বাজার অর্থনীতি ও করোনা পরিস্থিতি

সারা পৃথিবী জুড়ে দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাজার অর্থনীতি আজ করোনা পরিস্থিতির সামনে প্রায় নতজানু। অন্যদিকে অপাতত মাত্র কয়েকটি দেশে হলেও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা এই সংকটেও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে একদা বহু হাজার বা এমনকি লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত শোষণহীন সমাজের শ্রেষ্ঠত্বকে। একদিকে আমেরিকা, ইংলন্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, প্রভৃতি পশ্চিম ইউরোপ ও আটলান্টিক মহাসাগরের দুই পারের মহাপরাক্রান্ত বিভিন্ন রথী-মহারথীরা, অন্যদিকে ক্ষুদ্রকায় কিউবা, উত্তর কোরিয়া। আর আছে আর্থিক ও অন্যান্য ক্ষমতায় পিছিয়ে থাকা ভিয়েতনাম ও বিশ্ব অর্থনীতিতে মাথা তোলা নতুনতম মহাশক্তি চীন, যেখানে ভেঙে দেওয়া সমাজতন্ত্রের যতটুকু রেশ টিকে আছে, তাকেই আঁকড়ে ধরে লড়েছে মানুষ। আজকের করোনা পরিস্থিতিতে তাই দুই ব্যবস্থার তুলনাটা এড়িয়ে চলা মুশকিল।

প্রথমেই আসা যাক বর্তমান বিশ্বে বাজার অর্থনীতির দুই প্রধান পাণ্ডা আমেরিকা ও ইংলন্ডের কথায়। অর্থনীতির স্বার্থে বাজার চালু রাখা, না মানুষের স্বার্থে ঘরবন্দী থাকার নির্দেশ জারি– এই দ্বন্দ্বেই তারা উভয়েই সিদ্ধান্ত নিতে এত দেরি করে ফেলেছে যে, বর্তমানে তাদের অবস্থা একরকম দিশেহারা। মার্কিন সরকার প্রথম দিকে, এমনকি মার্চ মাসের দ্বিতীয়ার্ধের সূচনাতেও বিষয়টিকে নিতান্তই লঘু করে দেখেছে। আজ সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা সাত লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজারেরওবেশি, মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে আটত্রিশ হাজার (১৯ এপ্রিল দুপুর পর্যন্ত সংখ্যাটি ৩৮ হাজার ৯১০, সূত্রঃ জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি ও ফ্যাজ.নেট)। শুধুমাত্র এপ্রিল মাসের ১৮ তারিখে ২৪ ঘন্টায়সে দেশে মৃত্যুর সংখ্যা ছাপিয়ে গেছে ৩৫০০, এখনও পর্যন্ত কোনও একটি দেশে কোনও একদিনে এই মহামারিতে যা সর্বোচ্চ। নিউ ইয়র্ক শহরে ত্রাহি ত্রাহি রব। নেই ভেন্টিলেটর, পিপিই, উপযুক্ত মান ও পরিমানের মুখাবরণ, গ্লাভস, অমিল এমনকি চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরও অভাব। একই অবস্থা নিউ জার্সি, ডেট্রয়েট শহরেও। অথচ পরিস্থিতি এমনই যে আক্রান্তের সংখ্যায় এইসব শহরগুলি পাল্লা দিয়ে চলেছে বর্তমানে বিশ্বের অন্যপ্রান্তে অবস্থিত বিভিন্ন আস্ত আস্ত দেশের সঙ্গে। এখানেইশেষ নয়। মহামারির এই দিশেহারা সময়েও সেদেশের মানুষ আজ আরওবেশি দিশেহারা ইতিমধ্যেই জেঁকে বসা অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে। বাধ্যতামূলক লকডাউনের ধাক্কায় সেদেশের লক্ষ লক্ষ নয়, ইতিমধ্যেই কোটি কোটি মানুষ বেকার। তার উপর ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের চিকিৎসা বিমা অকার্যকরী হয়ে গেছে। ফলে এইসব কর্মহীন মানুষের আজ এমনকি রোগের সাথে যুঝবার ক্ষমতা বলেও আর কিছু অবশিষ্ট নেই। এদিকে দেশে সার্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা বলে প্রায় কিছুই না থাকার ফলে রোগাক্রান্ত মানুষের সামনে সামান্যতম চিকিৎসাটুকু পাওয়াও হয়ে দাঁড়িয়েছে রীতিমতো কঠিন কাজ। এই অবস্থায় অসহায় দিশেহারা মানুষ একরকম বাধ্য হয়েই রাস্তায়নেমে মিছিল করতে বাধ্য হচ্ছে – লক ডাউনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার দাবিতে। কারণ ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সামনে তাদের কাছে এমনকি করোনার ত্রাসও বহুক্ষেত্রেই তুচ্ছ হয়ে উঠছে।

আর ব্রিটেন? এখন বোধহয় কলকাতাকে লন্ডন করার স্লোগান পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও দেবেন না। অথচ এই ক’দিন আগে পর্যন্তও, যখন করোনার করাল ত্রাসে ইতালি ইতিমধ্যেই পর্যুদস্ত – তখনও পর্যন্ত ব্রিটেনের সরকার ভরসা রেখেছিল কমিউনিটির মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তোলার তত্ত্বে। এমনকি শোনা যাচ্ছে সে দেশের সরকারের মুখ্য উপদেষ্টা সরকারকে এমন পরামর্শও দিয়েছিলেন, সমাজের বয়স্ক, দুর্বলবেশ কিছু মানুষ মারা পড়লে তা নিয়ে বেশি মাথা ঘামানোর দরকার নেই। সমাজের মধ্যে ‘অটো ইমিউনিটি’ (স্বয়ংক্রিয় রোগপ্রতিরোধ) গড়ে উঠলে রোগ আপনা থেকে পিছু হটবে। আসলে কোনও ভাবেই তারা দৈনন্দিন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের চাকা থামিয়ে দিতে চাননি। ফল? আজ সেই মুখ্য উপদেষ্টা নিজে সহ, প্রধানমন্ত্রী, তাঁর বান্ধবী, যুবরাজ চার্লস – এরকম বহু সরকারি কেষ্টবিষ্টু পর্যন্ত সরাসরি আক্রান্ত কোভিড ১৯’এ। আর সাধারণ মানুষ? আক্রান্তের সংখ্যা ছুঁয়ে ফেলেছে প্রায় ১ লক্ষ ৮০ হাজার, মৃতের সংখ্যাও ইতিমধ্যেই পেরিয়ে গেছে ১৫ হাজার। তবে এই হিসেব নিয়েও উঠেছে গরমিলের বিপুল অভিযোগ। কারণ এক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকার শুধুমাত্র হাসপাতালগুলিতে মৃত্যুর সংখ্যা গণনা করেছে। কিন্তু এক বিরাট সংখ্যক মানুষ এর বাইরেও সে দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন বলে অভিযোগ। সেইসব মৃত্যুকে হিসেবের মধ্যে ধরলে নাকি তা সংখ্যায় ছাপিয়ে যাবে ৪০ হাজারকেও। সেই অর্থে ইতালি, স্পেন বা ফ্রান্সকেও বহু পিছনে ফেলে ব্রিটেনই হয়ে দাঁড়াবে ইউরোপ তথা পৃথিবীর এ পর্যন্ত সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। শুধু তাই নয়, পৃথিবীরদেশেদেশে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ারক্ষেত্রেও মূল অনুঘটকের কাজ করেছে বহুক্ষেত্রেই এই ইংলন্ড ফেরত মানুষই। যেমন, আমাদের এই পশ্চিবঙ্গে প্রথম চিহ্নিত করোনা আক্রান্তদের প্রায় সকলেরই ব্রিটেনযোগ বহু আলোচিত।

এবার দৃষ্টি একটু ফেরানো যাক বিপরীত শিবিরের দিকে। চীন – করোনা ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার বহু আলোচিত উৎস ও প্রথম এপিসেন্টার। বাস্তব হলসেখানকার হুবেই প্রদেশের উহান শহর, যেখান থেকে রোগটি প্রথম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, প্রথমেই কিছুমাত্র কালক্ষেপ না করে তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয় বাকি সমগ্র দেশথেকেই। গোটা শহর এবং প্রদেশের জন্যই চালু করা হয় সঙ্গরোধ ও নিভৃতাবাসের কঠোর নিয়মাবলী। কিন্তু সেই অবস্থাতেও কাউকে যাতে খাদ্যাভাবে ভুগতে না হয়, নিত্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিস যাতে মানুষের বাড়িতেই পৌঁছে যায়, তার জন্য সরকারিভাবেই যে উদ্যোগ নেওয়া হয়, তার সাফল্য আজ ইতিমধ্যেই সারা পৃথিবীতেই স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য – শুধুমাত্র উহান শহরেরই জনসংখ্যা কিন্তু ১ কোটি ১০ লক্ষ। ফলে উদ্যোগটির বিপুলতা সহজেই অনুমেয়। পাশাপাশি গোটাদেশ থেকে রাতারাতি সেখানে উড়িয়ে আনা হয় ৪০ হাজার ডাক্তারকে। আক্রান্ত রোগীদের স্থান সংকুলানের জন্য মাত্র ১০ দিনে খাড়া করে ফেলা হয় একটি সম্পূর্ণ নতুন বহুতল হাসপাতাল। মনে রাখতে হবে তখনও পর্যন্ত এই নতুন ভাইরাসটি সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা ছিল না। তা সত্ত্বেও সেখানে যে লড়াইটা লড়া হয় সেদিন – তারই ফলে আজ ভাইরাসটির চরিত্র ও কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে বা তাকে প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে জানা যায়। শেষ পর্যন্ত কিন্তু ওই উহানের বাইরে বাকি চীনে ভাইরাসটি এখনও পর্যন্ত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। অর্থাৎ, মহামারির আঁতুড়ঘর হওয়া সত্তে্বও সেখানে রোগ সংক্রমণকে অনেকটাই আটকেদেওয়া সম্ভব হয়েছে। বিশ্ব জুড়ে আতঙ্কের আবহের মধ্যেই চীনে জনজীবন আজ আবার তুলনামূলকভাবে স্বাভাবিকতায় ফিরে আসার পথে। এই লড়াইতে চীনের শাসকদের দ্বারা পরিত্যক্ত হয়েও পুরনো সমাজতান্ত্রিক ধাঁচার যে রেশটুকু থেকে গেছে তা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে ও মানুষকে এক যোগে লড়াইয়ে নামতে সাহায্য করেছে।

এবার আসি সমাজতান্ত্রিক কিউবার কথায়। অর্ধশতাব্দীরও অধিককাল নিরন্তর মার্কিনী অবরোধের মুখে দাঁড়িয়েও সে দেশ আজ চিকিৎসা ব্যবস্থায় এতটাই অগ্রসর, যে সমগ্র লাতিন আমেরিকার চিকিৎসা ব্যবস্থার আশার কেন্দ্র আজ তারাই। শুধু তাই নয়, বাজার অর্থনীতির উপর পুরোপুরি ছেড়ে রাখা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর যে বিশাল সংখ্যক গরিব মানুষ সেই বিপুল ব্যয়বহুল চিকিৎসা কিনতে অপারগ, তাদেরও আশাভরসা আজ কিন্তু সেই মার্কিন সরকারের দ্বারা বহুনিন্দিত এবং একরকম শত্রু হিসেবে গণ্য রাষ্ট্র কিউবাই। হ্যাঁ, এই করোনাক্রান্ত সময়েও। শুধু তাই নয়, করোনা আক্রমণে নাভিশ্বাস ওঠা অতি উন্নত পশ্চিম ইউরোপীয় বিরাট শক্তিধর দেশ ফ্রান্স, ইতালি, স্পেনও আজ নিজেদের দেশের পরিস্থিতি সামলাতে সেই কিউবার পাঠানো চিকিৎসক দল, ও চিকিৎসা পরিষেবার উপর অনেকাংশেই ভরসা রাখতে বাধ্য হচ্ছে।

ভিয়েতনাম – বিশ্ব অর্থনীতিতে একরকম তুচ্ছতাচ্ছিল্যের পাত্র এই দেশটিরোগের প্রথম উৎসস্থল ও ছড়িয়ে পড়ার কেন্দ্র উহান থেকে অনতিদূরে অবস্থিত (১৩০০ কিলোমিটার, কলকাতাথেকে দিল্লির দূরত্বও এর থেকে বেশি)। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ২৫০, মৃত্যু শূন্য। এই বিশ্ব জুড়ে জরুরি অবস্থার মধ্যেও জনজীবন প্রায় স্বাভাবিক। কীভাবে? ইতিমধ্যেই তা সামাজিক এবং গণমাধ্যমে বহু আলোচিত। গত ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকেই ১০কোটি জনসংখ্যার এই দেশে স্বাস্থ্যদপ্তর শুরু করে দেয় করোনারোধের সংক্রমণ রুখতে কী করতে হবে তা নিয়ে বাড়ি বাড়ি প্রচার কর্মসূচি।দেশের বিভিন্ন মিউজিয়াম, পার্ক, বিনোদনকেন্দ্রগুলি প্রথমেই বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর্থিক সামর্থের অভাবে প্রথমদিকে গণহারে পরীক্ষা শুরু করা যায়নি ঠিকই, তবু যা হয়েছে, তাও বহু দেশের থেকেই অনেকগুণ (প্রতি ১০ লক্ষ মানুষ পিছু ১৬০ জন, আমাদেরদেশে এখনও পর্যন্ত এই সংখ্যাটি ২০’র কম)। সেই সময়েই কমখরচে পরীক্ষার জন্য তৈরি করেফেলা হয় নতুন কিট। বিদেশাগত প্রতিটি যাত্রীকে পরীক্ষা করে দেখা শুরু হয়। তার মধ্যেও লন্ডন ফেরত (সেই লন্ডন) একজন যাত্রী পালিয়ে যান। তাকে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় খুঁজে বের করে পরীক্ষা করে দেখা হয় –দেশে ১৭ নম্বর করোনা আক্রান্ত। সাথে সাথে তিনি যাদের যাদের সাথে মিশেছিলেন, যে বিমানে এসেছিলেন তার প্রত্যেক যাত্রীকে তো বটেই, এমনকি যে যে রাস্তা ধরে গিয়েছিলেন, সেখানকার প্রতিটি অধিবাসীকে পাঠানো হয়কোয়ারান্টাইনে। প্রত্যেককেই আলাদা করে পরীক্ষা করে দেখা হয়। দেশব্যাপী কোয়ারান্টাইনের জন্য যে শিবিরগুলো গড়ে তোলা হয়, সেখানে নাগরিক স্বাচ্ছন্দের ব্যবস্থা লজ্জায় ফেলবে বহু উন্নত পশ্চিমী দেশকেও। প্রসঙ্গত তখনও পর্যন্ত লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে যাত্রীদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যপরীক্ষার ব্যবস্থাটুকুও গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। ভারতে সরকারের মূল মাথাব্যথা তখনও পর্যন্ত শাহিনবাগের প্রতিবাদীরাই।

উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে মিথ্যে রটনার অন্ত কোনও দিনই ছিল না, আজও নেই। কিন্তু ঘটনা হল, দক্ষিণ কোরিয়ার থেকে যে সেখানের অবস্থা এই রোগের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক ভাল, তা অতি বড় নিন্দুকও স্বীকার করতে বাধ্য। অবশ্য দক্ষিণ কোরিয়াও পার্শ্ববর্তী জাপানের মতোই এই ভাইরাসে প্রথম দিকে যথেষ্ট আক্রান্ত হয়েও অবস্থা শেষপর্যন্ত অনেকটাই সামাল দিতে পেরেছে। কীভাবে? তাদের চিরাচরিত বাজার নিয়ন্ত্রিত চিকিৎসাব্যবস্থার মাধ্যমে? না। সেখানেও গণপরীক্ষার উপরই গুরুত্ব আরোপ করতে হয়েছে। গণপরীক্ষা – আক্রান্ত চিহ্নিতকরণ – চিহ্নিত বা সন্দেহভাজনদের সঙ্গরোধ ও বাধ্যতামূলক নিভৃতাবাস – প্রয়োজনীয় যাবতীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। স্বাভাবিকভাবেই বাজারের উপর এত কিছ ছেড়ে রাখা চলে না, হয়ওনি। ইতালি বা স্পেনের অভিজ্ঞতাও তাই বলে। সেখানে প্রথমে বাজারের উপরে বিষয়টা ছেড়ে রেখে উপেক্ষা করা হলেও পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় নেমে পড়ে সেনা। শুরু হয় গণপরীক্ষা ও আক্রান্তদের চিহ্নিত করে তাদের বিচ্ছিন্ন করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। চিকিৎসাব্যবস্থাকে এতদিন বাজারের হাতে অংশত হলেও ছেড়ে রাখা জনিত অভাব ও অপর্যাপ্ততার মোকাবিলায় স্পেনে রাতারাতি সমস্ত বেসরকারি হাসপাতালকে সরকার থেকে জনস্বার্থে অধিগ্রহণ করা হয়। সারা দেশ ঐক্যবদ্ধভাবে বাজারী অর্থনীতির রীতিনীতি ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়ে পরিস্থিতির মোকাবিলায়। তবুও, এই লেখার সময় পর্যন্ত, নতুন আক্রান্তের হার একটু কমা ব্যতীত দুই দেশেরই অবস্থা এখনও যথেষ্টই উদ্বেগজনক।

অন্যদিকে জার্মানি। বাজার অর্থনীতির অন্যতম প্রবক্তা ও ইউরোপের অর্থনৈতিক পিস্টন বলে পরিচিত এই দেশটিরও পরিস্থিতি আক্রমণের প্রথম পর্যায়ে ছিল ইতালিরই অনুরূপ। কিন্তু সেইসময় থেকেই তারা মুক্ত অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা থেকে সরে গিয়ে চিকিৎসা ও সেই সংক্রান্ত গবেষণার ক্ষেত্রে সরকার নিয়ন্ত্রিত সার্বজনীন চিকিৎসা ব্যবস্থার উপরেই নির্ভর করতে শুরু করে। তাদের পাথেয় হয় তাদের দেশের আগে থেকেই চালু অতি-উন্নত গণচিকিৎসা ব্যবস্থা। শুরু হয় একই ভাবে গণপরীক্ষা – চিহ্নিতকরণ– সঙ্গরোধ– চিকিৎসা। ফলে আক্রান্তের সংখ্যাসে’দেশে ১ লক্ষ ৪৩ হাজার ছাড়ালেও, মৃত্যুর সংখ্যা এখনও পর্যন্ত আটকে রাখাগেছে সাড়ে চার হাজারের মধ্যেই। অন্যদিকে আক্রান্ত হয়েও সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষের সংখ্যা সেখানে ৮৫ হাজার ৪০০ জন (সূত্রঃ ডিপিএ, ১৯.০৪.২০)। সেদেশের হোবের্ট কখ ইনস্টিউট’এর গবেষণা জানাচ্ছে, একজন আক্রান্ত ব্যক্তি পিছু সংক্রমণের সংখ্যা যেখানে দুই সপ্তাহ আগেও ছিল ৫, এমনকি কখনও কখনও ৭, বর্তমানে তা নেমে এসেছে মাত্র ১’এরও কমে।

মুক্তবাজার অর্থনীতি নির্ভর চিকিৎসা ব্যবস্থার সমস্যাটা কোথায়? সেখানে সমস্ত উৎপাদন ও পরিষেবাই মুনাফানির্ভর ব্যবসা। স্বাস্থ্যও তাই। অর্থাৎ চুল চকচকে করার শ্যাম্পুর বিক্রি ও তা থেকে লাভের পরিমাণ যদি জীবনদায়ী কোনও ওষুধ বা নির্দিষ্ট কোনও পরীক্ষার চেয়েবেশি হয়, তবে সেগুলির পরিবর্তে এই ব্যবস্থায় সেই শ্যাম্পুর উৎপাদন ও জোগানই হবে বেশি। অন্যদিকে মূল চালিকাশক্তি লাভ হওয়ায় জীবনদায়ী কোনও ওষুধেরও চাহিদা হিসেব করা হবে শুধু সেই ওষুধ কেনার ক্ষমতা কতজনের আছে, তারই উপর নির্ভর করে। ওই ওষুধ সত্যি সত্যি কতজনের জীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজন –সে হিসেবসেখানে নিতান্তই অবান্তর।

পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল সমস্যাটাইতো এই। মানুষের প্রকৃত প্রয়োজন সেখানে চাহিদা হিসেবে স্বীকৃত নয়, উৎপাদিত বস্তু কতজনের কেনার ক্ষমতা আছে, তার উপরেই সেখানে চাহিদা নির্ভরশীল। কারণ, যে কোনও উৎপাদন ও বন্টনের মূল চালিকাশক্তিই সেখানে তারথেকে সেই উৎপাদক বা বন্টনকারী সংস্থা কতখানি লাভ করতে পারবে সেই হিসেব। স্বাভাবিকভাবেই যেখানে আশু হিসেবযোগ্য লাভ বা মুনাফার প্রশ্ন নেই, যত প্রয়োজনীয়ই তা হোক না কেন, এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় তা অবহেলিত হতে বাধ্য। ফলে এমনকি স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্যদ্রব্যের মতো মানুষের জীবনধারণের জন্য নিতান্ত প্রয়োজনীয় বিষয়গুলিও সেখানে মুনাফার স্বার্থে পণ্যায়িত – চূড়ান্ত বিপর্যয়ের মুখেও মানুষের প্রকৃত চাহিদা মেটানোর বন্দোবস্ত এই ব্যবস্থায় অপ্রতুল। অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হল এর বিপরীত। মানুষের সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদাগুলিই সেখানে গুরুত্বপূর্ণ। এরথেকে মুনাফার কোনও প্রশ্ন সেখানে না থাকায় যে কোনও সামাজিক, প্রাকৃতিক বা অন্য ধরনের বিপর্যয়ের সময় মানুষের প্রকৃত প্রয়োজনকেই সেখানে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হত। ফলে বিপর্যয় মোকাবিলা হত তুলনামূলকভাবে মসৃণ পথে। সেই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পরেও পূর্বতন সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে সেই পূর্ববর্তী ব্যবস্থার যে পরিকাঠামোটুকু এখনও বজায় রয়েছে – তা ব্যবহার করেই এই বিশ্বজোড়া বিপর্যয়ের মুহূর্তে আবার প্রমাণ পাওয়া গেল, বিপর্যয় সামলানোর ক্ষমতা আদতে সেই ব্যবস্থাতেই কত বেশি।

অর্থাৎ, এই নোভেল করোনা ভাইরাসের মোকাবিলায় দিশাহারা এই সময়ে দাঁড়িয়ে আবার পরিষ্কার হয়ে গেল বাজার নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার ত্রুটি ও অসাড়তা। এমনকি বহুদিনের পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহ্যবাহী পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলিও এই পরিস্থিতিতে এমন ধরনের কিছু পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হল, যা আসলে তাদের ভাষায় ‘ব্যর্থ’ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সমাজতন্ত্রকেই মান্যতা দেয়। প্রবল পরাক্রান্ত আমেরিকাকে সাহায্যের জন্য হাত পাততে হল সেই চীন, কিউবার কাছে। তাদের স্বাস্থ্যসচিবকে ভৎর্সিত হতে হল তাদেরই শীর্ষ আদালতে এই জরুরি অবস্থাতেও চিকিৎসা উপকরণ উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থায় সরকারি নিয়ন্ত্রণ কায়েম না করে, তাকে সার্বজনীন করে না তুলে, তা বাজারের হাতে, বিভিন্ন বিমা কোম্পানিগুলোর মুনাফামুখী প্রবণতার হাতেছেড়ে রাখার জন্য। আমরা সাধারণ মানুষই বা আর কবে বুঝবো আমাদের নিজেদের নিরাপত্তা আসলে কোন ব্যবস্থায় বেশি সুরক্ষিত? আর কোন ব্যবস্থায় আমরা অসম্ভব ঝুঁকির মধ্যেই দিনাতিপাত করতে বাধ্য হই? আমরা মরি, আক্রান্ত হই, দুরারোগ্য ব্যাধিতে অসহায় অবস্থায় মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুনি, খাবারের অভাবে মরিয়া হয়ে উঠি, আর আমাদেরইসেই দুর্দশা, অসহায়ত্ব, আতঙ্ক আর হাহাকারকেই হাতিয়ার করে কিছু কিছু গোষ্ঠী গড়ে তোলে মুনাফার অনতিক্রিম্য পাহাড়। সবকিছু থেকেই মুনাফা নির্ভর যে ব্যবস্থা বিশ্বজুড়ে এই পরিস্থিতির মূলে, আর কবে আমরা দাঁড় করাবো তাকে উদ্যত প্রশ্নের মুখে?