বিদ্যুৎ গ্রাহকদের উপর চলছে নজিরবিহীন জুলুমবাজি

ফাইল চিত্র

পশ্চিমবাংলার ১ কোটি ৬০ লক্ষ বিদ্যুৎ গ্রাহকের মধ্যে প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ গ্রাহক রয়েছেন প্রবল সমস্যায়। করোনা ও তার জেরে লকডাউনে অর্থনীতি বিপর্যস্ত। লক্ষ লক্ষ মানুষের কাজ নেই। আরও লক্ষ লক্ষ মানুষের বেতন কমে গেছে। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসের অত্যধিক দামবৃদ্ধি সাধারণ মানুষকে প্রবল সঙ্কটের গহ্বরে ফেলেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইয়াস ঝড়ে বেশ কিছু জেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। ঘর-বাড়ি, মাঠের ফসল, সঞ্চিত খাদ্যশস্য, গবাদি পশু, পুকুরের মাছ, সবজি-ফল সব শেষ। সমুদ্রের নোনাজল ঢুকে চাষের জমি নষ্ট হয়ে গেছে। বিদ্যুতের খুঁটি-তার-মিটার কিছুই নেই। বিদ্যুৎ বিল সহ দরকারি সমস্ত কাগজ-পত্র বন্যার জলে ভেসে গেছে। এই অবস্থায় বিদ্যুৎ দপ্তর গ্রাহকদের পাশে না দাঁড়িয়ে তাদের উপর মারণ আঘাত হানছে। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বিদ্যুৎ বিল দিতে একটু দেরি হলেই ডিপিএসসি-র (ডিলে পেমেন্ট সারচার্জ) নামে বা এলপিএসসি-র (লেট পেমেন্ট সারচার্জ) নামে ২৪ শতাংশ ফাইন আদায় করছে। ঘটছে লাইন কাটার ঘটনাও। ওরা লাইন কাটবে, সেজন্য গ্রাহককে টাকা দিতে হবে, আবার লাইন জোড়া দেওয়ার জন্য টাকা দিতে হবে। বিদ্যুৎ দপ্তরের এমন খামখেয়ালিপনায় গ্রাহকরা জর্জরিত।

রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে সরকারি ভর্তুকি যতটুকু দেওয়া হয় সেটা বন্ধ করার রাস্তাটা বের করাই তাঁর প্রধান কর্তব্য। ভর্তুকি বন্ধ করে দেওয়া কংগ্রেস ও বিজেপি সরকারের ঘোষিত নীতি। এই নীতি অনুযায়ী বিদ্যুৎ আর পরিষেবার বিষয় নয়, মুনাফা করার পণ্য। বিদ্যুৎকে পণ্য হিসাবে ঘোষণা করেই জনবিরোধী বিদ্যুৎ আইন-২০০৩ এনেছিল প্রথম বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার। তার ধাক্কাতেই বিদ্যুৎ মাশুল লাগামহীন। মাশুল বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। কিন্তু তাতেও কোম্পানি খুশি নয়। বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলিকে আরও বেশি মুনাফা পাইয়ে দিতে বর্তমান কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার এনেছে বিদ্যুৎ আইন ( সংশোধনী) বিল ২০২১। যার মূল কথা হল বিদ্যুৎকে যৌথ তালিকা থেকে বাদ দিয়ে পুরোপুরি কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনা, রাজ্যের সমস্ত ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে একচেটিয়া কেন্দ্রীয়করণ করা, অন্যদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে পরিবহণ ও বন্টন– সমস্তই বেসরকারি কর্পোরেটের সর্বোচ্চ মুনাফা লোটার হাঙ্গরের হাতে তুলে দেওয়া।

রাজ্যের হাতে বিদ্যুৎ সংক্রান্ত কী কী বিষয় রয়েছে? নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ, বিদ্যুৎ বিল, খারাপ মিটার পরিবর্তন ইত্যাদি পরিসেবা নিয়ে অভিযোগ, সর্বোপরি বিদ্যুতের মাশুল নির্ধারণ, সরকারি ভর্তুকি– এ সবের নিষ্পত্তির কিছুটা অধিকার এখনও রাজ্যের হাতে আছে। এই বিলের মধ্যে দিয়ে তার সমস্তটা কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য হাইকোর্টের সমতুল্য ক্ষমতার অধিকারী ‘ইলেকট্রিসিটি কনট্রাক্ট এনফোর্সমেন্ট অথরিটি’ নামের নতুন সংস্থাকে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। ক্রস সাবসিডি তুলে দিয়ে সকলের বিদ্যুতের দাম সমান করে দেওয়ার নামে বাস্তবে শিল্পপতি-পুঁজিপতিদের দাম কমিয়ে সাধারণ গ্রাহকদের দাম ব্যাপক বাড়ানোর ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন, বন্টন এই তিনটি বিভাগ করার পর আবারও নতুন করে ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। এবং প্রতি ক্ষেত্রে ন্যূনতম ১৬ শতাংশ মুনাফা করার যে আইনি অধিকার দেওয়া হয়েছে তার ফলে মাশুল বেড়ে চলেছে এবং আরও বাড়বে পর্বতপ্রমাণ, গ্রাহক হয়রানি হবে চূড়ান্ত। কর্পোরেট হাউসের মুনাফার স্বার্থে দেশের গ্রাহকদের অন্ধকারে রেখে বিদেশে বিদ্যুৎ বিক্রি করার জন্য নতুন করে আনা হয়েছে ‘ক্রস বর্ডার’ ধারা।

করোনা সংক্রমণের ভয়ে মিটার রিডিং নেওয়া বন্ধ, কিন্তু গড় বিল করার রেগুলেশনের সুযোগ নিয়ে বাড়িতে বাড়িতে গড় বিল পাঠানো চলছেই। বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো এই সুযোগে বাড়তি টাকার বিল দেদার পাঠিয়ে চলেছে। অভিযোগ করলে বলছে, আগে বিল মেটান, পরে অভিযোগ শোনা হবে। এভাবে চলছে গ্রাহকদের উপর জুলুমবাজি। বিদ্যুৎ আইন (সংশোধনী) বিল-২০২১ এখনও আইনে পরিণত হয়নি, কিন্তু তার প্রয়োগ রাজ্যে রাজ্যে শুরু হয়েছে নতুন কৌশলে, প্রতারণার ছদ্মবেশে, স্ট্যান্ডার্ড বিডিং ডকুমেন্ট (এসবিডি)-র নামে। যার মূল লক্ষ্য ১) রাজ্য বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চুক্তিবদ্ধ দামে ব্যক্তি শিল্পপতিদের কাছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সবটুকু সম্পদ বিক্রি করা। ২) বন্টন কোম্পানির জমি-বাড়ি নামমাত্র ভাড়ায় ব্যক্তি মালিককে ব্যবহার করতে দেওয়া। ৩) বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের সরকারি কর্মচারীদের ব্যক্তি মালিকানাধীন কর্মচারীতে পরিণত করা। এক কথায় বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের কোটি কোটি টাকার সম্পদ যা জনগণের ট্যাক্সের টাকায় গড়ে উঠেছে, তা বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দিতেই বিদ্যুৎ বিল-২০২১ আনা হয়েছে। এতে শুধু গ্রাহকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তা নয়, বিপন্ন হবেন কর্মচারীরাও।

সরকারের সহায়তায় ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ সেক্টরে টাটা, এসার, আদানি, গোয়েঙ্কা, টোরেন্ট ইত্যাদি কোম্পানিগুলো ঢুকে পড়েছে। এখন বিডিং-এর নামে পুরো বিদ্যুৎ বন্টন ব্যবস্থাকে মাত্র কয়েকজন একচেটিয়া কর্পোরেটের হাতে তুলে দিতে চাইছে। পুদুচেরি, জম্মু ও চণ্ডীগড় প্রভৃতি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে সমগ্র বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন, বন্টন ব্যবস্থাকে কর্পোরেটের কাছে বিক্রি করার নোটিশ জারি হয়েছে। উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকারও পূর্বাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ নিগমকে বেসরকারিকরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এর বিরুদ্ধে সারা দেশের বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের সমস্ত কর্মচারী সংগঠন আন্দোলন করেছে। কাজ বয়কটের ডাক দিয়ে আন্দোলনে নতুন মাত্রা দিয়েছে। অল বেঙ্গল ইলেকট্রিসিটি কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন (অ্যাবেকা) সেই আন্দোলনকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের চাপে উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার তাদের জনবিরোধী সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়েছে। আন্দোলনের এ এক বিরাট জয়।

শুধু বিজেপি নয়, পূর্বতন সিপিএম সরকার এ রাজ্যে সিইএসসি-কে গোয়েঙ্কার হাতে তুলে দিয়েছে। বেসরকারিকরণের যে পথ তারা দেখিয়েছে সে পথেই তৃণমূল সরকারও তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে বেসরকারিকরণে কয়েক ধাপ এগিয়েছে। ইতিমধ্যেই মিটার রিডার, বিল তৈরি, বিল বন্টন, মেরামতি, নতুন কানেকশন দেওয়া সহ যাবতীয় কাজ কন্ট্রাক্টরদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালনের বহু বিষয় এখন কন্ট্রাক্টরদের অধীন। এ রাজ্যে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবহারের বিষয়ে ইতিমধ্যেই নতুন জনবিরোধী রেগুলেশন হয়েছে বিদ্যুৎ গ্রাহক সংগঠন অ্যাবেকার প্রতিবাদ উপেক্ষা করেই। সেই রেগুলেশনে বলা হয়েছে, কেউ ইচ্ছা করলেই সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবহার করতে পারবেন না। সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ও ব্যবহার করতে হলে লাইসেন্স নিতে হবে। সেই লাইসেন্সের শর্ত হচ্ছে, যিনি যতটুকু বিদ্যুৎ উৎপাদন করবেন তাকে তার সবটুকুই পূর্ব নির্ধারিত দামে ন্যাশনাল গ্রিডে বিক্রি করতে হবে। তারপর সেই বিদ্যুৎ তার ঘরে বাধ্যতামূলকভাবে লাগানো ‘নেট মিটারিং’ ব্যবস্থার মাধ্যমে তিনি বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানির নির্ধারিত দাম দিয়ে ব্যবহার করতে পারবেন। এ ছাড়া চালু করা হয়েছে প্রিপেড মোবাইলের মতো প্রিপেড মিটার, যেখানে টাকা শেষ হয়ে গেলে অটোমেটিক্যালি মিটার থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।

এ কথা সকলেই জানেন, জীবিত মানুষের অক্সিজেন যেমন প্রয়োজন, মানব সমাজকে সচল রাখতে বিদ্যুতের প্রয়োজনও তেমনই। দেশের তথা মানবসমাজের অগ্রগতির অন্যতম প্রধান উপাদানই বিদ্যুৎ। যে দেশের বিদ্যুতের ব্যবহার যত বেশি সে দেশ তত উন্নত। ১৯১৭ সালে পুঁজিবাদ উচ্ছেদ করে রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঠিক পর পরই মহান লেনিন সোভিয়েট রাষ্ট্রের অধীন সমস্ত নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে বিদ্যুতের নীতি বাস্তবায়িত করেছিলেন। এই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে সর্বাধিক পরিষেবা দেওয়া। এই নীতি বহু মানুষকে আকর্ষিত করেছিল। দেশে দেশে জনগণের মধ্যে সমাজতন্তে্রর প্রতি আকর্ষণ লক্ষ করে বহু পুঁজিবাদী দেশ বিশেষ করে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশ বিনামূল্যে বিভিন্ন নাগরিক পরিষেবা দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর এই ধারায় সরকার বিদ্যুৎকে পরিষেবা হিসাবে ঘোষণা করে। আজ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির বিপর্যয় এবং গণআন্দোলনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র বিদ্যুৎকে পরিষেবা থেকে পণ্যে রূপান্তরিত করছে। যার ফলে জনগণকে অত্যধিক মাশুল দিতে বাধ্য করা হচ্ছে।

আজ বিদ্যুৎ গ্রাহকদের সামনে একটাই পথ– তা হল জনবিরোধী বিদ্যুৎ আইন ২০০৩ ও তার (সংশোধনী) বিল ২০২১ প্রত্যাহারের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলা। অ্যাবেকার এই মুহূর্তের দাবি, ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাতে আগামী এক বছর বিনামূল্যে বিদ্যুত দিতে হবে, গৃহস্থে ১০০ ইউনিট পর্যন্ত ও কৃষিতে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দিতে হবে এবং এল পি এস সি / ডি পি এস সি ২৪ শতাংশে নয়, ব্যাঙ্ক রেটে করতে হবে। এই দাবি আদায়ের লক্ষ্যে অ্যাবেকা ৭ জুলাই সারা রাজ্যে দাবি দিবস পালনের ডাক দিয়েছে। সরকার দাবি না মানলে আন্দোলন তীব্রতর করার জন্য বিদ্যুৎ গ্রাহক সহ সর্বসাধারণকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন অ্যাবেকা নেতৃত্ব।

গণদাবী ৭৩ বর্ষ ৩৮ সংখ্যা