প্যারি কমিউনের দেড়শো বছর (৬)

আজ থেকে ১৫০ বছর আগে ১৮৭১ সালে প্যারি কমিউনের ঐতিহাসিক সংগ্রামে উত্তাল হয়েছিল ফ্রান্স তথা সমগ্র ইউরোপ। বুর্জোয়া শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করে ১৮ মার্চ বিপ্লবী কেন্দ্রীয় কমিটি প্যারিসের ক্ষমতা দখল করে শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্র কমিউন প্রতিষ্ঠা করে। কমিউন গুণগত ভাবে ছিল বুর্জোয়া রাষ্ট্রের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। কমিউন শাসনে এই প্রথম শ্রমিকরা মুক্তির স্বাদ পায়।

কিন্তু নানা কারণে কমিউনকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। ৭২ দিন পর ২৮ মে বুর্জোয়া সরকার অপরিসীম বর্বরতায় নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালিয়ে কমিউনকে ধ্বংস করে। বিচারের নামে প্রহসন ঘটিয়ে হাজার হাজার কমিউনার্ডকে হত্যা করে বুর্জোয়ারা বিপ্লব দমন করে। এই লড়াইকে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে মানবমুক্তির দিশারী কার্ল মার্কস তাঁর চিন্তাধারাকে আরও ক্ষুরধার করেন, সমৃদ্ধ করেন। শ্রমিক বিপ্লবের প্রচলিত ভ্রান্ত তত্ত্বগুলিকে আদর্শগত সংগ্রামে পরাস্ত করে প্যারি কমিউনের লড়াই মার্কসবাদের অভ্রান্ত সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে। কমিউনার্ডদের অসীম বীরত্ব ও জঙ্গি লড়াই সত্ত্বেও কমিউনের পতন দেখায়, শ্রমিকবিপ্লবের জন্য সঠিক বিপ্লবী তত্ত্ব ও সঠিক বিপ্লবী দলের নেতৃত্ব অবশ্য-প্রয়োজন। প্যারি কমিউনের এই মহান সংগ্রামের ইতিহাস জানা সমস্ত মার্কসবাদীর অবশ্য-কর্তব্য।

আগের পাঁচটি কিস্তিতে নেপোলিয়ন সাম্রাজ্যের পতন, পুনরায় বুরবোঁ রাজতন্তে্রর ক্ষমতা দখল, ১৮৩০-এ জুলাই বিদ্রোহে অর্লিয়ানিস্ট বংশের লুই ফিলিপের ক্ষমতা দখল এবং ১৮৪৮-এ ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে অস্থায়ী সরকার গঠন ও বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, সংবিধান পরিষদ থেকে শ্রমিক প্রতিনিধিদের বিতাড়ন এবং ২২ জুন শ্রমিক শ্রেণির বিদ্রোহকে নৃশংস ভাবে দমনের মধ্যে দিয়ে বুর্জোয়াদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, নেপোলিয়নের ক্ষমতা দখল ও সম্রাটতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, ফ্রান্স-প্রুশিয়ার যুদ্ধ, নেপোলিয়নের পতনের কথা আলোচিত হয়েছে। এ বার ষষ্ঠ কিস্তি। – সম্পাদক, গণদাবী

প্যারিসের মানুষ কিন্তু জার্মানির বিসমার্ক আর ফরাসি শাসক তিয়েরর মধ্যে হওয়া সন্ধিচুক্তিটাকে ফরাসি জাতির প্রতি জাতীয় প্রতিরক্ষা সরকারের বিশ্বাসঘাতকতা হিসাবেই দেখে। শ্রমিক নেতাদের বেশিরভাগই তখন ৩১ অক্টোবরের বিক্ষোভের জেরে বন্দি হয়ে জেলে। প্রুশীয়রা ক্রমাগত এগিয়ে আসছে প্যারিসের দিকে। সেই সময় তিয়ের, ত্রশ্যুর মতো নেতাদের ক্ষমতা দখলটাকে প্যারিসের মানুষ মেনে নিয়েছিল পরিষ্কার এই শর্তে যে, একমাত্র জাতীয় প্রতিরক্ষার উদ্দেশ্যেই সেই ক্ষমতা ব্যবহার করা হবে। প্যারিস রক্ষা করতে হলে কিন্তু তার শ্রমিক শ্রেণিকে অস্ত্রসজ্জিত করা, কার্যকরী শক্তি হিসাবে তাদের সংগঠিত করা, যুদ্ধের ভিতর দিয়েই তাদের সুশিক্ষিত করে তোলা ছাড়া চলে না। অথচ অস্ত্রসজ্জিত প্যারিস মানেই অস্ত্রসজ্জিত বিপ্লব। প্রুশীয় আক্রমণকারীদের উপর প্যারিসের জয়লাভের অর্থ ফরাসি পুঁজিপতি ও তাদের রাষ্ট্রীয় পরগাছাদের উপর ফরাসি শ্রমিক শ্রেণির বিজয়। জাতীয় কর্তব্য ও শ্রেণি-স্বার্থের এই সংঘর্ষে জাতীয় প্রতিরক্ষার সরকার এক মুহূর্তও দ্বিধা করল না জাতিদ্রোহী সরকার হয়ে উঠতে।

আসলে শুরু থেকেই এই সরকারের গোপন পরিকল্পনা ছিল প্যারিসকে আত্মসমর্পণ করানোর। আর এই ষড়যন্ত্র আড়াল করতে প্যারিসের শাসনকর্তা ত্রশ্যু এবং পররাষ্ট্র সচিব জুল ফাভর ক্রমাগত আস্ফালন করে গেছে, ‘কখনওই আত্মসমর্পণ করা হবে না’, ‘আমাদের এক ইঞ্চি জমি বা দুর্গগুলির একটি ইটও শত্রুকে ছাড়া হবে না।’

১৮৭১-এর ২৮ জানুয়ারি অবরুদ্ধ প্যারি আত্মসমর্পণ করল। এঙ্গেলস বলেছেন, কিন্তু আত্মসমর্পণ এমন মর্যাদায় যা যুদ্ধের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। দুর্গগুলি সমর্পণ করা হল, নগরীর প্রাচীর থেকে কামানগুলি সরিয়ে ফেলা হল, সরকারি সেনাবাহিনীর অস্ত্র তুলে দেওয়া হল বিজয়ী বাহিনীর হাতে আর তারা গণ্য হল যুদ্ধবন্দি হিসাবে। কিন্তু প্যারির প্রলেতারিয়েতদের নিয়ে গঠিত জাতীয় রক্ষিবাহিনী তাদের অস্ত্র আর কামান হাতছাড়া করেনি।

সন্ধির শর্ত অনুসারেই ৮ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্স জুড়ে জাতীয় সভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। প্যারি এবং কয়েকটি শহর ছাড়া রক্ষণশীলরা, রাজতন্ত্রীরা নিরঙ্কুশ প্রাধান্য পেল। গ্রামের ভোটাররা, কৃষকরা এই যুদ্ধ আর চালিয়ে নিয়ে যেতে চায়নি। তারা চেয়েছিল যে-কোনও মূল্যে শান্তি। নির্বাচনে তারই প্রতিফলন ঘটল। এই রায় যুদ্ধ বিরতির পক্ষে রায়, প্রজাতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে, ‘লাল’দের মাথাচাড়া দেওয়ার বিরুদ্ধে রায়। প্যারি তার মর্যাদা রক্ষা করল। প্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচিত করল ৪৮-এর নায়কদের– লুই ব্লাঁ, গারিবল্ডি, ভিক্টর হুগো, গামবেতা, দেলসক্লুজ, পিয়ে, রোশোফোর। নির্বাচিত হতে পারলেন না শুধু ব্লাঙ্কি।

বিপুল ভোটে নির্বাচিত হলেন তিয়ের। রাজতন্ত্রীদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও তিয়েরই নতুন মন্ত্রিসভার প্রধানরূপে নির্বাচিত হলেন। এই তিয়ের সম্পর্কে মার্ক্স বলেছিলেন, ফরাসি বুর্জোয়াদের শ্রেণিকলুষের চরম বুদ্ধিগত প্রকাশ। সর্বদাই পুঁজির কাছে শ্রমের দাসত্ব– এই হল তিয়েরের নীতির মূল কথা।

তিয়েরের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা কাজ শুরু করল– প্যারিসে নয়– বোর্দোতে। প্যারিসকে তারা বিশ্বাস করে না। তাদের প্রথম কাজ হল প্যারিসকে শিক্ষা দেওয়া।

আইনসভার প্রথম অধিবেশনে গ্যারিবল্ডিকে ভাষণ দিতে দেওয়া হল না। তিনি বিদেশি এই অজুহাতে। ইতালির স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদী এই নেতা এসেছিলেন ফরাসিদের মুক্তিসংগ্রামে সহায়তা করতে। ভিক্টর হুগো বত্তৃতা দিতে উঠলে তাঁকে অপমান করা হল। হুগো পদত্যাগ করলেন। একে একে প্যারির ছজন বামপন্থী সদস্যই পদত্যাগ করলেন। শান্তিচুক্তি বিপুল ভোটে অনুমোদিত হয়ে গেল।

প্যারি শহরের মধ্য দিয়ে জার্মানদের বিজয় মিছিল করার শর্তটি যেন প্যারিবাসীর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়ে দিল। কিন্তু বিজেতা জার্মান বাহিনীও মূল শহরে ঢোকার সাহস দেখাতে পারল না।

তিয়ের সরকার ১০ মার্চ সিদ্ধান্ত নিল জাতীয় সভা বোর্দো থেকে প্যারিস আসবে না– ভার্সাইতে যাবে। প্যারিসকে রাজধানীর মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করে প্রতিশোধ নেওয়া হল।

১১ মার্চ সরকার কতগুলো আইন নিয়ে এল যা প্যারির পেটি বুর্জোয়াদের, নিম্নবিত্ত-কেরানি-দোকানি-কারিগরদের শ্রমিক শ্রেণির দিকে ঠেলে দিল। যুদ্ধ ও অবরোধের জন্য যে সব কর মুলতুবি রাখা হয়েছিল, তা আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে মিটিয়ে দিতে বলল। সমস্ত জমে থাকা ভাড়া বাড়িওয়ালাদের এক্ষুনি শোধ করে দিতে বলল ভাড়াটিয়াদের। ন্যাশনাল গার্ডদের বেতন বন্ধ করে দিল।

জার্মানরা প্যারিসে থাকা ফরাসি কামানগুলো দখল করার আগেই ন্যাশনাল গার্ডরা দুশো কামান দখল করে নিয়েছিল। এইসব কামান জনগণের চাঁদায় কেনা, তাই জনগণের সম্পত্তি।

জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকেই শ্রমিক মহল্লাগুলিতে ‘কমিউন জিন্দাবাদ’ ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। এখানে-ওখানে লাল পতাকা উড়তে দেখা যাচ্ছিল। ৩ মার্চ বাম মনোভাবাপন্ন ব্যাটেলিয়নের প্রতিনিধিদের নিয়ে গড়ে উঠল ন্যাশনাল গার্ডের কেন্দ্রীয় কমিটি। একদিকে তিয়ের সরকারের অনুগত এক ডিভিশন সেনা, অন্য দিকে কেন্দ্রীয় কমিটির উপর আস্থাশীল সাড়ে তিন লাখ ন্যাশনাল গার্ড– ১৮৭১ এর মার্চের প্রথম দিকেই প্যারিসে গড়ে উঠল দুটি ক্ষমতাকেন্দ্র। তিয়ের সরকারের প্রতি বিরূপ প্যারিবাসী ক্রমশ কেন্দ্রীয় কমিটির উপর আস্থাশীল হয়ে উঠতে থাকল। ঠিক এই পরিস্থিতিতেই ঘটল প্যারি কমিউনের আবির্ভাব।

তিয়েরের বুঝতে অসুবিধা হয়নি, প্যারির নিয়ন্ত্রণ তার সরকারের হাত থেকে অতি দ্রুত সরে যাচ্ছে। একটি প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি জন্ম নিচ্ছে। তার চিন্তার কারণ প্যারিবাসীর হাতের অস্ত্র আর এই কামানগুলো। তিনি জেনারেল ভিনয়কে আদেশ দিলেন ন্যাশনাল গার্ডের থেকে কামানগুলো উদ্ধার করতে। তিয়েরের প্রতিবিপ্লবী ষড়যন্ত্রের পথে প্যারিই একমাত্র গুরুতর প্রতিবন্ধক। তাই প্রয়োজন হল প্যারিকে নিরস্ত্র করা। ভিনয়কে কামান কাড়ার নির্দেশ দিয়ে তিয়েরই গৃহযুদ্ধ শুরু করলেন।

১৮ মার্চ ভোরবেলা সেনাবাহিনী শহরে ঢুকে পড়ল। কিন্তু প্রথম দিকে সাময়িক কিছু সাফল্য ছাড়া সেনারা ব্যর্থ হল। গোটা প্যারিবাসী এক হয়ে দাঁড়াল তাদের প্রতিরোধে। রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করে মেহনতি জনতা ও ন্যাশনাল গার্ড একত্রে বিপুল বিক্রমে লড়াই চালাতে থাকে। সেনাদের দখল করা কামানগুলি ছিনিয়ে নেয় তারা। বিপুল জনতা সেনাদের ঘিরে ফেলে বোঝাতে থাকাল, তোমরা কেন এই জঘন্য কাজ করতে এসেছ? যারা তোমাদের পাঠিয়েছে তারা দেশকে জার্মানির কাছে বেচে দিয়েছে, তারা আবার দেশে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে চায়। সহস্র মানুষের উতপ্ত আবেগের সম্মোহনী প্রভাবে শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়ল গরিব ঘরের ছেলে এই সব সোনারা। মোঁমার্ত্র, বাস্তিল, বেলভিল প্রভৃতি নানা জায়গায় উপরওয়ালার হুকুম অমান্য করে সেনাবাহিনী জনতার সঙ্গে একত্রে স্লোগান দিতে থাকল– সেনাবাহিনী ও জনগণের মৈত্রী দীর্ঘজীবী হোক, তিয়ের-ভিনয় নিপাত যাক। প্রায় সব কামানই জনগণের হাতে থেকে গেল, আরও পাওয়া গেল সেনাদের কাছ থেকে হাজার হাজার আধুনিক রাইফেল। তিয়ের চিন্তিত হয়ে পড়লেন– দ্রুত সৈন্যদের সরিয়ে না ফেললে বিদ্রোহীদের সংস্পর্শে তারা হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। ফলে সরকারকে ভার্সাইয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। তিয়ের সহ মন্ত্রীরা দ্রুত প্যারিস ছাড়লেন। তাদের সাথে প্যারিস ছাড়ল মধ্যবিত্তদের একটা অংশ। এর ফলে ন্যাশনাল গার্ডে শ্রমিকদেরই সংখ্যাধিক্য ঘটল।

অতি দ্রুত বিপ্লবী কেন্দ্রীয় কমিটি প্যারিতে সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করল। মার্কসের ভাষায় ‘‘মেহনতি মানুষের মহান বিপ্লব ১৮ মার্চ প্যারিসে পূর্ণ কর্তৃত্ব দখল করে।”

এখানে একটি কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। এই মহান সংগ্রামে পরবর্তীকালে কমিউন রক্ষার লড়াইয়ে মহিলারা এক বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন।

এই সংগ্রামে দিমিত্রিয়েভা ও লুই মিশেল নামে দুই শিক্ষিকার নেতৃত্বে একটি সংগ্রামী মহিলা রক্ষী বাহিনী সংগঠিত হয়। এই রক্ষী বাহিনী প্রধানত প্রতিরক্ষা কার্যে নিয়োজিত হবে বলে ঠিক হলেও, আক্রমণাত্মক যুদ্ধেও এই বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। কমিউন প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে মহিলাদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রত্যক্ষ করেছেন এমন একজন বুর্জোয়া সাংবাদিক কোনও একটি ইংরেজি দৈনিকে সে সময়ে লিখেছিলেন, ‘‘যদি ফরাসি জাতি শুধু নারীদের নিয়ে তৈরি হয়, তবে সে কী প্রচণ্ড শক্তিশালী হবে!”

পরিস্থিতির যে এত দ্রুত এবং এমন পরিবর্তন ঘটবে তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। বামপন্থী নেতারাও নয়। তাঁরা ভাবতেও পারেননি এমন করে হঠাৎ ক্ষমতা হাতে চলে আসবে। প্যারির দক্ষিণ ফটক দিয়ে ভিনয় সসৈন্যে মার্চ করে বেরিয়ে গেল। আটকানোর কথা কারও মনেও হল না। কেন্দ্রীয় কমিটি পলাতক সরকারের দপ্তরগুলি একের পর এক দখলে নিয়ে নিল। ওতেল দ্য ভিল এখন কেন্দ্রীয় কমিটির সদর দপ্তর। ১৭৯৩ এর পর এই প্রথম বিপ্লবীরা প্যারির একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হল।

মা’র্ বললেন, সম্রাটতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত কমিউন। কমিউন সামাজিক মুক্তির রাজনৈতিক রূপ। শ্রমিকদেরই তৈরি। শ্রমের উপায়ের উপরে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের দখলদারির থেকে শ্রমের মুক্তির ধরন।

কেন্দ্রীয় কমিটির উপর ন্যস্ত হল এক বিরাট দায়িত্ব। কমিটিতে যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে দুই একজন আন্তর্জাতিকের সদস্য ছাড়া বাকিদের কারওরই তেমন রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছিল না। তা সত্ত্বেও কমিটির চেয়ারম্যান ক্রিসেট ও ধর্মঘটের নেতা অ্যাসির তত্ত্বাবধানে যে সরকার প্রতিষ্ঠিত হল, তা মেহনতি মানুষের সরকার। আনুষ্ঠানিকভাবে কমিউন তখনও ঘোষিত না হলেও তখন থেকেই কমিউনের রাজত্বের শুরু বলা যায়। ১৯ মার্চ শুরু হল এক নবযুগ। প্যারি-অভ্যুত্থানের খবর চারপাশে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্যারিতে আনুষ্ঠানিক ভাবে কমিউন প্রতিষ্ঠার আগেই লিয়ঁ, নারবুগে প্রভৃতি শহরে কমিউনের প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়।

কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে ২১ মার্চ এক ঘোষণায় বন্ধকী দোকানের জিনিসপত্রের নিলাম করা নিষিদ্ধ করা হল। অভাবের তাড়নায় শ্রমিক পরিবারের নিত্যব্যবহার্য জিনিসও বাঁধা পড়ত। মহাজনের দেনা শোধ করার জন্য খাতকদের আরও সময় মঞ্জুর করা হল। বাড়িওয়ালারা আর ভাড়া বাকির জন্য ভাড়াটেদের উচ্ছেদ করতে পারবে না। এই ঘোষণাগুলি শ্রমিক ও গরিব জনতাকে কমিউনের আরও ঘনিষ্ঠ করে তুলল। কমিউনের সদস্য হিসাবে নির্বাচিত বিদেশিদের নির্বাচন বৈধ ঘোষণা করা হল। কমিটি এক আদেশে জুয়াখেলা নিষিদ্ধ করে দিল। তিয়ের সরকারের সাথে উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা সব ভার্সাই পালিয়ে গেছে। সরকারের কাজে এক চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়েছে। কিন্তু নতুন সরকার জনগণের সক্রিয় সহযোগিতায় অতি দ্রুত সব বিভাগের কাজ চালু করতে সক্ষম হল। প্যারির জীবন আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে এল।

সরকার চালাতে কমিউনের নেতারা ধনকুবের রথচাইল্ডের মাধ্যমে ব্যাঙ্ক অব ফ্রান্স থেকে দশ লক্ষ ফ্রাঁ ধার নিলেন। ব্যাঙ্ক কেন দখল করা হল না, এই প্রশ্নটি পরবর্তী সময়ে মার্ক্স লেনিন উভয়েই তুলেছেন। তাঁদের মতে ব্যাঙ্ক যদি কেন্দ্রীয় কমিটির দখলে আসত তা হলে ফ্রান্সের বুর্জোয়া শ্রেণির নাভিশ্বাস উঠত– তারা তিয়েরকে প্যারির শাসকদের কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য করত।

বিপ্লবী সরকার ক্ষমতায় আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নির্বাচনের মারফত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে তৎপর হয়ে ওঠে।

এত শীঘ্র নির্বাচন মারফত ক্ষমতা হস্তান্তর করা যুক্তিযুক্ত ছিল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

২৬ মার্চ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। বিপ্লবী, মডারেট, সোস্যালিস্ট, অ্যানার্কিস্ট সকলেই নির্বাচিত। নির্বাচিতদের মধ্যে রয়েছেন সব পেশার মানুষ– শ্রমিক, কেরানি, ছোট ব্যবসাদার, সাংবাদিক, লেখক, চিত্রকর। দু-দফায় নির্বাচনের পরে নির্বাচিত ৯২ জন সদস্যের ভিতরে ১৭ জন ছিলেন প্রথম কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সদস্য। ২১ জন ছিলেন শ্রমিক, ৩০ জন ছিলেন লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক এবং ১৩ জন ছিলেন কেরানি। বিখ্যাত শিল্পী কুরবে অন্যতম সদস্য ছিলেন। ব্লাঙ্কি নির্বাচিত হলেও জেলে থাকায় সক্রিয় অংশগ্রহণে সক্ষম হননি। ছিলেন পঁটিয়ে, পরবর্তীকালে যিনি বিখ্যাত আন্তর্জাতিক সঙ্গীতটি রচনা করেছিলেন। আর ছিলেন লঁগে (কার্ল মার্কসের জামাতা)।

৯২ জন নির্বাচিত সদস্যের মধ্য থেকে– যুদ্ধ, অর্থ, খাদ্য সরবরাহ, পররাষ্ট্র, শ্রম, বিচার, স্বাস্থ্য, জনসংযোগ ও আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত ন’জনকে নিয়ে কার্যকরী কমিটি গঠিত হয়। এই পরিচালকমণ্ডলীর অধিকাংশ সদস্যই ছিলেন ব্লাঙ্কি আর প্রুধোঁর অনুগামী।

২৮ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে হোটেল ‘দিন ভিই’-তে কমিউন প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করা হল। সমগ্র শহরে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। প্রতিষ্ঠিত হল ইতিহাসের পাতায় এক নতুন রাষ্ট্র। সর্বপ্রথম শ্রমিক-মেহনতি মানুষের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বিপুল সম্ভাবনার সৃষ্টি হল।

জন্মমুহূর্ত থেকে কমিউন অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে রত। তারই সঙ্গে প্রবল উৎসাহে দুনিয়াকে বদলানোর জন্য কমিউন দৃঢ়সঙ্কল্প। ২৮ মার্চ চার্লস বেলের সভাপতিত্বে কমিউনের প্রথম অধিবেশন বসে। তারপর থেকেই একের পর এক আইন পাস হতে থাকে। এই সব আইন, অর্ডিন্যান্স, ঘোষণা যা কমিউনের শ্রমিক চরিত্রকে স্পষ্ট করেছিল, যা প্রজাতন্তে্রর ঘোষণা– সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, যা শ্রমিক শ্রেণির রাষ্টে্রর এক রূপরেখা তৈরি করে দিয়েছিল।

স্বল্পকালের মধ্যেও যে সব উল্লেখযোগ্য কাজ কমিটি সম্পন্ন করতে পেরেছিল, তার মধ্যে রাজনৈতিক দিক থেকে দু’টি কার্যক্রম যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। পূর্বতন রাষ্ট্রের ভাড়াটে সৈন্যকে পুরোপুরি বরবাদ করে দিয়েছিল কমিউন। তার জায়গায় তৈরি করেছিল জাতীয় রক্ষী বাহিনী, যেটা তখন সে যুগের মতো করে গণফৌজের রূপ নিয়েছিল। যে কোনও নাগরিক অস্ত্র ধারণে সক্ষম হলেই তাকে রক্ষীবাহিনীতে গ্রহণ করা হয়। ভাড়াটে সৈন্যের উপরে নির্ভর না করে জনগণকে সশস্ত্র করে তুলে তার উপরে রাষ্ট্রের রক্ষাকার্য ন্যস্ত করা নিঃসন্দেহে পুরনো রাষ্ট্রযন্ত্র ভেঙে ফেলে নতুন রাষ্ট্রযন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে একটি উল্লেখযোগ্য কাজ।

কমিউন গঠিত হওয়ার আগেই কেন্দ্রীয় কমিটি তার অফিসিয়াল জার্নাল মারফত ঘোষণা করেছিল, যুদ্ধের ক্ষতিপূরণের বেশিরভাগটা দিতে হবে যুদ্ধ যারা বাধিয়েছিল তাদেরই। কমিউনের উপর বুর্জোয়াদের রাগ হবে না-ই বা কেন!

দেখা যাক অন্যান্য সব ঘোষণার রূপ কী ছিলঃ

১) সমস্ত সরকারি কর্মচারীদের বেতনের ঊর্ধ্বসীমা ৬ হাজার ফ্রাঁ-তে বেঁধে দেওয়া হল, যা একজন দক্ষ শ্রমিকের পারিশ্রমিকের মোটামুটি সমান। সর্বনিম্ন বেতনের পরিমাণও কমিউন আগের থেকে অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়। একই ব্যক্তি একাধিক দায়িত্বে থাকলেও বাড়তি সুযোগ-সুবিধা নাকচ করা হয়। এই দেখে বিস্মিত বিজ্ঞানী অধ্যাপক হাক্সলি বললেন, ব্রিটেনের মেট্রোপলিটন স্কুল বোর্ডের একজন কেরানিকে সন্তুষ্ট করার জন্য যতটা দরকার এই বেতন তার এক পঞ্চমাংশের থেকে কিছুটা বেশি।

২) শ্রমিকদের উপর জরিমানা ধার্য করা এবং রুটির কারখানার রাতের শিফটে কাজ নিষিদ্ধ হয়। শ্রমিকরা এই সিদ্ধান্তকে বিপুল সমর্থন জানায়। আট ঘণ্টা শ্রম-দিবস ঘোষণা করা হয়। যদিও রাষ্ট্র পরিচালিত কারখানা এবং প্রশাসনের বহু ক্ষেত্রে শ্রমিক-কর্মচারীরা কমিউনের স্বার্থে বিনা মজুরিতে আরও দু-ঘণ্টা বেশি কাজ করতে থাকেন।

শ্রম-দপ্তরের উদ্যোগে সিন্ডিকেট চেম্বার্স গঠন করা হয়– যার কাজ পরিত্যক্ত কারখানাগুলির দখল নিয়ে শ্রমিক-সমবায়ের মাধ্যমে পরিচালনা করা। যেসব মালিক এতদিন শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে আসছিল তাদের সম্পত্তিচ্যুত করার আদেশ দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিকের অনুগামী লিও ফ্রাঙ্কেলের নেতৃত্বে খোদ শ্রমিকদের নিয়ে শ্রম-কমিশন গঠিত হয়। প্রতি মহল্লায় কর্মসংস্থান কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং বেকার শ্রমিকদের সাহায্য দান কমিশনের অন্যতম লক্ষ্য হয়।

৩) কৃষি আর কৃষকের সমস্যা নিয়েও কমিউন ছিল সজাগ। কৃষি দপ্তরের ভার ছিল লিও ফ্রাঙ্কেলের বন্ধু জার্মান শ্রমিক ভিক্টর শিলির উপর।

৪) প্যারি রক্ষার সংগ্রামে নিহতেদের বিধবা আর সন্তান-সন্ততিদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেয় কমিউন। বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হোক বা না হোক, সমস্ত নিহতের স্ত্রীদের বার্ষিক ছশো ফ্রাঁ পেনশন ঘোষণা করা হয়। পতিতাবৃত্তি বন্ধের চেষ্টাও কমিউন আন্তরিক ভাবে চালায়।

৫) ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক ঘোষণা করা হয়। ঘোষণা করা হয়, ধর্ম প্রত্যেকের ব্যক্তিগত বিষয়। কমিউন নেতাদের মতে, যাবতীয় দুঃখ আর দুর্নীতির মূলে রয়েছে চার্চ। রাষ্ট্রকে চার্চের থেকে সম্পূর্ণভাবে পৃথক করা হয়। কতকগুলি চার্চের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে জনগণের সম্পত্তি হিসাবে ঘোষণা করা হয়। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে চার্চের জন্য অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করা হয়।

৬) নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার ভার নেন আন্তর্জাতিকের অনুগামী, একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী ভেলাঁ। শিক্ষাকে ধর্মনিরপেক্ষ, বাধ্যতামূলক এবং অবৈতনিক ঘোষণা করা হয়। স্কুলে ধর্মীয় প্রতীকের ব্যবহার, নীতিবাক্য উচ্চারণ ও প্রার্থনাসঙ্গীত বন্ধ করে দেয় কমিউন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে সকল যাজক শিক্ষক ছিলেন তাদের বরখাস্ত করা হয়। কমিউন স্ত্রী-শিক্ষার উপর জোর দেয়। যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত নারীদের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে কমিউন বিশেষ কমিশন গঠন করে। কারখানা লাগোয়া নার্সারি খোলা হয়, যাতে কর্মরত মহিলারা সেখানে শিশুসন্তানদের পরিচর্যার জন্য রেখে যেতে পারেন।

গঠিত হয় বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি। এতদিন মুষ্টিমেয় ধনীরাই কলারসিক বলে পরিচিত ছিল। কমিউন মনে করে সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষ মাত্রেই নান্দনিক দৃষ্টির অধিকারী। লুভর মিউজিয়মের আর্ট গ্যালারি সকলের জন্য খুলে দেওয়া হল।

কুর্বে এবং পতিয়ের নেতৃত্বে গঠিত হয় শিল্পীসংঘ। লেখক, ভাস্কর, চিত্রকর, নট, নাট্যকার শিল্পের সব শাখার গুণী ব্যক্তিরা রয়েছেন তাতে। শিল্পীসংঘ ঘোষণা করল, শিল্পীও একজন শ্রমিক। শ্রমজীবী মানুষ হিসাবে শিল্পী তার কাজের জন্য নিশ্চয় উপযুক্ত পারিশ্রমিক দাবি করতে পারে, কিন্তু কোনও মতেই শিল্পী নিজেকে বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণির মানুষ বলে মনে করবে না।

সমস্ত বিচারক তথা প্রশাসকদের পদকে নির্বাচনভিত্তিক করা হয়। অদক্ষ বা অযোগ্য প্রমাণ হলে নির্বাচকদের তাদের প্রতিনিধিদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়। দৈনন্দিন শাসন পরিচালনায় জনগণের ঘনিষ্ঠ ও প্রত্যক্ষ যোগ গড়ে তোলা হয়।

স্বল্পকালস্থায়ী কমিউনের এমন সংস্কারগুলির তাৎপর্য ছিল অপরিসীম। রাষ্ট্রযন্ত্রে কমিউন-প্রবর্তিত পরিবর্তনগুলির মধ্যে রয়েছে সর্বহারা একনায়কত্বের দিকে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ। অবশ্য শত্রুবেষ্টিত নগরীতে এই সব সিদ্ধান্ত কাজে পরিণত করার ব্যপারটা শুরু করা মাত্র সম্ভব ছিল। মে মাসের গোড়া থেকেই ভার্সাই সরকার ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় সেনাবাহিনী নিয়োগ করতে থাকে। তার বিরুদ্ধে লড়াইতেই কমিউনের সমস্ত শক্তি ব্যয় হতে থাকে। (ক্রমশ)

গণদাবী ৭৩ বর্ষ ৪০ সংখ্যা