বেসরকারি হলেই সামাধান! (পাঠকের মতামত)

 

ফাইল চিত্র

বেসরকারিকরণ হলে নাকি পণ্যের এবং পরিষেবার মান উন্নত হয়, এরকম একটা ধারণায় অনেকের বিশ্বাস। নিজের মতো কিছু যুক্তি খাড়া করে তারা বলেন, অমুক প্রতিষ্ঠান যখন সরকারি ছিল তখন ঘন্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হত। কিন্তু এখন বেসরকারি পরিষেবা কত উন্নত। অমুক অফিসে উৎকোচ দিয়েও কাজ হয় না। পুরোটাই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ আগে ঘন ঘন চলে যেত। এখন লোডশেডিং হয় না বললেই চলে।

এই ধরনের কথা প্রায়শই শোনা যায়। শুনে শুনে অনেকেই সরল মনে বিশ্বাস করেন, সত্যি বেসরকারিকরণ হলেই বোধহয় ভাল। এত ঝামেলা আর সহ্য হয় না। টাকা দেব, উৎকোচ দেব, সময় দেব, অথচ পরিষেবা পাব না, সেটা মানা যায় না।

প্রশ্ন হল, একজন ব্যক্তি মালিকের দ্বারা পরিচালিত কোনও প্রতিষ্ঠান যদি আপনার যুক্তিতে উন্নত পরিষেবা দেওয়ার সামর্থ্য রাখে, তবে একটা শক্তিশালী রাষ্ট্র কেন উন্নত পরিষেবা দিতে সমর্থ নয়? কীসের অভাবে রাষ্ট্র তা দিতে ব্যর্থ হয়? রাষ্ট্র কি পারে না ব্যক্তি মালিকের মতো কর্মসংস্কৃতি সৃষ্টি করতে? প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম ভঙ্গ করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে কি খুব কঠিন? উৎকোচ, স্বজনপোষণ, অনিয়মের জন্য রাষ্ট্র নানান ব্যবস্থা অতি সহজেই গ্রহণ করতে পারে। রাষ্ট্রের নিজের পরিচালনায় প্রতিরক্ষা দপ্তর কেমন দক্ষতার সাথে পরিচালিত হয়। কীভাবে হয়? কারণ একটাই। রাষ্ট্র চায় তাই হয়। যার হাতে পুলিশ মিলিটারি সহ নানা শক্তিশালী হাতিয়ার আছে, তার পক্ষে একটা সাধারণ পরিষেবা প্রদানমূলক দপ্তর পরিচালনা করা সত্যিই কি খুব কঠিন?

দ্বিতীয়ত, ব্যক্তি মালিক যদি উন্নত পরিষেবা প্রদানে সমর্থও হয়, সেটা কি ন্যায়সঙ্গত? সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান কি তাহলে ব্যক্তি মালিকের হাতে তুলে দেওয়া উচিত? যদি ধরে নিই একটা দেশের সকল পণ্য পরিষেবামূলক প্রতিষ্ঠানের মালিক কয়েকজন ব্যক্তি, তাহলে সেই সকল প্রতিষ্ঠানগুলোর যে বিপুল মুনাফা, স্বাভাবিকভাবেই তার মালিকানা থাকবে ওই কয়েকজন ব্যক্তির হাতে। সম্পদের চরম কেন্দ্রীকরণের ফলে চূড়ান্ত বৈষম্য কায়েম হবে। এ কখনও কাম্য হতে পারে?

রাষ্ট্র কেন তার সকল নাগরিক পরিষেবার দায়িত্ব ব্যক্তি মালিকের হাতে তুলে দিতে চাইছে? আপনারা কেন উন্নত পরিষেবা পাওয়ার জন্য বেসরকারি পরিষেবা কিনবেন? নাগরিক হিসাবে আপনি কেন রাষ্ট্রের উন্নত পরিষেবা দাবি করবেন না? কেন রাষ্ট্র আপনার ন্যায্য নাগরিক পরিষেবার দায়িত্ব ব্যক্তি মালিকের হাতে সমর্পণ করতে চায়? আপনার আমার সবার বিপুল ট্যাক্স রাষ্ট্র গ্রহণ করে আমাদেরই পরিষেবা প্রদানের জন্য। সেই দায়িত্ব একটা জনকল্যাণকামী বলে দাবিদার রাষ্ট্র কি এড়িয়ে যেতে পারে?

এ ভাবে চললে, আপনি দেখবেন ভবিষ্যতে কোনও সরকারি স্কুল, হাসপাতাল, ব্যাঙ্ক কিছুই থাকবে না। সবকিছুই আপনাকে বাজার মূল্যে কিনতে হবে। একবার ভেবে দেখুন তো কত জন মানুষের এই ক্রয়ক্ষমতা আছে? একদিকে আপনার ক্রয়ক্ষমতার ক্রমবর্ধমান অবনতি, আর একদিকে সমস্ত পণ্যের অগ্নিমূল্য। ক্রেতা বিক্রেতার সম্পর্কের এই সামাজিক অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতায় সামাজিক অবক্ষয় অনিবার্য। একদিকে সীমাহীন সম্পদের প্রাচুর্য, আর একদিকে সীমাহীন দারিদ্র। এই চরম সামাজিক অর্থনৈতিক বৈষম্য পুঁজিবাদের ক্ষয়িষ্ণু রূপ। তাই এই ব্যবস্থার অবসান চাই। কারণ সকল সমস্যার মূলে এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা।

সূর্যকান্ত চক্রবর্তী

তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ১৯ সংখ্যা ১৭ ডিসেম্বর ২০২১