নয়া কৃষি আইন কৃষকদের সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেবে

২৬ নভেম্বরের সাধারণ ধর্মঘটের অন্যতম দাবি– নয়া কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে হবে। অথচ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, সকলেই তো বলেছেন, এই আইন কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই তাঁরা এনেছেন। এই আইনের বলে কৃষকদের এত দিনের দুর্দশা দূর হবে। তা হলে দেশজুড়ে কৃষক সংগঠনগুলি এর বিরোধিতা করছে কেন? কেনই বা তাদের ডাকা গ্রামীণ ভারত বনধে কৃষকরা এমন বিপুল সংখ্যায় সাড়া দিলেন?

নতুন এই কৃষি আইন কৃষকদের সত্যিই ভাল করবে না মন্দ, তা কী দিয়ে বিচার হবে? শুধু গলার কিংবা ক্ষমতার জোর দিয়েই? নাকি অন্য কোনও মাপকাঠি আছে যা দিয়ে যে কেউ সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে? অবশ্যই তার মাপকাঠি আছে। তা হল, প্রথমেই দেখতে হবে, কৃষক জীবনের মূল সমস্যাগুলি কী। কেন পরিবারগুলি উদয়াস্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করলেও যুগ যুগ ধরে তাদের দুরবস্থা ঘোচে না। এ বার দেখতে হবে, কোনও নীতি বা আইন যা কৃষকের স্বার্থে তৈরি বলে বলা হচ্ছে, তা এই সমস্যাগুলির সুরাহা করছে কি না। যদি নতুন আইনের দ্বারা কৃষক জীবনের মূল সমস্যাগুলি, সত্যিকারের সমস্যাগুলি সমাধান হয়, তবেই বলা যাবে সেই আইন সত্যিই কৃষকের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে তৈরি করা। আর তা যদি করতে না পারে, তবে সেই আইনের যত গুণগানই গাওয়া হোক, তার দ্বারা কৃষকের অবস্থার কোনও পরিবর্তনই হবে না।

এই মুহূর্তে যখন কেন্দে্রর বিজেপি সরকার নতুন কৃষি আইনটি পাশ করাল, তখন কৃষকদের জীবনের প্রধান সমস্যা হল ফসলের লাভজনক দাম না পাওয়ার সমস্যা– যে দাম পেলে কৃষকের চাষের খরচ মিটেও অতিরিক্ত কিছু থাকে, যাতে তারা সংসার প্রতিপালন, অর্থাৎ জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার, পরিবারের চিকিৎসা, সন্তানদের পড়াশোনার ব্যবস্থা, লোক-লৌকিকতার খরচ মেটাতে পারে। বাস্তবে ফসলের এমন দাম যে কৃষক পায় না, তা উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না।

বর্তমানে চাষের জন্য খরচ আগের থেকে অনেক বেড়েছে। কৃষক এখন আর নিজে বীজ রাখতে পারে না। সব ধরনের বীজই বহুজাতিক কোম্পানিগুলির মুঠোয়। ফলে তাদের সর্বোচ্চ মুনাফার খাঁই মেটাতে গিয়ে বীজের দাম আকাশছোঁয়া। একই সমস্যা কৃষির জন্য অবশ্যপ্রয়োজনীয় সারের। আগে বেশির ভাগ রাসায়নিক সারই উৎপাদন হত সরকারি ভাবে। ফলে তার দাম ছিল কৃষকদের আয়ত্তের মধ্যে। একের পর এক নানা রঙের সরকার ক্ষমতায় বসে সারের পুরো উৎপাদন ব্যবস্থাটিকেই পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিয়েছে। ফলে সারের দামও আকাশছোঁয়া। কৃষির জন্য সরকারি সেচ ব্যবস্থা নাম কা ওয়াস্তে। ফলে মাটির তলা থেকে জল তোলার জন্য প্রয়োজন বিদ্যুৎ কিংবা ডিজেল। এ দুটিও একচেটিয়া ব্যবসায়ীদের হাতে পড়ে দুর্মূল্য। আধুনিক কৃষির অপরিহার্য অঙ্গ কীটনাশক। তা-ও উৎপাদন করে একমাত্র বহুজাতিক কোম্পানিগুলিই। প্রতি বছর এর যথেচ্ছ দাম বাড়িয়ে চলেছে তারা। অর্থাৎ কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুরই নিয়ন্ত্রণ দেশি-বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলির হাতে।

স্বাভাবিক ভাবেই কৃষির খরচ বেড়ে চলেছে লাফিয়ে। ভারতের মতো দেশে কৃষকদের ৮৬ শতাংশই ক্ষুদ্র কিংবা প্রান্তিক চাষি। একটা অংশ রয়েছে ভাগচাষি, যাদের নিজেদের জমি নেই। ফলে বেশির ভাগ চাষিরই ক্ষমতা নেই চাষের এই বিপুল খরচ বহন করার। তাদের এই খরচ মেটানোর জন্য ঋণ করতে হয়। নানা প্রশাসনিক জটিলতা, সরকার এবং ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের জনবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এই ছোট চাষিদের বেশির ভাগই ব্যাঙ্কঋণ পায় না। তাদের ঋণ নিতে হয় মহাজনদের থেকে। সেই ঋণের সুদ অকল্পনীয় রকমের চড়া, কখনও দেড়শ থেকে দুশো শতাংশ পর্যন্ত। স্বাভাবিক ভাবেই চাষের খরচের পরিমাণ দাঁড়ায় বিপুল। আর এই বিপুল খরচে চাষ করার পর যদি চাষি ফসলের ন্যায্য তথা লাভজনক দাম না পায় তবে তাকে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। সে ঋণ শোধ করতে পারে না। সংসার অচল হয়ে পড়ে। পরিবারের চিকিৎসা, সন্তানের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত কৃষককে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়। বাস্তবিক বিগত অর্ধশতক জুড়ে চাষির জীবনের ইতিহাস আসলে সর্বনাশের ইতিহাস, আত্মহত্যারই ইতিহাস।

ফলে প্রধানমন্ত্রী কিংবা বিজেপির অন্য নেতা-মন্ত্রীরা যখন বলেন, নতুন কৃষি আইন কৃষকের স্বার্থরক্ষার জন্যই তৈরি, তখন তাঁদের প্রথম এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে যে, নতুন আইনে কি এমন ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে যাতে কৃষকরা আর এই সমস্যাগুলির সম্মুখীন হবে না? তাতে কি রয়েছে কৃষির অস্বাভাবিক রকমের বেশি খরচ কমানোর ব্যবস্থা? বীজ, সার, কীটনাশক, বিদ্যুৎ, তেল কোম্পানিগুলি যে গরিব চাষির ঘাম-রক্ত শুষে নেয়, রয়েছে নাকি নতুন আইনে তা বন্ধ করার ব্যবস্থা? নতুন আইনে কি বলা হয়েছে, ক্ষুদ্র চাষি, ভাগচাষি, মধ্যচাষিরা চাষের জন্য খরচের টাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি থেকে বিনা সুদে কিংবা নামমাত্র সুদে ঋণ হিসাবে পাবে এবং বেসরকারি তথা মহাজনি ঋণের কারবার আর চালানো যাবে না। নতুন আইনে কি বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে অর্থাৎ খরা, বন্যা, কীটের উৎপাতে যদি ফসল নষ্ট হয়ে যায় তবে সরকার সেই ক্ষতি পূরণ করে দেবে? নতুন আইনে কি বলা হয়েছে চাষির খরচ হিসাব করে ন্যায্য তথা লাভজনক দাম সরকার বেঁধে দেবে এবং সরকারই তা কিনে নেবে। এর থেকে কম দামে কোনও ব্যবসায়ী ফসল কিনতে পারবে না। যদি এই সব ব্যবস্থা নতুন আইনে হয়ে থাকে তবেই একমাত্র বলা যাবে এই আইন কৃষক স্বার্থে তৈরি। আর তা যদি না থাকে তবে বুঝতে হবে নানা কথার প্যাঁচে কৃষকদের বোকা বানানো এবং তাদের উপর শোষণের স্টিম রোলারটি চালিয়ে নিয়ে যাওয়াই এর উদ্দেশ্য।

বাস্তব বলছে, নতুন কৃষি আইনে কৃষকের জীবনের জ্বলন্ত এই সমস্যগুলির কোনওটিরই উল্লেখমাত্র নেই। নেই সমাধানের কোনও দিকনির্দেশ। তা হলে, এই সমস্যগুলিকে জিইয়ে রেখে কী ভাবে কৃষকদের মঙ্গলের কথা ভেবেছেন বিজেপি নেতারা?

গোটা কৃষিক্ষেত্রটি থেকে সরকার নিজে সরে গিয়ে কৃষকদের মঙ্গলের জন্য ত্রাতা হিসাবে হাজির করেছে কৃষিপণ্যের দেশি-বিদেশি একচেটিয়া কারবারিদের। অর্থাৎ গত সাড়ে সাত দশকে কোনও সরকার যা করেনি তাই নাকি করে দেবে এই সব দেশি-বিদেশি একচেটিয়া পুঁজিপতিরা। তার আগে দেখে নেওয়া যাক কৃষক-মঙ্গলের নামে যে তিনটি আইন বিজেপি সরকার নিয়ে এল সেগুলির মূল বিষয় মোটামুটি কী?

প্রথমটি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (সংশোধনী) আইন। এই আইনের বলে যে কোনও বহুজাতিক কোম্পানি বা ব্যবসায়ী কৃষিপণ্য কিনে যত খুশি মজুত করে রাখতে পারবে। দ্বিতীয়টি কৃষকদের (ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা) দামের আশ্বাস ও খামার পরিষেবা চুক্তি আইন। এই আইনের বলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলি চুক্তিচাষের মাধ্যমে যে কোনও পণ্য কৃষকদের দিয়ে উৎপাদন করিয়ে নিতে পারবে। তৃতীয়টি, কৃষকের উৎপাদিত, কারবার ও বাণিজ্য (উন্নয়ন ও সুবিধা) আইন। এই আইনের বলে রাজ্য সরকার নিয়ন্ত্রিত রেগুলেটেড মার্কেট বা মান্ডির বাইরেও কৃষকরা যে কোনও ব্যবসায়ী বা বাণিজ্য সংস্থার কাছে তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারবে।

এইসব আইনের বলে এখন থেকে আম্বানি-আদানিদের মতো কৃষি পণ্যের একচেটিয়া ব্যবসায়ীরা ফসল ওঠার সময়েই, যখন দেশের নব্বই শতাংশ ছোট চাষি কম দামেই অভাবি বিক্রি করতে বাধ্য হয় তখন বেশির ভাগ ফসল কিনে নিয়ে বিশালাকায় সব হিমঘরে-গুদামে মজুত করে রাখবে। এর ফলে বাজারে কৃত্রিম অভাব তৈরি হবে এবং দাম বাড়বে লাফিয়ে। তখন কোম্পানিগুলি যথেচ্ছ দামে তা বিক্রি করবে। আর সরকারগুলি ‘হস্তক্ষেপ করা আইনসঙ্গত কি না’ এই বিচারে সময় কাটাতে থাকবে। এতদিন মজুতদারির বিরুদ্ধে আইন ছিল। নির্বিষ হলেও কিছু সরকারি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি ছিল। আন্দোলন এবং গণবিক্ষোভের চাপে কখনও কখনও কিছু ব্যবস্থাও সরকারকে নিতে হত। নতুন আইনের পর আর সে বালাই থাকল না। এর মারাত্মক ফল একদিকে যেমন চাষিদের ভোগ করতে হবে, তেমনই গরিব সাধারণ মানুষ, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত সবাইকেই ভোগ করতে হবে।

দ্বিতীয়ত চুক্তির মধ্য দিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলি চাষির থেকে ফসল কিনবে। বিজেপি নেতারা বলছেন, এর ফলে নাকি চাষিরা ন্যায্য দাম পাবে। বিজেপি নেতাদের কথা অনুযায়ী, আম্বানি-আদানি সহ বহুজাতিক কোম্পানিগুলি বিপুল অঙ্কের পুঁজি কৃষিক্ষেত্রে ঢালতে চলেছে চাষিদের বেশি দাম দেবে বলে। এর থেকে হাস্যকর আর কী হতে পারে!

এতদিন পর্যন্ত দেশের বেশির ভাগ রাজ্যেই বড় রিটেলারদের কৃষিপণ্য কিনতে হত এপিএমসি মান্ডির মাধ্যমে। নতুন আইনে এই বাধা কেটে গেল। এখন থেকে সরাসরি চাষির থেকেই ফসল কিনতে পারবে কোম্পানিগুলি। প্রথম প্রথম বহুজাতিক পুঁজি কৃষককে একটু বেশি দাম দিয়ে প্রলোভিত করবে, আবার সরকারও ফসল কেনার ক্ষেত্রে গড়িমসি করবে, ঠিক মতো টাকা বরাদ্দ করবে না, নূ্যনতম সহায়ক মূল্য ঘোষণা করবে না এবং এমন অবস্থা তৈরি করবে যাতে চাষি সরকারি মান্ডিতে যাওয়ার সমস্ত উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। এইভাবে সরকারি এপিএমসি মার্কেটগুলো রুগ্ন হয়ে বন্ধ হয়ে যাবে এবং সমস্ত কৃষিপণ্যের একমাত্র ক্রেতা হবে কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি। যে চাষি স্থানীয় ব্যবসায়ীদের থেকে ন্যায্য দাম আদায় করতে পারে না, তারা দেশের সবচেয়ে ধনী কোম্পানিগুলির থেকে সেই দাম আদায় করবে, এমন কথাও বিশ্বাস করতে বলছেন বিজেপি নেতারা!

আইনগুলির চরিত্র থেকেই স্পষ্ট, কৃষকের মঙ্গল দূরের কথা, কৃষক এবং সমস্ত স্তরের জনসাধারণকে এ দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের আরও তীব্র শোষণের মুখে ফেলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে গোটা কৃষিক্ষেত্রটিকে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের জন্য এমন বেআব্রু করে খুলে দেওয়া হল। অর্থাৎ এতদিন খাতায়-কলমে হলেও যতটুকু রাষ্ট্রীয় তথা সরকারি সুরক্ষা কৃষকদের জন্য ছিল সেগুলিও তুলে দিয়ে সরকার পুরোপুরি হাত গুটিয়ে নিল। একচেটিয়া পুঁজির আগ্রাসী থাবার হাত থেকে বাঁচানোর যতটুকু বিধি-ব্যবস্থা এতদিন ছিল সে সবই তুলে নিয়ে কৃষিক্ষেত্রে পুঁজিপতিদের অবাধ লুঠতরাজ চালানোর ব্যবস্থা করে বিজেপি সরকার পুঁজিপতিদের কাছে তার ঋণ শোধ করল।

এই অবস্থায় ব্যাপক কৃষক আন্দোলন এবং গণআন্দোলনই পারে সরকারকে একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থরক্ষাকারী এই সব পদক্ষেপগুলি থেকে পিছু হটাতে। পারে রাষ্ট্রীয বাণিজ্য চালুতে সরকারকে বাধ্য করতে। তার জন্য প্রয়োজন কৃষকদের ব্যাপক ঐক্য গড়ে তোলা। সেই ঐক্যের প্রয়োজনেই সমস্ত কৃষকদের সামিল করতে হবে এই ধর্মঘটকে সফল করার জন্য।

(ডিজিটাল গণদাবী-৭৩ বর্ষ ১০ সংখ্যা_১০ নভেম্বর, ২০২০)