বিচারের নামে প্রহসন : একের পর এক হিন্দুত্ববাদী অপরাধী ছাড় পেয়ে যাচ্ছে বিজেপি শাসনে

২০০৭ থেকে ২০১৮৷ ১১ বছর ধরে চলছে ‘প্রমাণ’ খোঁজা৷ তবুও অসংখ্য মানুষের চোখের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে যারা ৯টি তাজা প্রাণ কেড়ে নিল, রক্ত ঝরাল নিরীহ মানুষের তাদের বিরুদ্ধে নাকি পাওয়া গেল না প্রমাণ

হায়দরাবাদে মক্কা মসজিদ বিস্ফোরণ মামলায় অভিযুক্ত উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ‘অভিনব ভারতের’ সদস্য অসীমানন্দ ও তার চার সহযোগীকে ‘প্রমাণের অভাবে’ ছাড় দিয়ে দিল জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ–র (ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি) বিশেষ আদালত৷ প্রশ্ন উঠেছে, অনেকগুলি সুষ্পষ্ট অভিযোগ ও তার সাক্ষ্যপ্রমাণ পেশের পরও কীভাবে ‘প্রমাণাভাব’ হল৷ বিজেপি নেতারা শোরগোল তুলেছেন, এ সবই সাজানো অভিযোগ৷ ‘হিন্দু সন্ত্রাস’ বলে কিছু নেই৷ কোনও কোনও নেতা এমনও বলেছেন, হিন্দু সম্প্রদায়কে কলঙ্কিত করতেই নাকি অভিযোগ তোলা হয়েছিল অসীমানন্দ ও তার সহযোগীদের দিকে৷

ঘটনাক্রম কী বলছে দেখা যাক৷ ২০০৭ সালের ১৮ মে মসজিদে যখন নমাজ পড়া চলছিল, তখন সেখানে বিস্ফোরণ ঘটে৷ ঘটনাস্থলেই ৯ জনের মৃত্যু হয়, আহত হন ৫৮ জন৷ পরে বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে আরও পাঁচ জনের মৃত্যু হয়৷ সিবিআই অসীমানন্দ, আরএসএস কর্মকর্তা দেবেন্দ্র গুপ্তা, লোকেশ শর্মা, ভারত মোহনলাল সহ আট জন হিন্দুত্ববাদী নেতাকে দোষী সাব্যস্ত করে গ্রেপ্তার করে৷ ২০১১ সালে মামলা এনআইএ–র হাতে যায়৷ হঠাৎ এনআইএ ২০১২ সালের ডিসেম্বরে রাজেন্দর চৌধুরী নামে একজন কৃষক এবং তেজরাম পারমার নামে এক রাজমিস্ত্রীকে প্রধান অভিযুক্ত সাব্যস্ত করে মধ্যপ্রদেশ থেকে গ্রেপ্তার করে৷ যদিও চার্জশিটে পারমার–এর নাম নথিভুক্তই করেনি এনআইএ৷

এরপর তদন্ত মোড় নেয় অন্যদিকে৷ এনআইএ অভিযোগ তোলে পাকিস্তানের দিকে, বলে হরকত–উল–জিহাদ অল–ইসলামি (হুজি) এই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে৷ ২০১৫ সালে নজিরবিহীনভাবে কেন্দ্রীয় সরকার এনআইএ প্রধান শরদ কুমারকে এক্সটেনশনে রেখে দেয়৷ তারপরই ওই সংস্থার আইনজীবী রোহিনী সালিয়ান পদত্যাগ করে বিস্ফোরক অভিযোগ করেন, ‘হিন্দুত্ববাদীদের সন্ত্রাস নিয়ে নরম মনোভাব দেখাতে অসম্ভব চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে৷’ মক্কা মসজিদ মামলার রায় বেরোনোর দু’সপ্তাহ আগে শুনানির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এই মামলার প্রধান তদন্তকারীকে সরিয়ে দেয় এনআইএ৷ একজন অনভিজ্ঞ আইনজীবীকে এই গুরুত্বপূর্ণ মামলার সরকারি পক্ষের কৌঁসুলি হিসাবে দাঁড় করায়৷ মক্কা মসজিদ মামলায় মূল অভিযুক্ত অসীমানন্দ প্রথমে যে বয়ান দিয়েছিলেন, তাতে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ স্বীকার করেন এবং এই হামলায় যারা তাকে সাহায্য করেছে তাদের নামও জানান৷ এর মধ্যে আরএসএস নেতা ইন্দ্রেশ কুমার, সঙঘ প্রচারক সুনীল যোশী, সাধ্বী প্রজ্ঞারও নাম ছিল৷ পরে বয়ান বদলে ফেলেন অসীমানন্দ৷ কিন্তু আদালত কোন যুক্তিতে নতুন বয়ান গ্রহণ করল, তা স্পষ্ট নয়৷ তদন্ত চলাকালীন সুনীল যোশী রহস্যজনকভাবে খুন হয়ে যান৷ মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলাতে জড়িত সাধ্বী প্রজ্ঞাও এখন জামিনে মুক্ত৷

গত বছর মার্চ মাসে এই মামলার প্রধান তদন্তকারী এনআইএ–ভুক্ত পুলিশ অফিসার প্রতিভা অম্বেডকরকে এই মামলা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়৷ সেই সময়ই প্রধান দুই অভিযুক্ত স্বামী অসীমানন্দ ও ভারত মোহনলাল জামিন পেয়ে যায় এবং এনআইএ সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনও আপিলও করেনি৷ মাত্র কয়েক মাস কার্যকাল থাকা সত্ত্বেও এনআইএ–র বিশেষ আদালতের বিচারক রবীন্দ্র রেড্ডি রায় ঘোষণার পরই প্রধান বিচারপতির কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন৷ কেন এই পদত্যাগ, এর কোনও ব্যাখ্যা নেই৷ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, রায়ের সাথে একমত না হয়েও এই রায় দিতে বাধ্য হয়েছেন বলেই কি বিচারপতির পদত্যাগ?

মক্কা মসজিদ মামলায় একের পর এক ঘটনাক্রম– অভিযুক্তের বয়ান বদল, তদন্তকারী অফিসারের বদলি, এনআইএ প্রধানের অবসর গ্রহণের পর এক্সটেনশন, একটিও খুনের মামলা না লড়া অনভিজ্ঞ আইনজীবীকে মামলায় সরকারি কৌঁসুলি হিসাবে খাড়া করা, হামলায় জড়িত আরএসএস নেতা সুনীল যোশীর রহস্যজনক খুন, রায় দেওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বিচারপতির পদত্যাগ, বিজেপি নেতাদের হুজির দিকে অভিযোগের আঙুল তোলা ইত্যাদি বিষয়গুলি একসঙ্গে জুড়লেই একটি সুপরিকল্পনার ছবি স্পষ্ট হয়ে যায়৷

বিশেষত, এনআইএ–র মতো জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাস সংক্রান্ত বহু মামলাতেই যখন অভিযুক্ত বিজেপি–আরএসএস ঘনিষ্ঠরা ছাড় পেয়ে যাচ্ছে এবং প্রতিটিতেই বলা হচ্ছে ‘প্রমাণ’ নেই৷ আর পাকিস্তান জুজু (হুজি) দেখিয়ে অভিযুক্তদের দোষ আড়াল করছে বিজেপি–আরএসএস নেতারা৷ তখন সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়৷

স্বাভাবিকভাবেই দেশজুড়ে প্রশ্ন উঠেছে, যদি অসীমানন্দ ও তার সহযোগীরা মক্কা মসজিদ বিস্ফোরণ মামলায় দোষী না হয়, তাহলে কারা দোষী সেটা ১১ বছর পার হয়ে গেলেও এনআইএ তদন্ত করতে পারল না কেন? সরকার এবং আদালত বিস্ময়করভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যাচ্ছে৷

এই একই সময়ে গুজরাট হাইকোর্টের বিচারে ‘বেনিফিট অফ ডাউট’–এর জোরে ছাড়া পেয়ে গেলেন, ২০০২ সালে গণহত্যার সময় নারোদা পাটিয়াতে ৯৭ জন মানুষকে হত্যার দায়ে সাজাপ্রাপ্ত নরেন্দ্র মোদির অত্যন্ত আস্থাভাজন, গুজরাটের প্রাক্তন মন্ত্রী মায়াবেন কোডনানি৷ সেশন কোর্ট কোডনানিকে এই হত্যাকাণ্ডের ‘কিং পিন’ বা প্রধান ষড়যন্ত্রী বলেছিল৷ প্রত্যক্ষদর্শীরা তাঁকে হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দিতে এবং তরোয়াল বিলি করতে দেখেও ছিল৷ কোর্টে একাধিক সাক্ষী সুস্পষ্ট ভাষায় তা বলেওছেন৷ এই নারোদা পাটিয়াতেই মায়ের পেট চিরে ভ্রূণ বার করে তাকে ত্রিশুলে গেঁথে পাশবিক উল্লাস করেছিল হিন্দুত্ববাদের অভিভাবক বজরঙ দল–আরএসএস–বিজেপ উন্মত্ত বাহিনী৷

যদিও সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে ‘সিট’ তদন্তের দায়িত্ব নেওয়ার আগে কোডনানির বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রহণ করতে গুজরাট পুলিশ রাজিই হয়নি৷ এখানেই শেষ নয়, সেশন কোর্টে সাজা পাওয়ার পর হাইকোর্টে তাঁর শাস্তি নিয়ে আপিল মামলা থেকে সাত–সাতজন বিচারক নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন৷ কারণ হিসাবে এমনকী বিচারকদের প্রাণহানির হুমকির কথাও শোনা গিয়েছে৷ এত কিছু করেও তিনি অক্লেশে জামিন পেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, রাজ্য সরকার যথারীতি জামিন পেতে সাহায্যই করেছে৷ হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চও বলেছে কোডনানির বিরুদ্ধে কোনও কিছু প্রমাণ করার কোনও চেষ্টাই রাজ্য পুলিশ এবং সিট করেনি৷

আজমেম দরগা, সমঝোতা এক্সপ্রেসে বিস্ফোরণ, মালেগাঁও বিস্ফোরণ, গুজরাটের নিধনযজ্ঞ, নারোদা পাটিয়া মামলা, মক্কা মসজিদ বিস্ফোরণে বহু মানুষের মৃত্যু ও অসংখ্য ক্ষয়ক্ষতির জন্য অভিযুক্ত অসীমানন্দ ও অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠকরা যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ছাড় পেয়ে যাচ্ছে৷ এতে বিচারব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতাই প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়েছে আজ৷

 

(৭০ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা ২৭ এপ্রিল, ২০১৮)