পাঠকের মতামত : কৃত্তিকারা কি এভাবেই হারিয়ে যাবে!

জি ডি বিড়লা স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী কৃত্তিকা পালের মৃত্যু আরেকবার গোটা সমাজকে নাড়িয়ে দিল৷ যেভাবে হাতের কব্জি কেটে অস্বাভাবিক যন্ত্রণা ভোগ করে সে মৃত্যুবরণ করল তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়৷ প্রশ্ন হচ্ছে, এই ঘটনার পর কি অভিভাবকরা শিক্ষা নেবেন, স্কুল কর্তৃপক্ষ কি অনেক বেশি দায়িত্ববান হবেন, নাকি এই ধরনের ঘটনা আর কখনও ঘটবে না? ব্যাপারটা সেরকম নয়৷ মনোবিজ্ঞানীদের যতই সতর্কতামূলক বিশ্লেষণ থাকুক না কেন বা প্রশাসনিক তৎপরতা বৃদ্ধি পাক না কেন এ ঘটনা আবার ঘটার প্রবণতা রোধ করা যাবে না, যেমন করে সিগারেট প্যাকেটের উপরে স্বাস্থ্য সতর্কীকরণ বার্তা দেওয়া থাকলেও ধূমপান বন্ধ হয় না৷

কী করব, কেমন করে চলব তার নির্দেশনা আজকের এই অসুস্থ সমাজ থেকেই আমাদের চিন্তাজগতে স্থান পায়৷ অভিভাবকরা চান তাঁদের সন্তান যেন ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠিত হয় অর্থাৎ টাকা উপার্জন করতে শেখে৷ তাই চূডান্ত প্রতিযোগিতায় সাফল্য পেতে আগে থেকেই অনেকটা এগিয়ে রাখতে গিয়ে তাকে অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে নিজেদের অজান্তেই ঠেলে দেন৷ তার মধ্যে নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ গঠনের চেষ্টাও করা হয় না৷ সমাজবিমুখ ভাবেই সে বড় হতে থাকে একাকী৷ তারই সঙ্গে বেড়ে ওঠা তার আবেগ, অনুভূতির প্রতি কোনও মর্যাদাই দেওয়া হয় না৷ তার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে তাকে বোঝার চেষ্টা করা হয় না৷ তাকে দেওয়া হয় শুধু কর্মচারী হওয়ার শিক্ষাটুকু৷ প্রকৃত মানুষ হতে তাকে শেখানো হয় না৷ ঘর, স্কুল, পাড়া সমস্ত জায়গা থেকেই প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণে সে ব্যর্থ হয়৷ আর বাবা–মায়ের ব্যস্ত জীবনের কারণে তাঁদের যথার্থ সঙ্গ না পেয়ে তারা শিখে উঠতে পারে না বেঁচে থাকার প্রকৃত মানে৷ বাবা মায়েরা মনে করেন সাফল্যের জন্য প্রয়োজন সকলের থেকে এগিয়ে থাকার মানসিকতা৷ যে মানসিকতা সন্তানের মধ্যে সৃষ্টি করে জেদ, অন্যের প্রতি  বিদ্বেষমূলক আচরণ৷ আর সবশেষে অসফলতাকে ঘিরে তৈরি হয় এক মানসিক অস্থিরতা৷ এসবই কৃত্তিকাদের মতো কিশোর–কিশোরীদের ঠেলে দেয় আত্মহননের দিকে৷

মূল কথা হল, বাবা–মায়েরা চান সন্তানের জন্য একটি সম্মানজনক কাজ আর তার নিশ্চিত জীবন৷ এই চাওয়া কোনও অপরাধ নয়৷ কিন্তু ভাবতে হবে, তিনি কোন ব্যবস্থায় এই স্বপ্ন সফল হওয়ার আশা করছেন৷ যেখানে বাজার চাহিদার অভাবে একটার পর একটা কারখানা বন্ধ হচ্ছে, যেখানে অনিয়ম, দুর্নীতিকে ভিত্তি করে তীব্র বেকার সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে চাকরির বাজার সংকুচিত, একটা পোস্টের জন্য হাজার হাজার ছেলেমেয়ে আবেদন করছে, কাজ পেলেও তা হচ্ছে চুক্তিভিত্তিক, যে কোনও সময় কাজ হারানোর আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে, সেখানে নিশ্চিত জীবনের গ্যারান্টি কোথায়? এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন না করে সুস্থ সামাজিক পরিবেশ গডে তোলা সম্ভব নয় ঠিকই, তবুও যদি আমরা মনীষীদের জীবনাদর্শ থেকে শিক্ষা নিয়ে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারি, একটি সুস্থ সুন্দর সমাজের ছবি তাদের সামনে তুলে ধরতে পারি, তাহলেও যে কিছু শিশু–কিশোরদের রক্ষা করা যাবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়৷ তাই আজকের দিনে এই আন্দোলন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে৷

গৌতম দাস, মালদা

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ১ সংখ্যা)