বাংলাদেশের একজন বামপন্থী ব্যক্তিত্বের চোখে ১৭ নভেম্বর

১৫ নভেম্বর ঢাকা থেকে সরাসরি চালু হওয়া মৈত্রী ট্রেনে কলকাতা গিয়েছিলাম রুশ বিপ্লবের শতবর্ষ উদযাপনে এস ইউ সি আই (সি) দলের বিশাল সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অতিথি হয়ে৷ ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে নির্দিষ্ট সময় সকাল ৭টা ২০ মিনিটে ট্রেন ছাড়ে এবং একটানা চলে৷ গেদে সীমান্তে ট্রেনের ইঞ্জিন পরিবর্তন করে সরাসরি চিৎপুর স্টেশনে বিকেল সাড়ে চারটের সময় পৌঁছে যাই৷ ওই দিন স্টেশনের কম্পিউটার সার্ভার বিগড়ে দীর্ঘ দুই ঘন্টা সকল যাত্রীকে লম্বা লাইনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়৷ এরপর ইমিগ্রেশন শেষে কাস্টমস অতিক্রমেই ঘটে বিপত্তি৷ সঙ্গে ‘নতুন দিগন্ত’ পত্রিকার কিছু কপি নিয়েছিলাম, সেখানকার বন্ধুদের দেবার অভিপ্রায়ে৷ কাস্টমস কর্তৃপক্ষ পত্রিকা নেবার অনুমতিপত্র দেখাতে বলেন৷ যতই বলি এগুলো উপহারস্বরূপ নিয়ে যাচ্ছি, ততই আমাকে নানা আইনি–যুক্তিতে নাজেহাল করতে উঠে–পড়ে লাগে৷ অগত্যা আমাকে একটি ছোট কক্ষে নিয়ে গিয়ে সমঝোতার প্রস্তাব দেয়৷ হতবাক হলেও আমি যে পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সে কথা সচেতনভাবে গোপন রাখি৷ পরিচয় প্রকাশে আরও ঝামেলা হবে সেটা আঁচ করতে পেরেছিলাম৷ আমার কাছে নির্লজ্জভাবে টাকা চেয়ে সমাধানের সহজপথ বলে দেয় তারা৷ অগত্যা টাকা দেওয়া মাত্র একপ্রকার মুক্তি ঘটে আমার৷ একই অভিজ্ঞতা হয়েছে কলকাতা থেকে কিছু বই নিয়ে আসার বেলায়ও বাংলাদেশের কাস্টমসে৷ আমাদের দুই দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের নানা কথামালা, দৃশ্যমানতা প্রচার হয়৷ সাংস্কৃতিক বিনিময়ও ঘটে৷ কিন্তু বই নিয়ে দুই দেশের কাস্টমস কর্তৃপক্ষের তুঘলকি কীর্তি নিয়ে দুই রাষ্ট্রের কোনও  নিয়মনীতি–নির্দেশন না থাকার সুযোগে দুই দেশের কাস্টমসে নাজেহাল হতে হয় অসহায় বই আনা–নেওয়া যাত্রীদের৷ ব্যক্তিগত বই আনা–নেওয়ার বিষয়টির আশু মীমাংসা জরুরি৷ এতে সাংস্কৃতিক যোগাযোগের সুফল লাভ সম্ভব হবে দুই দেশের মানুষেরই৷

চিৎপুর স্টেশনের বাইরে এসে দেখি বৃষ্টি৷ আমাদের নিতে আসা এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) নেতৃবৃন্দ জানালেন বৃষ্টি আরও তিনদিন থাকবে৷ অর্থাৎ ১৭ তারিখ তাঁদের মহাসমাবেশের দিনেও বৃষ্টি থাকবে৷ আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে তেমন ঘোষণাই এসেছে৷ কলকাতার শহিদ মিনারের মহাসমাবেশ তবে কি বৃষ্টিতে ভেস্তে যাবে এ নিয়ে তাঁদের প্রশ্ন না করলেও তাঁরা যথাসময়ে সমাবেশ করবেন বলেই তাঁদের কথায়–আচরণে বুঝে নিয়েছিলাম৷ আমাদের জন্য গাড়ি তৈরি, বিলম্ব না করে গাড়িতে উঠে রওনা হই৷ মিনিট পনেরো বাস যাত্রায় পৌঁছে যাই শোভাবাজার মূল সড়কের পাশে ভারতীয় ধর্মশালা নামক গেস্ট হাউসে৷ বাংলাদেশ থেকে বাসদ (মার্কসবাদী) দলের একশতের অধিক সদস্য–সদস্যা আমন্ত্রিত হয়ে চারতলার বড় পরিসরে ওই গেস্ট হাউসে উঠেছিলেন৷ গেস্ট হাউসে নেমে দেখি আমাদের জন্য জলখাবার অপেক্ষা করছে৷ আমাদের জন্য আতিথেয়তায় নিয়োজিত এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) দলের সার্বক্ষণিক কর্মী–সংগঠকেরা৷ আলাপে জেনেছি কেউ ডাক্তার, কেউ পিএইচডি করছেন, প্রায় সবাই উচ্চশিক্ষা শেষ করেছেন৷ তাঁদের নির্মল আন্তরিকতার যেন শেষ নেই৷ বিনয়ের যেন অন্ত নেই৷ যে ছয়দিন তাঁদের সাহচর্যে ছিলাম তাঁদের উচ্চমাত্রার সাংস্কৃতিক মান প্রত্যক্ষে অভিযুক্ত হয়েছি৷ বিস্মিত হয়েছি নীতিনিষ্ঠ তাঁদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে৷

১৬ নভেম্বর বিশ্রাম ও বৃষ্টি উপেক্ষা করে কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে বই কিনেছি সদলবলে৷ ঢুকেছি কফি হাউসেও৷ ১৭ নভেম্বর মহাসমাবেশের দিন টানা বৃষ্টি৷ সমাবেশ যথাসময়ে হবে৷ তবে কলকাতার শহিদ মিনার প্রাঙ্গণ (ময়দান) হাঁটু অব্দি জল–কাদার কারণে পাশের রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ের তিন প্রধান সড়কজুড়ে সমাবেশের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে৷ সে ঘোষণা সমাবেশে আগতদের পূর্বেই অবহিত করা হয়েছে৷ পশ্চিমবাংলা, বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড থেকে কৃষকদের পাকা ফসল বৃষ্টির মধ্যে ফেলে না আসার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে৷ সে সমস্যা না থাকা কৃষকরাই যেন সমাবেশে অংশ নেয়, তেমন নির্দেশনা ছিল৷ আমরা সকাল ১১টায় সমাবেশ স্থলে পৌঁছে যাই৷ চারদিক থেকে লালপতাকা–ব্যানার নিয়ে মিছিল আসছে৷ বৃষ্টি উপেক্ষা করে সমাবেশ স্থল স্বল্প সময়ে পরিপূর্ণ হয়ে যায়৷ সমাবেশের শুরুতে সমবেত সঙ্গীত, তারপর কিশোর–কিশোরীদের বাদ্যের তালে ছন্দোবদ্ধ দৃষ্টিনন্দিত কুচকাওয়াজ৷ এরপর নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা৷

আমি সমাবেশ স্থল থেকে বেরিয়ে আশপাশে ঘুরলাম৷ ধর্মতলা, ওয়েলিংটন মোড়, নিউমার্কেট এলাকা সর্বত্র লোকে লোকারণ্য৷ ধর্মতলার উত্তর–দক্ষিণমুখী মূল সড়কটিতে যানবাহন যাওয়া–আসা করছে মাত্র৷ ট্রাফিক পুলিশদের গলদধর্ম অবস্থা৷ মানুষের ভিড়ে চলাচলও কঠিন৷ পরিচয় গোপন করে স্থানীয় হকার, ফেরিওয়ালা, পথচারীদের জিজ্ঞেস করেছি, ‘এই বৃষ্টির মধ্যে মানুষ ভিজে–ভিজে বক্তৃতা শুনছে শীতের বৃষ্টিতে অসুখের ভয় নেই তাদের? প্রত্যেকের কাছে একই উত্তর পেয়েছিলাম৷ ‘দাদা এসইউসিআই–এর সমাবেশ৷ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ দলের সমাবেশে লোক সমাগম হয়৷ ঝড়–বৃষ্টি তো সাধারণ ব্যাপার৷ বাজ পড়লেও এরা সমাবেশ শেষ না করে যাবে না’৷ ছাতা, পলিথিন, গামছা মাথায় দিয়ে কারও নড়চড় দেখিনি৷ গভীর মনোযোগে নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা শুনছে৷ জেনেছি রুশ বলশেভিক বিপ্লবের শতবর্ষ উদযাপনে কলকাতায় অন্য কোনও বামপন্থী দল এত বৃহৎ ও ব্যাপক আয়োজন করতে পারেনি৷ বিকেল ৪টায় সমাবেশ শেষ হয়৷ অর্থাৎ দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টার সমাবেশ৷

১৮ নভেম্বর কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছে, ‘‘ঠিক এক সপ্তাহ আগে একই জায়গায় কেন্দ্রীয় শাসক দলের সমাবেশ ঘিরে প্রচার হয়েছিল বিস্তর৷ বিজেপি–র সেই সভায় গেরুয়া উত্তরীয় গলায় প্রথম প্রকাশ্যে বক্তৃতা করেছিলেন মুকুল রায় (তৃণমূলত্যাগী বিতর্কিত সাংসদ)৷ সেই রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়েই শুক্রবার সমাবেশের বহরে বিজেপিকে টেক্কা দিয়ে গেল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)৷ যাদের হাতে ক্ষমতা দূরে থাক, রাজ্যে এখন একজন বিধায়কও নেই৷ নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষ উপলক্ষে এদিন এস ইউ সি আই(সি)–র সমাবেশে বক্তা ছিলেন প্রভাস ঘোষ,  মানিক মুখোপাধ্যায়, বাংলাদেশের মুবিনুল হায়দার চৌধুরী প্রমুখ৷ রানি রাসমণির তিনটি লেন ছাপিয়ে ভিড় ছিল ডোরিনা ক্রসিং, রেড রোড, ধর্মতলা সহ বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে৷ নিবিড় প্রচারে এবং তার পরে সমাবেশের চেহারা দেখে তৃপ্ত বহু বাম কর্মী–সমর্থকেরা’’৷ আনন্দবাজার পত্রিকার রাজনৈতিক অবস্থান কংগ্রেস সমর্থিত৷ বাম বিরোধিতায় তাদের জুড়ি নেই৷ কংগ্রেস সমর্থিত এই পত্রিকা পশ্চিমবঙ্গের সর্বাধিক পাঠক প্রিয়৷ অথচ পত্রিকাটি সমাবেশের প্রকৃত চিত্রটি সংক্ষিপ্ত আকারে হলেও প্রকাশ করেছে৷ অন্যভাবে বলা যায় বাধ্য হয়েছে৷

১৮ নভেম্বর কলকাতার সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান৷ পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বিহার, ওড়িশা, দিল্লি, কর্ণাটক, অন্ধ্রসহ বিভিন্ন ভাষার সঙ্গীত, নাটক, নৃত্যসহ নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়৷ বাংলাদেশের চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গণসঙ্গীত, রুশ বিপ্লবের ওপর বিভিন্ন নতুন নতুন গান পরিবেশন করে প্রশংসা কুড়িয়েছে৷ জীবন অভিজ্ঞতায় এ যাত্রায় নতুন অনেক বিষয় দেখা ও জানার সুযোগ হয়েছে৷ দলটির নেতৃবৃন্দ–কর্মীদের সান্নিধ্যে তাঁদের উচ্চতর রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাক্ষাৎ লাভ করেছি৷ যেটা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে মেলানো যাবে না৷ তাঁদের আতিথ্যে আবেগ–উচ্ছ্বাস ছিল না৷ ছিল মতাদর্শিক রাজনৈতিক দৃঢ় অঙ্গীকার৷ আবেগ হঠাৎ জ্বলে ওঠে আবার হঠাৎ মিলিয়ে যায়৷ কিন্তু রাজনৈতিক আদর্শবাদিতা ধারাবাহিক ভাবে গড়ে ওঠে৷ সেটা সহজে নিভে যাওয়ার নয়৷ সহযোদ্ধা কমরেডের প্রতি তাঁদের সহজাত সম্প্রীতি পুরোটাই মতাদর্শিক রাজনৈতিক শিক্ষা–অনুশীলনের মধ্য দিয়ে অর্জিত৷ তাঁদের উচ্চ মাত্রার সংস্কৃতি যে–কাউকে মুগ্ধ করবে৷ বাংলাদেশ থেকে আগত একশত জনের এই বহরে একমাত্র আমি ছাড়া সবাই (মার্কসবাদী) দলভুক্ত৷ তাই নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ আমার পক্ষে সহজ হয়েছে৷

সোস্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অফ ইন্ডিয়া (কমিউনিস্ট) দলটির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত কমরেড শিবদাস ঘোষ৷ তিনি ঢাকার কেরানিগঞ্জের সন্তান৷ ১৯৪৮ সালে তাঁর নেতৃত্বেই দলটির জন্ম৷ মার্কসবাদী–লেনিনব ধারায় দলের অনুশীলনে নানা পদ্ধতি অনুসরণে দলের ভিত গড়ে তুলেছেন৷ তাঁর চিন্তাধারায় আজও দলটি পরিচালিত হয়ে আসছে৷ সর্বভারতীয় দলে পরিণত দলটি বাম–প্রগতিশীল ধারায় ক্রমান্বয়ে এগিয়ে চলেছে৷ দলের মধ্যে যে শৃঙ্খলা দেখেছি সেটা হঠাৎ রেজিমেন্টাল ডিসিপ্লিন মনে হবে, আসলে তাঁদের শৃঙ্খলা আরোপিত নয়, শতভাগ স্বতঃস্ফূর্ত রাজনৈতিক চেতনায় শাণিত৷ ব্যক্তিমালিকানার বিপরীতে সামাজিক–যৌথমালিকা প্রতিষ্ঠায় দলের অভ্যন্তরে তাঁরা চর্চা জারি রেখেছেন৷ সার্বক্ষণিক উচ্চশিক্ষিত সংগঠক–কর্মীরা পৃথক পৃথক মেসে একত্রে থাকেন৷ স্কুল–কলেজের ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়ে তাঁরা থাকা–খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে থাকেন৷ বিভিন্ন শ্রেণি ও পরিবার থেকে আসা প্রত্যেকে প্রত্যেকের সাথে রাজনৈতিক সামাজিক বন্ধনে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত৷ পারিবারিক জীবনে উত্তরাধিকার সম্পত্তি নিয়ে নানা টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়৷ সম্পর্ক–সম্প্রীতির অবনতি ঘটে৷ তাঁরা সম্পত্তি দলের জিম্মায় উৎসর্গ করে শ্রেণিচ্যুত হয়ে মেস জীবনে সামষ্টিক সামাজিকতার এক অন্যন্য আদর্শিক ভুবন গড়ে তুলেছেন৷

সাম্প্রতিক সময়ে সিপিএম, সিপিআই, ফরওয়ার্ড ব্লক, এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) সহ ছয়টি বামপন্থী দল ঐক্যবদ্ধ হয়েছে৷ যদি তাঁরা পরস্পরের প্রতি আস্থা–মর্যাদা এবং নীতিনিষ্ঠতার পরিচয় দিতে পারে তবে পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে তাদের রোখা বুর্জোয়া এবং সাম্প্রদায়িক দলসমূহের পক্ষে সহজ হবে না৷ এই ছয় দলীয় ঐক্য ধরে রাখার ওপরই অবশ্য সেটা নির্ভর করছে৷

মযহারুল ইসলাম বাবলা

‘সপ্তাহের বাংলাদেশ’ সাপ্তাহিক থেকে, ৩০ নভেম্বর ২০১৭