বামপন্থার পুনরুজ্জীবনই কেবল পারে আরএসএস–বিজেপিকে প্রতিহত করতে — গুয়াহাটির সভায় কমরেড অসিত ভট্টাচার্য


১৯৪৮ সালের ২৪ এপ্রিল সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তার ভিত্তিতে তাঁরই নেতৃত্বে ভারতবর্ষের একমাত্র সাম্যবাদী দল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল৷ তারপর থেকে প্রতি বছরই আমরা নিষ্ঠার সাথে এই দিনটি পালন করি৷ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সর্বশেষ অবস্থা পর্যালোচনা করি এবং এরই ভিত্তিতে আমাদের বৈপ্লবিক কর্তব্য নির্ধারণ করি, জনসাধারণকে জড়িত করে ভারতবর্ষে পুঁজিবাদ বিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ত্বরান্বিত করার জন্য নতুন করে সংকল্প গ্রহণ করি৷ ফলে, ২৪ এপ্রিল উদযাপন একটি রুটিন মাফিক অনুষ্ঠান নয়৷ এই অনুষ্ঠান অতীব গুরুত্বপূর্ণ৷

আপনারা দেখছেন সমগ্র দেশে একটা কঠিন পরিস্থিতি বিরাজ করছে৷ অর্থনৈতিক সংকট চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে৷ মূল্যবৃদ্ধি, বেকার সমস্যা, গভীর অর্থনৈতিক মন্দা, সীমাহীন দুর্নীতি ভয়ংকর হয়ে উঠেছে৷ যা কিছু পাওয়া যায় তাকেই আঁকড়ে ধরে মানুষ বাঁচার চেষ্টা করছেন কিন্তু কোনও নিশ্চিত অবলম্বনই তাঁরা খুঁজে পাচ্ছেন না৷ নতুন কাজ কোথাও সৃষ্টি হচ্ছে না, কল–কারখানা গড়ে ওঠার কোনও চিহ্ণই নেই, বরং যেটুকু অতীতে গড়ে উঠেছিল সেগুলিও একটার পর একটা বন্ধ হচ্ছে৷ ফলে বেকার সমস্যা বিস্ফোরক রূপ ধারণ করেছে৷ কল–কারখানা গড়ে তোলার সমস্ত প্রয়োজনীয় উপাদানগুলি যথা প্রাকৃতিক সম্পদ, খনিজ সম্পদ, কাঁচামাল, প্রযুক্তিবিদ্যা, কায়িক শ্রম এবং বৌদ্ধিক শ্রম সবই পর্যাপ্ত পরিমাণে দেশে থাকা সত্ত্বেও দেশের সর্বত্র উৎপাদনমুখী শিল্প গড়েই উঠছে না৷ জনসাধারণ যাতে সুষ্ঠু জীবন যাপন করতে পারেন তার জন্য লাগাতার কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ৷ বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিবিদ্যার সাহায্যে সবসময় তা আমরা করতে পারি৷ কিন্তু চূড়ান্ত সংকটগ্রস্ত পুঁজিবাদের আজ আর তা করার ক্ষমতা নেই৷ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বিশ্বের সর্বত্র কর্মসংস্থান ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে৷ সেদিন খবরের কাগজে দেখলাম, এক হাজারের কিছু বেশি পিয়নের পদের জন্য আবেদন করেছে কয়েক লক্ষ, যার মধ্যে গ্র্যাজুয়েট, পোস্টগ্র্যাজুয়েট, এমনকী পিএইচডি ডিগ্রিধারীও বহু আছেন৷ এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, সর্বত্রই এমন ঘটছে৷ স্থায়ী চাকরি বলতে যা বোঝায় সেটা আজ প্রায় নেই–ই বলা যায়৷ যেখানে যতটুকু অপরিহার্য নির্মাণ কাজ বা টুকটাক উৎপাদন মূলক কাজ হচ্ছে সেগুলিতেও পুঁজিপতিদের মুনাফার স্বার্থে বেশির ভাগই যন্ত্রের সাহায্যে হচ্ছে৷ যেখানে যতটুকু শ্রমিক নিয়োগ হচ্ছে সেগুলিও ঠিকা ভিত্তিক নিয়োগ৷ কনট্র্যাক্ট সার্ভিস, ‘প্যারা টিচার’, ‘প্যারা প্রফেসার’, ‘প্যারা ডক্টরস’– এইসব ব্যবস্থাই এখন চালু হয়েছে৷ ২৫ – ৩০ বছর আগেও অবস্থা এমনটা ছিল না৷ ‘গ্লোবালাইজেশন’, ‘কমার্শিয়ালাইজেশন’, ‘প্রাইভেটাইজেশন’ ইত্যাদি স্লোগান আওড়ে দেশি এবং বিদেশি পুঁজিপতিদের শোষণ দেশের মানুষকে আজ মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে৷ এর ফলে গোটা দেশে এক শ্বাসরোধকারী অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে৷ আপনারা জানেন দেশের জনসংখ্যার ৭৫–৮০ ভাগ মানুষ গ্রামেই থাকেন৷ তাঁদের অবস্থা অবর্ণনীয়৷ জমিহারা কৃষকের সংখ্যা তো দেশের সর্বত্র হু হু করে বাড়ছে৷ এই জমি আকাশে যাচ্ছে না, গ্রামেরই ধনী কৃষকদের হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে৷ এই জমিচ্যুত কৃষকরা জীবিকার সন্ধানে শহরের দিকে ছুটছেন৷ কিন্তু নতুন কলকারখানা নেই৷ পুরনোগুলো পর্যন্ত বাজার সংকটের মুখে পড়ে দ্রুত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ এই ভাবেই এই জমিহারা কৃষকরা কোনও বিকল্প কাজ না পেয়ে সর্বহারা কৃষকে পরিণত হচ্ছেন৷ অন্নহীন, বস্ত্রহীন এই সর্বস্বান্ত কৃষকরা যখন তখন অসুখ–বিসুখে আক্রান্ত হয়ে কোনও চিকিৎসা না পেয়ে অসময়ে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছেন৷ নিম্ন–মধ্য চাষি এবং গরিব চাষিদের অবস্থাও অতি সংকটজনক হয়ে পড়েছে৷ ধনী কৃষক এবং ধনী পাইকারদের চক্রান্তে তাঁরা তাঁদের ফসলের ন্যায্য দাম আদৌ পাচ্ছেন না৷ মারাত্মক হারে এঁরা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন এবং ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে এঁদের অনেকেই আত্মহত্যার পথই বেছে নিচ্ছেন৷

এই তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের সাথে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক সংকট৷ রাজনৈতিক সংকটের বহু দিক আছে৷ সমস্তটা বিস্তারিত আলোচনা করা আজ সম্ভব নয়৷ কিন্তু যে কথাটা আমি জোর দিয়ে বলতে চাই সেটা হচ্ছে, অন্য সব মারাত্মক সংকট ছাপিয়ে সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা আজ অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে৷ আপনারা লক্ষ করছেন, সমগ্র দেশে সাম্প্রদায়িকতা অতি ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে৷ দেশের সর্বত্র সাম্প্রদায়িকতার বিষ পরিকল্পিত ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ হিন্দু মুসলমান জনসাধারণকে সংঘর্ষে লিপ্ত করার জন্য অবিরাম চেষ্টা চলছে৷ বহু জায়গাতেই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে অথবা সংঘর্ষের সম্ভাবনা বাড়ছে৷ এমনও দেখা যাচ্ছে– দুই সম্প্রদায়ের জনসাধারণ সংঘর্ষে লিপ্ত হতে চাইছেন না, কিন্তু বাইরে থেকে লোক নিয়ে এসে সংঘর্ষ লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বিনা বাধায় এই সাম্প্রদায়িকতা এবং বিভাজনের বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ সবথেকে মারাত্মক কথা হল সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর, আচার–আচরণ, খাদ্যাভাসের উপর, তাদের গোটা জীবনযাত্রার উপর আঘাত হানা হচ্ছে৷ ন্যূনতম নিরাপত্তাও আজ তাদের জীবনে নেই, এক কথায় তাদের বেঁচে থাকার অধিকারটাই আজ মারাত্মকভাবে বিপদাপন্ন৷ অন্যদিকে জনসাধারণের গণতান্ত্রিক অধিকার বিভিন্ন ভাবে সংকুচিত করা হচ্ছে৷ বহু সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনসাধারণ যে সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জন করেছিলেন, যেগুলো মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত, যেমন সংগঠন করা, মিটিং–মিছিল করা, মত প্রকাশ করা, গণতান্ত্রিক আন্দোলন করা এই সমস্ত অধিকার ক্রমান্বয়ে অতি পরিকল্পিত ভাবে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে৷ এগুলিকে ফ্যাসিবাদী আক্রমণ ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে?

শ্রমিক কর্মচারীদের আন্দোলনের উপরও চলছে নানা আক্রমণ৷ শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলা খুব জটিল হয়ে পড়ছে৷ কল–কারখানা সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ যেটুকু চলছে তার বেশির ভাগই অতি সামান্য বেতনে ঠিকা শ্রমিক দিয়ে৷ শ্রমিকরা যেটুকু বেতন পায় তার দ্বারা পরিবারের ভরণ পোষণ দূরে থাক তাদের নিজেদেরই বেঁচে থাকা কঠিন হচ্ছে৷ পুঁজিবাদ সম্পর্কে বলতে গিয়ে কার্ল মার্কস শ্রম দাসত্বের কথা বলেছিলেন বহু বছর আগে৷ কিন্তু শ্রমিকদের উপর আজ মালিকদের, পুঁজিপতিদের যে শোষণ চলছে তা সেই আদিম যুগের দাস প্রথাকেই মনে করিয়ে দেয়৷ কিন্তু যেটা আরও মারাত্মক তা হচ্ছে, পুঁজিপতি শ্রেণির এই নিষ্ঠুর শোষণের মোকাবিলা করার জন্য জাতি–ধর্ম–বর্ণ–ভাষা নির্বিশেষে সমস্ত মেহনতি জনসাধারণের শ্রেণি চেতনার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া যখন খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে, পুঁজিপতি শ্রেণি ও তাদের তাঁবেদার সরকারগুলো তাকেই ধ্বংস করার জন্য অবিরাম চেষ্টা চালাচ্ছে, শোষিত মানুষের মধ্যে জাত–পাত–ধর্ম–ভাষা বর্ণের নামে মারাত্মক ধরনের বিভাজনের জন্ম দিচ্ছে, তাদের ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে জড়িয়ে দিচ্ছে৷

আপনারা জানেন ইতিহাসের শিক্ষা হচ্ছে নির্দিষ্ট প্ররোচনা না থাকলে খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে বিভাজনবাদী মানসিকতা থাকে না, তার পরিবর্তে মালিকদের শোষণের বিরুদ্ধে একটা ঐক্যবোধ কাজ করে৷ কিন্তু পুঁজিপতি শ্রেণি ও তাদের রাজনৈতিক দলগুলি তাদের স্বার্থেই অত্যন্ত ধূর্ততার সাথে তাদের মধ্যে বিভাজনবাদী মানসিকতার জন্ম দেয়৷ পুঁজিপতি শ্রেণির সব রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বিজেপি প্রকাশ্যভাবে সমগ্র দেশে আজ যে জঘন্য ধরনের সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে দিচ্ছে– তাকে পুঁজিপতি শ্রেণির শাসন–শোষণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না৷ এই পরিস্থিতিতে চিন্তাশীল মানুষের মধ্যে তাই যে প্রশ্নটি বার বার ধাক্কা দিচ্ছে তা হল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে যে সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথা তুলতে পারেনি, যে হিন্দু মহাসভা এবং আর এস এস স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করে ধিক্কৃত হয়েছে– তারা স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করে আজকে এই দানবীয় রূপ ধারণ করল কীভাবে? সমগ্র দেশেই তো আজ বিভীষিকাময় অবস্থা বিরাজ করছে৷ সমস্ত বিজ্ঞানসম্মত ধ্যান–ধারণার বিরুদ্ধে তারা যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তাতে তাদের সমস্ত কাজকর্মের মধ্য দিয়ে তীব্র মুসলিম বিদ্বেষ নির্লজ্জ ভাবে ফুটে উঠছে৷ আপনারা দেখছেন কেবল তাদের ধর্মবিশ্বাস, খাওয়া–পরা, তাদের আচার–আচরণ নয়, এক কথায় তাদের দৈহিক নিরাপত্তা, তাদের মানসিক স্বাধীনতা পর্যন্ত আজ আক্রমণের মুখে৷ সর্বত্রই গেরুয়া বাহিনী সংখ্যালঘুদের ওপর একের পর এক ফরমান জারি করছে এবং সেগুলো না মানলে তাদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালাচ্ছে, এমনকী তাদের তারা নির্বিচারে হত্যা করছে৷ আর দেশের অবস্থা আজ এরকমই যে এর কোনও বিহিত নেই, প্রতিকার নেই, আছে রাষ্ট্রের পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা৷ এখানেই শেষ নয়– আরএসএস হিন্দু ধর্মের বুলি আওড়ে মুসলিমদের হিন্দুত্ব গ্রহণ করার ফরমান দিচ্ছে৷ প্রশ্ন জাগছে, একবিংশ শতাব্দীর এই বিজ্ঞান নির্ভর যুগে এ আমরা কী দেখছি৷ প্রাচীন ভারতবর্ষের কোন মহান দিকটি এর মধ্য দিয়ে ধরা পড়ছে? এই কারণেই আরএসএস–বিজেপির এই মারণ উত্থান নিছক একটা রাজনৈতিক ঘটনা নয়, এটা হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রগতির বিরুদ্ধে এক ধ্বংসাত্মক উত্থান, মানবজাতিকে কলঙ্কিত করার এক নিকৃষ্ট প্রয়াস৷

আপনারা জানেন, স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের দেশে দুটি ধারা ছিল৷ একটা আপসকামী এবং আরেকটা আপসহীন ধারা৷ এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস, ভারতীয় জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থ রক্ষাকারী দল হিসাবেই গড়ে উঠেছে৷ আন্তর্জাতিক ভাবে সেই সময়টা ছিল ক্ষয়িষু পুঁজিবাদের যুগ৷ এই যুগে পুঁজিবাদ হয়ে উঠেছে বিপ্লব ভয়ে ভীত৷ সাম্রাজ্যবাদ এবং সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে এই ক্ষয়িষু পুঁজিবাদের আর কোনও বৈপ্লবিক ভূমিকা ছিল না, উল্টে সেই সময়ে সে সাম্রাজ্যবাদ এবং সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে আপসের পথে চলতে শুরু করেছে৷ সামন্ততান্ত্রিক চিন্তা, ভাবনা, ধর্মবিশ্বাস,  বিভাজনবাদী মানসিকতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি– এসবের সঙ্গে জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি আপসের পথই বেছে নিয়েছে৷ শুধু তাই নয়, এই সব চিন্তা–ভাবনাকে তারা জিইয়ে রেখেছে যাতে ক্ষমতায় বসে তারা এগুলিকে ব্যবহার করেই তাদের শোষণ, শাসন অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে৷ প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা দূরে থাকুক, হিন্দু মুসলিম মানসিকতার ঊর্ধ্বে ওঠা দূরে থাক, ভারতীয় জাতীয় বুর্জোয়ার নেতৃত্বে ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদ হিন্দু জাতীয়তাবাদ হিসাবে গড়ে উঠেছে৷ এই সব ব্যাখ্যা করেই এ যুগের মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেছেন, ব্রিটিশের সাম্রাজ্যবাদী শোষণ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ভারতবাসীদের মধ্যে উপর উপর একটা রাজনৈতিক ঐক্যবোধ গড়ে উঠলেও সাংস্কৃতিক ভাবে আমরা বহুধা বিভক্ত হয়ে রয়েছি৷ স্বাধীনতা আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে পরিচালিত জাতীয় কংগ্রেসের আপসকামী মানসিকতার ফলাফল এটাই৷ এটাই ইতিহাস৷ অপরদিকে সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আপসহীন ধারা সেদিন জাতি–ধর্ম–ভাষা–বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করার কাজ করেছে, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছে৷ আপসহীন ধারার এই আন্দোলনের জন্যই হিন্দু মহাসভা সেদিন সাম্প্রদায়িক, বিভাজনবাদী চিন্তা ভাবনা ছড়াতে পারেনি৷ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের ধারাটাই তখনকার সময়ের বামপন্থী ধারা হিসাবে কাজ করেছে৷ সেই ধারার মধ্যেই বামপন্থী চিন্তা ভাবনা ফুটে উঠেছিল এবং তার জন্যই সেদিন মুসলিম লিগের সাম্প্রদায়িক চিন্তার প্ররোচনা সত্ত্বেও, এই সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং হিন্দু মহাসভা, আরএসএস মাথা চাড়া দিতে পারেনি৷ সেদিন এরা ছিল নেহাতই অকিঞ্চিতকর শক্তি৷ কিন্তু স্বাধীন ভারতবর্ষে পুঁজিপতি শ্রেণির দল কংগ্রেস ক্ষমতায় বসার পর পরই জাতপাতের নামে, ধর্মের নামে, ভাষার নামে, অঞ্চলের নামে ভারতবর্ষের জনসাধারণকে বিভক্ত করার পথেই হাঁটল৷ এই পরিস্থিতিতেই সাম্প্রদায়িকতা এবং বিভিন্ন বিভাজনবাদী মানসিকতা বাড়তে থাকল৷ তখন থেকেই দেখা গেল, ক্ষমতাসীন কংগ্রেস এবং শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির এই মনোভাবের সুযোগ নিয়ে আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক দল জনসংঘ যার পরিবর্তিত নাম বর্তমানের বিজেপি, তারা শক্তি সঞ্চয় করতে থাকল৷ ক্ষয়িষু পুঁজিবাদের যুগে ভারতীয় জাতীয় পুঁজিপতিদের দল হিসাবে কংগ্রেস মুখে না বললেও হিন্দুত্ববাদের ভিত্তিতেই রাজনীতি করেছে, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে কোনও সংঘাতে যায়নি৷ সাম্প্রদায়িক চিন্তা, বিভাজনবাদী চিন্তাকে আশ্রয় করে শাসক কংগ্রেসও যেখানে যেমন, সেখানে তেমন করেই ভোটের রাজনীতি করেছে এবং এই পথ ধরেই আরএসএস বিজেপিকেও শক্তি সঞ্চয় করতে তারাও পরোক্ষ সাহায্য করেছে৷ এটাই বিগত ৭০ বছরের ইতিহাস৷ ফলে কংগ্রেসকে যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষ বলেন, তাঁরা চূড়ান্ত মিথ্যাচার করেন, তাঁরা হয় অজ্ঞ, না হয় অতি ধূর্ত৷ এঁরা ইতিহাসকে পায়ে মাড়িয়ে যান, এঁরা জনসাধারণকে মারাত্মক ভাবে বিভ্রান্ত করেন৷ আরও মারাত্মক কথা হচ্ছে এর ফলে এই সত্যটিও চাপা পড়েছে যে কংগ্রেস ক্ষমতায় বসার পর থেকেই পুঁজিপতি শ্রেণির শোষণকে আড়াল করে, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বা অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে আসছে৷ ফলে আজ ভারতীয় সমাজের ওপর বিজেপি–আরএসএস–এর যে আঘাত, এর পিছনে কংগ্রেসের প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবদানকে আড়াল করা যেতে পারে না৷

কিন্তু যে কথাটা আমি জোরের সাথে উত্থাপন করতে চাই সেটা হল, স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে তখনকার বামপন্থী ধারা যে আরএসএস, হিন্দু মহাসভাকে কোণঠাসা করে দিল, একেবারেই সামনে আসতে দিল না, স্বাধীনতার পর ভারতবর্ষে নিজেদের বামপন্থী বলে যাঁরা পরিচয় দেন, তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের রাজনৈতিক কার্যকলাপ পরিচালনা করা সত্ত্বেও কোণঠাসা সাম্প্রদায়িক শক্তির এই পুনরুত্থান ঘটল কী করে? ভারতবর্ষে যারা বামপন্থী বলে পরিচিত তাঁদের উপস্থিতি সত্ত্বেও তাঁরা সাম্প্রদায়িকতাকে এইভাবে বেড়ে উঠতে দিলেন কী করে? পরবর্তী সময়ে তাকে প্রতিহত করার ক্ষেত্রে কোনও কার্যকরী ভূমিকাই তাঁরা পালন করতে ব্যর্থ হলেন কেন?

বামপন্থী ভাবধারা বলতে কী বোঝায়

এটা কী প্রকৃত বামপন্থার ব্যর্থতা নাকি মেকি বামপন্থার পরিণাম? এর সঠিক উত্তর পেতে হলে বামপন্থী ভাবধারা, বামপন্থী চিন্তা–ভাবনা বলতে প্রকৃত অর্থে কী বোঝায়, তার অর্থ কী বা তার আদর্শগত ভিত্তিটা কী? এটা পরিষ্কার হওয়া দরকার৷ শোষক এবং শোষিতে বিভক্ত দেশে যে সমস্ত রাজনৈতিক শক্তি তাদের উপস্থিতি সত্ত্বেও শোষণমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনও ভূমিকা পালন করে না– যা চলছে তাকে মেনে নিয়ে যাদের রাজনীতি আবর্তিত হয় তাদের বলা হয় দক্ষিণপন্থী৷ এরা কার্যত শোষণমূলক সমাজ ব্যবস্থায় শোষণের প্রক্রিয়াকে টিকিয়ে রাখার রাজনীতিরই চর্চ্চা করে৷ কিন্তু যারা যথার্থই স্থিতাবস্থার বিপক্ষে, তারাই বামপন্থী৷ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে মূল দ্বন্দ্বটা ছিল একদিকে সাম্রাজ্যবাদী শাসন–শোষণ অপর দিকে তার থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আপসহীন কঠিন সংগ্রাম৷ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তাদের শাসন–শোষণ টিকিয়ে রাখতে চায় আর পরাধীন ভারতবাসী, আপামর শোষিত জনসাধারণ তার থেকে মুক্ত হতে চায়৷ সাম্রাজ্যবাদী শাসন–শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়েই সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আপসহীন ধারা গড়ে উঠেছিল৷ সেই ধারাটাকেই তৎকালীন সময়ের বামপন্থী ধারা বলে চিহ্ণিত করা হয়৷ এর মধ্য দিয়ে জাতি–ধর্ম–ভাষা–বর্ণ নির্বিশেষে সকল স্বাধীনতাকামী জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক এবং গভীর ঐক্য সৃষ্টি করতে পারা যায় সেদিন সর্বতোভাবে সেই চেষ্টাই হয়েছিল৷ শোষিত মানুষের মধ্যে বিভাজন নয়, সর্বতোভাবে ঐক্য সৃষ্টি করাই প্রকৃত বামপন্থীদের নীতি৷ এটাই ছিল তার মর্মবস্তু৷ কিন্তু স্বাধীনতার পর মূল দ্বন্দ্বের জায়গাটায় মৌলিক পরিবর্তন হয়৷ রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পর শাসক–শোষকের জায়গায় আসে জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি৷ এই পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বামপন্থী হিসাবে কাকে চিহ্ণিত করা হবে? একদিকে শাসক–শোষক পুঁজিপতি শ্রেণি আর তাদের বশংবদ রাজনৈতিক দলগুলি, অপর দিকে ৯৫ শতাংশ শোষিত জনসাধারণ৷ স্বাধীন ভারতে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এটাই তো বেসিক কন্ট্রাডিকশন বা মূল রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব৷ এর প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলি যথার্থই কী অবস্থান নিচ্ছে, কারা স্থিতাবস্থার পক্ষে এবং কারা প্রকৃতই স্থিতাবস্থার বিপক্ষে? এটাই তো নির্ণয় করবে কারা আজ দক্ষিণপন্থী এবং কারা বামপন্থী এই ভাবে না বুঝলে দক্ষিণপন্থা এবং বামপন্থার মধ্যে যে মৌলিক পার্থক্য আছে তা ধরা পড়বে কীভাবে? ক্ষমতায় আসীন পুঁজিপতি শ্রেণির শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে যথার্থ বিপ্লবাত্মক অবস্থান নেয় একমাত্র বিপ্লবী দল৷ এই বিপ্লবী দলই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদকে উচ্ছেদের সংগ্রামে নেতৃত্ব দেবে৷এখানে অন্য কোনও দলের নেতৃত্ব দেওয়ার প্রশ্নই আসে না৷ কিন্তু পুঁজিবাদের নির্মম, নিষ্ঠুর শাসনের বিরুদ্ধে যাদের সত্যিকারের কোনও দ্বন্দ্বই নেই, তার বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের উদ্দেশ্যে প্রকৃত গণআন্দোলন গড়ে তোলার প্রশ্নে যাদের কোনও আগ্রহই নেই এমন শক্তি বা দলকে বামপন্থী দল বলে চিহ্ণিত করা যায় কীভাবে? শুধু দাবি করলেই তো বামপন্থী হওয়া যায় না৷ এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করলে দেখা যাবে স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতবর্ষে বামপন্থী বলে পরিচিত সিপিআই(এম), সিপিআই, আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লক প্রভৃতি দলগুলি বুর্জোয়া শাসন ব্যবস্থায় ভোটের মাধ্যমে কোনও কোনও রাজ্যে ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে, মেহনতি জনসাধারণের দাবি দাওয়া নিয়ে শাসক কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জায়গায় জায়গায়, কনস্টিটিউশনাল, রিফরমর্শিট অপোজিশনাল অর্থাৎ বুর্জোয়া সংবিধানের চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থেকে এবং সংস্কারবাদী ধারায়, শ্রমিক আন্দোলন এবং গণআন্দোলন গড়ে তুললেও কোনও দিনই তারা পুঁজিবাদী শোষকদের বিরুদ্ধে, জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির শোষণের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করেনি৷ শোষক পুঁজিপতি শ্রেণি বনাম পুঁজিবাদের শোষণে বিধ্বস্ত ৯৫ শতাংশ জনসাধারণের দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব হিসাবে মেনে নিয়ে শোষিত জনসাধারণের পক্ষে কোনও দিনই এদের রাজনৈতিক কার্যকলাপ আবর্তিত হয়নি, আজও হচ্ছে না৷ পুঁজিবাদী শোষণের বাস্তবতাকে স্বীকার না করে সাম্রাজ্যবাদ–সামন্ত বিরুদ্ধে সময়ে সময়ে কিছু কথা বলে এরা কার্যত  পুঁজিবাদের শোষণ–শাসনকেই আড়াল করার চেষ্টা করেছে, আজও করছে৷ তাদের গোটা রাজনৈতিক কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে শ্রেণি চেতনা সৃষ্টি করা দূরে থাকুক সব কিছুর মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত সংস্কারবাদ এবং সংবিধানসম্মত আন্দোলনের ধারাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে৷ তারা যে গণআন্দোলনগুলি করেছে সেগুলি যাতে এই গণ্ডীর মধ্যেই আবদ্ধ থাকে, তার বাইরে না যায় সেই ভাবেই তারা আন্দোলনগুলির রাশ টেনে ধরেছিল৷ আর আজ সোস্যাল ডেমোক্রেটিক রাজনীতি আরও নগ্নভাবে চর্চা করতে গিয়ে মেহনতি জনগণের গণআন্দোলনের পথ পরিত্যাগ করে তারা সবচেয়ে বড় আপসকামী শক্তি হয়ে উঠেছে৷ পুঁজিবাদ বনাম আপামর শোষিত জনসাধারণ– এই অতি বাস্তব মৌলিক দ্বন্দ্বে, পুঁজিবাদ সম্পর্কে কোনও কিছু না বলা, কোনও কিছু না করা কি কিছুই বোঝায় না? নিজেদের বামপন্থী বলে পরিচয় দিয়ে এটা কি অন্যান্য চিহ্ণিত বুর্জোয়া দলের মতোই আচরণ হচ্ছে না? আজ তো সকলেই দেখছেন তাদের রাজনৈতিক কার্যকলাপ আর পাঁচটা বুর্জোয়া দলগুলির মতো বিধানসভা এবং সংসদ, বা সংসদীয় গণতন্ত্রের চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ৷ স্পষ্টতই এটা অন্যান্য বুর্জোয়া দলগুলির মতোই স্থিতাবস্থা বা স্ট্যাটাস কোর পক্ষেই অবস্থান নেওয়া৷ এই বাস্তব সত্যকে কিছুতেই ঢেকে রাখা যাবে না৷ তাই এটা হচ্ছে বামপন্থার মোড়কে দক্ষিণপন্থার রাজনীতি৷ এটা আরও বেশি সর্বনাশা৷ এখানে আমি আবার উল্লেখ করতে চাই কেবল স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েই নয়, স্বাধীনতা আন্দোলন চলাকালীন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি প্রকৃত বামপন্থার পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে৷ স্বাধীনতা আন্দোলনের যে আপসহীন ধারা, যার নেতৃত্বে ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, যিনি ছিলেন সেদিন প্রকৃত বামপন্থার ধারক বাহক, তাঁর সাথে তারা সহযোগিতা করেনি৷ গান্ধীর সাথে নেতাজির যে তীব্র নীতিগত বিরোধ, সেই বিরোধে তারা নেতাজির পাশে দাঁড়ায়নি, তাঁর বিরোধিতাই করেছে৷ এরা ’৪২–এর আন্দোলনের তীব্র বিরোধিতা করেছে৷ আজাদ হিন্দ ফৌজের বিপ্লবাত্মক স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছে৷

এই পরিস্থিতিতে আমরা তাই বলছি, দেশের বামপন্থী রাজনীতির এই ট্র্যাজিক দিকটি, এই প্রেক্ষাপটটিকে সঠিক ভাবে অনুধাবন করতে না পারলে আরএসএস, বিজেপির মতো ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থানের মূল কারণ আদৌ বোঝা যাবে না, তাদের প্রতিহত করার সঠিক পথও নির্ণয় করা যাবে না৷ কারণ প্রকৃত বামপন্থার আদর্শের ভিত্তিতে জাতি– ধর্ম–ভাষা–বর্ণ নির্বিশেষে সকল শোষিত নিপীড়িত জনগণের জ্বলন্ত দাবিগুলির পূরণের জন্য শক্তিশালী আপসহীন গণআন্দোলনের অভাবের সুযোগ নিয়েই তো আরএসএস, বিজেপি এই জায়গায় আসতে পেরেছে৷ বলা নিষ্প্রয়োজন যে আরএসএস, বিজেপি–কে রুখতে হলে জাতি–ধর্ম–বর্ণ–ভাষা নির্বিশেষে সকল শোষিত জনগণকে জড়িত করে উন্নত নীতি–নৈতিকতার আধারে প্রকৃত বামপন্থার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ লাগাতার গণআন্দোলন গড়ে তুলেই তা করতে হবে৷ একই সাথে জনগণকে জড়িত করে আরএসএস–বিজেপির অতি প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক মতবাদের বিরুদ্ধে লাগাতার আদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনা করে তাদের জনগণ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করতে হবে৷ এর দ্বিতীয় কোনও বিকল্প নেই৷

ভারতবর্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান সম্পর্কে কমরেড শিবদাস ঘোষের একটি অতি মূল্যবান শিক্ষার কথাও এই প্রসঙ্গে আমি উল্লেখ করতে চাই৷ তিনি বলেছিলেন, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দৃশ্যত বহু রাজনৈতিক দল আছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দুটি পক্ষই বিদ্যমান৷ একটা হচ্ছে শোষকদের পক্ষ– কংগ্রেস, বিজেপি, সমাজবাদী পার্টি এমনকী সিপিএম, সিপিআই এরাও পুঁজিবাদের শোষণকে মেনে নিয়েই বুর্জোয়া পরিষদীয় রাজনীতিকেই একমাত্র অবলম্বন করে চলেছে৷ অন্যদিকে পুঁজিবাদের শাসন শোষণের বিরুদ্ধে শোষিত মানুষের পক্ষে সংগ্রামরত একমাত্র এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)৷ এই অর্থেই তিনি বলেছেন যে দৃশ্যত বহু রাজনৈতিক দল থাকলেও, আসলে পক্ষ দুটিই৷ একদিকে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) যারা সর্বশক্তি নিয়োগ করে শক্তিশালী গণআন্দোলন গড়ে তোলার সংগ্রাম করছে, তারই পরিপূরক করে বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নির্বাচনেও অংশ গ্রহণ করছে৷ সংসদের বাইরে যে গণআন্দোলন, শ্রেণি সংগ্রাম গড়ে ওঠে তার আওয়াজকে সংসদের ভিতরে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিপ্লবীরা নির্বাচনে একটা পর্যায় পর্যন্ত অংশগ্রহণ করে৷ অপরদিকে সিপিএম, সিপিআই–রা বুর্জোয়া ভোটের রাজনীতিকেই তাদের রাজনীতির একমাত্র মূল ভিত্তি বলে গ্রহণ করেছে এবং এই উদ্দেশ্যে নীতি বিগর্হিত ভাবে ভোটে জেতার উদ্দেশ্যে যার তার সাথে মিত্রতা গড়ে তুলছে৷ এইভাবেই তারা সুবিধাবাদী রাজনীতির পাঁকে ডুবছে৷ আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করছেন এরই অবশ্যম্ভাবী পরিণামে তাদের অস্তিত্ব আজ প্রায় নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে৷ গণআন্দোলন বিমুখ রাজনীতি চর্চা করতে গিয়ে, আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লকের মতো দলগুলির অস্তিত্বই তো আজ বিপন্ন৷ সিপিএম, সিপিআই–ও গণআন্দোলন বিমুখ রাজনীতি চর্চা করতে গিয়ে কার্যত অস্তিত্বহীন হয়ে যাচ্ছে৷ বামপন্থী দলগুলির এই বিপর্যয় কারও কাছেই সুখকর নয়, গভীর উদ্বেগের৷

এই পরিস্থিতিতে অতি উদ্বেগজনক কথা হচ্ছে একটি অতি প্রতিক্রিয়াশীল, সমাজ তথা সভ্যতার অগ্রগতি বিরোধী শক্তি যখন যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করে একটা ফ্যাসিবাদী বিপদের জন্ম দিচ্ছে, ক্ষয়িষ্ণু বুর্জোয়া গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য যতটুকু বজায় ছিল তাকেই বিপন্ন করে তুলছে, সেই সময়ই লক্ষ করা যাচ্ছে প্রকৃত বামপন্থী ভাবাদর্শকে ভিত্তি তে এই বিপদকে প্রতিহত করার সংগ্রাম ক্রমশ ক্ষয় পেতে পেতে আজ তলানিতে এসে ঠেকেছে৷ বস্তুত বামপন্থী আন্দোলনের এই দুর্বল স্থিতির পরিবেশেই আরএসএস–বিজেপির এই উত্থান ঘটেছে৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেন এবং কীভাবে এই দুর্বলতা সৃষ্টি হল? দেশের আপামর জনসাধারণের উপর পুঁজিবাদের শোষণ ও শাসনের পটভূমিতে তো বামপন্থা অকেজো বা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায় না৷ প্রকৃত বামপন্থী আন্দোলনের প্রয়োজন তো আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে৷ তথাপি কেন এই সংকট? বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনার মধ্য দিয়েই আমাদের এর উত্তর পেতে হবে৷ সমস্ত ঘটনার নির্দিষ্ট কারণ থাকে৷ এরও নিশ্চয়ই আছে৷ বামপন্থী আদর্শের অর্থ কোনও বিশেষ দল নয়৷ আবার দল বাদ দিয়েও নয়, দলই হবে তার আধার৷ আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করছেন বামপন্থী বলে যারা সবচেয়ে বেশি পরিচিত সেই সিপিএম, সিপিআই ক্রমশ আদর্শগত ভাবে এবং সাংগঠনিক দিক থেকে শক্তিহীন হয়ে পড়ছে৷ এর কারণ তো আর এস এস–বিজেপি হতে পারে না৷  আর এস এস–বিজেপি তো প্রকৃত বামপন্থী আন্দোলনের অনুপস্থিতির পরিবেশেই শক্তি বৃদ্ধি করেছে৷ আপনারা অনেকেই জানেন পশ্চিমবঙ্গ বামপন্থী ভাবধারা এবং আন্দোলনের একটি দুর্গ বলে পরিচিত৷ সেই পশ্চিমবঙ্গেই দীর্ঘ ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পর সিপিএম–সিপিআই জনগণের দ্বারাই ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে এবং কংগ্রেসেরই একাংশ যারা কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করে এবং যারা কংগ্রেসের মতো দক্ষিণপন্থী পুঁজিবাদী দল হিসাবে বিবেচিত সেই তৃণমূল কংগ্রেসই ক্ষমতায় বসে৷ কেরালায় নীতি–টিতির বালাই না রেখে পালা করে সরকার বদল হয়৷ পাঁচটা বছর অন্তর একবার কংগ্রেসের জগাখিচুড়ি সরকার তো পরের পাঁচ বছর পর সিপিএমের জগাখিচুড়ি সরকার৷ নীতি এবং কর্মসূচির ক্ষেত্রে এই দুই জোটের মধ্যে চুল পরিমাণ পার্থক্যও দেখা যায় না৷ একই ভাবে নীতি–আদর্শের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে ক্ষমতার বহর দেখিয়ে সিপিএম ত্রিপুরা রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় সব মিলিয়ে ৩০ বছর থেকেছে এবং সেখানেও দিনের পর দিন বুর্জোয়া কায়দায় কংগ্রেস সহ অন্যান্য পুঁজিবাদী দলগুলির মতো চূড়ান্তজনবিরোধী পুলিশ ও ব্যুরোক্রেসির উপর নির্ভর করে শাসন চালাতে গিয়ে জনগণের রোষের মুখে পড়েছে এবং শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক দক্ষিণপন্থী শক্তি আরএসএস–বিজেপির হাতেই ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে৷ আর কেবল ক্ষমতাচ্যুতই হয়নি, ক্ষমতায় বসে শাসক পুঁজিপতি শ্রেণিকে খুশি করতে গিয়ে যেভাবে জনবিরোধী শাসন চালিয়েছে তারই পরিণামে জনগণের ধিক্কার কুড়িয়েছে৷ প্রকৃত বামপন্থার পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে রাখতে গিয়ে এইসব রাজ্যে তারা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে এই কথা বলার জন্য আজ একটি লোককেও খুঁজে পাওয়া যাবে না৷ অন্যান্য রাজ্যে এদের শক্তি তো বিশেষ কিছুই ছিল না৷ কিন্তু কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরায় দীর্ঘ দিন তাদের সরকার ছিল৷ কিন্তু দেখুন এইসব রাজ্যে এমন ভাবে তারা সরকার পরিচালনা করল যার ফলে বামপন্থী দল হিসাবে তাদের আদর্শগত আবেদন ক্ষমতায় যাওয়ার আগে যতটুকু ছিল, তা আজ শূন্যে গিয়ে দাঁড়িয়েছে৷

আর কেবল তাই নয়, তাদের পুঁজিবাদ ঘেঁষা রাজনীতির ফলে বামপন্থা এবং মার্কসবাদের আবেদনও সাময়িক ভাবে হলেও বিভ্রান্তির মুখে পড়েছে৷ সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির ভিতর শ্রম এবং পুঁজির মধ্যে যে আপসকামিতা নিহিত থাকে, এইসব রাজ্যে তাদের দীর্ঘ দিনের সরকার পরিচালনার মধ্য দিয়ে তা আরও স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে৷ এর ফলে বামপন্থী ভাবাদর্শ এবং বামপন্থী শক্তি দিনের পর দিন দুর্বল হয়েছে এবং আর এস এস, বিজেপি সহ অন্যান্য চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলির দাপট মারাত্মক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে৷ এতে তো খুশি হওয়ার কিছুই নেই৷ কারণ এটা তো সামগ্রিক ভাবে বামপন্থা এবং মার্কসবাদের উপরই, যত সাময়িকই হোক না কেন, একটা বড় আঘাত৷ তাই এর মূল কারণ ধরা এবং তাকে নির্মূল করাই নিড অফ দ্য আওয়ার (সময়ের দাবি)৷ এখানে মহান সাহিত্যিক এবং চিন্তাবিদ শরৎচন্দ্রের একটি কথা আমার মনে পড়ে৷ তাঁর ‘শেষ প্রশ্নে’ এক জায়গায় তিনি বলেছিলেন, ভালর শত্রু আরও ভাল৷ এর অন্তর্নিহিত অর্থ হচ্ছে– যা প্রকৃতই ভাল তা বিকশিত হওয়ার পথে আরও উন্নততর ভাল– তা চিন্তা হোক, ক্রিয়া হোক তারই জন্ম দেবে, এর অন্যথা হতে পারে না৷ বিজ্ঞানের ক্রমশ উন্নততর হওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা এই ধারণার সত্যতাই খুঁজে পাই৷ যে কোনও ক্ষেত্রে সত্য নির্ধারণ করতে হলে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে তা করতে হবে৷ এখানে ইচ্ছা–অনিচ্ছার প্রশ্ন ওঠে না৷ নির্ধারক কথা হচ্ছে পদ্ধতি, বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ পদ্ধতি৷ বামপন্থা হচ্ছে একটা ক্যাটাগরি অফ থিঙ্কিং ডেপেলপড থ্রু এ পার্টিকুলার প্রসেস৷ এটা দক্ষিণপন্থী চিন্তাপ্রক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন৷ দক্ষিণপন্থী ভাবধারাকে ভাবগত ভাবেই পরাস্ত করেই তার জন্ম৷ বিজ্ঞানের বিকাশ এবং অগ্রগতির মধ্য দিয়ে এই সত্যটিই বেরিয়ে এসেছে যে, যে কোনও পরিবর্তন ঘটার ক্ষেত্রে মূল কারণ হচ্ছে বিশেষ পদ্ধতি এবং বিশেষ প্রক্রিয়া৷ বিজ্ঞানে আমরা দেখছি অক্সিজেন তৈরি করার বিশেষ প্রক্রিয়ায় অক্সিজেনই আসছে, হাইড্রোজেন আসছে না, তেমনি হাইড্রোজেন তৈরি করার বিশেষ প্রক্রিয়ায় হাইড্রোজেনই আসছে, অক্সিজেন আসছে না৷

এখানে কমরেড শিবদাস ঘোষের একটি অতি মূল্যবান শিক্ষার কথা মনে পড়ছে৷ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের কয়েকটি দিক বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘রেজাল্ট উইল শো হোয়াট ইজ হোয়াট’, কার্য–কারণ সম্বন্ধের উপলব্ধিও তাই৷ একটি ঘটনার একটিই নির্দিষ্ট কারণ থাকে৷ অন্য একটি ঘটনার অন্য একটি নির্দিষ্ট কারণ৷ বিজ্ঞানসম্মত ভাবে যে কোনও বিষয়ে, যে কোনও ঘটনায় এমন কী রাজনৈতিক বিশ্লেষণের সময় বিজ্ঞানের এই মৌলিক সিদ্ধান্তকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না৷ এখানে আমি মহান সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত একটি উক্তি স্মরণ করাতে চাই৷ তিনি এক জায়গায় বলছেন, ‘শুধু হৃদয় এবং ইচ্ছা থাকিলেই মহৎ কাজ করা যায় না৷’ কমরেড শিবদাস ঘোষও বারে বারে আমাদের স্মরণ করিয়েছেন, সমস্ত ক্ষেত্রে সঠিক পদ্ধতিই একমাত্র নির্ণায়ক৷ শুধু অন্য পার্টির বিচার বিশ্লেষণের সময় নয়, আমাদের কার্যকলাপ পর্যালোচনার সময়ও বিজ্ঞানের এই মৌলিক সিদ্ধান্ত অনুসরণ করেই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে৷ মুখ্যত কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরায় সিপিএম এবং তাদের অনুগামী দলগুলি দীর্ঘদিন রাজ্যের শাসনভার চালিয়েছেন৷ প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই তাদের শাসনের অবসানে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক শক্তিই ক্ষমতাসীন হয়েছে, উন্নততর বামপন্থার জন্ম তারা দিতে পারেনি, বামপন্থার ক্ষমতাবৃদ্ধি করতে পারেনি৷

এ প্রশ্নে আমি আপনাদের একথাটাও বলতে চাই– কোনও একটা ধারণা যেন তেন প্রকারেণ কারও উপর চাপিয়ে দেওয়া আদৌ আমাদের উদ্দেশ্য নয়৷ এইসব রাজ্যে আমাদের কার্যকলাপ চালাতে গিয়ে প্রতিনিয়ত আমরা প্রত্যক্ষ করেছি যে তাদের প্রতিদিনের সরকার পরিচালনা সম্পূর্ণরূপে বামপন্থী ভাবধারা বর্জিত৷ যে সব রাজ্যে তারা শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, তার জনসংখ্যার ৯০–৯৫ ভাগ শোষিত জনসাধারণের পুঁজিপতি শ্রেণির শাসন–শোষণের বিরুদ্ধে যে প্রচণ্ড ক্ষোভ বিক্ষোভ রয়েছে, সেই প্রশ্নে তারা তাদের পক্ষে দাঁড়াচ্ছে না, তাদের অতি ন্যায়সঙ্গত গণআন্দোলনগুলির পক্ষে দাঁড়াচ্ছে না৷ সেগুলির বিরুদ্ধাচরণ করছে, কেবল তাই নয়, সেগুলি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে এবং কোনও কোনও সময়ে পুঁজিবাদী কংগ্রেস শাসনের অনুরূপ ভাবে সেগুলিকে দমন করার পথই বেছে নিয়েছে৷ এই পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা বলছি প্রকৃত বামপন্থা উন্নততর বামপন্থী ভাবধারার আরও উন্নত উপলব্ধির জন্ম দেয়৷ সিপিএম, সিপিআই যে বামপন্থার কথা বলছে এবং চর্চা করছে তার ফলে প্রকৃত বামপন্থাকে সংকটের মুখে ফেলেছে– এর দ্বারা তো বামপন্থার উপর প্রবল আঘাতই হানা হচ্ছে৷ এই পরিণামের দায় তো তাদেরই নিতে হবে৷ স্বীকার করতে হবে তাদেরই বামপন্থাবর্জিত রাজনীতি, বামপন্থার নামে পুঁজিপতি শ্রেণির তোষণ করারই অবশ্যম্ভাবী পরিণামে, দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি নতুন করে গজিয়ে উঠছে৷

অভাবনীয় হলেও এটা সত্য যে পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে সমস্ত গ্রামাঞ্চলে তাদের কর্মী, সমর্থক, অনুগামীরা ব্যাপক সংখ্যায় প্রথমে তৃণমূলে গিয়েছে এবং বর্তমানে বিজেপিতে যাচ্ছে৷ ত্রিপুরাতে তাই হয়েছে৷ বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণে এগুলিকে উপেক্ষা করা যাবে না৷ তাদের নেতা এবং কর্মীরা যাঁরা বামপন্থী, মার্কসবাদ–কমিউনিজম আদর্শের প্রতি এখনও আস্থা এবং বিশ্বাস রাখেন, তাঁদের গভীরে গিয়ে এটা উপলব্ধি করতে হবে যে তাঁদের দলের শাসনের অবসানের পরেই যে এই চূড়ান্ত দক্ষিণপন্থা জন্ম নিল, তার কারণ তাঁদের দীর্ঘদিনের বামপন্থাবর্জিত, গণআন্দোলনবর্জিত রাজনীতি, পুঁজিবাদী অর্থনীতি– রাজনীতির সঙ্গে একাকার হওয়ার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম৷ আপনারা লক্ষ করুন সমগ্র দেশে আর এস এস–বিজেপির যে অতি প্রতিক্রিয়াশীল অভ্যুত্থান ঘটেছে, সাম্প্রদায়িকতা যেভাবে অতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে, তাকে সঠিক পথে, প্রকৃত বামপন্থার ভিত্তিতে জাতি–ধর্ম–বর্ণ–ভাষা নির্বিশেষে সকল শোষিত, মেহনতি জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করে মোকাবিলা করার ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা যখন জরুরি হয়ে উঠেছে, তখন এই দলগুলির নেতারা আরএসএস–বিজেপির বিষাক্ত ভাবধারার বিরুদ্ধে প্রকৃত বামপন্থার ভিত্তিতে শক্তিশালী ভাবগত আন্দোলন গড়ে তোলার অপরিহার্যতার কথা একবারও বলছেন না৷ তার পরিবর্তে বিজেপির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার কথা বলে, যে কংগ্রেস পুঁজিপতি শ্রেণির অতি বিশ্বস্ত দল সেই কংগ্রেস এবং তার সমগোত্রীয় দলগুলির সঙ্গে নির্বাচনে ঐক্য গড়ে তোলার কথাই বারবার বলছে৷ যেখানে বাস্তব সত্য হচ্ছে কংগ্রেস মুখে কখনও কখনও ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি আওড়ালেও কোনও দিনই প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা করেনি, স্বাধীনতা আন্দোলন চলাকালীন সময়েও গান্ধী, জওহরলালরা কার্যত হিন্দু জাতীয়তাবাদেরই চর্চা করেছেন৷ স্বাধীনতার পর ক্ষমতায় বসে কংগ্রেস ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে শাসন পরিচালনা করেনি, আরএসএস–বিজেপির মুসলিম বিদ্বেষের বিরুদ্ধে কোনও ভাবগত আন্দোলন করেনি, ভোটের স্বার্থে চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদের পক্ষে কথা বলেছে৷

আরও মারাত্মক কথা হচ্ছে, আরএসএস–বিজেপির মুসলিমদের উপর পরিকল্পিত আক্রমণের বিরুদ্ধে ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেস সরকার কোনও কঠোর অবস্থান নেয়নি৷ ইন্দিরা গান্ধী এবং রাজীব গান্ধী খোলাখুলি ভাবেই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির চর্চা করেছেন৷ অথচ কী মারাত্মক কথা– আরএসএস–বিজেপি কে রুখবার কথা বলে সিপিএম, সিপিআই–রা কংগ্রেসের সঙ্গে নির্বাচনে মিত্রতা গড়ে তোলার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে৷ এই সবই তো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে প্রকৃত বামপন্থা থেকে আজ তারা কত দূরে৷ এই পরিস্থিতিতে চিন্তাশীল জনসাধারণকে যে কথাটা আমরা বলতে চাই তা হল, ভেঙে পড়লে চলবে না৷ মনোবল হারানো চলবে না৷ কারণ জাতি–ধর্ম–বর্ণ–ভাষা নির্বিশেষে মেহনতি জনসাধারণের বাঁচার জন্য ঐক্যবদ্ধ ভাবে আন্দোলন গড়ে তোলার প্রশ্নে প্রকৃত বামপন্থী ভাবধারার কোনও বিকল্প নেই৷ তাই এর পুনরুজ্জীবন একটা ঐতিহাসিক প্রয়োজন৷ সকল চিন্তাশীল জনসাধারণকে, মেহনতি জনসাধারণকে তাই এই সংগ্রামে সামিল হতে হবে৷ এই প্রশ্নে এই কথাটাও আপনাদের স্মরণ করাতে চাই যে অন্যান্য ক্ষেত্রেও যেমন, এই ক্ষেত্রেও তেমনই একটি বিপ্লবী দলের নেতৃত্বেই এই সংগ্রামকে সঠিক পথে গড়ে তোলা এবং এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব৷

আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করছেন যে, নিষ্ঠার সঙ্গে এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করছে একমাত্র এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)৷ পুঁজিবাদকে নির্মূল করার লক্ষ্য নিয়ে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তোলা, জাতি–ধর্ম–বর্ণ–ভাষা নির্বিশেষে সকল শোষিত মেহনতি জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করে অবিরাম গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য এসইউসিআই (কমিউনিস্ট)–ই নিরলস ভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷ এটাও বাস্তব সত্য যে এর মধ্য দিয়েই বিভিন্ন রাজ্যে জনসাধারণ আমাদের দলের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন৷ আমরা জানি রাতারাতি একজন মানুষ মার্কসিস্ট, কমিউনিস্ট চরিত্র অর্জন করতে পারেন না৷ তার একটা সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া রয়েছে, পর্যায় রয়েছে৷ প্রথমে জনসাধারণকে বামপন্থার মহত্ত্ব বোঝাতে হবে৷ ঐক্যবদ্ধ বামপন্থী আন্দোলনে সামিল করতে হবে৷ এই পরিস্থিতিতে সর্বত্র জনসাধারণকে আমরা যেটা বোঝাবার চেষ্টা করছি তা হল পুঁজিবাদের শোষণ– শাসনের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের যে লাইন তার ভিত্তিতেই লাগাতার গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে৷ প্রকৃত বামপন্থাকে প্রতিষ্ঠা করার এটাই একমাত্র পথ৷ এই পথেই সাম্প্রদায়িকতা, বিভাজনবাদও ক্রমশ নির্মূল হবে৷ আসুন এই পথেই অগ্রসর হয়ে আমরা আমাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করি৷

(দলের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আসামের গুয়াহাটিতে পলিটব্যুরো সদস্য কমরেড অসিত ভট্টাচার্যের ভাষণ)

(৭০ বর্ষ ৪৪ সংখ্যা ২২ জুন, ২০১৮)