প্যারি কমিউনের দেড়শো বছর (৫)

 

আজ থেকে ১৫০ বছর আগে ১৮৭১ সালে প্যারি কমিউনের ঐতিহাসিক সংগ্রামে উত্তাল হয়েছিল ফ্রান্স তথা সমগ্র ইউরোপ। বুর্জোয়া শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করে ১৮ মার্চ বিপ্লবী কেন্দ্রীয় কমিটি প্যারিসের ক্ষমতা দখল করে শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্র কমিউন প্রতিষ্ঠা করে। কমিউন গুণগত ভাবে ছিল বুর্জোয়া রাষ্টে্রর থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। প্রথমেই প্রশাসন থেকে আমলাতন্ত্রকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে কমিউন। ভাড়াটে সেনাবাহিনীর পরিবর্তে জনতার হাতে অস্ত্র তুলে দেয়। কমিউন সদস্য, কর্মচারী, অফিসারদের বেতনের ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেয়, যা একজন দক্ষ শ্রমিকের বেতনের মোটামুটি সমান। আট ঘণ্টা শ্রমসময় নির্দিষ্ট করে দেয়। শ্রমিকদের উপর জরিমানা ধার্য করা, রুটির কারখানায় রাতের শিফটে কাজ নিষিদ্ধ করা হয়। শ্রমিক প্রতিনিধিদের নিয়ে শ্রমকমিশন গঠিত হয়। যে সব মালিক এতদিন শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে আসছিল তাদের সম্পত্তিচ্যুত করার আদেশ দেওয়া হয়। বেকার শ্রমিকদের কাজ ও সাহায্যের ঘোষণা করা হয়। অফিসার, সেনা অফিসার, বিচারপতি সকলের নির্বাচিত হওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। সব ধরনের নির্বাচিত ব্যক্তি অযোগ্য প্রমাণিত হলে নির্বাচকদের হাতে তাদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়। ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করা হয়। চার্চের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। শিক্ষা হয় অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক। কমিউন শাসনে এই প্রথম শ্রমিকরা মুক্তির স্বাদ পায়।

কিন্তু নানা কারণে কমিউনকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। ৭২ দিন পর ২৮ মে বুর্জোয়া সরকার অপরিসীম বর্বরতায় নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালিয়ে কমিউনকে ধ্বংস করে। বিচারের নামে প্রহসন ঘটিয়ে হাজার হাজার কমিউনার্ডকে হত্যা করে বুর্জোয়ারা বিপ্লব দমন করে। এই লড়াইকে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে মানবমুক্তির দিশারী কার্ল মার্কস তাঁর চিন্তাধারাকে আরও ক্ষুরধার করেন, সমৃদ্ধ করেন। শ্রমিক বিপ্লবের প্রচলিত ভ্রান্ত তত্ত্বগুলিকে আদর্শগত সংগ্রামে পরাস্ত করে প্যারি কমিউনের লড়াই মার্কসবাদের অভ্রান্ত সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে। কমিউনার্ডদের অসীম বীরত্ব ও জঙ্গি লড়াই সত্তে্বও কমিউনের পতন দেখায়, শ্রমিকবিপ্লবের জন্য সঠিক বিপ্লবী তত্ত্ব ও সঠিক বিপ্লবী দলের নেতৃত্ব অবশ্য-প্রয়োজন। প্যারি কমিউনের এই মহান সংগ্রামের ইতিহাস জানা সমস্ত মার্কসবাদীর অবশ্য-কর্তব্য। ২০১১ সালে গণদাবীতে এই ইতিহাস সংক্ষিপ্ত আকারে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। আরও কিছু সংযোজন ও সম্পাদনা করে ধারাবাহিক ভাবে সেটিকে আমরা প্রকাশ করছি। আগের তিনটি কিস্তিতে নেপোলিয়ন সাম্রাজ্যের পতন, পুনরায় বুরবোঁ রাজতন্ত্রের ক্ষমতা দখল, ১৮৩০-এ জুলাই বিদ্রোহে অর্লিয়ানিস্ট বংশের লুই ফিলিপের ক্ষমতা দখল এবং ১৮৪৮-এ ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে অস্থায়ী সরকার গঠন ও বুর্জোয়া প্রজাতন্তে্রর প্রতিষ্ঠা, সংবিধান পরিষদ থেকে শ্রমিক প্রতিনিধিদের বিতাড়ন এবং ২২ জুন শ্রমিক শ্রেণির বিদ্রোহকে নৃশংস ভাবে দমনের মধ্যে দিয়ে বুর্জোয়াদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, নেপোলিয়নের ক্ষমতা দখল ও সম্রাটতন্তে্রর প্রতিষ্ঠার কথা আলোচিত হয়েছে। এ বার পঞ্চম কিস্তি। – সম্পাদক, গণদাবী

রিপাবলিক সরকারের প্রতিষ্ঠা থেকে কমিউন প্রতিষ্ঠার পূর্ব মুহূর্ত

১৮৫১ থেকে ১৮৬৮ পর্যন্ত সতেরো বছরের ইতিহাসে অর্থাৎ, তৃতীয় নেপোলিয়নের রাজত্বকালে, সমস্ত দিক থেকে দেশের অবস্থা সঙ্গীন হয়ে উঠেছিল। ১৮৫০ এর পর ফ্রান্সের অর্থনীতির অগ্রগতি যে দ্রুত হারে ঘটছিল ষাটের দশকে এসে তা থমকে গেল। উৎপাদন শিল্প, ব্যাঙ্ক, জাহাজ প্রভৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রে মন্দার ছায়া ঘন হয়ে এল। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের কারণে বস্ত্রশিল্পে নিদারুণ সঙ্কট দেখা দিল। রেশমকীটের মড়কে রেশম শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হল। আঙুরের বাগিচায় ফসল নষ্ট হল এক ধরনের পোকার আক্রমণে। যুদ্ধের রটনা বিনিয়োগকারীদের দ্বিধাগ্রস্ত করে তুলল। নেপোলিয়নের অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক ধনকুবেরদের ব্যবসা লালবাতি জ্বালল। পুঁজিবাদের এই সংকটে শ্রমিক মেহনতি জনতা এবং বিভিন্ন পেশায় লিপ্ত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের অবস্থা খারাপ হয়ে ওঠে। ‘উদীয়মান’ ধনকুবেরদের মুনাফা মার খায়। সব দিক থেকেই সরকারের ওপর চাপ বাড়তে থাকে।

মার্কসবাদী শ্রেণি সংগ্রামের বিপ্লবী তত্ত্ব শোষিত শ্রেণির মধ্যে তখনও সেভাবে বিস্তারলাভ করতে পারেনি। জনতার মধ্যে যে সকল শক্তি কিছুটা প্রভাব বিস্তারে ক্রমশ সমর্থ হচ্ছিল, তাদের মধ্যে একদিকে ছিলেন প্রুধোঁর সমর্থকরা, ছিলেন ব্ল্যাঙ্কির সমর্থকরা ও অপর কয়েকজন আন্তর্জাতিকের কেন্দ্রীয় সংস্থার সদস্য। এ ছাড়া পূর্বতন জ্যাকোবিনদের কয়েকজন উত্তরসূরীও যথেষ্ট প্রভাব বিস্তারে সমর্থ হয়েছিলেন। এ সময়ে বুদ্ধিচর্চা আর শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপের বাড়াবাড়ির কারণে একদিকে দেশের বুদ্ধিজীবীরা, অন্য দিকে যুব সম্প্রদায়ের এক বিরাট অংশ সামাজিক ও রাষ্ট্রিক পরিবেশ সম্পর্কে ক্রমশই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল।

বুদ্ধিজীবীদের এক অংশ অন্যায় শাসন ও শোষণে ক্লিষ্ট দেশের শ্রমিক মেহনতি মানুষের সঙ্গে কিছুটা একাত্মতা অনুভব করলেও বা উদারনৈতিক মনোভাবাপন্ন হলেও মূলত বুর্জোয়া চিন্তাধারার মধ্যেই আবদ্ধ থেকেছে। ফলে একদিকে যেমন সেই সময়কার সমাজতান্ত্রিক ভাবধারাকে তারা পুরোপুরি মেনে নিতে পারেনি, তেমনি পূর্বতন যুগের জ্যাকোবিন চিন্তাধারার উত্তরসূরী নয়া জ্যাকোবিন চিন্তাধারাতেও পুরোপুরি আকৃষ্ট হয়ে উঠতে পারেননি। এদের অধিকাংশই ব্লাঙ্কির অনুগামী হন। আবার কেউ কেউ প্রুঁধোর চিন্তাধারায়ও প্রভাবিত হয়ে ওঠেন। এঁরাই পরবর্তীকালে প্যারি কমিউনের প্রতিষ্ঠায় ও তার পরিচালনায় এবং নেতৃত্বে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।

ব্ল্যাঙ্কি ছিলেন নৈরাজ্যবাদী। শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী ক্ষমতায় তাঁর আস্থা ছিল না। শ্রেণি সংগ্রামের তত্ত্ব তিনি সঠিকভাবে বোঝেননি। যদিও সংগ্রামে তিনি এবং তাঁর অনুগামীরা আন্তরিক ছিলেন। তাই ব্লাঙ্কির শিষ্যদের অনেকেই পরে মার্কসের চিন্তাধারা গ্রহণ করেন। প্রুঁধোও বুর্জোয়া ব্যবস্থার উচ্ছেদের কথা ভাবেননি। সেটা বুঝেছিলেন একমাত্র মার্ক্স।

যদিও ফরাসি দেশে ১৯ শতকের তৃতীয়াংশে বেশ কিছুটা শিল্পায়ন ঘটেছিল, তা সত্ত্বেও বিরাট বিরাট কলকারখানার মাধ্যমে শ্রমিকরা বিপুল সংখ্যায় সংগঠিত হয়ে উঠতে পারেনি। কারখানাগুলিতে শ্রমিকের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত কম। শ্রমিকদের মজুরি ১৮৫৭ থেকে ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত মোটামুটি অপরিবর্তিত থাকলেও জিনিসপত্রের দাম প্রভূত পরিমাণে বেড়ে যাওয়ায় তাদের ক্রয়ক্ষমতা যথেষ্ট কমে যায়। শ্রমিকদের আর্থিক অবস্থা ক্রমশই খারাপ হয়ে উঠেছিল। তা সত্ত্বেও জুন সংগ্রামের (১৮৪৮) ব্যর্থতার পর বহুদিন পর্যন্ত ‘সমাজতন্ত্র’ নিয়ে কেউ খোলাখুলি আলাপ আলোচনায় ভরসা পেতেন না।

নেপোলিয়ন বুঝেছিলেন যে, উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়কে রুখতে হলে, শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করা এবং সেই আন্দোলনকে স্বাভাবিক গতিপথ থেকে অন্য পথে চালানো একান্ত প্রয়োজন। সে কারণে তিনি প্রুঁধোর কিছু কিছু ধারণার ব্যবহারিক প্রয়োগ ঘটালেন – সৃষ্টি হল শ্রমিক সমবায়। অবশ্য আর্থিক দায়দায়িত্ব সরকারের কর্তৃত্বাধীন ব্যাঙ্কের উপরেই ন্যস্ত হল। এ সময়ে শ্রমিকরা একাধিক ইউনিয়ন স্থাপন করেছিল। আন্তর্জাতিকের সদস্য ভার্লিন প্রতিষ্ঠা করলেন বুক বাইন্ডার ইউনিয়ন, আর অপর শ্রমিক নেতা কামোলিলাট স্থাপন করলেন ধাতু শ্রমিকদের ইউনিয়ন। ধর্মঘট রোখার যে আইন চালু ছিল, অবস্থার চাপে পড়ে সরকার তা বাতিল করতে বাধ্য হল। এ সময়ে দশটি বড় বড় ধর্মঘট সংগঠিত হলে, ধর্মঘট আইনসঙ্গত হওয়া সত্তে্বও সরকার মালিকদের সাহায্য করার উদ্দেশ্যে সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করল।

ক্রমশ কয়েকজন সচেতন, চিন্তাশীল ও দৃঢ়চেতা ব্যক্তি এ আন্দোলনের নেতৃত্বে এলেন এবং এঁদের প্রচেষ্টায় সমগ্র প্যারিস শহরের শ্রমিকদের এক সপ্তমাংশ প্রথম আন্তর্জাতিকের প্যারিস শাখার সদস্য হলেন।

এদিকে দেশের অবস্থা ক্রমশই সঙ্গীন থেকে আরও সঙ্গীন হয়ে উঠল এবং তা ক্রমশ লুই নেপোলিয়নের আয়ত্তের বাইরে চলে গেল। গ্রামীণ কায়েমি স্বার্থ ও মধ্যবিত্ত চাষি সম্প্রদায়ের যে অংশ তাঁকে সমর্থন করেছিল, শহরের নয়া ধনকুবেরদের উপরে তাঁকে কিছুটা নির্ভরশীল হতে হওয়ায় তারা ক্রমশ তাঁর বিরোধী হয়ে পড়ল। এই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানো তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। এদিকে শ্রমিক অসন্তোষ ও বিক্ষোভ আর চাপা রইল না। তারা সংগঠিতভাবে যে ধর্মঘটগুলোকে সফল করল, তা সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিল।

এ অবস্থায় শেষপর্যন্ত লুই নেপোলিয়ন যা করলেন তা হলো ‘জুয়াড়ির শেষ দান’ – আজকের বুর্জোয়া রাষ্ট্রেও প্রায়শই আমরা তা প্রত্যক্ষ করি। দেশের আভ্যন্তরীণ সঙ্কটকে আশু ধামা চাপা দিয়ে জনগণের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ১৮৭০ এর ১৯ জুলাই তিনি প্রুশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসলেন।

মার্কস-এঙ্গেলস জার্মান শ্রমিক শ্রেণিকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, এই যুদ্ধ যতক্ষণ তৃতীয় নেপোলিয়নের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, ততক্ষণ ন্যায়যুদ্ধ হিসাবে জার্মান শ্রমিক শ্রেণি একে সমর্থন করবে। কিন্তু বিসমার্ক যে মুহূর্তে এই যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করে ফরাসি জনগণের বিরুদ্ধে পরিচালিত করবে, সেই মুহূর্তে জার্মান শ্রমিক শ্রেণিকে যুদ্ধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। এই বক্তব্যের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিকের সাধারণ পরিষদ ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ার যুদ্ধ সম্পর্কে দুটি অভিভাষণ প্রকাশ করে। ফ্রান্স ও জার্মানির শাসকরা সেদিন যে ভাবে উগ্র জাতীয়তাবাদের আগুন জ্বালিয়েছিল তার বিরুদ্ধে জার্মান ও ফরাসি শ্রমিকদের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধকে মার্কস ও এঙ্গেলস সমর্থন করেন এবং তাদের উদ্বুদ্ধ করেন। মার্কস-এঙ্গেলসের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আন্তর্জাতিকের প্যারিস শাখা এ যুদ্ধের তীব্র বিরোধিতা করল। ফরাসি, জার্মান ও স্পেনীয় শ্রমিকদের আহ্বান জানাল দুই সাম্রাজ্যলোলুপ চক্রের এই যুদ্ধের বিরোধিতা করার জন্য। বার্লিনে সেদিন জার্মানির কমিউনিস্ট নেতা লিবনেখট আর বেবেল যুদ্ধ প্রসঙ্গে ভোটাভুটিতে যোগ দেননি। তাঁরা নেপোলিয়ন আর বিসমার্কের মধ্যে কাউকে সমর্থনযোগ্য মনে করেননি। যুদ্ধ-ঋণের পক্ষে ভোট না দেওয়ার জন্য বেবেল আর লিবনেখটের জেল হয়। জার্মানির এক সোস্যালিস্ট কাগজে যুদ্ধের স্বরূপ উদঘাটন করে লেখা হয়, ‘‘জার্মান সাম্রাজ্যবাদ ও ফরাসি সাম্রাজ্যবাদ নিজেদের মধ্যে লড়াই করে মরুক। তাদের রসদ জোগাক ডিভিডেন্ট-শিকারিরা। আমরা সর্বহারারা এই যুদ্ধের মধ্যে নেই।”

প্রুশিয়ার সৈন্যসংখ্যা ফ্রান্সের থেকে অনেক বেশি ছিল। অস্ত্রবল এবং সামরিক কৌশলেও ছিল উন্নত। প্রুশিয়া যখন যুদ্ধের জন্য সব দিক থেকে প্রস্তুত তখন ফ্রান্সের সেনাবাহিনীতে প্রবল বিশৃঙ্খলা। ফলে একটির পর একটি যুদ্ধে সরকার পরাস্ত হতে থাকল। ২ সেপ্টেম্বর সম্রাট নেপোলিয়ন ৮৪ হাজার সৈন্য, সাতাশশো অফিসার আর তিরিশ জন জেনারেল সহ সেডানের যুদ্ধক্ষেত্রে জার্মান বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। ফ্রান্সে নেপোলিয়ন যুগের অবসান হল।

৪ঠা সেপ্টেম্বর দেশের শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের এক বিরাট জনতা রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার পক্ষে ধ্বনি দিতে দিতে সংসদ সদনে প্রবেশ করল। এ সময়ে জনতার হাতে যে সব পোস্টার ছিল তাতে কমিউন প্রতিষ্ঠার পক্ষে দাবি জানানো হয়েছিল। জেনারেল ত্রশু্যর নেতৃত্বে একটি অস্থায়ী সরকার গঠিত হল। এই সরকার থেকে অত্যন্ত চালাকির সাথে ‘লালদের’ বাদ দেওয়া হল।

৯ সেপ্টেম্বর মার্ক্স প্যারিসের শ্রমজীবী জনগণকে সতর্ক করে বললেন, ফ্রান্সের সর্বহারা শ্রেণি ভয়ঙ্কর অসুবিধাজনক পরিস্থিতির মধ্যে এগিয়ে চলেছে। … নাগরিক হিসাবে ফ্রান্সের শ্রমজীবী জনগণকে অবশ্যই তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে, কিন্তু সাথে সাথে তাদের লক্ষ্য রাখতে হবে তারা যেন জাতীয় আবেগে ভেসে না যায়। … অতীতের পুনরাবৃত্তি ঘটালে চলবে না। তাদের গড়ে তুলতে হবে ভবিষ্যতকে। প্রজাতন্ত্র যে স্বাধীনতা দিয়েছে তাকে শান্তচিত্তে, দৃঢ়তার সাথে তারা ব্যবহার করুক, ব্যবহার করুক নিজেদের শ্রেণি সংগঠন গড়ে তোলার জন্য। ফ্রান্সের পুনরুত্থানের জন্য এ তাদের অসীম শক্তি দেবে, অসীম শক্তি দেবে আমাদের সবার যা সাধারণ কর্তব্য সেই শ্রমের মুক্তির কাজে। তাদের শক্তি ও প্রজ্ঞার উপর ফ্রান্সের প্রজাতন্তে্রর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।

২০ সেপ্টেম্বর প্রুশীয় বাহিনী বিনা বাধায় ভার্সাই দখল করে নিল। ২৬ সেপ্টেম্বর প্যারিকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল। অবরুদ্ধ প্যারি গোটা ফ্রান্স থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল।

বিসমার্কের সাথে অস্থায়ী সরকারের সব শান্তি আলোচনা ব্যর্থ হল। প্যারির শ্রমিক-জনতা কিন্তু প্রুশীয় বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়ে উঠল। প্যারি রক্ষার জন্য দৈনিক ১.৫০ ফ্রাঁ পারিশ্রমিকে সাড়ে তিন লক্ষ মানুষ ন্যাশনাল গার্ডে নাম লেখাল। এই ঘটনা দেখিয়ে দিল, ঠিক মতো উদ্যোগ নিলে ফরাসি সৈন্যবাহিনীর সৈন্য সংখ্যা জার্মানির সমান হতে পারত। কুড়িটা মহল্লার প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হল ন্যাশনাল গার্ডের কেন্দ্রীয় কমিটি। তারা দাবি জানাল, পৌর নির্বাচন আর সংবাদপত্রের অবাধ স্বাধীনতা। বলল, পৌরসভার হাতে ছেড়ে দিতে হবে ম্যাজিস্ট্রেট আর পুলিশের নিয়ন্ত্রণভার। শত্রুর কাছে কোনও জায়গা ছেড়ে দিয়ে আত্মসমর্পণ করা চলবে না।

অস্থায়ী সরকার জার্মান অবরোধ ভাঙার কোনও আন্তরিক চেষ্টাই করল না। নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে পড়ে থাকল অবরুদ্ধ প্যারি। মানুষের ক্ষোভ বাড়তে থাকল। এমন সময় শোনা গেল, তিয়ের (পরবর্তীকালে ভার্সাই সরকারের প্রধান) কূটনৈতিক আলোচনা সেরে ফিরে এসেছেন। শিল্পসমৃদ্ধ আলশাস এবং উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে সন্ধি করার জন্য সরকারের উপর চাপ দেওয়া হচ্ছে। ক্ষোভে ফেটে পড়ল প্যারি। ওতেল দ্য ভিল– প্যারির টাউন হল। দলে দলে জনতা, ন্যাশনাল গার্ডের লোকরা টাউন হলে দখল নিয়ে নিল। ে¦¡াগান তুলল, বিশ্বাসঘাতক সরকার নিপাত যাক। কমিউন দীর্ঘজীবী হোক।

বুর্জোয়াদের আস্থাভাজন সেনাবাহিনী দ্রুত টাউন হলে পৌঁছে পরিস্থিতি বদলে দিল। ব্লাঙ্কি সহ শ্রমিক নেতারা গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন। তাঁদের জেলে পাঠানো হল। ন্যাশনাল গার্ডের ষোল জন ব্যাটেলিয়ন কমান্ডারকে বরখাস্ত করা হল। তাদের মধ্যে ছিলেন কার্ল মার্ক্সের ভাবী জামাতা লোঁগে।

নেতারা জেলে, কিন্তু লাল পত্রপত্রিকা, ক্লাব সবই পুরোদমে সক্রিয়। সরকারের অপদার্থতার বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণ অব্যাহত থাকল। দাবি উঠতে থাকল, ন্যাশনাল গার্ড আর জনসাধারণের উপর ছেড়ে দাও প্রতিআক্রমণের ভার। সর্বত্র লাল পোস্টার দেখা গলে– এই সরকারকে হটিয়ে দিয়ে কমিউন গড়ে তোল। অন্য দিকে বুর্জোয়াদের মধ্যে লাল আতঙ্ক আবার ছড়াতে থাকল। তারা বলতে থাকল, ব্লাঙ্কির চেয়ে বিসমার্ক ভাল।

অনেক সময় নষ্ট, বেশ কয়েকটি প্রচেষ্টা, অনেক ক্ষয়ক্ষতির পর জাতীয় প্রতিরক্ষা সরকার শেষবারের মতো পাল্টা আক্রমণের পরিকল্পনা করল। এর মধ্যে একটা শয়তানি ছিল। ঠিক করল, এ বারের আক্রমণে নাশনাল গার্ড প্রধান অংশ নেবে। বেছে বেছে প্রুশিয়ার সবচেয়ে সুরক্ষিত অংশটি বাছা হল। যুদ্ধে প্রুশিয়দের হতাহতের সংখ্যা সাতশ, ফরাসিদের চার হাজার। তার মধ্যে দেড় হাজার গার্ড। প্যারির শ্রমিক মহল্লাগুলো নাশনাল গার্ডদের অহেতুক মৃত্যুর মুখে ঠেলে পাঠানো নিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়ল। শুরু হল অবরোধের সময়ে সবচেয়ে হিংস্র বিক্ষোভ। সরকারের প্রধান হিসাবে ত্রশু্যকে সরে যেতে হল।

বিপ্লব আসন্ন– এই আতঙ্ক প্রতিটি বুর্জোয়ার মনে বাসা বেঁধেছে। বুর্জোয়ারা বুঝল, দুটো ফ্রন্টে লড়াই আর নয়। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি প্রয়োজন। ২৭ জানুয়ারি বিসমার্কের সাথে সন্ধি হল। শর্ত– পাঁচশো কোটি ফ্রাঁ ক্ষতিপূরণ, আলশাস পুরো আর মেৎসের দুর্গগুলি সব লোরেনের বেশির ভাগ জার্মানির দখলে যাবে। অবিলম্বে ফ্রান্সে নির্বাচন হবে এবং নবনির্বাচিত আইনসভা পাকাপাকি ভাবে সন্ধির শর্ত অনুমোদন করবে। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মাত্র এক ডিভিশন সৈন্য রাখার অনুমোদন পাওয়া গেল।

গণদাবী ৭৩ বর্ষ ৩৯ সংখ্যা