নেতাজির উত্তরাধিকার বহনের অঙ্গীকার

মহান বিপ্লবী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর উত্তরাধিকারকে বহন করব আমরা, তাঁর অপূরিত স্বপ্ন পূরণের যুগোপযোগী সংগ্রামের পথ ছেড়ে যাব না– ২৩ জানুয়ারি কলকাতার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে উচ্চারিত হল অঙ্গীকার। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের আপসহীন বিপ্লবী ধারার জ্বলন্ত প্রতীক এই মহান বিপ্লবীর ১২৫তম জন্মবার্ষিকীর সূচনা উপলক্ষে তাঁর স্মৃতি বিজড়িত প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে নেতাজি মূর্তি পর্যন্ত এক বিশাল পদযাত্রায় সামিল হলেন পাঁচ সহস্রাধিক ছাত্র-যুব-মহিলা সহ সমাজের নানা স্তরের মানুষ।

২৩ জানুয়ারি বাংলা তথা ভারতের মানুষের কাছে গভীর আবেগ ও ব্যথার দিন। এই মহান বিপ্লবীর জন্মদিনটিতে প্রতি বছর অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে তাঁকে স্মরণ করেন সাধারণ মানুষ। সে স্মরণে শ্রদ্ধার সঙ্গে মিশে থাকে এক গভীর ব্যথা– স্বাধীনতা এসেছে, কিন্তু তাঁর শোষণমুক্ত ভারতের স্বপ্ন সফল হয়নি। স্বাধীন ভারতের মাটি তাঁর স্পর্শ পায়নি। শোষণহীন সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখা ছাত্র-যুবক-শ্রমিক-কৃষক সহ সাধারণ মানুষের কাছে এই দিনটি পালনের তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর।

একদিকে এই প্রয়াস, অন্য দিকে এই মহান বিপ্লবীর প্রতি মানুষের আবেগকে পুঁজি করে ভোটে ফয়দা তোলার চেষ্টায় কিছু রাজনৈতিক দলের তৎপরতা। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় নেতাজি সুভাষচন্দ্রের সাথে এদের আচরণের ইতিহাস এতটাই কলঙ্কজনক যে, আজকের এই ধুমধাম, আড়ম্বর মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে মানুষের। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ছাত্র সংগঠন এ আই ডি এস ও, যুব সংগঠন এ আই ডি ওয়াই ও, মহিলা সংগঠন এ আই এম এস এস, কিশোর সংগঠন কমসোমল এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন পথিকৃৎ ডাক দিয়েছিল রাজ্য জুড়ে নেতাজি স্মরণ ও তাঁর অপূরিত স্বপ্নপূরণের অঙ্গীকার গ্রহণের।

২৩ জানুয়ারি সকাল থেকেই কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী জেলার ছাত্র যুব মহিলা ও কিশোর কমিউনিস্ট বাহিনীর স্বেচ্ছাসেবকরা আসতে শুরু করেছিলেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। তাঁদের চোখে মুখে এক অভূতপূর্ব প্রত্যয়। আসার পথেই তাঁরা অনুভব করেছেন তাঁদের প্রতি মানুষের আশা কী গভীর। বরানগর থেকে ২২২ নম্বর রুটের বাসের কন্ডাক্টররা কেউ তাঁদের ভাড়া নেননি। এমন আরও কত সহযোগিতা তাঁরা পেয়েছেন। কলকাতার ঘোষবাগান এলাকা থেকে আসা ছাত্র শুভ মাজী সকালে এ আই ডি এস ও-র দাদাদের সাথে পাড়ায় নেতাজি জয়ন্তী পালন করেছেন। পদযাত্রায় এসে উচ্ছসিত, ‘নেতাজির ছবি নিয়ে হাঁটব। দারুণ আনন্দ হচ্ছে’। নেতাজির উপর রচিত গান পরিবেশন করে অভিভূত হাওড়ার ছাত্র শুভ্রাংশু মণ্ডল বলে ওঠে, ‘গানটা গাইলেই বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে।’ কলেজ স্ট্রিট বই পাড়ার এক বর্ষীয়ান দোকানদার আবেগভরা কণ্ঠে দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করলেন। কমসোমলের ১২৫ জন স্বেচ্ছাসেবক ব্যস্ত শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে। ব্যান্ড বাহিনীও ঝালিয়ে নিচ্ছে শেষ বার। এই পরিবেশ দেখে অভিভূত বই কিনতে আসা এক দল ছাত্র নিজেদের মোবাইল ক্যামেরায় বন্দি করে নিলেন সমস্ত মুহূর্ত। এক ছাত্র বলে উঠলেন, ‘কী দারুণ ডিসিপ্লিন’!

২৩ জানুয়ারি গুজরাটের আহমেদাবাদে নেতাজি স্মরণ

শুরু হল সভা। বক্তব্য রাখলেন এআইডিএসও-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক মণিশঙ্কর পট্টনায়ক, এআইডিওয়াইও-র রাজ্য সভাপতি তমাল সামন্ত। সবশেষে বক্তব্য রাখেন সারা বাংলা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ১২৫তম জন্মবর্ষ কমিটির সম্পাদক ডাঃ অশোক সামন্ত। আগামী ১ বছর জুড়ে নেতাজি স্মরণে নানা উদ্যোগ নেওয়ার এবং সকলকে সামিল হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। সভায় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বাসদ (মার্কসবাদী)-র নেতা ফকরুদ্দিন কবীর আতিক এবং বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্রের নেত্রী নাঈমা খালেদ মনিকা। সভা পরিচালনা করেন এআইএমএসএস-এর রাজ্য সম্পাদক কল্পনা দত্ত।

শুরু হল পদযাত্রা। প্রথমেই কমসোমলের ১২৫ জন স্বেচ্ছাসেবক নেতাজির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীর আহ্বান সম্বলিত পতাকা বাহক। তারপর সংগঠন গুলির নেতৃবৃন্দ। সুশৃঙ্খল সুসজ্জিত মিছিল এগিয়ে চলেছে শ্যামবাজারের দিকে। পদযাত্রা এগোনোর সাথে সাথে রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজন অবাক বিস্ময়ে মিছিল দেখছেন। ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির সামনে এক ঠেলা রিক্সা চালক তাঁর সঙ্গীকে বলছেন, ‘দিনভর ইতনা জুলুস দেখা, লেকিন ইতনা আচ্ছা নেহি দেখা’।

পদযাত্রায় অংশ নিয়েছেন দূর-দূরান্ত থেকে আসা ছাত্র-যুবক-যুবতী মহিলা সহ সমাজের নানা অংশের মানুষ। পথ দীর্ঘ, কিন্তু কারও ক্লান্তি নেই। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তৃষিতা পাল আগে কোনও মিছিলে হাঁটেননি। নেতাজির ছবি নিয়ে হাঁটতে শুরু করে বললেন ‘এর অনুভূতি অন্য রকম।’ পদযাত্রা তখন হেদুয়া পেরিয়েছে। বাড়ির বারান্দা, ছাদ, জানলায় অসংখ্য মুখের ভিড়। রাস্তায় নেমে এসেছেন শত শত মানুষ। তাঁদের চোখ ভরা আশা। ছাত্র-যুবদের প্রতিটি দৃপ্ত পদক্ষেপ তাঁদের মনে সঞ্চারিত করছে এক গভীর অনুভূতি– ‘এই তো, এরা আছে! এরাই তো আশা।’ সুভাষচন্দ্রের উত্তরাধিকার বহনের শক্তি নিয়ে চলেছেন এই ছাত্র-যুব-মহিলা-কিশোর-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মীর দল।

পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশিয়াড়িতে নেতাজি স্মরণ

হাতিবাগান বাজারের ব্যবসায়ীরা অভিভূত। আরও মিছিল তাঁরা সেদিন দেখেছেন, দেখেছেন সরকারি দলের মিছিল। পদযাত্রার বলিষ্ঠতা, শৃঙ্খলা, অংশগ্রহণকারীদের মগ্নতা তাঁদের টানছিল চুম্বকের মতো। বাজার সমিতির সহ সম্পাদক তাই পরের দিনও জনে জনে ভাগ দিয়েছেন তাঁর মুগ্ধ আবেশের। পদযাত্রা দেখতে দেখতে এক ব্যক্তি পাশের জনকে বললেন, এঁরা যে অন্যদের থেকে আলাদা মিছিলের শৃঙ্খলা দেখলেই তা বোঝা যায়। হাতিবাগানের জামা কাপড়ের এক হকার বলে উঠলেন, ‘সকাল থেকে অনেক মিছিল হয়েছে। আবার একটা মিছিল আসছে দেখে কিছুটা বিরক্ত হয়েছিলাম। কিন্তু শুরুতেই ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা যে ভাবে হাঁটছে, তা দেখে সব ভুলে গেছি’। কিশোর কমিউনিস্ট বাহিনীর পায়ের তাল ঢেউ তুলেছে তাঁদের বুকে।

কর্ণাটকের গুলবর্গায় ২৩ জানুয়ারি নেতাজি স্মরণ

ঘড়িতে তখন বিকাল পৌনে চারটে প্রায়, পদযাত্রা প্রবেশ করছে শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে। আশপাশের দোকানদার-ক্রেতারা বেরিয়ে এসেছেন রাস্তায়। পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের লাল আভা পড়ছে পদযাত্রার উপর। নেতাজির মূর্তিতে মাল্যদান করলেন এসইউসিআই(সি)-র রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য, বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্রের কমরেড নাঈমা খালেদ মনিকা এবং পাঁচটি সংগঠনের রাজ্য নেতৃবৃন্দ। মহান বিপ্লবীর প্রতি গার্ড অফ অনার দিয়ে শ্রদ্ধা জানাল কমসোমল। মিছিলের শেষ ভাগ তখনও হেদুয়ায়। ফিরে যাওয়ার পথে হুগলির চুঁচুড়া থেকে আসা এমএসসির ছাত্রী শর্মিষ্ঠা সামন্ত বলে গেলেন, ‘এমন পদযাত্রায় অংশ নিতে পারার স্মৃতি অমলিন হয়ে থাকবে।’ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর উত্তরাধিকার বহনের অঙ্গীকারের মধ্যেই জাঁকজমক আর আড়ম্বর থেকে পৃথক করে যথার্থ অর্থে বিপ্লবীর জন্মবর্ষ পালনের সূচনা ঘটাল এই পদযাত্রা।