পাঁচ বছরে দিয়েছেন ফাঁপা অর্থনীতি, এবার কোন চমক!

পাঁচ বছরে সে শুধু দূরেই সরে গেছে তাহলে কি এবার ধরা দেবে নরেন্দ্র মোদি প্রতিশ্রুত সেই অধরা ‘আচ্ছে দিন’? ভোটে তাঁর যত বিপুল জয়ই হোক না কেন, দেশের সাধারণ মানুষ তো বটেই মোদি সাহেবের সবচেয়ে বড় সমর্থক শিল্পপতিরাও তা মনে করছেন না৷ তাই ২৩ মে ভোটের ফল বেরোতে না বেরোতেই টুইট করে অর্থনীতির বেহাল দশার কথা মোদিজিকে স্মরণ করাতে গিয়ে হর্ষ গোয়েঙ্কা থেকে শুরু করে বেশ কয়েকজন শিল্পপতিও বলেছেন, কর্মসংস্থান, কৃষকের ফসলের দামের নিশ্চয়তা, কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি এবং পরিকাঠামো উন্নয়নের মতো কাজগুলি না হলে অর্থনীতির চাকা গড়াবে না৷ তাঁরা এনএসএসও–র মতো সমীক্ষা সংস্থা বা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের উপর সরকারি খবরদারি বন্ধের দাবিও তুলেছেন৷

অর্থাৎ শিল্পপতিরা, যাদের টাকার থলির জোরেই বিশাল জয় হাসিল করেছেন মোদি সাহেব, তারাও আশঙ্কিত যে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা না বাড়লে কোনও স্লোগান, কোনও মেক ইন ইন্ডিয়া, আম্বানি–আদানি–টাটা–হিন্দুজাদের মালিকানায় কামান–বন্দুক কিংবা যুদ্ধবিমান–সাবমেরিনের কারখানা এর কোনও কিছু দিয়েই এই ভেঙে পড়া অর্থনীতির চাকাকে গর্ত থেকে তোলা যাবে না৷ সিঙ্গুরে টাটাকে ফিরিয়ে আনার চমক দিয়ে একদা ফিল্ম স্টার বিজেপি সাংসদ থেকে শুরু করে হতাশ সিপিএম পর্যন্ত যতই চোখের জল ফেলুক না কেন, সমগ্র গাড়ি শিল্পে অন্ধকার নেমে এসেছে৷ এমনকী টু–হুইলারের বিক্রি পর্যন্ত পুরোপুরি স্তব্ধ হতে বসেছে৷ সিঙ্গুর থেকে গুজরাটে চলে যাওয়া ন্যানো কারখানা অবশ্য আগেই লালবাতি জ্বেলেছে৷ সানন্দ থেকে উচ্ছেদ হওয়া মানুষগুলিকে পুরোপুরি পথে বসিয়ে, শিল্পায়নের নামে সরকারি কোষাগারের ৩৬ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে, প্রোমোটারদের স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দিয়ে টাটা সাহেবরা ন্যানো প্রকল্প গুটিয়ে বিদায় নিয়েছেন৷ অবশ্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে ন্যানোর নামে ১ শতাংশ সুদের ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণও ‘শিল্পায়নের’ মহৎ কার্যে ওই গোষ্ঠীর মালিকদের পকেটেই বিলীন হয়ে গেছে৷ কিন্তু সে প্রসঙ্গ আপাতত থাক৷

প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য রথীন রায় কী বলছেন দেখা যাক– তাঁর মতে দেশের ১৩০ কোটি লোকের মধ্যে ১০ কোটি লোকের কেনাকাটাই অর্থনীতিকে কিছুটা বাঁচিয়ে রেখেছে৷ বাকিরা বাস্তবে বেঁচে থাকার মতো সামান্য কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া ভোগ্যপণ্য প্রায় কেনে না বললেই চলে৷ তাঁর অভিমত এই বাজার আর বাড়ছে না৷ বরং মধ্য আয়ের লোক ক্রমাগত কমছে৷ একদিকে মুষ্টিমেয় ধনকুবেরদের সম্পদ বাড়ছে আকাশ ছোঁয়া হারে, অন্যদিকে দেশের বেশিরভাগ মানুষের আয় দ্রুত কমছে৷ তাহলে শিল্প, কর্মসংস্থান হবে কোন ম্যাজিকে?

২৬ মে প্রকাশিত একটি সংবাদ এই বিষয়ে আরও মারাত্মক খবর দিচ্ছে৷ দেখা যাচ্ছে জমি–বাড়ি থেকে শুরু করে ভোগ্য পণ্যের কেনাকাটার অধিকাংশটাই হচ্ছে ঋণ নির্ভর৷ মোদি জমানার বিগত কয়েক বছরেই এই খাতে অনাদায়ী ঋণ ৮০ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৬ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকা (আনন্দবাজার পত্রিকা ২৬.০৫.২০১৯)৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোদির ডিজিট্যাল ইন্ডিয়ার উৎসাহে ব্যাঙ্কগুলি অসংখ্য ক্রেডিট কার্ড বিক্রি করে চলেছে৷ পকেটের সামান্য নগদে টান পড়ছে না বলে মানুষ খেয়ালও করছে না তার কেনার প্রকৃত ক্ষমতা কতটুকু৷ ফলে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে সামর্থ্যের বাইরে গিয়েও ভোগ্য পণ্য কিনছে অনেকে৷ কিন্তু আয়ের স্থিরতা এবং কর্মসংস্থানের কোনও ব্যবস্থা না থাকায় এই ঋণ ক্রমে জমতে জমতে পাহাড় প্রমাণ হয়ে উঠছে৷ ফলে বহু পরিবারেই নেমে আসছে সংকট৷

ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অর্গানাইজেশন (এনএসএসও) জানাচ্ছে মোদি জমানায় বেকারি বেড়েছে ৪৫ বছরে সর্বাধিক৷ এই বেকারি ক্রমবর্ধমান, অর্থনীতির যে সব বিশেষজ্ঞ মোদিজির নেতৃত্বে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর খোয়াব দেখাচ্ছিলেন মানুষকে, তাঁরাও এখন আতঙ্কিত হয়ে বলতে শুরু করেছেন, কর্মসংস্থান এবং আয়ের সুযোগ বাড়ানোর ব্যবস্থা না করলে ঋণনির্ভর, ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলা ভোগ্য পণ্যের এই কৃত্রিম বাজার অচিরেই ভেঙে পড়বে৷ আজ পুঁজিবাদী দুনিয়ার ইঞ্জিন বলে কথিত আমেরিকাও এই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলা ঋণনির্ভর অর্থনীতির জোরে বাজারকে চাঙ্গা রাখতে গিয়ে বারবার সংকটে ডুবছে৷ শুধু ২০০৮–এর সাবপ্রাইম ঋণ সংকট নয়, সর্ব ক্ষেত্রেই এই সংকট তাকে গ্রাস করছে৷ ইউরোপের অর্থনীতিও দাঁড়িয়ে আছে এই ঋণ চালিত অর্থনীতির উপরই৷ পুঁজিবাদী বিশ্বের সর্বত্রই আজ এই পরিস্থিতি চলছে৷ নরেন্দ্র মোদির ম্যাজিক নিয়ে যত প্রচারের চমকই থাকুক না কেন ভারতের পুঁজিবাদী বাজারের পরিস্থিতি অন্য কিছু হতে পারে না৷ তাই ডিজিট্যাল ইন্ডিয়ার স্লোগান তুলে কার্ডে কেনাকাটা বাড়িয়ে কিছুটা বাজার চাঙ্গা করার চেষ্টা করেছিলেন মোদি সাহেব৷ কিন্তু তাতেও বিশেষ ফল হয়নি৷ এখন দেখা যাচ্ছে যেটুকু কেনাকাটা এই পথে তারা বাড়াতে চেয়েছিল সেটাই ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে এসে বাজারের সংকটকে আরও বাড়িয়েছে৷

নরেন্দ্র মোদি সাহেব এখন তাঁর এককালে তোলা ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশের’ স্লোগান থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইছেন৷ তাই গোটা নির্বাচনী প্রচার পর্বে এ নিয়ে একটি শব্দও খরচ করেননি৷ দেশের মানুষও জানে, নরেন্দ্র মোদির দ্বিতীয় দফার প্রধানমন্ত্রীত্বেও তাদের পাওয়ার কিছু নেই৷ এই সত্যকে ঢাকতে নতুন কোনও চমক, নতুন কোনও ভড়ং হয়ত খুঁজে বার করবেন মোদি সাহেবের পরামর্শদাতারা৷ কিন্তু ওই চমকই সার৷ কোনও কিছু দিয়েই আজ এই সংকট থেকে বেরনোর উপায় তাঁদের হাতে নেই৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৪২ সংখ্যা)