পরাক্রম দিবস (পাঠকের মতামত)

এখন থেকে নাকি নেতাজি সুভাষচন্দ্রের জন্মদিন ২৩ জানুয়ারি ‘পরাক্রম দিবস’ হিসাবে সূচিত হবে। এমনই ঘোষণা কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের। আগামী বছরের ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত ঘটা করে নানা কর্মসূচি পালনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটিও গঠিত হয়েছে।

কিন্তু স্বাধীনতার ৭৪ বছর পর নেতাজিকে নিয়ে বিজেপি নেতাদের এমন বোধোদয় কেন? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, নেতাজির চিন্তা ও আদর্শের সঙ্গে বিজেপির চিন্তা ও আদর্শের কোনও মিল আছে কি? তা যদি না থাকে তবে কেন এই শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ঘটা? ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী দেশের মানুষকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এলে বছরে ২ কোটি বেকারকে চাকরি দেবেন। বিদেশ থেকে কালো টাকা উদ্ধার করে প্রত্যেক ভারতবাসীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা করে জমা করে দেবেন। এমনই আরও নানা প্রতিশ্রুতি। ভোট শেষে দেখা গেল, প্রতিশ্রুতির রং-বেরঙের বেলুনগুলো চুপসে মাটিতে লুটোচ্ছে। দলের আর এক শীর্ষ নেতা অমিত শাহকে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এ সবই ‘জুমলা’, অর্থাৎ কথার কথা। এমন কথা ভোটের আগে না বললে নাকি ভোট পাওয়া যায় না। এ তো মিথ্যাচারের নির্লজ্জ ওকালতি! এই যাঁদের দর্শন তাঁরা কি নেতাজি, ক্ষুদিরামদের শ্রদ্ধা জানাতে পারেন? শ্রদ্ধা জানাতে পারেন বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথদের? নেতাজির আদর্শ অনুসরণ করে আত্মনির্ভর ভারত গড়া হচ্ছে বলে ঢালাও প্রচার করছেন বিজেপি নেতারা। এই প্রচারের মাধ্যমে বাস্তবে নেতাজির আসনে মোদিজিকে বসাতে চাইছেন বিজেপি নেতারা। এ একদিকে যেমন সমগ্র দেশবাসীর সাথে প্রতারণা, তেমনি নেতাজির প্রতিও চরম অবমাননা।

২৩ জানুয়ারি ‘পরাক্রম দিবস’-এর সিদ্ধান্ত কীসের ভিত্তিতে? ‘দেশপ্রেম দিবস’, ‘দেশনায়ক দিবস’-এর প্রস্তাবগুলি বাতিল হল কেন? তা ছাড়া নেতাজির নামের সঙ্গে ‘পরাক্রম’কেন? কীসের পরাক্রম? পরাক্রম অবশ্যই নেতাজির। নেতাজির ব্যক্তিত্ব, আদর্শনিষ্ঠা, হৃদয়ের প্রসারতা, চিন্তার গভীরতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা– এগুলি অবশ্যই তাঁর পরাক্রম। কিন্তু তাঁর এই পরাক্রমই তো স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে আরএসএসের ভ্রান্ত চিন্তা এবং স্বাধীনতা আন্দোলন বিরোধী কর্মকাণ্ডকে মাথা তুলতে দেয়নি! আরএসএস ১৯৪২ সালের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল। নেতাজি যখন ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ নিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ভারতে ঢুকছেন, তখন ব্রিটিশদের সঙ্গে আরএসএস-ও আজাদ হিন্দ বাহিনীকে রুখে দেওয়া ও পরাস্ত করার জন্য পরিকল্পনা করছিল। বর্তমান বিজেপির অন্যতম তাত্ত্বিক নেতা সাভারকর, শ্যামাপ্রসাদরা তখন ভারতীয় যুবকদের, বঙ্গবাসী যুবকদের ব্রিটিশ বাহিনীতে যুক্ত করার প্রক্রিয়া চালাচ্ছিলেন। আরএসএসের গুরুত্বপূর্ণ সঙ্ঘচালক এম এস গোলওয়ালকর দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে প্রতিক্রিয়াশীল কাজ হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন।

আরএসএসের দৃষ্টিতে নেতাজি সহ স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই আমলের নেতা-কর্মী এবং বিপ্লবীরা ছিলেন প্রতিক্রিয়াশীল। অবশ্য তাঁদের এই চিন্তাকে সেদিন যেমন দেশের মানুষ প্রত্যাখান করেছিল, তেমনই সাম্প্রদায়িকতাকে মূলধন করে আরএসএসের এই রাজনীতির প্রত্যক্ষ বিরোধিতায় নেমেছিলেন নেতাজি স্বয়ং। ১৯৩৮ সালের ১৪ জুন কুমিল্লার এক সভায় বলেছিলেন, ‘‘… হিন্দুরা ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ বলিয়া ‘হিন্দু রাজের ধ্বনি’ শোনা যায়। এগুলি সর্বৈব অলস চিন্তা।” তার আগে ১৯২৮ সালের ১৩ এপ্রিল রাজশাহী শহরের জনসভায় এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘হিন্দু ও মুসলমান স্বার্থ পৃথক– ইহার চেয়ে মিথ্যা বাক্য আর কিছু হইতে পারে না। বন্যা, দুর্ভিক্ষ, মড়ক ইত্যাদি বিপর্যয় তো কাহাকেও রেহাই দেয় না।’ সুভাষচন্দ্র যখন রাজনীতিকে সবরকম ধর্মীয় চিন্তা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার কথা বলছেন তখন আরএসএস নেতারা হিন্দুত্বের জয়গান করছেন, হিটলারের দর্শন ও কাজকর্মের জয়গান করছেন, ত্রিশের দশকের জার্মানিতে ইহুদিদের প্রতি অবর্ণনীয় নিষ্পেষণ, ঘৃণা ও হিংসাকে সমর্থনযোগ্য কার্যক্রম হিসাবে তুলে ধরছেন। সে সময়ও সুভাষচন্দ্র ছিলেন ভারতবাসীর কাছে গ্রহণীয় আদর্শ চরিত্র, গোলওয়ালকর-সাভারকর-শ্যামাপ্রসাদরা ছিলেন ব্রাত্য।

এই আরএসএসের চিন্তার অনুসারী বিজেপি। সেদিন নেতাজির মত এবং পথের বিরোধিতা করে আরএসএস দাঁড়াতে পারেনি বলেই কি নেতাজির প্রতি দেশবাসীর গভীর আবেগকে ভোটের বাজারে কাজে লাগাতে আজ তাঁরা নেতাজিপ্রেমী সাজতে চাইছেন? তাঁদের হিন্দুত্বের পরাক্রমের সাথে মিলিয়ে নেতাজিকে পরাক্রমশালী হিসাবে তুলে ধরতে চাইছেন? কিন্তু কোনও ছলনাতেই দেশের মানুষ, বিশেষত বাংলার মানুষের মন থেকে তাঁরা তাঁদের কলঙ্কজনক ইতিহাস মুছে দিতে পারবেন না।

গৌরীশঙ্কর দাস, খড়গপুর