পাশ–ফেল : ৩০ জানুয়ারি মহামিছিলে সামিল হোন

পাশ–ফেল : রাজ্য আর কতদিন কেন্দ্রের দোহাই দেবে

 ৩০ জানুয়ারি মহামিছিলে সামিল হোন

এস ইউ সি আই (সি) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি অবিলম্বে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ–ফেল চালু সহ জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি সমাধানের দাবিতে কলকাতায় ৩০ জানুয়ারি মহামিছিলের ডাক দিয়েছে৷

পাশ–ফেল চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও রাজ্য সরকার রক্ষা করেনি৷ কর্মসংস্থান শূন্যে নেমে এসেছে৷ সরকার মদের ঢালাও লাইসেন্স দিয়ে চলেছে৷ চাষিরা ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না, প্রতিদিন কোনও না কোনও কারখানা বন্ধ হচ্ছে, শ্রমিকদের উপর চাপানো হচ্ছে নিত্যনতুন কালাকানুন৷ কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারের জনবিরোধী নীতির ফলে জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠছে৷ এরই প্রতিবাদে মহামিছিলের ডাক৷

দলের রাজ্য কমিটির সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে চার সদস্যের এক প্রতিনিধি দল চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকেই পাশ–ফেল চালু করার দাবি জানাতে ২৭ ডিসেম্বর বিধানসভায় উচ্চশিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জীর সাথে সাক্ষাৎ করেন৷ দাবি মেটানোর পরিবর্তে মন্ত্রীমশায় আবারও সেই পুরনো কথার পুনরাবৃত্তি করে বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার এখনও সুস্পষ্টভাবে না জানানোর ফলে শিক্ষামন্ত্রী হিসাবে তিনি আগেও চিঠি দিয়েছেন এবং আবারও দেবেন৷

কিন্তু চিঠি দেওয়ার কথা তাঁর এস ইউ সি আই (সি)–র ডেপুটেশন দিতে যাওয়ার পর মনে পড়ল কেন? এতদিন তিনি চিঠি দেননি কেন? আর শুধু চিঠিই বা কেন, যদি তিনি আন্তরিকভাবেই মনে করেন পাশ–ফেল না থাকার ফলে ছাত্রছাত্রীদের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে, দু’ধরনের নাগরিক তৈরি হয়ে যাচ্ছে, এমনকী সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলি উঠে যাচ্ছে, তবে তিনি কিংবা তাঁর সরকার এতদিন নিশ্চুপ থাকলেন কেন? ইদানিং তো কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে তাঁরা দু’বেলা হুঙ্কার ছাড়ছেন, পাশ–ফেল চালুর দাবিতে তাঁদের কোনও হুঙ্কার শোনা গেল না কেন? মুখমন্ত্রী তো কেন্দ্রে সরকার পাল্টে বিরোধীদের সরকার গড়তে উঠেপড়ে লেগেছেন৷ সাম্প্রদায়িক, জনবিরোধী, একচেটিয়া পুঁজির গোলাম এই সরকারকে সরানোই দরকার৷ কিন্তু কেন্দ্রের সরকারের যে নীতিতে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রী চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রীকে সেই দাবিতে বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ করতে দেখা যাচ্ছে না কেন? এই লড়াইয়ে তো তাঁরা রাজ্যের বেশির ভাগ মানুষকেই পেতেন৷ তা না করে শিক্ষামন্ত্রী স্কুলছুটের বস্তাপচা তত্ত্ব আবার আওড়েছেন৷ এ রাজ্যের পূর্বতন সিপিএম সরকারও ৩৬ বছর আগে পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার সর্বনাশটি করার সময় ঠিক এই কুযুক্তিটি তুলেছিল৷ কিন্তু পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার পরও স্কুলছুট কমার পরিবর্তে তা যে ঊর্ধ্বমুখী, এ সত্য আজ প্রমাণিত৷ এ রাজ্যের অভিভাবকদের মধ্যে এ নিয়ে কোনও বিভ্রান্তি নেই৷ তবুও শিক্ষামন্ত্রী সেই বাতিল হওয়া যুক্তিকে আবার আস্তাকুঁড় থেকে তুলে আনলেন৷ এ থেকেই তো বোঝা যায়, এমন একটি গুরুতর বিষয়ে তাঁরা আদৌ আন্তরিক নন৷ এরই প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি মহামিছিল৷

পাশ–ফেলের সঙ্গে স্কুলছুটের সম্পর্ক নেই

 এস ইউ সি আই (সি)–র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য ২৮ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে বলেন,

‘‘গতকাল রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সাংবাদিকদের বলেছেন, প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল চালু করার ক্ষেত্রে তাঁরা স্কুলছুটের সমস্যা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত৷ কারণ, পাশ–ফেল চালু হলে নাকি স্কুলছুট বেড়ে যাবে এ রাজ্যের পূর্বতন সিপিএম সরকারও পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার সময় ঠিক এই কুযুক্তিটি তুলেছিল৷ কিন্তু পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার পরও বাস্তবে স্কুলছুট কমার পরিবর্তে তা যে ঊর্ধ্বমুখী, এ সত্য অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই৷ আমরা তখনই দেখিয়েছিলাম যে, স্কুলছুটের পেছনে শিক্ষার ভার বা ফেল করার সমস্যা কারণ নয়৷ মূল কারণ দারিদ্র্য৷ এখনও আমরা দেখছি, যারা সেদিন ‘ইংরেজি সাম্রাজ্যবাদী ভাষা’– এ কথা বলে প্রাথমিকে ইংরেজি চালু করার বিরোধিতা করেছিলেন, যার সর্বনাশা ফলাফল আজও এ রাজ্যের কোটি কোটি ছেলেমেয়েদের ভুগতে হচ্ছে, ‘পাশ–ফেল চালু করলে স্কুলছুট বাড়বে’– এই যুক্তিটিও তাদেরই৷ এই যুক্তিও একইরকম বিভ্রান্তিমূলক যা সরকার মেনে নিলে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের জীবনে অন্ধকারকেই আরও দীর্ঘায়িত করা হবে৷

ফলে আমরা শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং এ জাতীয় অযৌক্তিক চিন্তার দ্বারা পরিচালিত না হওয়ার দাবি জানাচ্ছি৷’’

 

 

দল–মত–ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের গরিব মধ্যবিত্ত জনসাধারণের অকুণ্ঠ সমর্থন নিয়ে প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল চালুর দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দেশ জুড়ে আন্দোলন চালিয়ে আসছে৷ সেই ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে কেন্দ্রীয় সরকার ২০০৯ সালের শিক্ষার অধিকার আইনে সংশোধন এনে পাশ–ফেল চালু করার কথা বলতে বাধ্য হয়েছে৷ ওড়িশা সরকার সম্প্রতি ২০১৯–এর শিক্ষাবর্ষেই প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ–ফেল চালুর ঘোষণা করেছে৷ অথচ পশ্চিমবঙ্গ সরকার এখনও টালবাহানা করে চলেছে৷ কেন্দ্রীয় সরকার না রাজ্য সরকার এই ঠেলাঠেলি করে অসংখ্য ছাত্রছাত্রীর ক্ষতি করে চলেছে৷

সকলেরই মনে আছে, বহু মিছিল–মিটিং–স্বাক্ষর সংগ্রহ–আইন অমান্য সহ দীর্ঘ আন্দোলনের পরও সরকার দাবি মানতে রাজি না হলে ২০১৭ সালের ১৭ জুলাই এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) এ রাজ্যে সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান জানিয়েছিল৷ প্রথম শ্রেণি থেকেই পাশ–ফেল চাই– এই দাবিতে সেদিন পশ্চিমবঙ্গের ঘরে ঘরে মানুষ ধর্মঘট সফল করার জন্য যখন প্রস্তুত, সেই প্রবল জনমতের চাপে শিক্ষামন্ত্রী লিখিতভাবে অবিলম্বে পাশ–ফেল চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন৷ ওই বছরের ২২ ডিসেম্বর বিকাশ ভবনে শিক্ষামন্ত্রীর উপস্থিতিতে শিক্ষাবিদ, শিক্ষক সংগঠনের প্রতিনিধি ও কয়েকজন রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে সভা হয়েছিল তাতে সিপিএম দলের প্রতিনিধি ছাড়া প্রায় সকলেই প্রথম শ্রেণি থেকেই পাশ–ফেল চালু করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন৷ শিক্ষামন্ত্রীর দলের শিক্ষক সংগঠনের প্রতিনিধিরাও সহমত পোষণ করেছিলেন৷ এই পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যের মানুষ আশা করেছিল, ২০১৮ শিক্ষাবর্ষ থেকেই রাজ্য সরকার পাশ–ফেল চালু করে দেবে৷ কিন্তু তা তো হয়ইনি, এমনকী আর একটি শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়ে গেলেও সরকার নিশ্চুপ৷ একে জনমত বা জনস্বার্থের প্রতি তাঁদের চূড়ান্ত অবজ্ঞা, অসম্মান, প্রতারণা ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে

শিক্ষার দাবি ছাড়াও জনজীবনের অন্যান্য সমস্যাগুলির সমাধানও এই মিছিলের দাবি৷ কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের জনবিরোধী নীতির ফলে ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে ঋণের ফাঁদে পড়ে কৃষকরা আত্মহত্যা করছে৷ একের পর এক কলকারখানা বন্ধ হচ্ছে, লে অফ–লক আউট–ছাঁটাই–এর যাঁতাকলে কর্মচ্যুত শ্রমিক পথে বসেছে৷ কোটি কোটি বেকার কাজ্যের সন্ধানে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে, এমনকী বিদেশেও ছুটে যাচ্ছে৷ আর সরকার চাকরির পরিবর্তে মদের জোগান দিয়ে যাচ্ছে৷ হাজার হাজার মদের দোকান শুধু নয়, কারখানা পর্যন্ত খুলে দিচ্ছে৷

আসলে, বেকার যুবক, খেটে খাওয়া মজুর, ফসলের দাম না পাওয়া চাষি, নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা নারী বাঁচল কি মরল– এ নিয়ে কি কেন্দ্র কি রাজ্য, কোনও সরকারেরই কোনও মাথাব্যথা নেই৷ এদের শুধু চাই ভোট– এমএলএ, এমপি, গদি৷ তাই লোকসভা নির্বাচনের আগে ভারতের বড়–ছোট, জাতীয়–আঞ্চলিক, এমনকী তথাকথিত বামপন্থী দলগুলিও দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে চলেছে ভোটের নেশায়৷ কীভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায়, আর কীভাবে ক্ষমতা দখল করা যায়, কার সাথে গেলে দুটো বেশি আসন পাওয়া যায়– মোক্ষলাভের এই উদগ্র লালসায় কোনও নীতি–নৈতিকতা নেই, কোনও জনস্বার্থ নেই৷ তাই কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে ভোটের স্বার্থেই একদিকে বিজেপির ‘রথযাত্রা’ তো পাল্টা তৃণমূলের ‘পবিত্রযাত্রা’৷ এর সাথে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, অনাহারে জর্জরিত জনসাধারণের কোনও সম্পর্ক নেই৷

একমাত্র এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দল উন্নত আদর্শভিত্তিক রাজনীতিকে হাতিয়ার করে জনস্বার্থে লড়াই করে চলেছে৷ ইতিহাস দেখিয়েছে, একমাত্র সঠিক নেতৃত্বে গণআন্দোলনের দ্বারাই মানুষের দাবি আদায় সম্ভব৷ দীর্ঘ ১৯ বছর আন্দোলনের পরে ইংরেজি চালু করতে বাধ্য হয়েছিল তৎকালীন সিপিএম সরকার৷ প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল চালুর দাবিও গণআন্দোলনের চাপেই সরকারকে মানতে বাধ্য করা সম্ভব হবে৷  ৩০ জানুয়ারির মহানগরী দেখবে সংগঠিত গণআন্দোলনের সেই রূপ– মহামিছিল৷ শুরু হবে হেদুয়া পার্ক থেকে৷ সামিল হবে রাজ্যের প্রতিটি জেলার হাজার হাজার খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ, শ্রমিক কৃষক যুবক মহিলা৷ আপনিও সামিল হোন দাবি আদায়ের এই মহামিছিলে৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ২১ সংখ্যা)