Breaking News

বিভেদ বাড়াতেই  ‘বিভীষিকা’র স্মরণ

ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস! যারা দেশভাগের হোতা ছিলেন, স্বাধীনতার ৭৫ বছরে আজ তারাই দেশভাগের দুঃখে কাতর হয়ে পড়েছেন। তাদেরই উত্তরসূরী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ১৪ আগস্ট দিনটিকে ‘দেশভাগের বিভীষিকা স্মরণ দিবস’, হিসাবে পালন করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘দেশভাগের দুঃখ ভোলা যায় না। লাখো ভাইবোনেরা ঘরছাড়া হয়েছেন। ঘৃণা ও হিংসার শিকার হয়ে বহু মানুষ জীবন দিয়েছেন। সেই সব মানুষের দুঃখে কাতর প্রধানমন্ত্রীর আবেদন–‘দেশভাগের বিভীষিকা স্মরণ দিবস’ যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সামাজিক বিভাজন, বিভেদের বিষকে মুছে ফেলার প্রয়োজন রয়েছে।’

৭৫ বছর পর ইতিহাস খুঁড়ে দেশভাগের বীভৎস স্মৃতির কথা প্রধানমন্ত্রী আজ হঠাৎ তুলে আনলেন কেন? সাম্প্রদায়িক হিংসা, মৃত্যু, দেশত্যাগ, সর্বস্ব হারানোর বীভৎস স্মৃতি তো মানুষ আজ প্রায় ভুলতে বসেছে। তাকে আবার নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়া কেন? বিভাজন, বিভেদের বিষ মুছে ফেলার জন্যই কি প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা? এই যুক্তি দেশের মানুষ মেনে নিত যদি তাঁর নেতৃত্বে সাত বছরের ইতিহাস এর ঠিক বিপরীত আচরণে কালো না হয়ে উঠত। তাঁর শাসনে বিভাজন ও বিভেদ কি আরও তীব্র করে তোলা হয়নি? সম্প্রীতি ধ্বংস করা হয়নি? সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়নের যে উদ্দেশ্যের কথা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তা কি মূল্যবৃদ্ধি, ছাঁটাই, বেকারি, অশিক্ষা আর চিকিৎসাহীনতায় জর্জরিত মানুষের কানে বিদ্রুপের মতো শোনায় না?

এই প্রধানমন্ত্রীই তো এনআরসি-সিএএ-র মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বিভেদের বীজ পাকাপোক্তভাবে রোপন করার ব্যবস্থা করেছেন, বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপর রামমন্দির নির্মাণ এবং কাশ্মীরের মানুষের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার ৩৭০ ধারা বাতিল করে কাশ্মীরের মানুষের সাথে বাকি ভারতের দূরত্বের বাতাবরণ তৈরি করেছেন। তিনিই আজ ঘৃণার বিষকে মুছে ফেলার কথা বলছেন! একে ভণ্ডামি ও দ্বিচারিতা ছাড়া আর কী বলা যায়?

এত দিনের রাজত্বের পর তাঁকে এই ভণ্ডামির আশ্রয় নিতে হচ্ছে কেন? সামনেই উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন। লোকসভা নির্বাচনের আগে এই নির্বাচনের ফলাফল তাঁদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপি গোহারা হেরেছে। এর কারণ কেন্দে্র বিজেপি শাসন জনসাধারণের জীবনে শুধু ব্যর্থতাই নিয়ে আসেনি, একচেটিয়া পুঁজিপতিদের তুষ্ট করতে গিয়ে জনসাধারণের জীবনকে দুবির্ষহ করে তুলেছে। দেশজুড়ে বিজেপি শাসনের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ বেড়ে চলেছে। তাই উন্নয়নের, বিকাশের কোনও ছেঁদো প্রতিশ্রুতিতেই যে তাঁদের অপরাধ ঢাকা যাবে না, তা বিজেপি নেতারা ভালই বোঝেন। এই অবস্থায় বিজেপি নেতাদের হাতে একটি অস্ত্রই আছে। তা সাম্প্রদায়িকতার অস্ত্র। যে অস্ত্র ব্যবহার করে তাঁরা সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ জাগিয়ে হিন্দুত্ববাদের আবেগকে উস্কে তুলতে চান। বিজেপির উচ্চবর্ণ ঘেঁষা রাজনীতিকে ঐক্যের আলখাল্লা পরিয়ে নিম্নবর্ণের ত্রাতা সাজতে চান, যাতে ভোটব্যাঙ্ক বড় হয়। তাই দেশভাগের স্মৃতি উস্কে তোলা।

অথচ যে দেশভাগের দুঃখে কাতর হয়ে তিনি অশ্রুমোচন করেছেন, সেই দেশভাগের প্রকৃত ইতিহাস কী? দেশভাগের হোতা কারা? একপক্ষীয় প্রচারে মহম্মদ আলি জিন্নার নামই আলোচিত হয় এবং প্রধানমন্ত্রী যাদের প্রতিনিধি, সেই সংঘ পরিবার এটাই প্রচার করে প্রমাণ করতে চায় যে, মুসলমানরাই দেশ ভাগের জন্য দায়ী। কিন্তু ইতিহাস অন্য কথা বলে। ১৯৪০ সালে জিন্না এই দাবি তোলার তিন বছর আগেই অর্থাৎ ১৯৩৭ সালে আরএসএস নেতা সাভারকার হিন্দু মহাসভার সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন, ‘‘ইন্ডিয়া ক্যান নট অ্যাসিউমড টুডে টু বি এ ইউনিটেরিয়ান অ্যান্ড হোমোজিনিয়াস নেশন, বাট অন দ্য কনট্র্যারি দেয়ার আর টু নেশনস ইন দি মেইন, হিন্দুস অ্যান্ড মুসলিমস, ইন ইন্ডিয়া,”। এর পরের বছর ১৯৩৮ সালে সাভারকার তাঁর ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ গ্রন্থেও দ্বিজাতি তত্ত্বের উল্লেখ করেছেন। ১৯৪০ সালে জিন্না যখন দ্বিজাতির প্রস্তাব উত্থাপন করেন, তখনও হিন্দু মহাসভা তা সমর্থন করে।

এই প্রশ্নে অবিভক্ত সিপিআই-এর ভূমিকা উল্লেখ না করলে এ প্রসঙ্গে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। কমিউনিস্ট নামধারী এই দলটি সঠিক কমিউনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে না পারার জন্য জাতি গঠনের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াটিই ধরতে পারেনি। ফলে মহান লেনিনের ‘নিপীড়িত জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার’ থিসিসটির ভুল ব্যাখ্যা করে সিপিআই বলে যে, হিন্দু ও মুসলমান–দুটি জাতি এবং সেজন্যই তাদের পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি ন্যায়সঙ্গত। এই দাবিকে সামনে রেখে তারা সেই সময়ে প্রকাশ্যে প্রচারও চালায়। এমন ঘটনাও দেখা গিয়েছিল যে, সিপিআই-এর লাল ঝান্ডার একদিকে কংগ্রেসের তেরঙা পতাকা এবং আর একদিকে মুসলিম লিগের পতাকা লাগিয়ে তারা মিটিং করত।

জাতীয় কংগ্রেসের আপসকামী নেতৃত্ব দেশভাগ মেনে নিয়েছিল। তখন তাদের পিছনের আসল শক্তি জাতীয় বুর্জোয়ারা যে কোনও মূল্যে এ দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের জন্য উদগ্রীব। ফলে দেশকে দ্বিখণ্ডিত করার যে নীতি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নিয়েছিল, তা কার্যকর করতে বিশেষ অসুবিধা হয়নি।

উল্লেখ্য, কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির হিন্দু সদস্যরা গান্ধীজির উপস্থিতিতে একযোগে যখন দেশভাগের পক্ষে সম্মতি জানিয়েছিলেন, তখন বলিষ্ঠভাবে দেশভাগের বিরোধিতা করেছিলেন দু’জন মুসলিম সদস্য– সর্দার আব্দুল গফফর খান ও মৌলানা আবুল কালাম আজাদ।

তবে এ কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা যায় যে, সাধারণ মানুষ দেশভাগ মেনে নেয়নি। মুসলিম লিগ মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের দাবি করলেও সমগ্র মুসলিম সমাজ তাদের পিছনে ছিল না। একইভাবে হিন্দুত্ববাদীরা এই দাবি করলেও ব্যাপক অংশের হিন্দু জনসাধারণ এই দাবির বিরুদ্ধে ছিল।

তাই দেশভাগের ক্ষত নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যখন চোখের জল ফেলেন, তখন তাঁর সততা নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই দেশের মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে। যে সাভারকার দ্বিজাতি তত্তে্বর প্রথম প্রবক্তা, সেই সাভারকারকে ‘মহান দেশপ্রেমিক’ বানানোর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করতে দেখা গেছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকেই। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর গত সাত বছর ধরে সংখ্যাগুরুবাদের যে আধিপত্য চলছে, তার দায়িত্ব কি তিনি অস্বীকার করতে পারেন? দেশভাগের যে ক্ষত নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করছেন, সেই ক্ষত যে আজ দেশজুড়ে বিপজ্জনকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, তার দায়ও কি তাঁর নয়? তা হলে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করা ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার আর কি উদ্দেশ্য আছে?

দেশে আজ মুখোশধারীদেরই প্রাধান্য। মুখোশের আড়ালে যে কুৎসিত মুখগুলো ঢাকা রয়েছে, তাকে চিনতে হলে প্রকৃত ইতিহাস চর্চার আজ বড় বেশি প্রয়োজন। রাষ্ট্র সেই সুযোগ আমাদের দেবে না। তাই স্ব-উদ্যোগে এই চর্চার পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে আমাদের, প্রতিটি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন গণতন্ত্রপ্রিয় নাগরিককে।