নির্ভয়া কমিশন বাতিল

নারী নিরাপত্তার দায়িত্ব অস্বীকার করছে সরকার

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নারী ও শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের বিরামহীন স্রোত চলছে৷ শঙ্কিত মানুষ যখন প্রতিকার চাইছেন ঠিক তখন মহিলাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের ক্ষেত্রে পৃথক তদন্ত কমিশন গঠনের পরিকল্পনা বাতিল করে দিল কেন্দ্রের বিজেপি সরকার৷

২০১২ সালের ডিসেম্বরে দিল্লিতে ধর্ষণ ও নৃশংস বর্বর অত্যাচারের ফলে এক প্যারামেডিকেল ছাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা দেশবাসীকে শোকে বিহ্বলই নয়, প্রতিবাদেও মুখর করেছিল ৷ ডিসেম্বর মাসের প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে পুলিশের লাঠিচার্জ, জলকামান উপেক্ষা করে হাজার হাজার ছাত্র–যুব–মহিলার প্রবল আন্দোলন দিল্লির রাজপথ কাঁপিয়ে দিয়েছিল৷ আন্দোলনের চাপে সেদিন কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার নারীদের সুরক্ষার উদ্দেশ্যে কিছু পরিকল্পনা ও প্রকল্প ঘোষণা করতে বাধ্য হয়৷ ২০১৩ সালে গঠন করা হয় নির্ভয়া তহবিল নামে ১০০০ কোটি টাকার একটি তহবিল৷ এই নির্ভয়া তহবিলের আওতাতেই দেশের সব রাজ্যে আলাদা করে তদন্ত কমিশন গঠন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে কেন্দ্রীয় সরকার, ২০১৫ সালে৷ প্রস্তাব

ছিল, নির্ভয়া তহবিল থেকে ৫০ শতাংশ অর্থ দেবে কেন্দ্রীয় সরকার, বাকি অর্ধেক দেবে রাজ্য সরকার৷ দেশের মোট ১৫০টি তদন্ত কমিশনের জন্য আলাদা করে পুলিশকর্মী নিয়োগের কথাও স্থির হয়৷ তাঁদের নিয়োগ ও বেতন দেওয়ার কথা সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের তহবিল থেকে৷ এই কাজে প্রাথমিকভাবে রাজ্য পিছু ৮৪ কোটি টাকা খরচের অনুমান করা হয়৷ সেখানে অর্ধেক টাকা অর্থাৎ ৪২ কোটি টাকা রাজ্য সরকার ও অর্ধেক কেন্দ্রের নির্ভয়া তহবিল থেকে দেওয়ার কথা৷ কিন্তু অনেকগুলি রাজ্য সরকারই জানিয়েছে তাদের টাকা নেই, তাই তারা প্রতি বছর নির্ধারিত ৪২ কোটি টাকা দিতে পারবে না৷

যে সব রাজ্য টাকা দিতে অস্বীকার করেছে, সেখানে সরকারে আছে কোন দলগুলি? বিজেপি, কংগ্রেস সহ এ রাজ্যের তৃণমূল এবং অন্যান্য আঞ্চলিক দল শাসিত রাজ্য সরকারগুলি টাকা দিতে আপত্তি জানিয়েছে৷ তারই ভিত্তিতে পৃথক তদন্ত কমিশন গঠনের প্রকল্পটি মোদি সরকার বাতিল করে৷ কেন মোদি সরকার রাজ্যগুলিকে চাপ দিল না? তবে কি মোদি একটা অজুহাত খুঁজছিলেন যাতে প্রকল্পটি বাতিল করা যায়?

ভারতে প্রতি ১.৭ মিনিটে একটি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, প্রত্যেক ১৬ মিনিটে একটি ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হয় এবং প্রত্যেক ৪.৪ মিনিটে একজন মহিলা বা শিশুকন্যা গার্হস্থ হিংসার শিকার হচ্ছেন৷ মহিলাদের উপর হিংসার ঘটনা ২০০১ থেকে ২০১৪ সালে বৃদ্ধি পেয়েছে ১৩৫ শতাংশ, ধর্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছে ১২৯ শতাংশ, পণের জন্য মৃত্যু বৃদ্ধি পেয়েছে ২৯ শতাংশ, অপহরণ ও হত্যার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৯১ শতাংশ, শ্লীলতাহানি ১৪১ শতাংশ বেড়েছে৷ ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য দেখাচ্ছে, ২০১১ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত চার বছরে নারীর উপর সংঘটিত অপরাধের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৪ শতাংশ৷ আদালতগুলিতে মামলার পাহাড় জমে আছে৷ এক একটা ঘটনার বিচার শেষ করে দোষীদের শাস্তি দিতে অনেক বছর লেগে যাচ্ছে৷ এবং পুলিশ–প্রশাসনের গাফিলতিতে যথাযথ তথ্য সহ চার্জশিট জমা না করায় অনেক অপরাধীর সাজা হচ্ছে না৷ বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেওয়ার দাবি বারবার উঠলেও গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারগুলির যে আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকা দরকার তা কার্যত দেখাই যাচ্ছে না৷ এবং শেষ পর্যন্ত পৃথক তদন্ত কমিশন গঠনের প্রস্তাবই বাতিল করে দেওয়া হল৷ এর দ্বারা মহিলাদের নিরাপত্তা সম্পর্কে সরকারগুলির দৃষ্টিভঙ্গি কত নিষ্ঠুর, অমানবিক তা আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট৷ সরকার নারী নিরাপত্তার প্রশ্নে যথার্থই আন্তরিক হলে এ ব্যাপারে অর্থ ব্যয়ে পিছপা হত না৷ বছর বছর এমএলএ, এমপি–দের মাইনে না বাড়িয়ে নারী নিরাপত্তার দিকে দৃষ্টি দেওয়া হত৷ কেন্দ্রীয় সরকার সেস বসিয়ে নির্ভয়া তহবিলের জন্য প্রায় ৩২০০ কোটি টাকা জনগণের কাছ থেকে সংগ্রহ করার পর তারা কেন নারীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা থেকে পিছিয়ে গেল?

দেখা যাচ্ছে, গণআন্দোলনের চাপে পাঁচ বছর আগে সরকার যে সব প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হয়েছিল, আজ আন্দোলন স্তিমিত হতেই তারা সেগুলি অস্বীকার করতে চাইছে৷ তাই প্রয়োজন দাবি না মেটা পর্যন্ত লাগাতার আন্দোলন৷