Breaking News

ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে কর্মীরা আন্দোলনে

এবারের কেন্দ্রীয় বাজেটের মাধ্যমে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিলগ্নিকরণের যে ঘোষণা হয়েছে তাতে প্রথম পদক্ষেপে রাষ্ট্রায়ত্ত দু’টি ব্যাঙ্ক এবং একটি বিমা সংস্থাকে বেসরকারিকরণের প্রস্তাব রয়েছে। প্রথমে বেছে নেওয়া হয়েছিল পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক এবং ব্যাঙ্ক অফ বরোদাকে। তবে এ নিয়ে বেশি বাধার সম্মুখীন হতে হবে ভেবে পরে ব্যাঙ্ক অফ মহারাষ্ট্র, ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান ওভারসিজ ব্যাঙ্ক এবং সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া– এই চারটি ব্যাঙ্কের মধ্যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে দুটি ব্যাঙ্ক বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এজন্য তারা ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ এবং বিমা আইনগুলির পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। এতে ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের সমস্ত বাধা দূর করতে ব্যাঙ্কিং কোম্পানি ১৯৭০ এবং ১৯৮০ নামের দুটি আইন সংশোধন এবং বিমা ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের সীমা ৪৯ থেকে ৭৪ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব রয়েছে।

উদার অর্থনীতির আদলে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার সংস্কারের উদ্দেশ্যে গঠিত নরসিঙ্ঘম কমিটির সুপারিশ কার্যকর করতে গিয়ে ইতিমধ্যে সংযুক্তিকরণের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সংখ্যা ২৭ থেকে ১২তে নামিয়ে আনা হয়েছে। এই কমিটি দু’বার তাদের সুপারিশ রেখেছিল। প্রথমবার ১৯৯১ সালে কংগ্রেস রাজত্বে এবং পরে যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে। এই সরকারের শরিক ছিল সিপিএম ও তার সহযোগী বামপন্থীরাও। এই সুপারিশ অনুযায়ী বেশ কিছু শাখার অবলুপ্তি ঘটানো হয়েছে। নতুন নিয়োগ বন্ধ হয়েছে। গ্রাহক এবং ব্যাঙ্ক কর্মচারীরা সমস্যায় পড়েছেন। বলা হচ্ছে, ব্যাঙ্কগুলির শক্তিবৃদ্ধি করতেই এই সংযুক্তিকরণ। এরপরও ব্যাঙ্কগুলির শক্তিক্ষয় অব্যাহত। অনাদায়ী ঋণ বাড়তে বাড়তে প্রতিটি ব্যাঙ্কেই যে অনুৎপাদক সম্পদ সৃষ্টি হচ্ছে তার় চাপে ব্যাঙ্কশিল্প সঙ্কটাপন্ন। ২০১৮ সালের ৩১ মার্চের হিসাবে ভারতীয় অর্থনীতিতে অনুৎপাদক সম্পদ ছিল ১০ লক্ষ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এতদিনে তা অনেক বেড়ে গিয়েছে। এই সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পেতে অনাদায়ী ঋণ আদায়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার পরিবর্তে ‘ওয়ান টাইম সেটলমেন্ট’ (ওটিএস), ঋণের পুনর্গঠন বা অনুরূপ অন্য উপায়ে ঋণ মকুব এবং সর্বোপরি এনপিএ ‘রাইট অফ’ করে ইচ্ছাকৃত ঋণ শোধ না করা বৃহৎ ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের ঋণ মকুব করে সমস্যা মেটানোর নামে ব্যাঙ্কগুলিকে লোকসানে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। গত বছর ফেব্রুয়ারির গোড়ার দিকে অর্থমন্ত্রকের প্রতিনিধি লোকসভায় জানান, ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের প্রথমার্ধে তফসিলভুক্ত বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি এবং বাছাই কিছু অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান মোট ১ লক্ষ ১৩ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকার প্রতারণার শিকার হয়েছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাঙ্কগুলির দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি যদিও লড়াই করে টিকে আছে সেখানে বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলি একের পর এক মুখ থুবড়ে পড়ছে, আর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকেই এসব ব্যাঙ্কগুলির বাঁচানোর দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। গত এক বছরেই পাঞ্জাব মহারাষ্ট্র কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক, ইয়েস ব্যাঙ্ক, লক্ষ্মীবিলাস ব্যাঙ্ক, কারাড জনতা সহকারী ব্যাঙ্কের মতো বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলির অবস্থা সঙ্কটজনক। এর মধ্যে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক শেষোক্ত ব্যাঙ্কের লাইসেন্স বাতিল করেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া মোটা অঙ্কের মূলধনের টাকা (৭,২৫০কোটি টাকা) জোগান দিয়ে ইয়েস ব্যাঙ্ককে বাঁচাচ্ছে। বেসরকারি লক্ষ্মীবিলাস ব্যাঙ্ককে বাঁচাতে তাকে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে সিঙ্গাপুরের ডি বি এস ব্যাঙ্কের সাথে। চোখের সামনে এত সব দেখার পরও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ককে বেসরকারিকরণের নিরন্তর প্রচেষ্টা অব্যাহত। কেন? মোদি সরকারের ব্যাখ্যা, এর ফলে আগামী দিনে আরও বেশি করে বিদেশি ব্যাঙ্কের আগমন দেশের অর্থব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে।

সম্প্রতি আবার রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার বিশেষ আভ্যন্তরীণ কমিটি ‘ব্যাঙ্কিং রেগুলেশন অ্যাক্ট-১৯৪৯’-এ কয়েকটি সংশোধনের যে সুপারিশ করেছে, তা প্রকাশ্যে এসেছে। এই সুপারিশের মধ্যে রয়েছে, বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে ব্যাঙ্ক খোলার অনুমতি দেওয়া। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন এবং প্রাক্তন ডেপুটি গভর্নর বিরল আচার্য সংশ্লিষ্ট সব মহলকে এ নিয়ে সতর্ক করেছেন, এর বিপদের দিক ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! এই সঙ্কটের পিছনে মূলত দায়ী এ দেশের ধনকুবের গোষ্ঠী। ভারতবর্ষের পুঁজি ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সংহতি ও উন্নতির জন্য ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা আশানুরূপ না হওয়ায় একসময় ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ করেছিল তদানীন্তন কংগ্রেস সরকার। তা ছিল তদানীন্তন পুঁজিবাদের সামগ্রিক স্বার্থে। কিন্তু বর্তমানে এদেশের পুঁজি বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির অংশ হিসাবে তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ। বিশ্ববাজারে তাদের স্থান আরও দৃঢ় করার উদ্দেশ্যে ভারতীয় পুঁজিপতিরা যে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ সেখানে তাদের প্রয়োজন ভারতবর্ষের সকল পুঁজি সঞ্চয়কারী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। আবার এই প্রয়োজনেই তারা বিদেশি একচেটিয়া পুঁজিপতিদেরও এ দেশের বাজারে ঢোকার সুযোগ করে দিতে বাধ্য। সে কারণেই এবারের বাজেটে বর্তমানে বিমা ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের সীমা ৪৯ থেকে ৭৪ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির বেসরকারিকরণের প্রস্তাব। নব্বইয়ের দশকের গোড়া থেকেই ধাপে ধাপে এ কাজ চলছে। আন্দোলনের চাপে একাজ তারা দ্রুততার সাথে করতে পারেনি যা মোদি সরকার দ্রুত রূপায়ণ করতে বদ্ধপরিকর। বর্তমানে ব্যাঙ্কে যে বিশাল লোকসান তা সৃষ্টির পিছনে মূলত দায়ী এ দেশের ধনকুবেরর গোষ্ঠী। এদের আড়াল করতে কর্তৃপক্ষ এদের নাম পর্যন্ত প্রকাশ করছে না। ব্যাঙ্ক বেসরকারি হলে এই গোষ্ঠীই হবে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের মালিক। এরাই নিয়ন্ত্রণ করবে ব্যাঙ্কের বিশাল পরিমাণ আমানত। আমানতের উপর ধনকুবেরদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম হলে গ্র্রাহকদের গচ্ছিত অর্থের কোনও নিরাপত্তা থাকবে না। নিরাপত্তা থাকবে না কর্মচারীদের চাকরিরও।

এই পরিস্থিতিতে সরকারের এই কর্মসূচিকে সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রতিহত করার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন ব্যাঙ্ক কর্মচারী এবং গ্রাহকেরা। বেসরকারিকরণ প্রতিহত করতে ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের ৯টি ইউনিয়নের যুক্ত মঞ্চ আগামী ১৫ এবং ১৬ মার্চ দেশব্যাপী ব্যাঙ্ক ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। অল ইন্ডিয়া ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ ইউনিটি ফোরামের পক্ষ থেকেও এই দু’দিন ধর্মঘটের আহ্বান করা হয়েছে। ফোরামের সাধারণ সম্পাদক জগন্নাথ রায়মণ্ডল বলেন, ‘দু’দিনের ধর্মঘটের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান না হলে আমাদের লাগাতার আন্দোলনের দিকে যেতে হবে।’ প্রতিরোধ আন্দোলনের একটি ধাপ হিসাবে এই ধর্মঘটকে সফল করার জন্য তিনি সমস্ত ব্যাঙ্ক কর্মচারী এবং গ্রাহকদের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। আবেদন জানিয়েছেন, বেসরকারিকরণ প্রতিরোধে আগামী দিনে ঐক্যবদ্ধভাবে আরও বৃহত্তর এবং লাগাতার আন্দোলন গড়ে তোলার।

(ডিজিটাল গণদাবী-৭৩ বর্ষ ২৩ সংখ্যা_২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১)