নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মবার্ষিকী পালনের আহ্বান উদযাপন কমিটির

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের আপসহীন ধারার শ্রেষ্ঠ মনীষা, মহান বিপ্লবী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৬তম জন্মবার্ষিকী ২৩ জানুয়ারি। তাঁকে ঘিরে জড়িয়ে আছে এ দেশের সাধারণ মানুষের গভীর আবেগ। ২০২২-এ তাঁর ১২৫তম জন্মবার্ষিকী অতিক্রান্ত হয়েছে কোভিড অতিমারির মধ্যে। ফলে দেশবাসী যে ব্যাপকতায় তাঁর জীবনসংগ্রাম চর্চা করতে চেয়েছিলেন, তা সম্ভব হয়নি। স্বভাবতই আগামী ২৩ জানুয়ারি তাঁরা গভীর আবেগ নিয়েই দিনটি উদযাপন করবেন।

যে স্বপ্নকে সামনে রেখে নেতাজির সংগ্রাম, সেই স্বপ্ন যে আজও পূরণ হয়নি, নেতাজির পথে দেশ স্বাধীন হলে তার চেহারা যে অন্যরকম হত– এ চিন্তা ধাক্কা দেয় বহু মানুষকে। এ চিন্তার মধ্যে থাকা গভীর সত্যের রূপটি বহু মানুষের কাছে সঠিকভাবে উপলব্ধির স্তরে না থাকলেও এ কথাটুকু তাঁদের সকলেরই জানা যে, নেতাজি একজন পরিপূর্ণ রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর জীবনের সাথে যোগাযোগ শুধু স্বাধীনতা আন্দোলনের যুগেরই নয়, বর্তমানের রাজনীতির, ইতিহাসেরও।

স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও দেশ জুড়ে সাধারণ মানুষের জীবনের সমস্যাগুলির সমাধান হওয়া দূরের কথা, ক্রমে তা বেড়েই চলেছে। সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা ক্রমক্ষয়িষ্ণু। চিকিৎসার সুযোগ রয়েছে শুধু অর্থবানদের। অর্থনৈতিক শোষণের যাঁতাকলে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, অনাহার, ছাঁটাই ও দারিদ্র, দেউলিয়া সমাজব্যবস্থার আঁতুড়ে জন্ম নেওয়া জাত-ধর্মের নামে ঘৃণা ও বিদ্বেষ, রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট সন্ত্রাস, বিচ্ছিন্নতাবাদ ইত্যাদি বহু রকম সঙ্কটের আবর্তে জনজীবন মারাত্মক অচলাবস্থার সম্মুখীন। এই সময়ে নেতাজির আপসহীন স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস এবং স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতবর্ষকে গড়ে তুলবার ক্ষেত্রে তাঁর স্বপ্ন ও পরিকল্পনা আজও শোষিত-নিপীড়িত সাধারণ মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।

নিঃস্ব অসহায় মানুষের প্রতি তাঁর অসীম মমত্ব, শৌর্য, সাহস, দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, বিপ্লবী আত্মসম্মানবোধ ও জ্বলন্ত দেশপ্রেম আজও দেশের ছাত্র যুবক সহ সমাজ সচেতন প্রতিটি মানুষের কাছেই গভীরভাবে অনুধাবনযোগ্য ও শিক্ষণীয়। তিনি বলেছেন, ‘‘মনুষ্যত্ব অর্জনের একমাত্র উপায় মনুষ্যত্ব বিকাশের সমস্ত অন্তরায় চূর্ণ-বিচূর্ণ করা। যেখানে যখন অত্যাচার অবিচার ও অনাচার দেখিবে সেখানে নির্ভীক হৃদয়ে শির উন্নত করিয়া প্রতিবাদ করিবে এবং নিবারণের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিবে।”

অন্যায়ের প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে মনুষ্যত্ব অর্জনের এই নীতিই তিনি অনুসরণ করেছিলেন তাঁর সমগ্র জীবনে। বড় বড় প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি, বিরাট মাইনের চাকরি, ব্রিটিশ সরকারের উঁচু পদ, গৃহকোণের আয়েশ– সমস্ত প্রলোভন হেলায় উপেক্ষা করে তিনি মাতৃভূমিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার কঠিন দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। এই স্বপ্ন তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন পরাধীন ভারতের লক্ষ লক্ষ ছাত্র যুবক সহ অসংখ্য মানুষের মনে।

নেতাজি স্বপ্ন দেখেছিলেন, স্বাধীন দেশে শিক্ষা হবে ছাত্রসমাজের মনুষ্যত্ব ও চরিত্র গঠনের সোপান। শিক্ষা হবে সমস্ত প্রকার ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে মুক্ত, বিজ্ঞান ও যুক্তিভিত্তিক। তা হবে নতুন সমাজ গড়ার উপযোগী, সচেতন উন্নত সংস্কৃতি ও নৈতিকতাসম্পন্ন নতুন মানুষ গড়ে তোলার সহায়ক। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে প্রত্যেকে শিক্ষার আঙিনায় আসতে পারবে। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই দেশের, যেখানে সুনিশ্চিত হবে নারীর সম্মান ও নিরাপত্তা। নারী মানুষ হিসাবে পাবে পুরুষের সঙ্গে সমান মর্যাদা। স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই স্বাধীন দেশের, যেখানে দারিদ্র, অনাহার, অবমাননা থেকে মুক্ত হয়ে সকলেই উন্নত ও মর্যাদাময় জীবনযাপন করতে পারবে। প্রত্যেকে তার নিজের ধর্ম পালনের সুযোগ পাবে। কিন্তু ধর্ম কোনওভাবে রাজনীতির মধ্যে স্থান পাবে না। সাম্প্রদায়িকতা এবং সম্প্রদায় ভিত্তিক রাজনীতি নির্মূল হবে, রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সামান্যতম সম্ভাবনারও অবসান হবে। তাঁর সেই স্বপ্ন আজও অধরা রয়ে গেছে শুধু নয়, এই বিপদ ক্রমাগত বাড়ছে।

আজ ধর্মনিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক-গণতান্ত্রিক শিক্ষার মূলে কুঠারাঘাত করে শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিজ্ঞানবিরোধী অন্ধকারাচ্ছন্ন চিন্তা, ধর্মীয় কুসংস্কার, অন্ধতা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। দেশের আকাশ-বাতাস আজও নিপীড়িত-বঞ্চিত আক্রান্ত ও অত্যাচারিত মানুষের হাহাকার আর নারীর আর্তনাদে ভারাক্রান্ত।

স্বাধীনতা সংগ্রামের যুগে এ দেশের শোষক পুঁজিপতি শ্রেণি স্বাধীনতা সংগ্রামের আপসহীন বিপ্লবী ধারাকে আটকাতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। তারা চেয়েছিল শোষণ-শাসনের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাটি ব্রিটিশের থেকে নিজেদের হস্তগত করতে। সেজন্যই তারা ছিল এক দিকে ব্রিটিশের সাথে বোঝাপড়া ও আপস-মীমাংসায় বিশ্বাসী, অন্য দিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবী ধারা তথা নেতাজির বিরুদ্ধে খড়গহস্ত। কারণ, তারা জানত নেতাজি কল্পিত স্বাধীন দেশের মডেল তাদের শোষণ-শাসনের পথে অন্তরায়।

নেতাজিকে যারা ব্রিটিশের থেকেও বিপদজনক শত্রু বলে মনে করত, আপসকামী সেই দক্ষিণপন্থী নেতৃবৃন্দের উত্তরসূরীরাই আজ দেশের শাসনক্ষমতায়। তাদের শাসন-শোষণ এবং জনগণের চরম দুর্দশাকে চিরস্থায়ী করে রাখতে নেতাজির মতো মহান বিপ্লবী এবং এদেশের মহান মানবতাবাদী মনীষীদের জীবন সংগ্রাম এবং শিক্ষা মুছে ফেলতে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করছে।

দেশের মধ্যে উন্নয়নের নামে বঞ্চনা, লুঠ ও মিথ্যার যে রাজত্ব চলছে তার অবসান হবে কবে? এ প্রশ্ন আজ দেশের কোটি কোটি মানুষকে অস্থির করে তুলছে। এই প্রসঙ্গে তাঁর সেই শিক্ষা স্মরণীয়, ‘‘আমার ছোটবেলায় আমি ব্রিটিশকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়াই সবচেয়ে বড় কর্তব্য মনে করতাম। পরে গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেছি যে ব্রিটিশকে তাড়ালেই আমার কর্তব্য শেষ হয়ে যাবে না। ভারতবর্ষের নতুন সমাজব্যবস্থা চালু করার জন্য আরেকটা বিপ্লব প্রয়োজন হবে।”

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপনের সর্বভারতীয় কমিটি পুরো ২০২১ জুড়ে সারা দেশে তাঁর স্মরণে এবং সেদিনের ইতিহাস অধ্যয়ন, অনুশীলন ও চর্চার উদ্দেশ্যে নানা উদ্যোগ গ্রহণের চেষ্টা করেছে। কিন্তু তখন অতিমারি চলছিল। স্বভাবতই পরিকল্পনা অনুযায়ী সব কাজ করে ওঠা যায়নি। তাই ২০২২ সালেই কমিটির পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত হয়, ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত এক বছর কর্মসূচি জারি রাখা হবে এবং এই কর্মসূচির সমাপনী অনুষ্ঠান হবে ২০২৩ সালের ২৩ জানুয়ারি।

সমাপনী অনুষ্ঠানে স্বাভাবিক ভাবেই নেতাজিচর্চা ভিন্ন মাত্রা পাবে। সেই লক্ষে্যই কমিটি ১ জানুয়ারি থেকে ২৩ জানুয়ারি নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতাজির আপসহীন সংগ্রাম, স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষকে গড়ে তোলার স্বপ্ন পরিকল্পনা ও তাঁর চিন্তাধারা তুলে ধরার সাথে সাথে এ দেশের লাঞ্ছিত বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের বেদনা নেতাজি যেভাবে বুকে বহন করতেন, তা উপলব্ধি করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে।

প্রত্যেকটি পরিবারের কাছে কমিটির আবেদন, ২৩ জানুয়ারি নেতাজির প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করুন, তরুণ প্রজন্মের কাছে নেতাজির সংগ্রামী জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে তাঁর প্রতি তাদের শ্রদ্ধাশীল করে তুলুন। যেখানে নেতাজির মূর্তি আছে সেখানে তাঁর মূর্তিতে, বাকি সর্বত্র রাস্তার মোড, বাড়ি সহ সম্ভাব্য সমস্ত জায়গায় তাঁর প্রতিকৃতি স্থাপন করে মাল্যদান ও পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্য দিয়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় দিনটি পালন করুন।

আগামী ২৩ জানুয়ারি কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট হলে একটি মনোজ্ঞ আলোচনাসভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। দেশ-বিদেশের স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ কেন্দ্রীয় এই সমাপনী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন।

আসুন, ধারাবাহিক চর্চার মধ্য দিয়ে আমরা নেতাজির অপূরিত স্বপ্ন পূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ হই।