বিলাসী নেতারা গরিবের দুঃখ কী করে বুঝবেন

বিজেপির তাবড় নেতারা, অমিত শাহ থেকে নাড্ডা, সকলেই প্রচারে গিয়ে মাঝে মাঝেই কোনও দরিদ্রের কুঁড়ে ঘরে গিয়ে পাত পাড়ছেন। তাই দেখিয়ে বিজেপির আইটি সেল ‘বাহ বাহ’ ধুয়ো তুলে আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করছেন।

সত্যিই যদি কোনও দলের শীর্ষ নেতারা প্রচারে গিয়ে দরিদ্রের কুটিরে ওঠেন, তাঁদের জীবনের সুখ-দুঃখের খোঁজ-খবর নেন, তাঁদের সাথে একাত্ম বোধ করেন, চেষ্টা করেন তাঁদের দুঃখ দূর করার তবে তার থেকে আনন্দের আর কী আছে! অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ভারত বিশ্বের প্রথম কয়েকটি দেশের মধ্যে থাকলেও সেই সমৃদ্ধির ভাগ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই পান না। দেশের বেশির ভাগ মানুষই গরিব। তেমন দেশের নেতাদের এমন আচরণ দৃষ্টান্তমূলক বৈকি!

কিন্তু যদি জানা যায়, দরিদ্রের কুঁড়েতে এই পাতপাড়ার মধ্যে কোনও আন্তরিকতাই নেই। এর সবটাই অভিনয়, শুধুমাত্র সাংবাদিক ফটোগ্রাফার, টিভি চ্যানেল নিয়ে গিয়ে প্রচারের জন্যই এমন কাজ, তবে কী মনে হয়? যদি জানা যায়, দরিদ্রের মাটির দাওয়ায় বসে ভোজন সেরে সেই নেতারাই ফিরছেন কোনও বিলাসবহুল পাঁচতারা হোটেলে এবং সেখানেই থাকছেন, তবে কেমন লাগে? সেটিই দেখা গেল সম্প্রতি প্রকাশিত এক সংবাদে– নির্বাচনী প্রচারকাজ চালানোর জন্য বিজেপি মহানগরীর এক পাঁচতারা হোটেল ভাড়া নিয়েছে (দি টেলিগ্রাফ, ১৭ ফেব্রুয়ারি)। প্রথম সারির পাঁচতারা হোটেল ‘হোটেল হিন্দুস্তান ইন্টারন্যাশনাল’-এর বেশ কিছু ঘর বিজেপি ভাড়া নিয়েছে নেতাদের থাকা এবং মিডিয়া সেন্টার পরিচালনার জন্য। বিজেপি সূত্রেই জানা গেছে, নেতাদের থাকার জন্য ভোটের আগে আরও কিছু হোটেলের ঘর, বিলাসবহুল রিসর্ট, দুটি আধুনিক মানের গেস্টহাউস ভাড়া নেওয়ার কথা।

দলের এক সদস্য জানিয়েছেন, মুরলীধর সেন লেনে পার্টির মূল অফিস ছাড়াও পার্টি বেশ কয়েক মাস আগেই দক্ষিণ কলকাতার হেস্টিংস এলাকায় একটি বাড়ির চারটি তলা ভাড়া নিয়েছে দলের কাজ পরিচালনার জন্য। ভোটের কাজ দেখার জন্যে সেখানে যথেষ্ট পরিমাণ জায়গাই রয়েছে। তিনি বলেছেন, জানি না, এর পরেও বিলাসবহুল হোটেল ভাড়া নেওয়ার কী দরকার পড়লো। এতদিন বাংলার বাইরে অন্য রাজ্যের ভোটে দল হোটেল ভাড়া নিত, এ বার বাংলাতেও সেই কালচারই আমদানি করা হল।

রাজ্য বিজেপির সোস্যাল মিডিয়া এবং আইটি সেল হেস্টিংসের এই বিল্ডিং থেকেই কাজ করে। এখানে প্রায় প্রত্যেক নেতার জন্যই, এমনকি তৃণমূল থেকে সদ্য আসা নেতাদের জন্যও নির্দিষ্ট ঘর রয়েছে। সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, প্রতিদিন এখানে কমপক্ষে ২৫০ জনের খাবার তৈরির ব্যবস্থা রয়েছে।

গত বছর বিহার নির্বাচনেও বিজেপি এ ভাবেই পাটনার একটি হোটেলের একাংশ ভাড়া নিয়েছিল, যেখানে থেকে নেতারা ভোটের প্রচার কাজ চালিয়েছিলেন। পার্টির মিডিয়া সেন্টারও সেখান থেকেই কাজ করেছিল।

স্বাভাবিক ভাবেই জনমনে এই প্রশ্ন উঠছে যে, নির্বাচনী প্রচারে নেতাদের জন্য এমন বিলাসবহুল হোটেলের প্রয়োজন কী? এর জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থের দরকার তাই বা কোথা থেকে আসছে? এই বিপুল পরিমাণ টাকা কি জনগণের থেকে চাঁদা হিসাবে সংগ্রহ করা হয়? দেখা যাক।

২০১৪ সালের নির্বাচনেই দেশের মানুষ প্রথম দেখেছিল, বিজেপি কি অবিশ্বাস্য পরিমাণ টাকা নির্বাচনে খরচ করে। সেই নির্বাচনে টাকার স্রোত বয়ে গিয়েছিল। ২০১৯-এর নির্বাচনেও তারই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। এত টাকা তো জনগণের থেকে চাঁদা হিসাবে আসতে পারে না। তা হলে? দেখা যাচ্ছে, কর্পোরেট সংস্থাগুলি এখন বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলিকে নির্বাচন পরিচালনার জন্য বিপুল পরিমাণ টাকা দেয়। এই দেওয়াটাকে আইনি বৈধতা দেওয়া হয়েছে বড় বড় দলগুলির স্বার্থেই। তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০১৭-১৮ আর্থিক বছরে বিজেপি কর্পোরেট থেকে মোট পেয়েছে ৪০০ কোটি টাকা। যা মোট কর্পোরেট ডোনেশনের ৯২ শতাংশ। বছর দশেক আগে নির্বাচনে টাকা ঢালার জন্য কর্পোরেট সংস্থাগুলি নির্বাচনী ট্রাস্ট তৈরি করেছে। ওই আর্থিক বছরে এই ট্রাস্ট থেকেও বিজেপি পেয়েছে বিপুল পরিমাণ টাকা। প্রুডেন্ট নির্বাচনী ট্রাস্ট ১৪৪ কোটি টাকা দিয়েছে বিজেপিকে। একটি হিসেবে দেখা যাচ্ছে, ২০১৪ থেকে এই সংস্থাটি শুধু বিজেপিকেই দিয়েছে ৫৯৪ কোটি টাকা। এতেই শেষ নয়। এর পরেও রয়েছে ইলেকটোরাল বন্ডে টাকা আমদানির হিসেব। শিল্পসংস্থাগুলি ইলেকটোরাল বন্ডের মাধ্যমে বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলিকে টাকা দেয়। যার সবই বড় অঙ্কের। ২০১৮-তে এই মাধ্যমে বিজেপি পেয়েছে ২১০ কোটি টাকা। এ এখন কোনও গোপন খবর নয়। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর। উপরের তথ্যগুলি অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘দি প্রিন্ট’-এর ৫ মে ২০১৯ থেকে নেওয়া।

তা হলে যে দল শিল্পপতি-পুঁজিপতি-কর্পোরেট সংস্থার থেকে এ ভাবে দেদার টাকা পায় তারা কি তাদের বাদ দিয়ে জনগণের মঙ্গলের কথা চিন্তা করতে পারে? এই সব শিল্পপতি-কর্পোরেটদের শোষণের হাত থেকে জনগণকে রেহাই দেওয়ার জন্য লড়াই করতে পারে? এই যে লক্ষ কোটি টাকা ভোটের পিছনে বিজেপির মতো দলগুলি খরচ করছে এতে কি জনগণের সত্যিকারের কোনও মঙ্গল আছে? করোনা অতিমারির কারণে কাজ হারিয়ে দেশের অধিকাংশ মানুষের জীবন যখন বিপর্যস্ত তখন নেতাদের এত বিলাসিতা, টাকার এমন নয়ছয় অত্যন্ত অমানবিক নয় কি! আসলে এইসব দলের নেতারা এমন ভাবে জীবনযাপনেই অভ্যস্ত। বিমান ছাড়া চড়েন না, বিলাসবহুল হোটেল না হলে চলে না, দামী খাবার ছাড়া মুখে রোচে না। কিন্তু যে নেতারা এমন জীবনে অভ্যস্ত তাঁরা কি জনগণের নেতা? তাঁদের সঙ্গে কি জনগণের সুখ-দুঃখের সত্যিই কোনও যোগ আছে? এই সব নেতারাই নাকি শোষিত নিপীড়িত লাঞ্ছিত সব মানুষের জীবনে আচ্ছে দিন নিয়ে আসবেন! যে সব সাধারণ মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ তৃণমূলের সম্পর্কে হতাশ হয়ে এই সব নেতাদের পিছু পিছু ছুটছেন, তাঁদের ভেবে দেখা দরকার, তাঁরা মরীচিকার পিছনে ছুটছেন না তো! ফুটন্ত কড়াই থেকে বাঁচতে গিয়ে জ্বলন্ত উনুনে গিয়ে পড়বেন না তো! কোনও রকম বিচার না করে একদিন কংগ্রেসের পিছনে ছুটেছিলেন, তারপর সিপিএমের পিছনে, তারপর তৃণমূলের। এখন আবার ছুটছেন বিজেপির পিছনে। বরং আসুন, রাজনীতির ভালমন্দ, নীতির ভালমন্দ, দলের ভালমন্দ বিচার করে বুঝে নিই সত্যিকারের শোষিত মানুষের, মেহনতি মানুষের, সাধারণ মানুষের দল কোনটা। তার পাশে দাঁড়াই। তাকে শক্তিশালী করি।