংখ্যাগুরু ধর্মের মানুষও উচ্চ নিচ বর্ণের ভেদাভেদের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব পাবে। নিম্নবর্ণের মানুষ নাগরিকত্ব পাবে না। আসামে তেমন ছবিই দেখা গেছে। এই যে ধর্মগত, বর্ণগত, জাতিগত বিভাজন এবং তার ভিত্তিতে একটা বিশেষ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাকিদের বেনাগরিক দাসে পরিণত করার রাষ্ট্রীয় চক্রান্ত, এটা ভারতীয় বহুত্ববাদী ঐতিহ্যের পরিপন্থী। এই জাতিগত আগ্রাসন শুধু একটা বিশেষ জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় সীমাবদ্ধ নেই। তা আঘাত করেছে দেশের গণতন্ত্রকে, সংবিধানকে, সহনশীলতাকে, বহুত্ববাদের মহান আদর্শকে। উৎসাহিত করেছে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতাকে।

কিন্তু কেন রাষ্ট্রকে তার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ধর্মের সাহায্য নিতে হচ্ছে? কেন ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টির মাধ্যমে তার নাগরিকদের বিচ্ছিন্ন করতে হচ্ছে?

রাষ্ট্র শ্রেণি শোষণের হাতিয়ার। আর ধর্ম হল মানুষের কাছে আফিমের নেশার মতো। তাই রাষ্ট্র সবসময় চেয়েছে শোষিত মানুষের বিভাজিত রূপ। যাতে সে সংগঠিত প্রতিবাদের শক্তি অর্জন করতে না পারে। তার শক্তি যাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থের দ্বারা বিভাজিত হয়। আর সেই বিভাজন যদি ধর্মীয় মেরুকরণের ভিত্তিতে হয়, তবে মানুষকে প্রশ্নহীন আনুগত্য প্রদর্শনে বাধ্য করা সহজ হবে। কারণ ধর্মের ভিত্তি হল বিশ্বাস। যুক্তিকে সে মান্যতা দেয় না। প্রতিটি ধর্মের প্রাথমিক উদ্দেশ্য তার নিজের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করা। আর রাষ্ট্র সেই ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকেই তার নিরঙ্কুশ প্রাধান্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে চাইছে। প্ররোচিত করছে ধর্মীয় হানাহানিতে। কারণ মানুষকে গণতন্ত্রের আদর্শের বেড়াজালে বেঁধে রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিগত পার্থক্য আজ আর কাজ করছে না। নীতিগত ঐক্যই আজ তার বাস্তব রূপ। তাই রাজনীতিতে ধর্মীয় অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে তার ভিত্তিতে নির্বাচনে সাফল্য লাভের অভিসন্ধি ছাড়া তাদের সামনে অন্য কোনও পথ খোলা নেই। তারা জানে একমাত্র ধর্ম দিয়েই মানুষকে বিভাজিত করা অনেক সহজ এবং প্রায় আশি শতাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে ভারতের মতো দেশে হিন্দু ধর্মভিত্তিক সংগঠিত জনমত তৈরির মাধ্যমে একটা শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করাও অপেক্ষাকৃত সহজ।

একজন ধর্মনিরপেক্ষ দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েও তাই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় তাঁকে মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের অনুষ্ঠানে যেমন উপস্থিত থাকতে হয়, তেমনই ভবিষ্যতে একটা বিশেষ ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লিখিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ও ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দ দুটিও বাতিলের কথা ভাবতে হয়। আর এই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার নিরঙ্কুশ প্রাধান্য বিস্তারে বহুত্ববাদ, বহুজাতীয় সংস্কৃতি, বহুভাষার প্রাধান্য বাধাস্বরূপ। তাই এক জাতি, এক ধর্ম, এক ভাষা, এক রাজনৈতিক দলের আদর্শ প্রতিষ্ঠা তাদের কাছে জরুরি।

সূর্যকান্ত চক্রবর্তী

তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর