বিজেপি শাসনে সংবাদমাধ্যমেরও স্বাধীনতা নেই

গণতন্ত্রে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা মানে রাষ্ট্র ও সরকারের সমালোচনার স্বাধীনতা৷ সংবাদমাধ্যমের প্রয়োজনও এ কারণেই গণতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ৷ কিন্তু বিজেপি শাসনে সংবাদমাধ্যম সেই ভূমিকা পালন করতে গেলেই প্রবল বাধার মুখে পড়ছে৷ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে শত কোটি টাকার মামলা, সংবাদমাধ্যমের দপ্তরে আয়কর বিভাগ বা পুলিশের তল্লাশি, এমনকি সাংবাদিকদের প্রাণে মেরে ফেলাও চলছে৷ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে ভারতের স্থান গত কয়েক বছরে ক্রমশ নিচের দিকে নামছে৷

সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশে স্কুলের মিড ডে মিলে নুন–রুটি খাওয়া শিশুদের ছবি প্রকাশ করায় এক সাংবাদিককে বিজেপি সরকারের রোষের মুখে পড়তে হয়েছে৷ তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি কাজে ত্রুটি দেখানো তথা সরকারের সম্মানহানি করবার ষড়যন্ত্র, সরকারি কাজে বাধা এবং দেশবাসীর সাথে প্রতারণা ইত্যাদি অভিযোগ তোলা হয়েছে৷ যে গ্রামবাসী ওই সাংবাদিককে মিড ডে মিল নিয়ে খবর দিয়েছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে– তিনি চাইলেই বাজার থেকে সবজি এনে দিতে পারতেন স্কুলকে৷ তা না করে সাংবাদিক ডেকে এনেছেন, অতএব সেটা ষড়যন্ত্র স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, সাংবাদিকরা সব ষড়যন্ত্রী!

গত জুন মাসে মুখ্যমন্ত্রী যখন মোরাদাবাদে জেলা হাসপাতাল পরিদর্শনে যান, সে সময় পুলিশ সাংবাদিকদের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে ঢুকিয়ে তালাবন্ধ করে দেয়৷ কেন? কারণ, যাতে তাঁরা প্রশ্ন করে মুখ্যমন্ত্রীকে বিরক্ত করতে না পারেন৷ এসবের বিরুদ্ধে মুখ খুললে বা সংবাদ পরিবেশন করলেই ‘দেশদ্রোহী’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷

বর্তমানে সাংবাদিকদের আদৌ কোনও স্বাধীনতা আছে কি না সে প্রশ্ন তুলেছেন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার প্রাপ্ত এনডিটিভি–র সাংবাদিক রবীশ কুমার৷ এ প্রসঙ্গে তিনি কাশ্মীরের বর্তমান পরিস্থিতির উল্লেখ করেছেন৷ ম্যানিলায় এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার নিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, অনেকেই জীবন ও কাজ হারানোর ঝুঁকি নিয়ে সাংবাদিকতার কাজ করে চলেছেন, তার জন্য তিনি গর্বিত৷ কিন্তু বহু সংবাদমাধ্যমই সরকারের তাঁবেদার হয়ে উঠেছে এবং মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে খবর পরিবেশন করছে যা গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক৷ দেশের সরকারগুলি তো পেটোয়া সংবাদমাধ্যমই চায়৷

উত্তরপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী গোশালা পরিদর্শনের সময় সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে গিয়ে হাসি মুখে ছবি তোলেন, গঙ্গা–স্নানে গেলে ক্যামেরাম্যান সঙ্গে নিয়ে যান, রিপোর্ট করতে দেন৷ কিন্তু সরকারের কোনও অন্যায্য কাজের সমালোচনা করে খবর পরিবেশন করলে তাদের প্রতি তোপ দাগতে শুরু করেন সরকারি নেতা–মন্ত্রীরা৷ সংবাদমাধ্যমকে তাঁরা কার্যত সেবাদাস বানাতে চান৷ উত্তরপ্রদেশেই গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে খুন হতে হয়েছে খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে৷ অক্টোবরে কুশীনগরে এক হিন্দি সংবাদপত্রের সাংবাদিককে গলার নলি কেটে খুন করা হয়েছে৷ শাহাজানপুরে দৈনিক জাগরণের এক সাংবাদিক ও তাঁর ভাই গুলিতে খুন হয়েছেন৷ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তাঁরা খবর করছিলেন৷ কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা রদ করে মিলিটারির বন্দুকের মুখে সাধারণ মানুষের জীবনকে ঠেলে দেওয়ার খবর যাতে সংবাদপত্রের পাতায় না আসে সেজন্য বহু সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷

এর আগে মধ্যপ্রদেশেও বিজেপির আমলে চাকরির পরীক্ষায় বৃহৎ কেলেঙ্কারি ‘ব্যাপম’–এর সত্য উদঘাটনে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের রহস্যমৃত্যু ঘটেছে৷ আজও তার কিনারা হয়নি৷

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টে এক হলফনামায় জানিয়েছে, ইন্টারনেটে ‘বিদ্বেষমূলক বার্তা’ ও ‘ভ্রান্ত সংবাদ’ নিয়ন্ত্রণ করতে খুব শীঘ্রই ব্যবস্থা নেবে৷ কারণ, বর্তমান প্রজন্ম সংবাদমাধ্যমের প্রতি নয়, সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি বিশেষ অনুরক্ত৷ বলাই বাহুল্য, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ‘জাতীয়তা বিরোধী’ বলতে সাধারণত ‘সরকার বিরোধী’ বুঝিয়ে থাকে এবং সরকারের সমালোচনাকে ‘মানহানি’ বলে থাকে৷ ফলে ডিজিটাল দুনিয়াকে অপরাধ মুক্ত করবার অজুহাতে প্রশাসনকে বিরোধিতা–মুক্ত করবার অপচেষ্টার আশঙ্কা অমূলক নয়৷

ফলে কী সংবাদমাধ্যম, কী ডিজিটাল দুনিয়া– সাধারণ মানুষ যাতে এগুলিতে পরিবেশিত নিরপেক্ষ সংবাদে সত্য জানতে না পারে, বিশেষ করে সরকারের জনবিরোধী কাজ ধরতে না পারে সেই উদ্দেশ্যেই সংবাদমাধ্যমের প্রতি সরকারের হুলিয়া জারি– সরকার বিরোধী কিছু প্রকাশ্যে আনা যাবে না৷ কিন্তু এভাবে ভয় দেখিয়ে বা অন্য কোনও উপায়ে সত্যকে চাপা দেওয়া যায় না৷ তা শতগুণ, সহস্রগুণ হয়ে প্রকাশ পায়৷ ইতিহাসই এ কথা বলে৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ১২ সংখ্যা)