বিশ্ব ক্ষুধা তালিকায় ১০৭-এ ভারত রেশনে খাদ্য বন্ধের পরিকল্পনা কেন্দ্রীয় সরকারের

করোনা অতিমারির জন্য কেন্দ্রীয় সরকার যে অতিরিক্ত খাদ্যশস্য রেশনের মাধ্যমে বিলি করছিল, কেন্দ্রীয় সরকার তা বন্ধ করবে বলে শোনা যাচ্ছে। সরকারি যুক্তি, লকডাউন শেষ হয়ে গেছে, কর্মক্ষেত্রগুলি খুলে গেছে, ফলে প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা আর তেমন নেই। তারা এও বলছে, এ বছর গম ও ধান, দুটোরই উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দেওয়ায় খাদ্য ভাণ্ডারে টান পড়েছে। তাই দেওয়া সম্ভব নয়। স্বাভাবিক ভাবেই এ প্রশ্ন উঠেছে, কোনটা সত্য? প্রয়োজন নেই, নাকি উৎপাদন হচ্ছে না?

প্রয়োজন না থাকার অজুহাতে এই অর্থবর্ষে ‘অন্ন যোজনা’ প্রকল্পের বরাদ্দ টাকার পুরোটা কেন্দ্রীয় সরকার খরচ করেনি। এই অবস্থায় দেখা যাক, এই প্রকল্পের এখন আর দরকার আছে কি নেই? সরকারি-অসরকারি নানা সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, দরকার অত্যন্ত বেশি রকমের। দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ খেতে পান না দু’বেলা। গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স ২০২১-এ ভারতের স্থান ছিল ১০১। এখন তার থেকে আরও অন্ধকারে ভারত, ২০২২-এ ১২১টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১০৭। দেশের ৮০ কোটিরও বেশি মানুষ রেশন ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে দিন যাপন করেন। তা হলে রেশন ব্যবস্থায় কোপ কেন?

গত জুলাই মাসে রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি আন্তর্জাতিক রিপোর্টে প্রকাশ, ভারতে ২০১৮-২০ সালের তুলনায় ২০১৯-২১ সালে ক্ষুধা ও অপুষ্টির প্রকোপ বেড়েছে। গত দু’বছরে অন্তত ৫৬ কোটি ভারতীয় খাদ্য নিরাপত্তার অভাবে ভুগেছেন, যা দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ। রাষ্ট্রপুঞ্জের আর এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ৯৭ কোটি ভারতীয় সুষম আহার থেকে বঞ্চিত। তা হলে প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা নেই, মন্ত্রীরা কীসের ভিত্তিতে তা ঠিক করলেন?

তাছাড়া লকডাউন উঠে গেলেও কাজ ফিরে পাননি একটা বড় অংশ, বেকারির হার ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ। সিএমআইই ২০২২-এর মে মাসে জানিয়েছে, নতুন করে ১ কোটি ৪০ লক্ষ কর্মচারী কাজ হারিয়েছেন। এতে প্রকাশ, আগস্টে বেকারত্বের হার বেড়ে শহরে দাঁড়িয়েছে ৯.৭ শতাংশ, গ্রামে ৭.৬ শতাংশ। যারা কাজ খুঁজতে গিয়ে পাননি বেকারত্বের এই হিসাব সেটা ধরে। আর যারা কাজ করতে সক্ষম, তাদের ধরলে জনসংখ্যার ৫৩ শতাংশ পুরোপুরি রোজগারহীন। ৪৭ শতাংশ মাত্র কিছু কাজ পায়। আয় কমেছে বহু মানুষের।

বেশিরভাগ কাজ অসংগঠিত ক্ষেত্রের। মজুরি অনেকেরই দিনে ২০০ টাকারও কম। এদিকে মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে চড়চড় করে। ফলে ক্রয়ক্ষমতা কমছে মানুষের। ন্যূনতম প্রয়োজনীয় খাদ্য কিনতে পারছে না তারা। নিত্যপ্রয়োজনীয় চাল-গম-ডাল-তেল-সবজি-আলু কিনতে তাদের হিমসিম অবস্থা। খুচরো বাজারে ডালের দাম গত ১০৫ মাসের মধ্যে সেপ্টেম্বরে সর্বোচ্চে পৌঁছেছে। কোনও বেসরকারি সংস্থা নয়, সরকারি হিসাব বলছে দেশের ৩৩ লক্ষ শিশু গুরুতর অপুষ্টিতে ভুগছে।

খাদ্য নিগমের ভাণ্ডারে চাল-গমের আকাল, এই যুক্তির সঙ্গে আদৌ কি বাস্তবের কোনও মিল আছে? সরকারের যুক্তি, চাল-গমের উৎপাদন কম। কেন্দে্রর কৃষি দপ্তর কী বলছে দেখা যাক। তাদের রেকর্ড অনুযায়ী, ২০২১-২২-এ চাল উৎপাদন হয়েছে ১২৭.৯৩ মিলিয়ন টন, গত পাঁচ বছরের গড় উৎপাদনের থেকে ১১.৪৯ মিলিয়ন টন বেশি। গমের উৎপাদন গত পাঁচ বছরের গড় উৎপাদনের থেকে বেড়ে ২০২১-২২-এ হয়েছে ১১১.৩২ মিলিয়ন টন। ২০২২-২৩-এ চাল-গম উৎপাদন কমতে পারে এমন আশঙ্কার কথা বলে সরকার গম রপ্তানি বন্ধ করেছে গত চার মাস ধরে, চাল রপ্তানির উপরও নিয়ন্ত্রণ চলছে। বাস্তবে সত্যিই কি এই নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমার আশঙ্কার কোনও সম্পর্ক আছে? যে ভাবে খাদ্যপণ্যের একচেটিয়া ব্যবসায়ীরা এই নিয়ন্ত্রণের মুখ্য পরিচালক হয়ে উঠছেন, তাতে এই নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে যে দেশের সাধারণ মানুষের সুবিধা-অসুবিধার কোনও সম্পর্ক নেই, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তা ছাড়া, ক’দিন আগেই কেন্দ্রীয় সরকার যখন লক্ষ লক্ষ টন চাল মদ কোম্পানিগুলিকে ইথানল তৈরির জন্য দিচ্ছিল তখন যুক্তি তুলেছিল, এফসিআই গোডাউনে চাল উপচে পড়ছে, তাই জায়গার অভাবের জন্য তারা এ কাজ করছে। অর্থাৎ তাদের কথা অনুযায়ী, ভাণ্ডারে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত চাল-গম রয়েছে। তা সত্তে্বও দেশের মানুষ যখন খাদ্য সঙ্কটে ডুবছে,তখন সরকারের এই অপরাধমূলক অবহেলা কেন? আর যদি সরকার এই সংকটকে মোকাবিলা করতে চায়, তাহলে উৎপাদিত চাল-গম সরাসরি চাষির থেকে কিনে সুলভে ক্রেতাদের হাতে পৌঁছে দিচ্ছে না কেন? বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে মানুষের হাতে খাদ্য পৌঁছে দিতে সরকারের হাতে রয়েছে বাফার স্টক। সেই স্টক প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করা হচ্ছে না কেন?

অন্যদিকে সরকার বাজারে চাল-গমের দামবৃদ্ধির কথা বলছে। দামবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ না করে সেই যুক্তি দেখিয়ে রেশন নিয়ন্ত্রণ করছে। এ অবস্থায় মানুষকে বাঁচাতে রেশনে সরকারি বরাদ্দ আরও বাড়ানো উচিত, যাতে তারা অন্তত রেশনের ভাত-রুটি খেয়ে দিন কাটাতে পারে। তা না করে রেশন ব্যবস্থায় বরাদ্দ কমানো সরকারের জনস্বার্থ রক্ষার নমুনা কি?

কেন্দ্র সরকার মানুষকে খাদ্য নিরাপত্তা দিতে যা যা করা দরকার তা না করে উল্টে গণবন্টন ব্যবস্থাকে সঙ্কুচিত করছে। অথচ ‘খাদ্যের অধিকার আইন’, ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা’-র প্রচার করে ভোটের বাজার গরম করছে। আইন থেকে, প্রকল্প থেকে কী হবে, যদি খেয়ে বেঁচে থাকার অধিকারই মানুষের না থাকে?

বাস্তবে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের কাছে জনস্বার্থের থেকে একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থরক্ষাই প্রধান লক্ষ্য। পুঁজির সেবাদাস হিসাবেই তারা এই ভূমিকা পালন করছে। আর রাজ্যের শাসক দলগুলিও রেশনে বরাদ্দ বহাল রাখার দাবিতে কোনও রকম আন্দোলন না গড়ে তুলে শুকনো বিবৃতি দেওয়ার পথ নিয়েছে। এভাবে সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলছে। মানুষকে খাদ্য জোগানোর দায়িত্ব সরকার কোনওভাবেই অস্বীকার করতে পারে না।