বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি দেখলেই বোঝা যায় কেমন ‘সোনার বাংলা’ তারা গড়তে পারে

 

রাজ্যে ক্ষমতায় এলে বিজেপি নেতারা নাকি সোনার বাংলা গড়ে দেবেন! তাহলে দেখা যাক, তারা যে সমস্ত রাজ্যে ক্ষমতায় আছেন সেগুলিকে কেমন ‘সোনায়’ মুড়ে দিয়েছেন।

বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলির অবস্থা কী? বিজেপি সরাসরি রাজ্য সরকারে আছে বারোটি রাজ্যে, যার একটি গুজরাট। বিজেপির বহুল প্রচারিত ‘গুজরাট মডেলে’র হাল কী? বর্তমানে গুজরাটে প্রতিদিন কমপক্ষে ৫ জন নারী ধর্ষিতা হন। আহমেদাবাদের নাম হয়ে গেছে ধর্ষণের রাজধানী। সেখানে গত দু’বছরে ৫৪০টি এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। সুরাট, রাজকোট, বানাসকাথাও পিছিয়ে নেই (আহমেদাবাদ মিরর, ১২ মার্চ, ২০২০)। গুজরাটে বেকারির হার বেড়েছে ১২ শতাংশ (সিএমআইই-র রিপোর্ট, এপ্রিল ২০২০)। গুজরাট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (জিআইডিসি)-র অন্তর্ভুক্ত দু’হাজার কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। গুজরাট ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক বলেছেন, বছর বছর কত কারখানা বন্ধ হচ্ছে তার সঠিক তথ্য পর্যন্ত নেই সরকারি দপ্তরে। রাজ্যের দুর্নীতি দমন বিভাগ গত বছরেই শুধু ২৭ জন সরকারি আধিকারিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দাখিল করেছে। শুধু চুনোপুঁটিরাই নয়, অনেক রাঘববোয়ালও দুর্নীতিতে যুক্ত রয়েছে। আহমেদাবাদ, সুরাট প্রভৃতি জায়গায় অনেক বৃহৎ সংস্থা বিপুল পরিমাণ ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছে, দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে।

শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বাজেটে সবচেয়ে কম বরাদ্দ করেছে গুজরাটের বিজেপি সরকার। নাগরিকদের চিকিৎসা পরিষেবার হাল অত্যন্ত খারাপ। ১৯৯৫ সালে বিজেপি গুজরাটে প্রথম ক্ষমতায় আসার আগের পাঁচ বছরে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় হয়েছিল মোট সরকারি ব্যয়ের ৪.২৫ শতাংশ। ২০০৫-১০ সালে তা কমে দাঁড়ায় মাত্র ০.৭৭ শতাংশে। ২০১০ সালে স্বাস্থ্যখাতে মাথাপিছু সরকারি ব্যয়ের নিরিখে গুজরাট ছিল ২৮টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ১৭ নম্বরে। অপরাধের নিরিখেও বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলি এগিয়ে। ক্রাইম সূচকে বিজেপি-শাসিত ন’টি রাজ্যেই অপরাধ অনেক বেশি, এদের মধ্যে প্রথম হরিয়ানা, দ্বিতীয় গুজরাট (আনন্দবাজার-১১।২।২০২১)। গুজরাটে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির দেড় লাখের মতো শিশু মারাত্মক অপুষ্টির শিকার। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০১১-১২ সালে স্থায়ী ও অস্থায়ী শ্রমিকের দৈনিক মজুরির নিরিখে জাতীয় গড়ের চেয়ে গুজরাট পিছিয়ে। সামগ্রিক মানব উন্নয়ন সূচকেও ২০১১ সালে গুজরাট ছিল রাজ্য তালিকায় ১৫তম স্থানে।

কেন্দ্রীয় শাসনে থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে ভারতকে সর্বোচ্চ বেকারির হার উপহার দিয়েছে বিজেপি। সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে অর্গানাইজেশন (এনএসএসও)-র ২০১৯ সালের রিপোর্টে জানা গেছে, ২০১৯ সালের শেষে যে ১০টি রাজ্যে বেকারির হার সর্বোচ্চ ছিল তার মধ্যে ৬টি বিজেপির ‘সোনার শাসনে’। ওই সময় সরকারি হিসাবে বেকারির জাতীয় হার ছিল ৭.২ শতাংশ। সেই সময় সিএমআইই তথ্য অনুযায়ী বেকারত্বের হারে সর্বোচ্চ ত্রিপুরা ৩১.২ শতাংশ, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দিল্লি ও হরিয়ানায় বেকার যথাক্রমে ২০.৪ এবং ২০.৩ শতাংশ। হিমাচলপ্রদেশ ১৫.৬, পাঞ্জাব ১১.৮, ঝাড়খণ্ড ১০.৯, বিহার ১০.৩, ছত্তিশগড় ৮.৬ এবং উত্তরপ্রদেশ ৮.২ শতাংশ। বেকারত্বের হার মানে এখানে জনসংখ্যার কত শতাংশ বেকার তা বোঝায় না। কাজ চেয়েও পাননি এমন লোকের শতাংশকে বোঝায়। জনসংখ্যার নিরিখে বেকারত্বের হার আসলে অনেক বেশি। ঝাড়খণ্ডে বিজেপি সরকারে থাকাকালীন বেকারত্বের হার দাঁড়িয়েছে জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ। বিজেপি জোট সরকার ‘সোনার বিহার’ বানিয়েছে। সেই বিহারে বেকারত্বের হার ৪০ শতাংশের উপরে (টাইমস নিউজ নেটওয়ার্ক, ২ জুন ২০২০ এবং সিইআইসিডাটা.কম)।

করোনা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, হিমাচলপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড সহ বেশ কয়েকটি বিজেপি পরিচালিত রাজ্য সরকার শ্রম আইনকে দুর্বল করে সপ্তাহে ৬ দিন, দিনে ১২ ঘন্টা কাজ করার নির্দেশ জারি করেছে। অবাধ ছাঁটাইয়ের অধিকার মালিকদের হাতে তুলে দিয়েছে, ন্যূনতম মজুরির অধিকারকেও খর্ব করেছে। ছুটি, সামাজিক সুরক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি সুযোগকে খর্ব করেছে। তিন বছরের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার স্থগিত করে দিয়েছে। এই হল বিজেপির সোনার রাজত্বে শ্রমিকের অবস্থা।

প্রধানমন্ত্রীর বহু প্রশংসিত যোগী আদিত্যনাথের ‘মডেল’ উত্তরপ্রদেশের পরিস্থিতি কেমন? গত দুই বছরে বেকার যুবকের সংখ্যা ১২.৫ লাখ থেকে লাফিয়ে ৩৪ লাখে পৌঁছেছে। ‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি’-র প্রকাশিত এই তথ্যকে অস্বীকার করতে পারেনি যোগী সরকারও। করোনা কিট কেনার জন্য বিধায়ক তহবিলের টাকা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন খোদ বিজেপির বিধায়ক (ন্যাশনাল হেরাল্ড, ২৭ জুলাই, ২০২০)। পশুখাদ্য নিয়েও দুর্নীতি হয়েছে এ রাজ্যে। বিজেপির ‘সোনার রাজত্বে’ আখ চাষিদের গত বছরের পাওনা ১১ হাজার কোটি টাকা আটকে রেখেছে বৃহৎ চিনিকল এবং বহুজাতিক মদ কোম্পানির মালিকরা। এর সঙ্গে বাজাজ থেকে শুরু করে আদানি পর্যন্ত বড় বড় কর্পোরেট মালিক যুক্ত। ২০২০-র মে মাস পর্যন্ত ১৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা বকেয়া হয়েছে। এনকাউন্টার-খ্যাত যোগী আদিত্যনাথ সরকার কিন্তু বৃহৎ পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করার সাহস করেনি। পরিবর্তে তারা কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছে টাকার বদলে ঘরে চিনি নিয়ে যেতে। সেই চিনি বিক্রি করে টাকা তুলে নিতে হবে। কৃষকরা কুইন্টাল কুইন্টাল চিনি কোথায় বিক্রি করবেন? তার কোনও উত্তর অবশ্য বিজেপি সরকার দেয়নি। (ফিনান্সিয়াল এ’প্রেস- ২২.০৭.২০১৯, দ্য প্রিন্ট- ১.০৫.২০২০, ইন্ডিয়ান এ’প্রেস- ১২.০৫.২০২০)

আইনশৃঙখলায় উত্তরপ্রদেশ ‘মডেল’ রাজ্য বলে দাবি করে থাকেন মুখ্যমন্ত্রী। কেমন ‘মডেল’? নারী নির্যাতনে দেশের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ। সেখানে এক বছরে নির্যাতনের মামলা হয়েছে ৫৯ হাজার ৮৫৩। ধর্ষণের মামলা ৩০৬৫টি। শিশুকন্যা নির্যাতনে শীর্ষে উত্তরপ্রদেশ (৭৪৪৪), তারপর মহারাষ্ট্র (৬৪০২), মধ্যপ্রদেশ (৬০৫৩)। প্রতি লক্ষ জনসংখ্যায় মহিলাদের উপর নির্যাতন, ধর্ষণে এগিয়ে আছে বিজেপি শাসিত আসাম। দেখা যাচ্ছে আরএসএস-বিজেপির মতো হিন্দুত্ববাদের ঠিকাদাররা যেখানেই প্রভাব বেশি বিস্তার করেছে, সেখানেই মহিলাদের উপর নির্যাতন, ধর্ষণ বেড়েছে। তাও নথিভুক্ত সংখ্যা এগুলি, প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। মুজজফরনগর সহ রাজ্যের বহু স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও ঘটেছে যোগীর আমলে।

‘সোনার’ গুজরাট, ‘সোনার’ উত্তরপ্রদেশ, ‘সোনার’ আসাম, ‘সোনার’ মধ্যপ্রদেশ, ‘সোনার’ মহারাষ্ট্র বানিয়েছে যারা, সেই ঠিকাদাররা ‘সোনার বাংলা’ করতে এখন উঠেপড়ে লেগেছেন। কিন্তু বাংলা কেন, দেশের কোনও অংশের মানুষেরই উন্নয়ন কি তাদের লক্ষ্য? পুঁজিপতি শ্রেণির অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন বিজেপি, তাদের স্বার্থ পূরণ করতেই যে নানা নীতি নিয়ে চলেছে সেগুলি সবই জনবিরোধী। কৃষক বিরোধী, শ্রমিক বিরোধী, শিক্ষাবিরোধী নানা নীতি তারা প্রণয়ন করছেন জনমতের কোনও তোয়াক্কা না করেই। আদানি-আম্বানির স্বার্থে চলা সরকার কখনও আমজনতার স্বার্থ দেখতে পারে না। কারণ দুটো স্বার্থ পরস্পরের বিপরীত। ফলে বিজেপি নেতাদের ‘উন্নয়ন’-এর কথা মুখে ফাঁকা আওয়াজ মাত্র। তারা চায় ক্ষমতার তখতে বসে লুটপাট চালাতে, গুণ্ডাবাজি চালাতে আর মালিক শ্রেণির সেবা করে সেই ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে। তার জন্যই নিত্যনতুন চটকদারি স্লোগানের আমদানি।

(ডিজিটাল গণদাবী-৭৩ বর্ষ ২৩ সংখ্যা_২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১)