ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ বেসরকারিকরণের লক্ষ্যেই FSDR বিল

আর্থিক দিক থেকে ক্রমশ দুর্বল হতে থাকা সমস্ত ধরনের ব্যাঙ্ক, নন–ব্যাঙ্কিং সংস্থা, বিমা সহ বিভিন্ন আর্থিক সংস্থাগুলিকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে বছর তিনেক আগে আনা হয়েছিল এফ আরডিআইবিল–২০১৭৷ এই বিলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল বেইল–ইন৷ অর্থাৎ ব্যাঙ্কগুলির আর্থিক অবস্থা খারাপ হলে তাকে সুস্থ করার বা এক কথায় ব্যাঙ্কগুলি ফেল করলে তাকে পাশ করানোর দায়িত্ব নিতে হবে গ্রাহকদের৷ নানা সুযোগ সুবিধা ছেড়ে এমনকি আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করেও ওই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটিকে দাঁড করানোর দায়িত্ব গ্রাহকদের নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল ওই বিলে৷ ওই বিলের মাধ্যমে কর্মচারীদের ওপরও প্রয়োজনে আঘাত নামিয়ে আনার নানা উপায় বাতলে দেওয়া হয়েছিল৷ স্বভাবতই ওই বিলের বিরুদ্ধে  তখন কর্মচারী,  গ্রাহক সহ নানা মহলে প্রতিবাদের ঝড উঠেছিল৷ অবস্থা বেগতিক বুঝে সরকার বিলটিকে পার্লামেন্ট পর্যন্ত নিয়ে আসার দুঃসাহস দেখায় নি৷

কিন্তু কী কৌশলে এই বিলটিকে আইনে পরিণত করা যায় তার পরিকল্পনা চলছিল ভেতরে ভেতরে৷ বর্তমানে দেশজুডে কোভিড–১৯ এর ব্যাপক সংক্রমণ এবং সে কারণে লকডাউনের নানা বিধিনিষেধ৷ এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এ জাতীয় বিলকে আইনে পরিণত করার চেষ্টা তারা চালিয়ে যাচ্ছে৷ ইতিমধ্যে বিলটির রং পাল্টে ফেলা হয়েছে৷ বিলটির নাম দেওয়া হয়েছে ফিনান্সিয়াল সেক্টর ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেশন (রেজলিউশন) বিল ২০১৯ বা এফএসডিআর বিল–২০১৯৷

মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে এ জাতীয় বিল আনার পরিপ্রেক্ষিতটা বুঝে নেওয়া দরকার৷ ২০০৮ সালে যখন আমেরিকার বহু বড় বড় ব্যাঙ্ক ফেল করেছিল তখন সরকার সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় গড়ে ওঠা কোষাগার থেকে সাহায্য করে কিছু কিছু ব্যাঙ্ককে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিল৷ কিন্তু পুঁজিবাদের রক্ষকদের পক্ষে এটা সবসময় সম্ভব নয় বুঝে জি–৭ দেশগুলি ঐক্যবদ্ধ হয়ে পরবর্তীকালে কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে৷ ওই সময় তারা এ সিদ্ধান্তের অংশীদার করেছিল ভারতবর্ষ সহ আরও কিছু দেশকে৷ সেখানেই দেশে দেশে ‘ফিনান্সিয়াল স্টেবিলিটি বোর্ড’ বা এফএসবি গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং বলা হয় রুগ্ণ ব্যাঙ্ক বা আর্থিক সংস্থাগুলিকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে এই বোর্ড কী ব্যবস্থা নেবে৷ সেই অনুযায়ী এফএসডিআর বিল–এর ক্ষেত্রে গঠিত হওয়ার কথা একটি ‘রেজোলিউশন অথরিটি’ বা আরএ৷ মূলত আর্থিক নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার কয়েকজন প্রতিনিধি নিয়ে এই আরএ গঠিত হওয়ার কথা৷ এই অথরিটির সিদ্ধান্তই ব্যাঙ্ক বা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে মানতে হবে৷ এ ক্ষেত্রে ‘ব্যাঙ্কিং রেগুলেশন অ্যাক্ট–১৯৪৯’, ‘ন্যাশনালাইজেশন অ্যাক্ট’, ‘ইন্সিওরেন্স রেগুলেটরি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অথরিটি অ্যাক্ট (আইআরডিএ অ্যাক্ট)–১৯৯৯’ প্রভৃতির কোন ভূমিকা থাকবে না৷ ভূমিকা থাকবে না রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (আরবিআই), সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া (সেবি), আইআরডিএ, পেনশন ফান্ড রেগুলেটরি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (পিএফআরডিএ)–এর মত পরিচালন সংস্থাগুলির৷ ভারতবর্ষে পি এস ইউ (পাবলিক সেক্টর আন্ডারটেকিং) ব্যাঙ্কগুলি যে দক্ষতা এবং যোগ্যতার সঙ্গে কাজ করছে তাতে ১৯৬৯ সালের পর কোন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ফেল করেনি৷ এই ব্যাঙ্কগুলির প্রতি ভারতবাসীর একটা বিশ্বাস বা আস্থার জায়গা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ একে ভেঙ্গে দেবে এই আরএ৷ এই আরএ’র হাতে ৪টি ক্ষমতা দেওয়ার কথা বিলে বলা হয়েছে৷

প্রথমত, কোনও ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল হলে সেই প্রতিষ্ঠানের সাথে গ্রাহকদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সকল চুক্তি তা নস্যাৎ করে দিতে পারে এই সংস্থা৷ অর্থাৎ আপনি কিছু পরিমাণ টাকা একটা বিশেষ মেয়াদের জন্য কোন ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিট (এফডি) করেছেন৷ এ ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক আপনাকে একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট হারে সুদ সহ টাকা ফেরৎ দেওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে৷ ওই ব্যাঙ্ক ইতিমধ্যে দুর্বল হলে এই চুক্তি আরএ’র সহযোগিতায় যে কোন সময় ভেঙে দিতে পারে ব্যাঙ্ক৷ এক্ষেত্রে সুদের হার কমিয়ে দিতে পারে, এমনকি ওই এফডি’র মেয়াদও পরিবর্তন করতে পারে ব্যাঙ্ক৷ আবার পাওনা টাকা নগদে না পেয়ে শেয়ার, বন্ড বা নানা রকম ঋণপত্রের রূপেও ফেরৎ পেতে পারেন৷

দ্বিতীয়তঃ, প্রত্যেক ব্যাঙ্কে এখন অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ক্রমবর্ধমান৷ এই অনাদায়ী ঋণ বা এনপিএ (নন–পারফর্মিং অ্যাসেট) ধীরে ধীরে ব্যাঙ্কগুলিকে দুর্বল করে দিচ্ছে৷ বর্তমানে এই এনপিএ’র পরিমাণ প্রায় ১০ লক্ষ কোটি টাকা৷ এই ঋণ আদায়ে তেমন গুরুত্ব না দেখা গেলেও, সরকারি মধ্যস্থতায় গত ৫ বছরে প্রায় ৪ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ ছাড় দেওয়া হয়েছে বড় বড় শিল্পপতি–ব্যবসায়ীদ্৷ এতে ব্যাঙ্কগুলি আরও দুর্বল হয়েছে৷ এই ঋণ ছাড দেওয়ার ব্যাপারে এরপর আরএ’র সিদ্ধান্তই হবে চূডান্ত৷ বলাবাহুল্য, ব্যাঙ্কগুলিতে মোট এনপিএ’র ৮৩ শতাংশ হল বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলির, আম্বানি–আদানিদের৷ কৃষিঋণে এনপিএ’র পরিমাণ ১০ শতাংশের কাছাকাছি৷ কৃষিঋণ আদায়ে যেভাবে জোর দেওয়া হয়, কর্পোরেট সংস্থার এনপিএ তে তা করা হয় না৷ ব্যাঙ্কের চোখে এরা হল সবচেয়ে মূল্যবান গ্রাহক৷ এদের ঋণ মকুবের ব্যাপারে আরএ’র ভূমিকা হবে চূড়ান্ত৷

তৃতীয়ত, ব্যাঙ্ক যদি কোনও বিপদে পডে তখন গ্রাহকদের প্রতি ব্যাঙ্কের দায়বদ্ধতা ঠিক করে দেবে এই আরএ৷ আপনি আপনার আয়ের বা সঞ্চয়ের একটা বড় অংশ ব্যাঙ্কে রেখেছেন প্রয়োজনে ব্যাঙ্ক থেকে তুলে ব্যবহার করবেন এই আশা নিয়ে৷ কিন্তু এ ক্ষেত্রে আপনার গচ্ছিত টাকার কতটা, কবে তুলতে পারবেন বা ব্যবহার করতে পারবেন তা আপনার ইচ্ছা–নিচ্ছার উপর নির্ভর করবে না৷ ঠিক করবে আরএ৷ সম্প্রতি পাঞ্জাব অ্যান্ড মহারাষ্ট্র কোপারেটিভ ব্যাঙ্ক (পিএমসি ব্যাঙ্ক) যখন আর্থিক দিক থেকে দেউলিয়া হল তখন গ্রাহকদের প্রথমে মাসে ২০ হাজার টাকার বেশি তুলতে দেওয়া হয়নি৷ এখন তা বাড়তে বাড়তে ১ লাখ টাকা হয়েছে৷ এ জাতীয় সমস্ত কিছুর সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার থাকবে আরএ’র৷

চতুর্থত কোনও ব্যাঙ্ক আর্থিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পডলে আরএ ঠিক করবে তার মালিকানার হস্তান্তর হবে কিনা, আর হস্তান্তর হলে কেমন হস্তান্তর হবে৷ অর্থাৎ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে ব্যক্তি মালিকানায় নিয়ে যাওয়ার রাস্তাকে এর মাধ্যমে অনেকখানি প্রশস্ত করা হল৷ এমনি করে কোনও রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে কোন ব্যক্তির বা কোন কোন ব্যক্তির মালিকানায় হস্তান্তর করা হবে তাও ঠিক করবে আরএ৷ এর সবকটি ক্ষেত্রে আরবিআই, সেবি বা আইআরডিএ’র কোনও ভূমিকা থাকবে না৷

এই প্রক্রিয়া যে শেষ পর্যন্ত এই সব প্রতিষ্ঠানের সাধারণ গ্রাহকদের বিশ্বাসে চিড় ধরাবে তা সহজেই অনুমান করা যায়৷ এর পরিণতিতে একদিকে যেমন ব্যাঙ্ক সেভিংস অ্যাকাউন্টে গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ক্রমাগত কমবে তেমনি বিভিন্ন অসুরক্ষিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান, চিট ফান্ডের বাড় বাড়ন্ত দেখা দেবে৷ উল্লেখ্য, দেশের মোট জিডিপি’র প্রায় ৭৮ শতাংশ এই সেভিংসের উপর নির্ভরশীল৷ এই সেভিংস দুর্বল হলে জিডিপিও নিম্নগামী হবে৷ দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ তা ছাড়া মানুষ ব্যাঙ্ক এডিয়ে বিভিন্ন অসুরক্ষিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে, চিট ফান্ডে সঞ্চয় করলে, তার ভবিষ্যৎ কী হবে তা কারও অজানা নয়৷ গ্রাহকরা যে অচিরেই সর্বস্বান্ত হবেন– এমনটা জোর দিয়েই বলা যায়৷

বলাবাহুল্য ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে আনা হচ্ছে এই বিল৷ ইতিমধ্যে অনেক ব্যাঙ্কে নানা দুর্নীতি, প্রতারণা, জালিয়াতির কথা প্রকাশ্যে এসেছে৷ বিজয় মালিয়া অনেকদিন আগেই বিভিন্ন ব্যাঙ্ক থেকে ৯৬০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন৷ পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক থেকে ১১,৪০০ কোটি আত্মসাৎ করে প্রধানমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ নীরব মোদি, মেহুল চোক্সিরাও নির্বিঘ্ণে দেশ ছেডেছেন৷ এ বছরের প্রথম ৬ মাসে সিবিআই–এর তথ্য অনুযায়ী আমাদের দেশের বিভিন্ন ব্যাঙ্ক থেকে ১৪,৪২৯ কোটি টাকার ব্যাঙ্ক জালিয়াতি হয়েছে৷ এগুলি বন্ধ করার চেষ্টা না করে ব্যাঙ্কশিল্পকে বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে সরকার নিয়ে আসছে এফএসডিআর বিল৷ যারা ব্যাঙ্কগুলিকে লুট করে নিজেদের আখের গোছাচ্ছে তাদেরই ব্যাঙ্কের মালিক করার জন্য এমন পদক্ষেপ৷ এই দৃষ্টিভঙ্গির এ যাবৎ নানা রকম বাস্তবায়নের পরিণতিতে এ দেশের ৭৩ শতাংশ সম্পদের মালিকানা রয়েছে ১ শতাংশ মানুষের হাতে৷ ডুবছে দেশের অর্থনীতি৷ সে কারণে এই এফএসডিআর বিলের বিরোধিতা করতে হবে৷ কেবল ব্যাঙ্ককর্মী, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মী বা গ্রাহকরা নয়, সমস্ত সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে এই জনবিরোধী বিলকে প্রতিহত করতে৷