‘পিএম-কিসান’ বনাম ‘কৃষকবন্ধু’ কোনওটিই কৃষক সমস্যার সমাধান নয়

এপ্রিলে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন, রাজ্য নির্বাচন কমিশন এমনই ইঙ্গিত দিয়েছে। এই ভোটের দিকে তাকিয়েই কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ও রাজ্যের তৃণমূল সরকার প্রতিযোগিতায় নেমেছে কে কত জনদরদি তা প্রমাণ করতে। উভয়ই প্রকল্পের পর প্রকল্পের ঘোষণা করছে। এতে সাধারণ মানুষের উল্লসিত হওয়ারই কথা, কিন্তু তাঁরা দেখছেন আসলে এ সবই ফাঁকা আওয়াজ মাত্র।

কেন্দ্রের সরকার বলছে, ‘প্রধানমন্ত্রী কিসান সম্মাননিধি যোজনা’র মধ্য দিয়ে কৃষকদের ভাল করব। রাজ্য সরকার বলছে ‘কৃষকবন্ধু’ প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের মানোন্নয়ন ঘটাব। ভাল থেকে আরও ভাল করার প্রতিযোগিতা হলে মন্দ কী? কিন্তু খটকা-টা অন্য জায়গায়।

কেন্দ্রীয় সরকার বলছে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের চাষে সহায়তা করতে বছরে ৬ হাজার টাকা দেওয়া হবে। অর্থাৎ, পরিবার পিছু বরাদ্দ মাসে ৫০০ টাকা। পরিবারের সদস্য চার জন ধরলে মাথাপিছু মাসিক বরাদ্দ ১২৫ টাকা। এই হিসাবে দৈনিক মাথাপিছু বরাদ্দ মাত্র ৪ টাকা, যা দিয়ে এক কাপ চাও জুটবে না। এটা কি কৃষকদরদ না কি কৃষকদের দুর্দশা নিয়ে তামাশা? এই ভিক্ষাতুল্য অনুদানটুকুও যাতে নির্ঝঞ্ঝাটে সব কৃষক না পায় তারও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে প্রকল্পে। বহু শর্ত আরোপ করা হয়েছে যাতে বড় সংখ্যায় কৃষককে বাদ দেওয়া যায়। তাতে সরকার দায়মুক্ত থাকতে পারে। এ ছাড়াও ‘প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা’, ‘প্রধানমন্ত্রী কিসান সিঁচাই যোজনা’, ‘প্রধানমন্ত্রী কিসান মনধন যোজনা’র মতো আরও প্রকল্প রয়েছে। প্রকল্প অনেক, কিন্তু টাকার বরাদ্দ যা, তাতে কিছুই হয় না। সেদিকে সরকারের নজর নেই, তাদের একমাত্র তৎপরতা প্রকল্পগুলির প্রতিটিতেই প্রধানমন্ত্রীর নাম যুক্ত করায়। ভোটই যে একমাত্র লক্ষ্য, কৃষক কল্যাণ সেখানে নিমিত্ত মাত্র তা সহজেই বোঝা যায়।

সম্প্রতি কিসান রেল প্রকল্পে হাওড়াকে জোড়া হয়েছে এবং মহারাষ্টে্রর সাঙ্গোলা থেকে শালিমার পর্যন্ত বিশেষ ট্রেনের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। রেলপথে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ফসল পৌঁছে দেওয়ার জন্যই নাকি এমন সিদ্ধান্ত! এমনকি কৃষি সম্পদ যোজনার আওতায় ফুড পার্ক, কোল্ড চেইন পরিকাঠামো, অ্যাগ্রো প্রোসেসিং ক্লাস্টারের মতো সাড়ে ৬ হাজার ‘মেগা’ প্রকল্পের ঘোষণা করেছেন তিনি। এগুলির সুবিধা কি গরিব-প্রান্তিক কৃষক পাবে? না কি অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রি অর্থাৎ কৃষিজপণ্যের বৃহৎ ব্যবসায়ীরা, বড় বড় পুঁজিপতিরা এর সুফল পাবে? এই বিনিয়োগ প্রধানমন্ত্রী করেছেন বৃহৎ পুঁজিপতিদের জন্যই। এমনকি খাদ্যশস্য মজুত করার বরাতও বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দিচ্ছে মোদি সরকার। সরকারি সংস্থা এফসিআই-এর খাদ্যশস্য মজুত করার বরাত প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন তাঁর অন্যতম বন্ধু এবং নির্বাচনী তহবিলের জোগানদার আদানি এগ্রিলজিস্টিকসকে (আনন্দবাজার পত্রিকা : ৪। ১। ২০২১)। আদানি গোষ্ঠীর এই সংস্থা এখন এফসিআই-এর হয়ে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, তামিলনাড়ু, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গে ৫ লক্ষ ৭৫ হাজার টন খাদ্যশস্য মজুত করার দায়িত্বে। মধ্যপ্রদেশে আরও ৩ লক্ষ টন খাদ্যশস্য মজুত করার দায়িত্ব নিয়েছে আদানি। ২০১৬-র পর থেকে এই সমস্ত চুক্তি হয়েছে। এমনকি ৩০ বছরের এই চুক্তিতে প্রতি টন খাদ্যশস্যের জন্য নির্দিষ্ট আয়ের গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে আদানির ওই সংস্থাকে।

বিজেপি নেতারা তারস্বরে প্রচার করছেন, কিসান সম্মাননিধি প্রকল্পের বিরাট সুযোগ নাকি পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের দিচ্ছে না রাজ্যের তৃণমূল সরকার। সম্প্রতি খবরে প্রকাশ, পিএম-কিসান প্রকল্প চালুর ক্ষেত্রে তৃণমূল সহযোগিতা করবে। শুনে আবার বিজেপি নেতারা হাত কামড়াচ্ছেন। কারণ তৃণমূল বিরোধিতার একটা ইস্যু তাদের হাতছাড়া হয়ে গেল। এ দিকে তৃণমূল সরকার বলছে, তারাই প্রকৃত কৃষকদরদি। কৃষকবন্ধু প্রকল্পের মধ্য দিয়ে তারা কৃষক পরিবারকে বছরে ৫ হাজার টাকা করে দেবে। সেই একই রকম সস্তা চমক। কৃষকদের ফসলের ন্যায্য দাম দেওয়ার কোনও চেষ্টা কারও নেই।

কৃষকদের উপকার করাই যদি সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য হত, তা হলে তাদের আসল সমস্যাগুলির সমাধান করত সরকার। সার, বীজ, কীটনাশক সস্তায় দেওয়ার ব্যবস্থা, সেচে বিদ্যুৎ বিনামূল্যে দেওয়া, ফসলের ন্যায্য দাম দেওয়ার ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য চালু করা, ভাগচাষি-ক্ষুদ্রচাষিদের বিনা সুদে ঋণ– ইত্যাদি চাষের জন্য যা যা প্রয়োজন সে সমস্ত ব্যবস্থা কেন্দ্র-রাজ্য কোনও সরকার করছে না। উল্টে সরকারি নীতির পরিণামে বহুজাতিক কোম্পানির থেকে অগ্নিমূল্যে বীজ, সার, কীটনাশক, বিদ্যুৎ কিনতে বাধ্য হচ্ছে চাষি। তারা ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) পাচ্ছে না। সরকারি ক্রয়ব্যবস্থা না থাকার ফলে বাস্তবে জলের দরে বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দিতে হচ্ছে রক্ত-জল করা পরিশ্রমে ফলানো ফসল, চাষের খরচটুকুও উঠছে না। পরিবার নিয়ে পথে বসছেন অনেকে। আত্মহত্যার পথে যেতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষিজীবী মানুষ। এই পরিস্থিতি তৈরির জন্য দায়ী বর্তমানে বিজেপি, পূর্বতন কংগ্রেস সরকার। তারা দেশি-বিদেশি পুঁজিপতিদের স্বার্থে কৃষকদের উপর শোষণের স্টিমরোলার নামিয়ে এনেছে। পুঁজিপতিদের আরও মুনাফা বৃদ্ধির সুযোগ দিতে পথে বসিয়েছে চাষিকে। এই অবস্থায় ভিক্ষাতুল্য অনুদান ঘোষণা বাস্তবে গোড়া কেটে আগায় জল দেওয়ার নামান্তর।