প্রতিবাদী কণ্ঠ রোধ করতেই এই গ্রেপ্তারি

প্রমাণিত, নোট বাতিল ছিল নিছক পলিটিক্যাল চমক৷ বছরে দু’কোটি চাকরি– কৌতুকের বিষয়ে পরিণত৷ আচ্ছে দিন আজ চায়ের মজলিশেও অত্যন্ত ক্লিসে রসিকতা, গোরক্ষা–জাতীয়তাবাদে জিগির বেশি দিন লোক মাতাতে পারছে না! বাড়ছে ক্ষোভ–বিক্ষোভ–প্রতিবাদ৷ তার থেকে মানুষের চোখ ঘোরাতে বিজেপির চাই নতুন চমক৷ তাই মাওবাদী জুজু দেখিয়ে হিমশীতল সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে দমনের চেষ্টায় নেমেছে বিজেপি সরকার৷ মহারাষ্ট্রের বিজেপি সরকারের পুলিশ অতি তৎপর হয়ে দেশের নানা প্রান্ত থেকে একের পর এক বিশিষ্ট মানুষদের যেভাবে গ্রেপ্তার করে তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনেছে, তাতে এই দুরভিসন্ধিই স্পষ্ট৷ এমনকী রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে তাদের বিরুদ্ধে ইউএপিএ–র মতো মারাত্মক দানবীয় আইন প্রয়োগ করেছে৷

দেশজোড়া প্রতিবাদ এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ–ইতিহাসবিদ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে পুলিশ তাঁদের জেলের বদলে গৃহবন্দি করে রাখতে বাধ্য হয়েছে আপাতত৷ প্রশ্ন উঠেছে, এমন কী গুরুতর অভিযোগ যে, পুলিশকে এইভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে হল যদিও মহারাষ্ট্র সরকারের পুলিশ দিল্লি হাইকোর্টে দাঁড়িয়ে বলতেই পারেনি কেন তারা গ্রেপ্তার করতে চাইছে এমনকী অতিতৎপর পুলিশ অভিযুক্তদের ট্রানজিট রিম্যান্ডের ভিত্তিতে পুণে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে দিল্লির নিম্ন আদালতে যে নথি পেশ করেছিল তা ছিল মারাঠিতে লেখা৷ যা দিল্লির কোনও বিচারকের পক্ষে পড়া সম্ভব হয়নি৷ পুলিশ এমনকী কেস ডায়েরির কপিও দিতে পারেনি৷ সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত প্রশ্ন তুলেছে এই পরিস্থিতিতে বিচারক গ্রেপ্তার অনুমোদন করলেন কী করে? পুলিশের কথাই কি আদালতের শিরোধার্য হবে?

 

ধৃত মানবাধিকার কর্মী ও সমাজকর্মীদের

অবিলম্বে মুক্তির দাবি এসইউসিআই(সি)

২৮ আগস্ট দেশের নানা প্রান্তে প্রবীণ মানবাধিকার কর্মী ও সমাজকর্মীদের বাড়িতে পুলিশি হানা এবং গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে এস ইউ সি আই (সি)–র সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ ২৯ আগস্ট এক বিবৃতিতে বলেন, ‘‘বিজেপির প্ররোচনায় মহারাষ্ট্র পুলিশ ও প্রশাসন চরম অগণতান্ত্রিক পথে যেভাবে ভীমা–কোরেগাঁও ঘটনায় যুক্ত থাকার অভিযোগ তুলে মানবাধিকার কর্মী ও সমাজকর্মীদের বাড়িতে হানা দিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করেছে তা একটি ফ্যাসিবাদী পদক্ষেপ৷ এর দ্বারা বিজেপি সরকার প্রতিবাদী মানুষকে ভয় দেখিয়ে প্রতিবাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করার যে অপচেষ্টা চালাচ্ছে তা অত্যন্ত নিন্দনীয়৷ আমরা আটক মানবাধিকার কর্মী ও সমাজকর্মীদের অবিলম্বে মুক্তির দাবি করছি’’৷

 

 

পুণের কাছে কোরেগাঁও–ভিমা গ্রামে গত ৩১ ডিসেম্বর পেশোয়ার সাথে দলিতদের যুদ্ধের ২০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে যে সমাবেশ হয়েছিল তার উপর আক্রমণ করেছিল তথাকথিত উচ্চবর্ণের স্বঘোষিত প্রতিনিধি আরএসএস ঘনিষ্ঠ কট্টর হিন্দুত্ববাদী ‘শিব প্রতিষ্ঠান হিন্দুস্তান’ সংগঠন৷ ১ জানুয়ারি তাদের আক্রমণে একজনের মৃত্যু হয়, আহত হন দলিত সম্প্রদায়ের বহু মানুষ৷ এই ঘটনায় দলিতদের উপর আক্রমণ, হত্যা, দাঙ্গা, সরকারি সম্পত্তি ধ্বংসের মূল হোতা হিসাবে ‘শিব প্রতিষ্ঠানের’ নেতা শম্ভাজি ভিদে–র নাম উঠে এসেছিল৷ তাঁর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষদর্শীদের এফআইআর থাকা সত্ত্বেও এ হেন ‘তৎপর’ পুলিশ তাঁকে আজও গ্রেপ্তার করেনি৷ ভিদেকে যখন পুলিশ পলাতক দেখিয়েছে সেই সময় তিনি নিশ্চিন্তে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন, মহারাষ্ট্র সরকারের মন্ত্রীদের পাশে নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন পর্যন্ত করেছেন৷ এমনকী বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ বিধানসভায় দাঁড়িয়ে ভিদেকে ক্লিনচিট দিয়ে বলেছেন, যে মহিলা তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর করেছিলেন তিনি তাঁকে চিনতে ভুল করেছিলেন৷ অর্থাৎ তদন্ত করার আগেই মামলা কোন দিকে চালাতে হবে তা পুলিশকে বলেই  দিয়েছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী৷ কে এই শম্ভাজি ভিদে? তিনি এমন একজন স্বঘোষিত গুরু যাঁর পা ছোঁয়ার জন্য ২০১৪ সালে হেলিকপ্ঢার থেকে নেমেই প্রধানমন্ত্রী ছুটে গিয়েছিলেন৷ ফলে পুলিশের পক্ষে তাঁকে গ্রেপ্তার করা দূরে থাক তাঁর টিকিটি স্পর্শ করাও যে সম্ভব নয় তা বলাই বাহুল্য৷ তাই আক্রান্ত দলিতদের এফআইআরের উপর পুলিশ চেপে বসে থেকেছে, কিছুই করেনি৷ অথচ ভিদের শিষ্য তুষার দামগুড়ে ঘটনার বেশ কিছুদিন পর একটা এফআইআর করতেই পুলিশ তাকে মান্যতা দিতে উঠে পড়ে লেগেছে৷ এজন্য সবচেয়ে সহজ পথ হল নির্বিচারে মাওবাদী তকমা দেগে দেওয়া!

ফলে কোরেগাঁও–ভিমা দাঙ্গার মামলায় পুলিশ এখন দলিত জনগণ এবং তাঁদের পক্ষে দাঁড়ানো সমাজকর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের গায়ে নির্বিচারে ‘মাওবাদী’ তকমা সেঁটে দাঙ্গার দায় বিজেপির কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলতে তৎপর৷ তাই আরএসএস–বিজেপি প্রভুদের খুশি করতে অতি তৎপরতা দেখাতে গিয়ে আইন বা নথিপত্রের দিকে ন্যূনতম মন দেওয়ার কথাটা তাদের মনেও ছিল না৷ সুপ্রিম কোর্টে তাদের এই অস্বাভাবিক উৎসাহের ব্যাখ্যা দিতে না পেরে গ্রেপ্তারের প্রায় দু’দিন পরে কিছু চিঠি তুলে ধরে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে দেখাতে যে, প্রধানমন্ত্রীকে খুন, সরকার ফেলে দেওয়ার মতো অভিযোগে এঁরা নাকি অভিযুক্ত অথচ এতগুলি ‘অকাট্য’ প্রমাণ পুলিশ প্রথমেই আদালতে দিল না কেন? নাকি সেগুলি তখনও তৈরি করে উঠতে পারেনি আরও মজাদার অভিযোগও আছে, পুলিশ বলেছে এই অভিযুক্তরা ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী’ ফ্রন্ট তৈরি করছেন৷ অর্থাৎ বিজেপি সরকার যে ‘ফ্যাসিস্ট’ তা বলেছে তার নিজের পুলিশ বাহিনী!

পুলিশ যে তার সরকারি প্রভুদের স্বার্থে এমন সাজানো নথি, তথাকথিত অকাট্য প্রমাণ, মিথ্যা মামলা দিতে সিদ্ধহস্ত তা এ দেশের মানুষের জানতে বাকি নেই৷ যে কোনও আন্দোলনে মাওবাদী নাম জড়িয়ে দিতে পারলেই যেন তার সব ন্যায্যতা চলে যায় অতীতে ঠিক এই অপচেষ্টা দেখা গেছে পশ্চিমবঙ্গের নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর, লালগড়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে৷ রাষ্ট্রীয় বাহিনীর পৈশাচিক নির্যাতনকে জনমানসে বৈধতা দিতে মাওবাদীদের নাম প্রচার করেছে সরকার নিজেই৷ সিপিএম, তৃণমূল, কংগ্রেস সব সরকারই একই কাজ করেছে৷ মহারাষ্ট্র সরকারও নির্লজ্জভাবে ঠিক সেটাই করেছে৷ অথচ বাস্তব হল সুপ্রিম কোর্ট এবং হাইকোর্টের দুই প্রাক্তন বিচারপতি পি বি সবন্ত এবং বি জি কোলসে–পাটিল সুনির্দিষ্টভাবে জানিয়েছেন, মাওবাদীরা নয় কোরেগাঁও–ভিমার ‘এলগার সম্মেলন’ ডেকেছিলেন তাঁরা৷ মাওবাদী দূরে থাক, যে সমাজকর্মীদের নাম এখন বলা হচ্ছে তাঁরাও এর মধ্যে আদৌ ছিলেন না বলে দুই বিচারপতি জানিয়েছেন৷

যে কায়দায় বিজেপি সরকার এই স্বৈরাচারী পদক্ষেপ করেছে তার একটাই পরিচয়–ফ্যাসিবাদী৷ এদেশের বুকে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা দীর্ঘদিন ধরেই প্রকট হয়ে উঠেছে৷ বিজেপি ক্ষমতায় বসার পর থেকে এর পরিসরকে আরও বাড়িয়ে চলেছে৷ শুধু প্রশাসনিক ক্ষেত্রে নয় সমাজজীবনেও উগ্র জাতীয়তাবাদের আগ্রাসী মনোভাব, উগ্র হিন্দুত্ব ইত্যাদি ছড়িয়ে তারা মানুষের মননজগতকেও ফ্যাসিবাদী ধাঁচায় ঢেলে সাজাতে তৎপর৷ যার জেরেই গো–রক্ষকদের তাণ্ডব মাত্রছাড়া হয়েছে৷ তাদের হাতে বহু মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু পর্যন্ত ঘটছে৷ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো ভয়াবহভাবে বাড়ছে৷ সাধারণ গুজবে পর্যন্ত পিটিয়ে মানুষ খুন করতে তথাকথিত ‘জাতীয়তা ও হিন্দুত্বের’ রক্ষকদের এতটুকু বাধছে না৷ দেশরক্ষার ছুতোয় গণতান্ত্রিক বোধসম্পন্ন যে কোনও প্রতিবাদীকে হেনস্থা করতে এরা তৎপর৷  পুলিশ এইসব ক্ষেত্রে একজন হত্যাকারীকেও গ্রেপ্তার পর্যন্ত করেনি৷

মহারাষ্ট্র সরকারের যে পুলিশ বুদ্ধিজীবীদের ধরতে এত তৎপর, তারা পুণেতেই কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বলার অপরাধে আরএসএস–বিজেপি ঘনিষ্ঠ হিন্দুত্ববাদীদের হাতে নিহত যুক্তিবাদী নরেন্দ্র দাভোলকরের খুনিদের ধরতে পাঁচ বছরেও কোনও চেষ্টা করেনি৷ ২০১৫ সালে এই একই হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর হাতে মুম্বইয়ে  নিহত হন গোবিন্দ পানসারে এবং কর্ণাটকে এমএম কালবুর্গি৷ ২০১৭–তে তারাই হত্যা করেছে সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশকে৷ একজন খুনিও শাস্তি পায়নি৷ মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলায় সন্ত্রাসে অভিযুক্ত হিন্দুত্ববাদী নেতাদের শাস্তি দিতে চেষ্টাই করেনি মহারাষ্ট্র সরকারের পুলিশ৷

এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার বিজেপির ফ্যাসিবাদী পদক্ষেপকে রোখবার জন্য কংগ্রেসের হাত ধরার কথা ভাবা চরম মুর্খামি হবে৷ যে কংগ্রেস এখন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গলা ফাটিয়ে গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ান সাজছে তারা নিজেদের শাসনকালে একই জিনিস করেছে৷ দানবীয় ইউএপিএ আইন, যার ভিত্তিতে এখন বিজেপি সরকার মনগড়া অভিযোগে বিনা বিচারে আটক রাখার সুযোগ পাচ্ছে, তা কংগ্রেসেরই অবদান৷ কংগ্রেস ১৯৭১–৭২ সালে পশ্চিমবঙ্গের বুকে একই রকম ভুয়ো সংঘর্ষে বহু মানুষকে হত্যা করেছে৷ অবশ্য মিথ্যা মামলা দিয়ে বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার চেষ্টায় এ দেশের কোনও শাসকদলই কম যায় না৷ একাজে সিপিএম থেকে তৃণমূল সব সরকারই সমান দক্ষ৷ এ কাজে মাওবাদী তকমা তাদের বড় হাতিয়ার৷

মাওবাদী জুজু দেখিয়ে এ ধরনের নাটক মঞ্চস্থ করার একটা রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতাও ছিল বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদির সামনে৷ আর কয়েকমাস বাদেই লোকসভা ভোটের ময়দানে গলা ফাটিয়ে বলবার জন্য তাঁর হাতে মজুত রসদ কিছুই নেই৷ ২০১৪ সালের ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলা ক্যারিশমাও আর নেই৷ তাই সহানুভূতির হাওয়া তুলতে ‘প্রধানমন্ত্রীকে খুনের ছকে’র মতো রোমহর্ষক গল্পের গরুই ভরসা৷ এর আগে গুজরাটেও ঠিক একই কায়দায় মোদিকে হত্যা করার পরিকল্পনা ধরা পড়েছে এই জিগির তুলে ভুয়ো সংঘর্ষে বিজেপি সরকার হত্যা করেছিল ইসরাত জাহান, সোহরাবুদ্দিন সেখ, তুলসিরাম প্রজাপতি সহ অন্যদের৷ সেই সহানুভূতির প্রচারের ঝড়ে ভোট বৈতরণী মোদি পার হয়ে যাওয়ার অনেক পরে জানা গেল সংঘর্ষটি সাজানো ছিল৷ আবার এই রকমই একটা চক্রান্তে সামিল বিজেপি সরকার৷

আশার কথা প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে গলা টিপে মারার চেষ্টার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে ধিক্কারের স্বর উঠেছে৷ এই প্রতিবাদের কন্ঠকে গণআন্দোলনের রূপ দিয়ে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই আজ গণতান্ত্রিক বোধসম্পন্ন মানুষের পরিচয়৷

(৭১ বর্ষ ৬ সংখ্যা ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)