‘পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের স্বর্গরাজ্যে’ এ কী তাণ্ডব!

ক্যাপিটল ভবনে হামলা

বুর্জোয়া গণতন্ত্র যে আজ কতটা অন্তঃসারশূন্য ফাঁপা খোলসে পরিণত হয়েছে, তা ‘পার্লামেন্টারিগণতন্ত্রের স্বর্গরাজ্যে’ নজিরবিহীন তাণ্ডবে আরও একবার স্পষ্ট হল। ৬ ডিসেম্বর আমেরিকার প্রধান প্রশাসনিক ভবন ক্যাপিটলে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমর্থকদের প্রবল তাণ্ডব সেই সত্যকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল। এ ঘটনা এমন একটি দেশের যার শাসকরা নিজেদের গোটা পৃথিবীর গণতন্তে্রর রক্ষক বলে অবিরত জাহির করে। যে নির্বাচনী ব্যবস্থাটিকে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি বলে মনে করা হয়, ক্যাপিটলে শ্বেতাঙ্গবাদীদের এ দিনের তাণ্ডব সেই ব্যবস্থাটির ওপরেই সরাসরি পদাঘাত করল। পছন্দের প্রার্থী পরাজিত হওয়া মাত্র একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে ধাপ্পাবাজি বলে দাগিয়ে দেওয়া এবং গায়ের জোরে ভোটের ফলাফল ভণ্ডুল করে দেওয়ার এই প্রচেষ্টা গণতন্তে্রর প্রতি বুর্জোয়া শাসকদের মনোভাব কী, তা প্রমাণ করে দিয়ে গেল। মার্কিন গণতন্ত্রের শবদেহে যে আবরণটুকু ছিল, ট্রাম্প-সমর্থকদের এই তাণ্ডব সেটুকুও সরিয়ে দিয়ে গেল।

ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পদে বসেইছিলেন বিপুল কারচুপির অভিযোগ ঘাড়ে নিয়ে। কারচুপির অভিযোগের মধ্যেই নিজের মেয়াদ শেষ করলেন তিনি। এবারের নির্বাচনের বেশ আগে থেকেই ট্রাম্প ঘোষণা করে দেন যে কারচুপি না হলে ভোটে কোনও মতেই তিনি হারতে পারেন না। গণনা শুরু হওয়ার পর প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের থেকে পিছিয়ে পড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে এই নির্বাচনকে সরাসরি ধাপ্পাবাজি বলে বিপুল শোরগোল শুরু করেন ট্রাম্প। সমাজমাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমের একাংশকে পাশে নিয়ে নিজের সমর্থক শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের ক্রমাগত এই বলে উস্কানি দিতে থাকেন যে, বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থাবিরোধী উদারবাদীদের কারচুপিতেই হারছেন তিনি। দায়ের করেন ৬২টি মামলা, যদিও প্রতিটিতেই হারতে হয় তাঁকে। শেষ পর্যন্ত ৬ ডিসেম্বর যেদিন ক্যাপিটলে সেনেট সদস্যরা জড়ো হয়েছিলেন নির্বাচনের ফল আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করতে, সেদিন ট্রাম্পের উস্কানিতে তাঁর সমর্থক বর্ণবিদ্বেষী, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী দক্ষিণপন্থী কয়েকশো জনতা লন্ডভণ্ড করে দেয় মার্কিন গণতন্তে্রর প্রতীক এই ভবনটিকে। চলে লুটপাট, ভাঙচুর। মৃত্যু হয় পাঁচজনের।

এ কোনও আচমকা ঘটে যাওয়া বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এই ভয়ঙ্কর ক্ষোভ-ক্রোধের পিছনে রয়েছে আমেরিকার সমাজ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বীভৎস আর্থিক বৈষম্য, ব্যাপক বেকারি ও চরম গরিবির মতো সমস্যাগুলি, কোনও শাসকই যার সমাধানের কোনও দিশা দেখাতে পারছে না। বর্তমান মুমূর্ষু পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখে এই সমস্যাগুলির সমাধান করা কারও পক্ষে সম্ভবও নয়, তা সে দেশ যত ধনীই হোক না কেন। সেই কারণেই অর্থ ও অস্ত্র ভাণ্ডারের বহরে গোটা বিশ্বের মাথায় চড়ে বসে থাকা আমেরিকাও আজ আর পাঁচটা পুঁজিবাদী দেশের মতোই অসংখ্য সংকটের আবর্তে হাবুডুবু খাচ্ছে। গরিবি, বেকারি ও প্রবল আর্থিক বৈষম্যের ফাঁসে ছটফট করছে সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে-খাওয়া মানুষ। ‘মধ্যবিত্তের স্বপ্ন’ আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ মধ্যবিত্ত অংশ আজ অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়ে নিম্নবিত্তের জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। চরম দারিদ্র, বেকারত্বের পাশাপাশি সমাজের বীভৎস আর্থিক বৈষম্যের চেহারাটা সাম্প্রতিক করোনা অতিমারিতে আরও প্রকট হয়েছে।

এই অবস্থায় অসংখ্য সমস্যায় জর্জরিত অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশের শাসকদের মতোই দক্ষিণপন্থাকে আশ্রয় করে সমাজের একটি অংশকে টার্গেট করে, যাবতীয় সমস্যার দায় তাদের ওপর চাপিয়ে নিজেদের পিঠ বাঁচানোর চেষ্টা করছে মার্কিন পুঁজিপতি শ্রেণি। ট্রাম্প তাদেরই প্রতিনিধি। বস্তুত ট্রাম্প প্রথম নন, মার্কিন সমাজে বিদ্বেষের বীজ বোনার কাজ বহু আগেই শুরু করেছেন তাঁর পূর্বতন শাসকরা। আগে যে আড়ালটুকু ছিল, পুঁজিপতি শ্রেণির ত্রাতা হিসাবে চ্যাম্পিয়ন সাজতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সে সব ছুঁড়ে ফেলে একেবারে নগ্ন ভাবে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী বর্ণবিদ্বেষ, অভিবাসী বিদ্বেষের় আগুন উস্কে দিয়েছেন। বেকারি, গরিবি, বৈষম্য, শিক্ষা ও চিকিৎসা না মেলার মতো সমাজের মৌলিক সমস্যাগুলির জন্য কৃষ্ণাঙ্গ ও অভিবাসী মানুষকে দায়ী করে সে দেশের শ্বেতাঙ্গ মধ্যবিত্তের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছেন ট্রাম্প। বিজ্ঞানবিরোধী, যুক্তিহীন, দক্ষিণপন্থী, বর্ণবিদ্বেষী আধিপত্যবাদের উস্কানি দিয়ে ক্রমাগত উত্তেজিত করে তুলেছেন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার চূড়ান্ত সংকটে জর্জরিত দেশের শ্বেতাঙ্গ সমাজের বঞ্চিত ও ক্ষুব্ধ ব্যাপক অংশটিকে। এই কাজে ট্রাম্পকে পুরো মদত দিয়েছে কর্পোরেট পরিচালিত মার্কিন মিডিয়া। এরই ফল এদিনের হামলা।

শুরু থেকেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদী মানসিকতার প্রকাশ দেখে শিউরে উঠেছে গোটা বিশ্ব। তাঁর চরম ঔদ্ধত্য, কৃষiরাঙ্গ ও অভিবাসীদের প্রতি বর্ণবাদী বিদ্বেষ, উদ্বাস্তুদের প্রতি চূড়ান্ত নিষ্ঠুরতা, পুরুষতান্ত্রিক অশালীন নানা মন্তব্য ও নারীঘটিত কেলেঙ্কারির একের পর এক উন্মোচন দেখতে দেখতে শুধু আমেরিকা নয়, গোটা পৃথিবীর শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই নির্বাচনে তাঁর পরাজয় চাইছিলেন। ক্ষমতা থেকে আপাতত উৎখাত হয়েছেন ট্রাম্প। কিন্তু সংকটগ্রস্ত মার্কিন পুঁজিপতি শ্রেণি যে ফ্যাসিবাদী, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী, বিদ্বেষী মনোভাব সমাজ জুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে, ট্রাম্পের পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে কি তা দূর হয়ে যাবে? সন্দেহের কারণ নেই– তা যাবে না। বিশ্ব জুড়ে ধিক্কৃত ট্রাম্প এবারের নির্বাচনেও একটা বড় অংশের মানুষের ভোট পেয়েছেন। এমনকি ক্যাপিটল ভবনে হামলার এই ঘটনা সমর্থন করেছেন রিপাবলিকান পার্টির ৪৫ শতাংশ সমর্থক! বাস্তবে আমেরিকায় গত বেশ কয়েক বছর ধরেই নব্য ফ্যাসিস্টদের উত্থান লক্ষ করা যাচ্ছে। একের পর এক ঘটনায় মার্কিন সমাজের আপাত উদার, গণতান্ত্রিক আবরণ ছিঁড়ে ফুটে বেরোচ্ছে ভিতরে লুকিয়ে থাকা বর্ণবিদ্বেষী, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের অস্তিত্বের ব্যাপকতা। মার্কিন পুঁজিপতি শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতায় ট্রাম্প এই অংশটির ‘হিরো’ সেজে বসেছিলেন। আগামী দিনে মার্কিন অর্থনীতির সংকট আরও বাড়বে। আজ ট্রাম্প সরে গেলেও আগামী দিনে সেই সংকটের থেকে দৃষ্টি ঘোরাতেই মার্কিন বুর্জোয়া শ্রেণি আবার নতুন ‘ট্রাম্প’কে খুঁজে নেবে।

ইউরোপের বহু দেশেও আজ একই চিত্র। সেখানেও পুঁজিবাদী সংকটের সর্বব্যাপক আক্রমণের সামনে পড়া সাধারণ মানুষের অভিযোগের বর্শামুখ ঘুরিয়ে দিতে ধর্ম, গায়ের রঙ বা অন্য কোনও বিষয়কে কেন্দ্র করে সমাজের একটি অংশের মানুষকে চিহ্নিত করে তাদের বলির পাঁঠা বানাচ্ছে শাসকরা। সেই প্ররোচনায় পা দিয়ে গরিবির চাবুক খাওয়া বহু কর্মহীন যুবক ‘নয়া নাৎসি’ বনে যাচ্ছে। সমাজে বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে দক্ষিণপন্থার। ঠিক একই কারণে ভারতের মাটিতেও পুঁজিপতি শ্রেণি মদত দিচ্ছে দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলিকে। সেগুলিকে প্রচার দিচ্ছে, অর্থ জোগাচ্ছে। তাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে অনায়াসে বন্ধুত্ব হয়ে যায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির। মোদি ও তাঁর দলবল ট্রাম্পের মতোই কুসংস্কার, উগ্র জাতীয়তা ও ধর্মবিদ্বেষে উস্কানি দেয়, সংকটে জর্জরিত সাধারণ মানুষের ঐক্য নষ্ট করার অপচেষ্টা চালায়। ক্যাপিটল বিল্ডিংয়ে দুর্বৃত্তদের হামলায় তাই ভারতের জাতীয় পতাকা হাতে এক অভিবাসী ভারতীয়কেও দেখা যায় যিনি ট্রাম্পের অন্ধ ভক্ত।

ট্রাম্প-মোদিরা দেশে দেশে একই সংকটগ্রস্ত পুঁজিপতিদের প্রতিনিধি। যতদিন মানুষের ওপর মানুষের শোষণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থা অন্তিম শ্বাসের জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকবে, ততদিন শাসকরা নিজেদের কোনও ক্রমে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সমাজে এমনই চরম দক্ষিণপন্থা ও অন্ধ বিদ্বেষের বিষ ছড়াবার কাজে এমন সব প্রতিনিধিদেরই বেছে নেবে। আর তারা এভাবেই পুঁজিবাদের শেষ আশ্রয় ফ্যাসিবাদের জমি তৈরির অপচেষ্টা চালাবে। গণতন্ত্র টিকে থাকবে শুধু সংবিধানের পাতায় ছাপা কালো অক্ষরগুলিতে আর সংসদ ভবনের সুসজ্জিত কাঠামোয়। সে সব ভেদ করে ক্যাপিটল ভবনে হামলার মতো ঘটনাগুলির মধ্য দিয়ে মাঝে মাঝেই বে-আব্রু হয়ে পড়বে পচা গলা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক কদাকার চেহারাটা।