পেহলু খান হত্যায় অভিযুক্তদের বেকসুর খালাস গণতন্ত্রের খোলসটাকেও বেআব্রু করে দিল

চাক্ষুষ প্রমাণ সত্ত্বেও যখন অভিযুক্তের শাস্তি হয় না, তখন প্রশাসন কিংবা বিচারব্যবস্থা বলে আদৌ কিছু দেশে আছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ জাগে৷ পেহলু খানের হত্যায় অভিযুক্তদের বেকসুর খালাস সেই সন্দেহকেই আরও দৃঢ় করল৷

একজনকে পিটিয়ে খুন করা হল, দু’জনকে মারাত্মকভাবে পিটিয়ে আধমরা করে ফেলে দেওয়া হল, স্ব–ঘোষিত গো–রক্ষকরা তিনজনকে নৃশংসভাবে পেটাচ্ছে এই ভিডিও দেখে সারা দেশ শিউরে উঠল– কিন্তু তার পরেও প্রমাণ হল না পেহলু খানকে মারা হয়েছে! রাজস্থানের আলওয়ারের জেলা আদালতে পুলিশের দায়সারা তদন্তে ব্যাপারটা এমনই দাঁড়িয়েছে৷ তাই দিনে–দুপুরে পিটিয়ে হত্যা করেও রেহাই পেয়ে গেল খুনিরা৷ সে সময় এনডিটিভি একটি স্টিং অপারেশন করেছিল, যার মধ্যে অন্যতম অভিযুক্ত বিপিন যাদব বর্ণনা দিয়েছিলেন, তিনি কীভাবে এই ঘটনায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন৷ তা সত্ত্বেও ‘প্রমাণের অভাবে’ মূল অভিযুক্ত ৬ জন আদালতের রায়ে বেকসুর খালাস পেয়ে গেল৷ এই লজ্জাজনক ঘটনায় ধিক্কার জানিয়েছেন দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ৷

বিচারপতি জানিয়েছেন, রাজস্থান পুলিশ ওই ভিডিওটি এবং যে ফোনে ভিডিওটি তোলা হয় সেগুলি আদালতে পেশই করেনি৷ ভিডিওটির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য কোনও ফরেন্সিক পরীক্ষাগারে সেটি পাঠানোর প্রয়োজনও বোধ করেনি পুলিশ৷ সাধারণ বুদ্ধিতে যে যে কাজগুলি একটি খুনের তদন্তে অবশ্যকরণীয় ছিল, সেগুলি পুলিশ করেনি৷ কেন করেনি? উত্তরটাও জানা– করতে চায়নি৷ কারণ, অভিযুক্তরা হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সঙ্গে যুক্ত৷ তাঁদের বাঁচানোই রাজস্থানের সদ্য প্রাক্তন বিজেপি সরকারের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল৷ সেজন্য পুলিশ–প্রশাসনকে সেভাবেই ব্যবহার করা হয়েছে৷ খান পরিবারের আইনজীবী বলেছেন, ‘বিজেপি সরকারের পুলিশ হত্যার মামলাকে লঘু করে দেখাতে পরস্পরবিরোধী দু’টি চার্জশিট দাখিল করে৷ কোর্টে এমনভাবে তথ্যাদি পেশ করা হয়েছে যাতে প্রমাণিত হয় পেহলু খানকে কেউ খুন করেনি৷’ কীভাবে? মৃত্যুর সময় পেহলু খান যে ছ’জন অভিযুক্তের নাম বলে গিয়েছিলেন, পুলিশ তাদের নাম দেয়নি চার্জশিটে৷ উল্টেমোবাইল ফোনের কলরেকর্ড ও একটি গোশালার এক কর্মচারীর সাক্ষ্য নিয়ে পুলিশ তিনজন নাবালক সহ অন্য কয়েকজনের নামে আলাদা চার্জশিট দিয়েছে৷ পুলিশ দু’রকম মেডিকেল সার্টিফিকেট দাখিল করেছে৷ পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট বলছে, একাধিক আঘাত পেয়ে এবং প্রবল রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয়েছে পেহলু খানের৷ কিন্তু আর একটি রিপোর্টে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার বলেছেন, হার্ট অ্যাটাকেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর৷ এই পুলিশি তদন্তের নমুনা এইভাবে মামলা সাজিয়ে তদন্ত প্রক্রিয়াকে আরও দুর্বল করেছে পুলিশ৷ তদন্তে ইচ্ছাকৃত গাফিলতি শাসক দল আশ্রিত অপরাধী কিংবা প্রভাবশালী অপরাধীদের ক্ষেত্রে ঘটে অহরহ, কিন্তু এই মামলা চলাকালীন পেহলু খানের দুই ছেলের বিরুদ্ধে যেভাবে গরু পাচারের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, তাতে পুলিশ–প্রশাসন যে মূল বিষয়টি থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইছে, তা পরিষ্কার৷ আজও এই মামলা থেকে অব্যাহতি মেলেনি পেহলু খানের ছেলেদের৷

রাজস্থানের আলোয়ারে ২০১৭ সালে যখন হরিয়ানার দুধ ব্যবসায়ী পেহলু খানকে বিজেপি মদতপুষ্ট ‘গো–রক্ষক’ বাহিনী পিটিয়ে মেরেছিল, সে সময় রাজ্যে সরকার ছিল বিজেপির৷ তাদের নির্দেশে পুলিশ তদন্ত আদৌ করেনি৷ কিন্তু কংগ্রেস ক্ষমতায় এসে নতুন করে তদন্তের ব্যবস্থা এবং পেহলু খানের ছেলেদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের ব্যবস্থাও করেনি৷ কারণ বিজেপি যে জন্য নরহত্যায় মদত দিয়েছে সেই একই হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে না চটানোর তাগিদেই কংগ্রেসও হত্যাকারীদের শাস্তি চায়নি৷

এই ঘৃণ্য রাজনীতির শিকার আজ ন্যায়বিচার৷ পবিত্র বিচারব্যবস্থা নিয়ে শত কথা বলে এভাবেই তাকে দু’পায়ে মাড়িয়ে যায় বুর্জোয়া শাসক দলগুলি৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ৫ সংখ্যা)