বহু ভাষাভাষী ভারতে কোনও একটি ভাষা চাপিয়ে দেওয়া চলে না

মূল্যবৃদ্ধি বেকারি আর চরম দুর্নীতি–এই তিন জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে চিন্তিত দেশের জনসাধারণ। অন্য দিকে কেন্দ্রীয় সরকার নাকি সর্বদা চিন্তিত জাতীয় ঐক্য ও দেশভক্তির অভাব নিয়ে। তাই এক জাতি-এক ধর্ম-এক ভাষা তথা হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান অ্যাজেন্ডাটি সম্প্রতি আরেকবার ভালো করে খুঁচিয়ে তোলার চেষ্টা হয়েছে। এবার প্রসঙ্গ ভাষা। সম্প্রতি ভাষা সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির ৩৭তম অধিবেশনে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, তিনি তথা কেন্দ্রীয় সরকার চায় দেশের অহিন্দিভাষীরা অন্য ভাষার মানুষের সাথে বিদেশি ইংরেজিতে নয় স্বদেশি হিন্দিতে কথা বলুন। অর্থাৎ প্রথম ভাষা বা মাতৃভাষা যাদের হিন্দি নয় তাদের সকলেরই অন্তত দ্বিতীয় ভাষা হিন্দি হতে হবে।

সরকারি হিসেব বলছে, ভারতে ১৩০ কোটি মানুষের মাতৃভাষা কয়েক হাজার। এককভাবে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ হিন্দি ভাষাতে কথা বলেন, এ কথা সত্য। আবার এ কথাটিও সত্য যে অ-হিন্দিভাষী মানুষের সংখ্যা হিন্দিভাষীদের প্রায় তিন গুণ। ২০১১ সালের জনগণনা রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে ৩৫টি রাজ্যের মধ্যে ১২টির প্রথম পছন্দের ভাষা হিন্দি। বাকি ২৩টি রাজ্যের অধিকাংশ মানুষ অ-হিন্দিভাষী। যদিও হিন্দি বলতে ৫৬টি স্থানীয়ভাষা বা ডায়লেক্ট যেমন আওধি, মাঘাই, মৈথিলী, ভোজপুরি, রাজস্থানী ইত্যাদিকে একসঙ্গে ব্যাপকতর অর্থে হিন্দি বলে ধরে নিলে হিন্দিতে কথা বলা মানুষ দেশের ৪৩ শতাংশ বা ৫৩ কোটি। আর বাস্তবে হিন্দি ভাষা বলতে যা বোঝায়, তা ২৬ শতাংশ বা ৩১ কোটি মানুষের মাতৃভাষা। বাকি ৭৪ শতাংশ বা প্রায় ১০০ কোটি ভারতবাসী অ-হিন্দিভাষী। দেশের অ-হিন্দিভাষী ভিন্ন ভিন্ন ভাষা গোষ্ঠীর এই ১০০ কোটির কাছাকাছি মানুষকে অন্য ভারতীয় ভাষাভাষিদের সাথে কথোপকথনের জন্য শুধু হিন্দিকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে বলার অর্থ বাংলা, ওড়িয়া, তামিল, তেলেগু, কন্নড়, মালায়ালাম ইত্যাদি ভাষাভাষী মানুষ ভিন্ন ভাষার মানুষের সাথে কথা বলবেন কেবলমাত্র হিন্দিতে। ইংরেজি একেবারেই বর্জনীয় হবে!

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হিন্দিকে পরোক্ষে ‘জাতীয় ভাষা’ করে তুলবার চেষ্টার এই মন্তব্যকে ঘিরে হিন্দিভাষী মানুষের প্রবল জনসমর্থন সরকার আশা করেছিল। কিন্তু তাঁদের এ নিয়ে তেমন কোনও উন্মাদনা বা ভাবান্তর লক্ষ করা যায়নি। অন্য দিকে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই সারা দেশে হিন্দি, অহিন্দিভাষী নির্বিশেষে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এই প্রস্তাব, পরিকল্পনা বা অভিসন্ধির প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এবং বিশেষ করে অহিন্দিভাষী দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে প্রবল প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে এর বিরুদ্ধে। বিরোধিতা এসেছে আসাম মণিপুর সহ উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি থেকেও।

বিজেপি বিষয়টিকে নিয়ে উন্মাদনা তৈরি করতে বদ্ধপরিকর। অহিন্দিভাষী রাজ্যগুলির স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে তাই তারা প্রবল আক্রমণাত্মক। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের বিরুদ্ধ সমালোচনাকে দেশবিরোধী, জাতীয় ঐক্যবিরোধী বলে দাগিয়ে দেওয়ার সংগঠিত প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে পুরোদমে। এই প্রচারে বিজেপির সাথে কেন্দ্রীয় সরকারের বশংবদ সংবাদমাধ্যমগুলিও সামিল। এ ছাড়াও সক্রিয় আইটি সেল, ট্রোল বাহিনী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের বিরুদ্ধে যে কোনও সমালোচনাকে তীব্র আক্রমণ করা হচ্ছে, এমনকি উস্কে দেওয়া হচ্ছে হিংসার প্ররোচনাকেও।

নানা অজুহাতে হিন্দিকে সারা দেশের মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা এবং অহিন্দিভাষী মানুষের তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার ঠিক পরে দেশের সংবিধান রচনার জন্য যে কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি বা সংবিধান সভা গঠিত হয়েছিল সেখানেও এ নিয়ে প্রবল উত্তপ্ত বিতর্ক হয়েছিল। প্রশ্ন ছিল, পূর্ববর্তী ব্রিটিশ সরকারের ব্যবহৃত সরকারি ভাষা বা অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ স্বাধীন ভারতে অপরিবর্তিত থাকবে, নাকি এর পরিবর্তন করে হিন্দিকেই সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হবে। এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে মতবিরোধের জন্য এমনকি সংবিধান সভা ভেঙে যাওয়ার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। এই বিস্ফোরক দ্বন্দে্বর পেছনে নিহিত ছিল জাত-পাত, ধর্ম, বর্ণ, প্রদেশ, ভাষা ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে একটি সুসংহত জাতি গঠনের পথে অসংখ্য সংকীর্ণতা এবং অমীমাংসিত বিরোধ। ছিল সদ্য ক্ষমতাসীন জাতীয় পুঁজিপতি শ্রেণির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও।

এখানে মনে রাখা দরকার ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে এ দেশে জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি ক্ষমতা দখল করেছিল। এই শাসকরা ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যে ছিল নিজেদের স্বার্থে। তাদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সতর্ক রক্ষণশীল এবং আপসপন্থী। ধর্ম-বর্ণ জাতপাত প্রদেশ ও আঞ্চলিক সংকীর্ণতার সাথে তারা আপস করেছেন। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ঐতিহ্যবাদকে মেলানোর চেষ্টা করেছেন। ধর্মনিরপেক্ষ, বৈজ্ঞানিক মননের ভিত্তিতে সামাজিক রাজনৈতিক শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আপসহীন সংগ্রামকে তারা দেখেছেন অত্যন্ত ভয়ের চোখে। এ ধরনের আন্দোলনকে হয় বাধা দিয়েছেন না হলে এড়িয়ে চলেছেন। কারণ তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন, জাতপাত ধর্মের সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ, সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা, নারী-পুরুষের সমানাধিকারের দাবিতে সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভিত্তিতে দেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম পরিচালিত হলে তা তাঁদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।

ভারতে স্বাধীনতা যখন দোরগোড়ায় তখন সারা বিশ্বে পুঁজিবাদী অর্থনীতি চরম সংকটগ্রস্ত। বাজার নিয়ে কাড়াকাড়ির পরিণামে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি দ্বিতীয় বার বিশ্বযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। তার দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে বিশ্ব পুঁজিবাদের আরও গভীরতর সংকট। অন্য দিকে এর আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে শোষণহীন রাষ্ট্র সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রকে দেখে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো এ দেশের মানুষেরও উন্নততর জীবনের প্রতি গভীর আবেগ ও আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। এ দেশেও সম্ভাব্য বিপ্লবের আতঙ্কে চরম আতঙ্কিত ছিল জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি। সুভাষচন্দ্রের আপসহীন সশস্ত্র জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে যে কোনও উপায়ে প্রতিহত করার অপচেষ্টার কারণ নিহিত ছিল এই টানাপোড়েনের মধ্যেই। আমরা সকলেই জানি এই অনিরসনীয় দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণিই জয়লাভ করেছিল। সক্ষম হয়েছিল রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তগত করতে। পরিণামে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সমাজ গঠন তথা বহু ভাষা সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্যপূর্ণ একটি সুসংবদ্ধ শক্তিশালী জাতি গঠনের প্রক্রিয়া অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছিল এ দেশে। যুক্তিবাদী ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার ভিত্তিতে ধর্মীয় অন্ধতা গোঁড়ামি সহ যে কোনও রকমের সংকীর্ণতা, কূপমণ্ডুকতা থেকে মুক্তির সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে এড়িয়ে যাওয়ার পরিণামে সদ্য স্বাধীন ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে থেকে গেল জাতপাত ধর্ম বর্ণ ভাষা প্রদেশ ইত্যাদিকে ভিত্তি করে বিরোধের বীজ। বৃহৎ জাতি-ধর্ম ভাষাগোষ্ঠীর আধিপত্যের মানসিকতা আর অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র বা দুর্বল গোষ্ঠীর আত্মরক্ষার তাগিদ। শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির হাতে যে বিরোধ রাজনৈতিক স্বার্থে শোষিত মানুষের ঐক্যকে ভাঙার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে পরবর্তীকালে।

উল্লিখিত সংবিধান সভায় হিন্দি বলয়ের প্রভাবশালী সদ্য ক্ষমতাসীন জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি তাদের একজন শীর্ষস্থানীয় প্রতিনিধি পুরুষোত্তম দাস ট্যান্ডনকে সামনে রেখে সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছিল যাতে হিন্দি জাতীয় ভাষা না হলেও অন্তত একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। যুক্তি দেওয়া হয়েছিল, ইংরেজি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের ভাষা। সেই ইংরেজিকে স্বাধীন ভারত যেন সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ না করে। তিনি অ্যাসেম্বলিতে আকূল আবেদন করেছিলেন যে জাতীয় ঐক্যের কথা ভেবে কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির সদস্যরা অন্তত এইটুকু মেনে নিন। কট্টর দক্ষিণপন্থী এই নেতার সেদিনের এই দাবির পিছনে নিহিত ছিল হিন্দি বলয়ের বৃহৎ পুঁজিপতিদের সারা দেশে রাজনৈতিক আধিপত্যের প্রবল আকাঙক্ষা। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের প্রতিস্পর্ধী পুঁজিপতিদের হিন্দি বলয়ের বৃহৎ পুঁজিপতিদের প্রতি আনুগত্যই তাঁদের কাছে জাতীয় ঐক্যের সমার্থক ছিল। হিন্দিকে জাতীয় কিংবা একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে মেনে নেওয়া ছিল সেই ঐক্য রক্ষা অথবা আনুগত্যের নিদর্শন। কিন্তু অন্যান্য রাজ্যের প্রতিনিধিরা সঙ্গত কারণেই তা মানেননি।

স্বাধীন ভারতের শাসক শ্রেণি ইংরেজিকে সাম্রাজ্যবাদীদের ভাষা হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা প্রথম থেকেই করেছে। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে, ইংরেজি ভাষার হাত ধরেই এদেশের বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও শিল্প কলকারখানার বিকাশ। আধুনিক গণতান্ত্রিক ধারণা ও উন্নত সামাজিক ব্যবস্থা ও জীবনের প্রতি জনগণের আকর্ষণ। তাকে ভিত্তি করে স্বাধীনতা লাভের স্পৃহা। এক কথায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম শক্তিশালী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় ইংরেজি ভাষার অবদান অবিস্মরণীয়। ইংরেজি ভাষা চর্চার গুরুত্ব অনুধাবন করেই আমাদের দেশে রামমোহন বিদ্যাসাগর প্রমুখ মনীষী শিক্ষায় ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রবর্তনের জন্য প্রাণপাত পরিশ্রম করেছিলেন। ইংরেজি যেমন ব্রিটিশ শাসকদের ভাষা ছিল তেমনি সেই সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের তেজ অনুপ্রেরণা এবং ভাবগত ভিত্তি গড়ে উঠেছিল ইংরেজি ভাষা তথা পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মধ্য দিয়েই। এই ঐতিহাসিক ঘটনা মা’র্বাদের ভাষা সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে যে, ভাষার নিজস্ব কোনও শ্রেণিচরিত্র নেই। একই সাথে একটি ভাষা একটা সমাজের শাসক এবং শাসিত উভয় শ্রেণির চিন্তাকে প্রকাশ করতে পারে।

বিশেষ কোনও ভাষার সাথে বিশেষ কোনও ধর্মেরও কোনও সম্পর্ক নেই। ভাষাকে ধর্ম সম্প্রদায় ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত করা, কোনও একটি ভাষাকে অন্য ভাষাভাষী মানুষের উপরে চাপিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে বিদ্বেষের বাতাবরণ তৈরি করার জন্য কোনও ভাষার নিজস্ব কোনও বৈশিষ্ট্য কখনওই দায়ী নয়। প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী ভাষাকে ব্যবহার করে এ ধরনের কাজ করে। ইংরেজিকে সাম্রাজ্যবাদের, উর্দুকে মুসলমানের কিংবা হিন্দিকে হিন্দুর ভাষা হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া সেই অপকর্মের একটি দৃষ্টান্ত মাত্র।

কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে সে দিন প্রশ্ন উঠেছিল, ইংরেজি ভাষাকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষের সমাজ অর্থনীতিতে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় শিল্পসাহিত্যে যে সম্পদ সৃষ্টি হয়েছে, তাকে কি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্টি বলা উচিত? সেই উত্তরাধিকারকে স্বাধীন ভারতবর্ষ গ্রহণ করবে কি করবে না। পুরুষোত্তমদাস ট্যান্ডন যখন জাতীয় ঐক্যের ধুয়ো তুলে ইংরেজিকে বিদায় করার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন তখন তাঁকে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ বলেছিলেন, দেশের উত্তর ও দক্ষিণের ঐক্য সম্ভব হয়েছে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে। যদি আজ আমরা ইংরেজিকে ত্যাগ করি তা হলে উত্তর দক্ষিণে এই ভাষাগত আদান প্রদানের সম্পর্কটি শেষ হয়ে যাবে। অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে ইংরেজিকে না রাখলে দক্ষিণ ভারতের সাথে উত্তর ভারতের ঐক্যবদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্বই অসম্ভব হয়ে পড়বে। বর্তমানে বিজেপি কি ঐক্যবদ্ধ যুক্তরাষ্টে্রর অস্তিত্বকে বিপন্ন করার সেই কাজটিই করতে চাইছে?

যাই হোক সেই বিতর্ক সামাল দিতে শেষ পর্যন্ত একটি সমাধানসূত্র বের করা হয়। সিদ্ধান্ত হয় যে সংবিধান প্রবর্তিত হওয়ার ১৫ বছর পর্যন্ত হিন্দির সাথে ইংরেজি যেমন সরকারি ভাষা ছিল তেমনই থাকবে। পরে পার্লামেন্ট ইংরেজির বিকল্প সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। তখনকার মতো বিষয়টিকে ধামাচাপা দিলেও হিন্দি বলয়ের প্রভাবশালী বুর্জোয়া শ্রেণি তাদের স্বার্থে সারা দেশের উপর হিন্দি ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার পরিকল্পিত ও ধারাবাহিক চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। এরপর ১৯৫১ সালে ভাষা সুমারির সময় সরকারি তরফে একটি কৌশল অবলম্বন করা হয়। প্রথম ভাষার সাথে দ্বিতীয় পছন্দের ভাষা হিসেবে সকলকে ইংরেজি এবং উর্দু বাদ দিয়ে একটি দেশীয় ভাষার উল্লেখ করতে বলা হয়। ফলে ভাষা-সুমারির কৌশলী পরিসংখ্যানে প্রথম ও দ্বিতীয় পছন্দের ভাষা হিসেবে হিন্দি সবার উপরে উঠে আসে। এর পর কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির পনের বছর অতিক্রান্ত হওয়ার ঠিক আগেই জওহরলাল নেহেরু সরকার আবার হিন্দিকে ইংরেজির বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব আনে। দেশের অহিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতে বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে এর বিরুদ্ধে পুনরায় প্রবল প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এই প্রস্তাবের প্রতিবাদে তামিলনাড়ুতে এমনকি গায়ে আগুন দিয়ে আত্মাহুতির ঘটনা পর্যন্ত ঘটে। এবারও দেশব্যাপী প্রতিবাদের সামনে পিছু হটে শেষ পর্যন্ত সরকার তার প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয়। পার্লামেন্টে ‘অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাক্ট -১৯৬৩’ পাস হয়। হিন্দির পাশাপাশি ইংরেজিকেও সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। রাজ্যগুলিকে স্বাধীনতা দেওয়া হয় এক বা একাধিক ভাষাকে রাজ্যের সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার। নেহেরু দেশবাসীকে নিশ্চয়তা দিতে বাধ্য হন যে দেশের অহিন্দিভাষী মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইংরেজির পরিবর্তে হিন্দি ভাষাকে গ্রহণ করার ইচ্ছা না প্রকাশ করলে তাদের উপর হিন্দিকে চাপিয়ে দেওয়া হবে না।

কাগজে-কলমে চাপিয়ে না দেওয়ার কথা বলা হলেও হিন্দি ভাষাকে জনপ্রিয় করে তুলবার জন্য নানা প্রকল্পে অঢেল আর্থিক বরাদ্দ করা, রেডিও টিভি সংবাদ মাধ্যম সিনেমা ধারাবাহিক ইত্যাদিকে কাজে লাগিয়ে, কংগ্রেস জনতা বিজেপি, যে দলেরই হোক কেন্দ্রীয় সরকার কখনো সরাসরি কখনো নানা কৌশলে হিন্দিকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে যেতে থাকে। বর্তমান বিজেপি আরএসএস পরিচালিত সরকার ক্ষমতায় আসার পর হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান অ্যাজেন্ডা কার্যকর করার লক্ষ্যে এই প্রচেষ্টা অত্যন্ত আগ্রাসী রূপ গ্রহণ করছে। ২০১৭ সালে বিজেপি আরএসএস নেতা তথা দেশের উপরাষ্ট্রপতি বেঙ্কাইয়া নাইডুর প্রকাশ্য একটি বত্তৃতায় হিন্দিকে জাতীয় ভাষা হিসেবে উল্লেখ করা, ২০১৮ সালে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক থেকে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে সমস্ত বিভাগের স্নাতক স্তরে হিন্দিকে অবশ্যপাঠ্য করার নির্দেশ পাঠানো, ২০১৯ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষ থেকে হিন্দিকে জাতীয় ভাষা হিসেবে উল্লেখ করা, সম্প্রতি নবম শ্রেণি পর্যন্ত হিন্দিকে আবশ্যিক হিসেবে পড়ানোর নির্দেশ ইত্যাদি একের পর এক পদক্ষেপ তার দৃষ্টান্ত। এরই ধারাবাহিকতায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বর্তমান ঘোষণা।

সরকারি এই অতি তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দিভাষী আমজনতার কিছুটা নিস্পৃহ প্রতিক্রিয়া কিন্তু অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আসলে মূল্যবৃদ্ধি বেকারত্বের সমস্যা বা দুর্নীতি সারা দেশের মতো প্রতিটি হিন্দিভাষী মানুষেরও দৈনন্দিন জীবনের প্রধান সমস্যা। অন্য রাজ্যের মতো হিন্দি ভাষাভাষী ছাত্র উচ্চশিক্ষায়, গবেষণায়, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার সায়েন্স, ইনফরমেশন টেকনোলজি ইত্যাদিতে যারা পাঠরত কিংবা একটা উপযুক্ত কর্মসংস্থানের লক্ষ্য সামনে রেখে যাঁরা লড়াই করে যাচ্ছেন সেই সব যুবক, তাঁদের শিক্ষক-অভিভাবকরা সকলেই বাস্তবটা জানেন। তাঁরা ভাল করেই জানেন এসব ক্ষেত্রে হিন্দির পাশাপাশি ইংরেজি না জানা থাকলে তাঁদের চলে না, ইংরেজি শিক্ষার থেকে দূরে সরিয়ে রাখলে তাঁদের বঞ্চিতই করা হবে। সরকার হিন্দির জন্য যত উত্তেজনাই তৈরি করার চেষ্টা করুক বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে ইংরেজির গুরুত্ব খাটো করার মধ্যে তাঁরা উৎসাহিত হওয়ার মতো কিছু পাচ্ছেন না।

ভারতের একটা বিরাট অংশের মানুষ ইংরেজিকে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছেন। অনেকের মাতৃভাষাও ইংরেজি। শুধু তাই নয়, হিন্দি ভাষাকে যে কোনও উপায়ে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য নানা চেষ্টা সত্তে্বও প্রয়োজনের অনিবার্য তাগিদেই আজও আমাদের দেশের সমস্ত আদালত, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, রাজ্য কিংবা কেন্দ্রের আইনসভাগুলির নথিপত্র ইংরেজিতেই লিখিত ও সংরক্ষিত হয়। দেশের রাজ্য সরকারগুলির এবং কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের মধ্যে নানা প্রশাসনিক নথিপত্রের আদান-প্রদানের ভাষাও অবশ্যই ইংরেজি। ইংরাজিকে ভারতীয় ভাষা হিসেবে মেনে নিয়েই আমাদের দেশের সাহিত্য অ্যাকাডেমি প্রতি বছর এই ভাষায় লিখিত ভারতীয় সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্মকে অ্যাকাডেমি পুরস্কারে পুরস্কৃত করে থাকে।

আশ্চর্যের কথা শুধু আজকের বিজেপি সরকারই নয়, স্বাধীন ভারতের সমস্ত শাসকরাই ইংরেজি বিদেশি ভাষা এই অজুহাত তুলে ইংরেজি শিক্ষার বিরোধিতা করেছেন। এ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের স্মরণে না এসে পারে না যে, এখানেও সিপিএম ফ্রন্ট সরকারের ক্ষেত্রেও এর কোনও ব্যতিক্রম হয়নি। নানা অজুহাতে ইংরেজি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত তারাও কার্যকর করেছিল। প্রাথমিকে ইংরেজি তুলে দেওয়ার সর্বনাশা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনায় ‘শিক্ষা সংকোচন বিরোধী ও স্বাধীকার রক্ষা কমিটি’ গড়ে ওঠে। সুকুমার সেন, প্রমথনাথ বিশি, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুশীল মুখার্জীর মতো বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা এই আন্দোলনে অংশ নেন। দীর্ঘ দু’দশক ধরে লাগাতার আন্দেলানের চাপে সরকার তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। কিন্তু ততদিনে এ রাজ্যে শিক্ষার সামগ্রিক মানের যে অবনমন ঘটেছিল তার প্রভাব এ রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

আজ সারা বিশ্বের সাথে যোগাযোগের গ্রহণযোগ্য ভাষা হিসেবে, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতে প্রবেশের মাধ্যম হিসেবে ইংরেজির গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রযুক্তির জগৎ ইংরেজি ছাড়া অচল। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে ব্যাপক উন্নতির কারণে বাঙ্গালোরকে ভারতের আইটি ক্যাপিটাল বলা হয়, সেটা সম্ভব হয়েছে ইংরেজির কারণেই। ইংরেজির এই অপরিহার্য গুরুত্বের কথা চিন, জাপান, জার্মানির মতো উন্নত দেশগুলিও স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছে। অহিন্দি ভাষাভাষী মানুষ তো বটেই এমনকি হিন্দি ভাষাভাষী মানুষের কাছে ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা আসলে তাদের যথার্থ ক্ষমতায়ন থেকে, উন্নত চিন্তা ভাবনা শিক্ষার সুযোগ, বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগ এবং উন্নত জীবন জীবিকার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে রাখা। ভাষা আধিপত্যের উন্মাদনা তৈরি করে সরকার আসলে হিন্দিভাষী জনসাধারণকে অন্ধকারের দিকেই ঠেলে দিতে চাইছে

বেকারি আর দারিদ্রের তাড়নায় কাজের খোঁজে বিপুল সংখ্যক হিন্দিভাষী যুবককে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিতে হয়। সেই ভিন রাজ্যের মানুষের সাথে অন্তত কাজের কথা আদান প্রদানের জন্য পরস্পরের ভাষা জানার চেষ্টা করতে হয়। অহিন্দি ভাষাভাষীরা হিন্দি বোঝার চেষ্টা করেন। হিন্দিভাষী বোঝার চেষ্টা করেন বাংলা, মালয়ালম বা অন্য কোনও সংশ্লিষ্ট রাজ্যের ভাষা। শ্রমজীবী মানুষের এই আদান-প্রদানের মধ্যে সাধারণভাবে কোনও রেষারেষির ব্যাপার থাকে না। ইংরেজির মতো একটি ভাষা জানা থাকলে উভয়েরই সুবিধা হয়, আবার নিজেদের ভাষায় আদানপ্রদান মাধ্যমে দু’জনে সমৃদ্ধ হন। কিন্তু সেই ভিন রাজ্যের মানুষদের ‘হিন্দিতেই কথা বলতে হবে’ এ রকম ফরমান জারি হলে এই স্বাভাবিক সম্পর্কের অপূরণীয় ক্ষতির সম্ভাবনা। সাম্প্রতিক অতীতে মহারাষ্টে্রর মারাঠিভাষী কিছু মানুষের দ্বারা উত্তরপ্রদেশের হিন্দিভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর আক্রমণ ও হেনস্থার ঘটনা এই ক্ষতিরই একটা জ্বলন্ত নিদর্শন। কাজেই, হিন্দি ভাষার সরকারি ফরমানের পর দক্ষিণ ভারতের মানুষের ক্ষোভের মধ্যে সঙ্গতভাবেই বিপদের সিঁদুরে মেঘ দেখছেন হিন্দি বলয়ের পরিযায়ী শ্রমিকরা। আর বিজেপি দেখছে তার ভোট রাজনীতির স্বার্থ।

আমাদের দেশে বেকার সমস্যার প্রবল চাপে কোটি কোটি যুবক কাজের সন্ধানে সারা দেশে ঘুরে বেড়ান এ কথা সকলের জানা। ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ভারতীয় রেলওয়ের তরফে প্রায় ৯০ লক্ষ দূরপাল্লার যাত্রী, যারা ২০০ কিমির বেশি দূরত্ব কাজের খোঁজে অসংরক্ষিত কামরায় চড়ে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যাতায়াত করেছেন, তাদের উপর একটি সমীক্ষা চালানো হয়। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে কাজের খোঁজে যেসব রাজ্য থেকে বাইরে যাওয়ার (নেট আউট মাইগ্রেশন) সংখ্যা অন্য রাজ্য থেকে আসার সংখ্যায় (নেট ইন মাইগ্রেশন) তুলনায় অনেক বেশি সেই রাজ্যগুলি সাধারণভাবে অ-হিন্দিভাষী, বহুভাষাভাষী কিংবা হিন্দিভাষী জনসংখ্যা সেখানে ৫০ শতাংশের কম। উদাহরণ তামিলনাড়ূ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক, পাঞ্জাব ও দিল্লি। উল্টো দিক থেকে যেসব রাজ্যে নেট ইন মাইগ্রেশনের তুলনায় নেট আউট মাইগ্রেশনের সংখ্যা অনেক বেশি অর্থাৎ যে সব রাজ্যে যুবকরা কাজের খোঁজে বাইরে থেকে আসার তুলনায় দলে দলে ভিন রাজ্যে কাজের খোঁজে ট্রেনের অসংরক্ষিত কামরায় চড়ে অশেষ কষ্ট সহ্য করে শত শত কোথাও হাজার মাইল পাড়ি দিচ্ছেন কিন্তু বাইরে থেকে আসা কর্মপ্রার্থীর সংখ্যা কম সেই রাজ্যগুলি হল উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, রাজস্থান, উত্তরাখণ্ড, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, ছত্তিশগড় ইত্যাদি হিন্দি ভাষাভাষী রাজ্য। দেখা যাচ্ছে হিন্দি ভাষাভাষীর সংখ্যা যেখানে যত বেশি, পরিযায়ী শ্রমিকদের অন্য রাজ্য থেকে আসার তুলনায় কাজের খোঁজে অন্য রাজ্যে যাওয়ার সংখ্যা সেই রাজ্যে তত বেশি। অর্থাৎ শুধুমাত্র হিন্দিভাষী হওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট হিন্দি ভাষাভাষী রাজ্যগুলির মানুষ শিক্ষাদীক্ষা অর্থনৈতিক অবস্থা জীবনযাত্রার মান কর্মসংস্থানের সুযোগ কোনওদিক থেকেই লাভবান হতে পেরেছেন এমন প্রমাণ কোথাও নেই।

জাতীয় ঐক্যের ধুয়া তুললেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর লক্ষ্য যে নির্বাচনী রাজনীতি এবং ক্ষমতায় টিকে থাকা এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ থাকতে পারে না। হিন্দি ভাষাকে একমাত্র সরকারি ভাষা ঘোষণা করা কিংবা দেশের সকল মানুষকে হিন্দি বলতে বাধ্য করার দ্বারা তারা আসলে হিন্দি বলয়ের ভোটব্যাঙ্ককে আরও শক্তপোক্ত করতে চাইছেন। ২০২৪-এর গোড়ায় দেশের সাধারণ নির্বাচন। এরই মধ্যে গুজরাট, হিমাচল প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ইত্যাদি হিন্দি বলয়ের প্রধান প্রধান কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনও আছে। কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার মনে করছে যে এই প্রস্তাবের দ্বারা হিন্দি ভাষাভাষী এলাকার মানুষের ব্যাপক সমর্থন পাওয়া যাবে। ধর্মের মতো এবার ভাষার প্রশ্নে বিভাজন ও তীব্র মেরুকরণ তৈরি করে তারা নির্বাচনী বৈতরণী পার করবেন। বোঝানো হচ্ছে যে এর দ্বারা হিন্দি ভাষাভাষী মানুষকে আর ইংরেজি বা অন্য কোনও ভাষা শিখতে হবে না। চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে তারা অহিন্দিভাষীদের থেকে এক পা এগিয়ে থাকবেন। এর সাথে উস্কানি দেওয়া হচ্ছে হিন্দিভাষী বৃহৎ জাতিসুলভ গর্ববোধে বা জাতিদম্ভে।

যদিও মূল্যবৃদ্ধি বেকারি আর রাজনৈতিক নেতাদের ভণ্ডামি ও সীমাহীন দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত সাধারণ মানুষের মধ্যে এই উস্কানি তেমন কোনও উন্মাদনা তৈরি করতে পারছে এমন নয়। এমনকী হিন্দিভাষীদের কোনও অতিরিক্ত উৎসাহ-উদ্দীপনাও কিন্তু চোখে পড়েনি। দেশের সমস্ত মানুষ হিন্দিতে কথা বলতে বাধ্য হলে বর্তমানে যারা হিন্দিভাষী সেইসব মানুষের একটা মস্ত উপকার হবে এ কথা আপাতত মনে করছেন না হিন্দিভাষী আমজনতাও। তাই বলে বিজেপি রণে ভঙ্গ দেবে এমন আশা করা বাতুলতা মাত্র। তাদের অ্যাজেন্ডাকে তারা সামনে আনতেই থাকবে নানা বিরোধ, অজুহাত, কুযুক্তি বিভেদ আর বিদ্বেষের বিষকে হাতিয়ার করে। নির্বাচনী দাবা খেলায় কিস্তিমাত করার উদ্দেশ্যে মানুষের জীবনের আসল সমস্যাগুলি থেকে নজর ঘুরিয়ে দেওয়া এবং শোষিত মানুষের মধ্যে বিভাজন ও মেরুকরণ তৈরির এ-ও আর একটা চাল।

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা ১৭ জুন ২০২২