বিজেপির গদি–লালসার বে–আব্রু প্রদর্শনী

ভোট প্রচারে যার দুর্নীতি নিয়ে সবচেয়ে সোচ্চার প্রচার করল কোনও দল, ভোটের পর তারই হাত ধরে মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ কী মনে হচ্ছে, দুর্নীতি, অনৈতিকতা? কিন্তু, বিজেপি প্রমাণ করেছে তাদের গদি দখলের অভিধানে এই শব্দগুলির অর্থ বদলে গেছে৷

২২ নভেম্বর মধ্যরাত থেকে ২৩ নভেম্বর ভোর পর্যন্ত চলা মহারাষ্ট্রের কুনাট্য দেখে অনেকেরই মনে পড়ে গেছে সোশাল মিডিয়াতে ঘোরা একটি রসিকতার কথা– এদেশের ভোটবাজ দলগুলির নেতারা ‘জনসেবায়’ এত উদগ্রীব যে, পার্টি ভোটের টিকিট না দিলে দল বদলে নেবে, তবু ‘জনসেবার’ সুযোগ ফসকাতে দেবে না!

মহারাষ্ট্রে এমনই ‘জনসেবার’ কারসাজি দেখিয়েছে বিজেপি৷ ২২ নভেম্বর গভীর রাতে এনসিপি নেতা অজিত পাওয়ারকে কবজা করে ২৩ নভেম্বর ভোর হওয়ার আগেই তারা শপথ গ্রহণের সব ব্যবস্থা করে ফেলল৷ মহারাষ্ট্রের মানুষের দুঃখে কাতর বিজেপি এমন ‘সার্জিকাল স্ট্রাইকটি’ করল কার হাত ধরে? তাঁর অন্য পরিচয় বাদ থাক, মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেওয়া দেবেন্দ্র ফড়নবিস ভোটের সময় প্রতিটি জনসভায় মুম্বইয়ের বিখ্যাত ছবি ‘শোলে’র ডায়লগ নকল করে বলতেন, একবার বিজেপি জিতলেই এই অজিত পাওয়ারকে কুচি কুচি করে কাটা হবে৷ তিনিই হয়েছেন ফড়নবিশ সাহেবের উপমুখ্যমন্ত্রী শোনা যাচ্ছে অজিত পাওয়ারকে বাগে আনতে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্তের ফাইল খোলার ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেলিংয়ের পাশাপাশি নানা প্রলোভনের টোপ কাজে লাগিয়েছে বিজেপি৷ রাজনীতি শব্দটিতে যে ‘নীতি’ অংশটি জুড়ে আছে, সেটিকে দলের রাজনীতি থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছে বিজেপি৷ এই দলই এখন হিন্দু ধর্মের রক্ষাকর্তা সেজে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা বলে, ধর্মের নাম নিয়ে ভোট চায় সত্যিকারের ধার্মিক মানুষ এইসব বক–ধার্মিকদের ভণ্ড ছাড়া অন্য কিছু বলতে পারেন কি?

বুর্জোয়া রাজনৈতিক ব্যবস্থা শবদেহে পরিণত

মহারাষ্ট্র নিয়ে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)

বিজেপির নেতৃত্বে সংখ্যালঘু সরকারকে মহারাষ্ট্রের গদিতে বসিয়ে দিতে যেভাবে আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত দলত্যাগীদের কাজে লাগানো হয়েছে তার তীব্র নিন্দা করেছেন এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ৷ ২৪ নভেম্বর এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, চূড়ান্ত স্বৈরতান্ত্রিক পথে ক্ষমতা দখল করতে এবং সেই প্রয়োজনে গণতান্ত্রিক রীতি–নীতি, প্রথা সব কিছুকে দু’পায়ে মাড়িয়ে যেতে বিপুল পরিমাণে টাকা ঢালা হয়েছে৷ এই ঘটনা আবার দেখিয়ে দিল শবদেহে পরিণত বুর্জোয়া রাজনৈতিক ব্যবস্থা আজ সমাজের সমস্ত ক্ষেত্রকে বিষাক্ত করে তুলছে৷ তিনি দেশের মানুষের কাছে এই ন্যক্কারজনক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন৷

ভোটে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি৷ প্রথমে রাজ্যপাল তাদেরই সরকার গড়তে ডেকেছিলেন৷ কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীত্বের কুর্সির ভাগাভাগি নিয়ে দরকষাকষি করতে করতে তাদের সাথে শিবসেনার জোট প্রক্রিয়া ভেস্তে যায়৷ ইতিমধ্যে বিধানসভার মেয়াদ শেষ হয়ে যেতে জারি হয় রাষ্ট্রপতি শাসন৷ শিবসেনা, এনসিপি, কংগ্রেস মিলে জোটের প্রক্রিয়া চলতে থাকে৷ ২২ নভেম্বর বিকালে এই জোট জানায় সরকার গঠনের দাবি নিয়ে পরদিন তারা রাজ্যপালের সাথে দেখা করবে৷ কিন্তু ওইদিন গভীর রাত থেকে আসরে নেমে রাজ্যপাল, প্রধানমন্ত্রী এমনকী রাষ্ট্রপতিকে পর্যন্ত জড়িয়ে প্রায় অভ্যুত্থানের কায়দায় বিজেপির নেতৃত্বে সংখ্যালঘু সরকার ভোরের মধ্যে গদিতে বসে পড়ল স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ণ উঠেছে, সারা রাত ধরে এমন প্রবল তৎপরতা, যাকে অনেকটা ক্যু–র (অভ্যুত্থানের) সাথেই তুলনা করা যায়, তার কী দরকার পড়ল? বিজেপির যদি সরকার গঠনের মতো এমএলএ সংখ্যা জোগাড় হয়ে গিয়ে থাকে তা নিয়ে রাজ্যপাল তো সকালেই বৈঠক করতে পারতেন৷ রাত দুটোর সময় রাজভবনে গিয়ে বিজেপি নেতা দেবেন্দ্র ফড়নবিশ দেখা করলেন রাজ্যপাল ভগৎ সিংহ কোশিয়ারির সাথে৷ রাজ্যপাল আবার আরএসএস এবং বিজেপির সক্রিয় কর্মী৷ এদিকে কখন রাষ্ট্রপতি শাসন প্রত্যাহারের সুপারিশ রাজ্যপাল পাঠালেন, কখনই বা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা এই বিষয়ে তাদের সুপারিশ রাষ্ট্রপতি ভবনে পাঠালো, আর রাষ্ট্রপতিই বা কেন এতকিছুর জন্য জেগে বসে রইলেন, যাতে আলো ফোটার আগেই (ভোর পৌনে ছটায়) রাষ্ট্রপতির নির্দেশ দিল্লি থেকে বোম্বের রাজভবনে পৌঁছে যেতে পারে এসবের কোনও উত্তর নেই৷ বিজেপি মুখপাত্র রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেছেন, ‘রাজ্যপালের বিবেক আছে’, তার ডাকেই তিনি সাড়া দিয়েছেন৷ কি অপূর্ব চিত্রনাট্য!

২৩ নভেম্বর দিল্লিতে রাজ্যপালদের সম্মেলনে তাঁদের সংবিধান রক্ষার উপদেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী৷ কিন্তু মহারাষ্ট্রের রাজ্যপাল সেখানে যাননি৷ প্রধানমন্ত্রীর দলেরই গোপন অ্যাজেন্ডা মেনে সংবিধান, আইন, নীতি–নৈতিকতা সবকিছুকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে পায়ে দলে যাওয়ার কর্তব্যের টানেই কি তিনি রাজভবন আগলে বসে ছিলেন? সংবাদমাধ্যম লিখেছে, ‘মাঝরাতের এই অভ্যুত্থান জরুরি অবস্থাকেই মনে পড়িয়ে দিচ্ছে৷ কোথাও কোনও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ছিল না৷ তা সত্ত্বেও কেন এত তড়িঘড়ি করে রাত দুটোর সময় দেবেন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে রাজি হলেন রাজ্যপাল?… নেতাদের না হয় সরকার গড়ার জন্য নিশিলন্ঠনের তেলপোড়ানোর দায় রয়েছে৷ কিন্তু সাংবিধানিক পদের দুই অন্যতম বয়স্ক ব্যক্তি রাত দুটোর সময় কেন জেগে?’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪ মে ২০১৯)৷ প্রশ্ন উঠেছে, রাজ্যের হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি, বিরোধী দলের নেতারা মুখ্যমন্ত্রীর শপথে থাকেন, এটাই তো রীতি৷ কোথায় তাঁরা? রাজ্যপাল কী করে রাতেই সমস্ত বিধায়কের সই যাচাই করলেন? বিধানসভায় কত দিনের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে হবে, রাজ্যপাল সে ব্যাপারে নীরব কেন? আরও কিছু ঘোড়া কেনাবেচার পথ খুলে রাখতেই কি?

কিছুদিন আগে প্রায় একই রকম ঘটনা দেখা গেছে কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনের পর৷ কংগ্রেস–জেডিএস জোটের সরকারের পতন ঘটাতে এমএলএ–দের টাকা থেকে শুরু করে, মন্ত্রিত্বের টোপ এবং তাদের বিরুদ্ধে থাকা দুর্নীতির মামলা খুঁচিয়ে তোলার হুমকি দিয়ে ব্ল্যাকমেলিংয়ের অস্ত্র ব্যবহার করেছে বিজেপি৷ সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টও অনৈতিকভাবে দল ভাঙানোর জন্য স্পিকার যে ১৭ জন এমএলএ–র সদস্যপদ খারিজের নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাকে মান্যতা দিয়েছে৷ মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পাকে (যাঁকে দুর্নীতির অভিযোগে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিতে হয়েছিল) বলতে শোনা গেছে, কর্ণাটকের গোটা অপারেশনটার দেখভাল করেছেন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ (ইকনমিক টাইমস, ৫ নভেম্বর, ২০১৯)৷ এর আগে গোয়া বিধানসভা দখল করতেও ঠিক একই কায়দা নিয়েছিল বিজেপি৷ বিগত লোকসভা নির্বাচনেও আমরা দেখেছি, এই পশ্চিমবঙ্গেই বিজেপি এমন সব লোককে প্রার্থী করেছে, যাদের তারা ভোটের কিছুদিন আগেও মাফিয়া, অস্ত্রপাচারকারী ইত্যাদি ভূষণে ভূষিত করত৷

আজ ভারতে এমন কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ নেই যিনি বিজেপির এই উদগ্র ক্ষমতা লিপ্সার নিন্দা করছেন না৷ এক বাক্যে মানুষ বলছে অতি ন্যক্কারজনক এবং মারাত্মক দৃষ্টান্ত তৈরি করল বিজেপি৷ কিন্তু একই সাথে তাঁদের ভাবাচ্ছে, যে কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, শিবসেনা, এনসিপি, জেডিএস ইত্যাদি দলগুলি ভোটের আগে বিজেপির দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়বার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট চাইছে, তাদের টিকিটে জেতা প্রতিনিধিরাই প্রলোভন অথবা দুর্নীতির তদন্তের ফাইল খোলার ভয়ে বিজেপিতে ভিড়ছে কী করে? সংসদীয় রাজনীতিতে এতটুকু নৈতিকতার বাষ্প থাকলেও কি এ জিনিস বিজেপির পক্ষে সম্ভব হত? নীতি–নৈতিকতা, নূ্যনতম গণতান্ত্রিক বোধ নিয়ে রাজনীতি যাঁরা করেন তাঁদের পক্ষে কি এমন কাজ সম্ভব? একসময় কংগ্রেসই এই ‘ঘোড়া কেনাবেচা’ করে ক্ষমতা দখলের রাজনীতি শুরু করেছে৷ আজ বিজেপির টাকার থলির জোর বেশি বলে তারা বেশি কিনছে৷ টাকার জোরে তারা ইচ্ছা করলেই সেই এমএলএ–এমপিদেরও কিনছে যারা নির্বাচনী প্রচারে দুদিন আগেই তথাকথিত ‘সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী’, ‘সেকুলার’ ইত্যাদি নাম গ্রহণ করেছেন৷ এমনকী বামপন্থী বলে পরিচিত দলগুলিও স্রেফ বিজেপির বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়ানোর কারণেই কংগ্রেস, এনসিপি–র মতো দলগুলিকে একই আখ্যা দিচ্ছে মহারাষ্ট্রের এই গদি দখলের ন্যক্কারজনক প্রয়াস দেখিয়ে দিল আজ বুর্জোয়া সংসদীয় গণতন্ত্র পরিণত হয়েছে এক শবদেহে, যে শবদেহের পচন আজ বিষিয়ে তুলছে গোটা সমাজকে৷ তার গায়ে জড়ানো অতীতের গণতন্ত্রের নামাবলিটুকুও পচে জীর্ণ হয়ে খসে পড়েছে৷ এই পচে যাওয়া ভোট–রাজনীতির পিছনে ছুটে জোট গড়ে তুলতেই হন্যে হয়ে ঘুরছে সিপিএম–সিপিআইয়ের মতো বামপন্থী বলে পরিচিত দলগুলি৷ ভোট–রাজনীতির এই কানাগলিতে ঘুরপাক খেয়ে যে সমাজ তথা রাজনীতিতে কোনও দিশা পাওয়া যাবে না, মহারাষ্ট্রের উদাহরণ তা দেখিয়ে দিল৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ১৬ সংখ্যা)