Breaking News

প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল ফেরাতে কেন্দ্র রাজ্যের টালবাহানা আর কতদিন চলবে

ফাইল চিত্র

পরাধীন ভারতের সংসদকক্ষে জোরালো আওয়াজের বোমা নিক্ষেপ করে শহিদ–ই–আজম ভগৎ সিং বলেছিলেন, বধিরকে শোনাতে উচ্চকণ্ঠের প্রয়োজন৷ সেদিন ভারত ছিল ব্রিটিশের পদানত৷ আজ ব্রিটিশরা নেই৷ ক্ষমতায় আসীন দেশীয় শাসকরা৷ একদল কেন্দ্রে, একদল রাজ্যে৷ ঘটনা এটাই, আজকের শাসকরাও আন্দোলনের জোরালো কণ্ঠ, জোরালো দাবি ছাড়া সহজে জনগণের দাবি মেনে নেয় না৷ যেমন ঘটে চলেছে পাশ–ফেল ফেরানো নিয়ে৷

এ ইতিহাস সকলেরই জানা, পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার নীতি বিগত শতকের আটের দশকে প্রথম এ রাজ্যে প্রাথমিক স্তরে চালু করেছিল সিপিএম সরকার৷ ২০১০ সালে শিক্ষার অধিকার আইনের মাধ্যমে তা গোটা দেশে চালু হয়৷ এবার অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত তুলে দেওয়া হয়৷ তখন কেন্দ্রে ছিল কংগ্রেস জোট সরকার৷ এরপর শাসক বদল হয়ে কেন্দ্রে বিজেপি ও রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় বসলেও নীতির কোনও বদল হয়নি৷

শিক্ষায় চরম সর্বনাশ নামিয়ে আনা এই নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের শুরুও সেই প্রথম দিন থেকে৷ একসময় যার নেতৃত্বে ছিলেন ভাষাবিদ সুকুমার সেন, নীহাররঞ্জন রায়, প্রমথনাথ বিশী, অরবিন্দনাথ বসু, সুশীল মুখার্জী, শৈলেশ দে, মানিক মুখার্জীর মতো বরেণ্য মানুষেরা৷ সে আন্দোলন আজও অব্যাহত৷ সমাজের সমস্ত অংশের মানুষের মধ্যে পাশ–ফেল ফেরানোর দাবি আরও জোরদার হয়েছে৷ এর সামনে শাসকরাও বারে বারে তাদের কৌশল পাল্টেছে৷ এবং শেষ পর্যন্ত ব্যাপক জনমত ও আন্দোলনের প্রবল চাপের কাছে নতি স্বীকার করে কেন্দ্র–রাজ্য দুই সরকারই অন্তত মুখে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে, পাশ–ফেল ফিরবে৷

কিন্তু ফিরবে ফিরবে করেও পার হয়ে গিয়েছে কয়েকটা বছর৷ পাশ–ফেল ফিরবে, বিজেপি বলে চলেছে সেই ২০১৫ সাল থেকে৷ অথচ এর জন্য প্রয়োজনীয় সংশোধনী সংসদের দুই সভায় পাশ করাতে তারা তিন বছর কাটিয়ে দিয়েছে৷ আবার সেখানেও চলছে এক মস্তবড় চালাকি৷ শিক্ষা আইনের সংশোধনীতে তারা বলেছে, পাশ–ফেল ফিরবে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে৷ এতে সমস্যা মিটবে?

২০১২ সালে হরিয়ানার তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত রিভিউ কমিটি থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে শিক্ষা নিয়ে যত কমিটি হয়েছে, প্রতিটি কমিটিই তার রিপোর্টে এক বাক্যে বলেছে, প্রাথমিক ও উচ্চপ্রাথমিকে শিক্ষার মান দ্রুত নামছে এবং তার জন্য দায়ী পাশ–ফেল বিসজর্নের নীতি৷ শিক্ষক অভিভাবকসহ সমস্ত শিক্ষানুরাগী মানুষের অভিমতও তাই৷ পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পাশ–ফেল ফিরিয়ে শিক্ষার এই অবনমন ঠেকানো যাবে না৷ তার জন্য দরকার প্রথম শ্রেণি থেকেই পাশ–ফেল প্রথাকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা৷

রাজ্যে তৃণমূল সরকারের ভূমিকাতেও সেই একই চালাকি৷ ২০১৭ সালের ১৭ জুলাই প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল ফেরানোর দাবিতে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর ডাকা এক বনধের পক্ষে অভূতপূর্ব জনসমর্থন দেখে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন, তাঁরাও এই দাবির পক্ষে৷ তাঁরাও চান, প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল ফিরুক এবং পরের শিক্ষাবর্ষ, অর্থাৎ ২০১৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে তাঁরা তা চালু করবেন৷ ২০১৮ সাল চলে গিয়েছে৷ ২০১৯ যেতে বসেছে৷ এখনও তাঁদের ঘুম ভাঙেনি৷

রাজ্যে ইতিমধ্যে বেশ কয়েক হাজার প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক স্কুল ছাত্রের অভাবে বন্ধ এবং বন্ধ হওয়ার মুখে৷ তবুও তাঁদের চেতনা ফেরেনি৷ তাঁরা শুধু সরকারি স্তরে একটা কমিটি করেই দায় শেষ করেছেন৷ এই কমিটি হাতে গোনা কয়েকটা স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের চোখ রাঙিয়েছে এবং পরে সুপারিশ করেছেন, কুড়ির কম ছাত্র হলে সে স্কুল বন্ধ করে দাও এবং সেখানে ইংরেজি–মিডিয়াম স্কুল চালু কর৷

একসময় যে সব স্কুলে ছাত্রদের বসার জায়গা দেওয়া যেত না, কেন সেইসব স্কুল আজ ছাত্রের অভাবে ধুঁকছে– এর কারণ যদি সত্যিই তাঁরা খুঁজে পেতে চাইতেন তবে তাঁরা দেখতে পেতেন, এর কারণ অভিভাবকরা এই সব স্কুলের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন এবং এই আস্থা হারিয়ে ফেলার কারণ সরকারি ও সরকার পরিচালিত স্কুলগুলির পাশ–ফেল বিহীন শিক্ষাব্যবস্থা৷ যার পরিণতিতে এখানে পড়াশোনার পরিবেশটাই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে৷ ছাত্রছাত্রীদের জামা–জুতো–ব্যাগ–মিড-ডে মিল দেওয়া হচ্ছে, স্কুলবাড়ি রঙ সবই হচ্ছে– কিন্তু স্কুলের যেটা আসল কাজ সেই শিক্ষাটাই হারিয়ে যেতে বসেছে৷ অভিভাবকরা নিজের সন্তানদের ভবিষ্যৎ ভেবে নিজেরা না খেয়ে না পরেও বেসরকারি স্কুলের দিকে ছুটছেন৷ এই সরকারের নেতা–মন্ত্রীরা কি তা দেখতে পাচ্ছেন না? নাকি দেখেও দেখতে চাইছেন না? এবারের লোকসভা ভোটে পায়ের তলা থেকে অনেকখানি জমি সরে যাওয়ার ঘটনায় ধাক্কা খেয়ে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী তাঁর ফেসবুকে শিক্ষক, শিক্ষাবিদ ও শিক্ষানুরাগীদের উদ্দেশে শিক্ষা নিয়ে কোনও পরামর্শ থাকলে সরাসরি তাঁকে জানানোর আবেদন জানিয়েছেন৷ বিষয়টা কিছুটা অভাবিত৷ কারণ এ হেন শুভবুদ্ধির প্রকাশ তাঁদের মধ্যে আগে কখনও ঘটতে দেখা যায়নি৷ তবুও এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনেকে তাঁদের মতামত পাঠিয়েছেন৷ এইসব মতামতের কী পরিণতি হবে, আমরা জানি না৷ তবে এ প্রশ্ন এসেই যায়, এ সবের কোনও গুরুত্ব কি তাঁদের কাছে আছে, না এর সবটাই মানুষকে বোকা বানানোর আর একটা অপকৌশল? যদি তা না হয়, তবে সব দেখেশুনেও কেন তাঁরা হাত–পা গুটিয়ে বসে আছেন? জনস্বার্থ, শিক্ষাস্বার্থ তাঁদের কাছে এতটুকু গুরুত্ব পেলে তো তাঁদের ছটফট করার কথা৷ কীভাবে এই সর্বনাশ ঠেকানো যায় তা নিয়ে তাঁদের মরিয়া চেষ্টা চালানোর কথা৷ কোথায় তাঁদের সেই উদ্বেগ, সেই যন্ত্রণা?

শিক্ষা এখনও যুগ্ম তালিকায়৷ এখানে রাজ্যের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ এ ক্ষেত্রে সেই ভূমিকা পালনের সামান্যতম চেষ্টাও তাঁরা করেছেন কি? আর কেন্দ্রের সঙ্গে তাঁরা কখনও সংঘাতে যাননি, এমন তো নয়৷ নানা সময় নানা প্রশ্নে তাঁদের সাথে কেন্দ্রের বিরোধ হয়েছে৷ দু’দিন আগেও ভোটের মুখে এমনকী প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে কড়া মন্তব্য করতেও তাঁদের বাধেনি৷ এখনও রাজ্যের বিষয়ে কেন্দ্রের অতি–সক্রিয়তা নিয়ে তাঁরা সরব৷ তা হলে শিক্ষা নিয়ে তাঁরা এত নিস্পৃহ, এত নির্লিপ্ত কেন? কেন তাঁরা এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রের একান্ত আজ্ঞাবহের মতোই আচরণ করছেন? এমনকি অনেক টালবাহানার পর লোকঠকানোর জন্য পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পাশ–ফেল ফেরানোর যে সিদ্ধান্ত কেন্দ্র নিয়েছে তা কার্যকর করা নিয়েও তাঁরা গড়িমসি করে চলেছেন৷ এই নিষ্ক্রিয়তা এক সামাজিক অপরাধ৷ কোটি কোটি ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যৎ নিয়ে এই ছিনিমিনি খেলা  রাজ্যের মানুষ মুখ বুজে মেনে নেবে না৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৪৮ সংখ্যা)