নির্বাচনে মাফিয়ারাজের রমরমা গণতন্ত্রের নামে প্রহসন

ভারতের প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নবীন চাওলা সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘গুন্ডারাজ এবং টাকার থলির অশুভ জোট ভারতের গণতন্ত্রকে দুর্বল করছে’ (হিন্দুস্থান টাইমস : ২৬–১২–২০১৭)৷

নবীন চাওলা সাড়ে পাঁচ বছর ভারতের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ছিলেন৷ ২০০৯–এর লোকসভা নির্বাচন তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানেই পরিচালিত হয়েছে৷ তাঁর কার্যকালে রাজ্য রাজ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে বিধানসভা নির্বাচনও৷ সে সব দেখে তাঁর উপলব্ধি, ‘মানি পাওয়ার’ এবং ‘মাসল পাওয়ার’ হয়ে দাঁড়িয়েছে নির্বাচনে জেতার মূল নির্ণায়ক৷ গত নভেম্বরে গুজরাট এবং হিমাচল প্রদেশে অনুষ্ঠিত হল বিধানসভা নির্বাচন৷ সেখানেও তিনি টাকা দিয়ে ভোট কেনা এবং গুন্ডা দিয়ে সন্ত্রাস কায়েম করে ভোট কুক্ষিগত করার বিপদ লক্ষ করেছেন৷ তাঁর পর্যবেক্ষণ, এ কোনও নতুন বিষয় নয়, সত্তর বা আশির দশক থেকেই ভোটে এই প্রবণতা বাড়তে থাকে৷

চাওলা তথ্য দিয়ে দেখিয়েছেন, এখন কোটিপতি এবং কোটিপতি ক্রিমিনালরাই নির্বাচনে জয়ী হয়৷ দেখিয়েছেন, ১৫তম বা বর্তমানের ১৬তম লোকসভায় প্রায় ৩০ শতাংশ সাংসদের বিরুদ্ধেই এক বা একাধিক ক্রিমিনাল কেস বা ফৌজদারি মামলা রয়েছে৷ খুন, খুনের জন্য আক্রমণ, হুমকি দিয়ে বা ভয় দেখিয়ে বিরাট অঙ্কের তোলা আদায়, ধর্ষণ, ডাকাতি, অপহরণ– এইসব মারাত্মক অপরাধে তারা অভিযুক্ত৷ তাঁর বক্তব্য, পুলিশ বা প্রশাসনের সঙ্গে নানা মিটিং–এ তিনি দেখেছেন, সরাসরি অভিযোগ দায়ের না হলেও বহু সাংসদের ক্রিমিনাল কাজের সঙ্গে যোগ রয়েছে৷ ফলে বাস্তবে অপরাধী সংসদের সংখ্যা ৩০ শতাংশ নয়, আরও বেশি৷ আশির দশক পর্যন্ত নির্বাচনে এই সব মাফিয়ারা বাইরে থেকে প্রার্থীদের সাহায্য করত, যাতে প্রার্থী এমএলএ, এমপি হয়ে তাদের স্বার্থ রক্ষা করে বা অন্তত তাদের কাজে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়৷ এখন তারা নিজেরাই নির্বাচনে দাঁড়ায়, যাতে বিধায়ক, সাংসদ হয়ে নিজেরাই পুলিশ–প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে৷ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সহজে জিততে তাদের প্রার্থী করে৷ সদ্য সমাপ্ত  হিমাচল প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে ৩৩৮ জন প্রার্থীর মধ্যে, স্বঘোষিত হলফনামা অনুযায়ী ৬১ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রয়েছে৷ সংখ্যাটা ১৮ শতাংশ৷ কিন্তু এই ৬১ জনের মধ্যে জয়ী হয়েছেন ২২ জন৷ যে ২২ জন জয়ী হলেন তার ৬৭ শতাংশই কোটিপতি৷

একই চিত্র গুজরাটেও৷ সেখানে স্বঘোষিত হলফনামা অনুযায়ী ১,৮১৯ জন প্রার্থীর মধ্যে ২৫৩ জন ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত৷ এঁদের মধ্যে যে ৪৭ জন জয়ী হয়েছেন তার ৮১ শতাংশই কোটিপতি৷ বাকিরা কোটিপতি না হলেও প্রায় কাছাকাছি৷

কিন্তু নির্বাচিত যে সব সাংসদের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেসের উল্লেখ নেই, তাদেরও একটা বিরাট অংশ কোটি কোটি টাকার মালিক৷ সব মিলিয়ে ক্রিমিনাল কাজকর্মে অভিযুক্ত অথবা অভিযুক্ত নন– এমন সাংসদ মিলিয়ে কোটিপতি সাংসদই বাস্তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ৷ সংবাদে প্রকাশিত, ২০১৪ সালে নির্বাচিত লোকসভায় মোট আসন ৫৪৩৷ তার মধ্যে কোটিপতি সাংসদের সংখ্যা ৪৪২৷ দেশের জনগণের মধ্যে অতি নগণ্য অংশই কোটিপতি৷ অথচ পার্লামেন্টে কোটিপতিদেরই প্রতিনিধি বেশি৷ বিপরীতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ গরিব, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত৷ পার্লামেন্টে তাদের প্রতিনিধি কোথায়? কোটিপতি সাংসদরা পার্লামেন্টে পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থে কাজ করে৷ সেই কারণে আজ পার্লামেন্টে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বার্থে কোনও কণ্ঠস্বর শোনা যায় না৷

পুঁজির বিকাশের প্রয়োজনে সামন্তী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে বুর্জোয়ারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল৷ তারা ঘোষণা করেছিল, সরকার হবে জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনগণের সরকার৷ এই ঘোষণার মধ্যে জনগণ মুক্তির স্বাদ পেয়েছিল৷ কিন্তু বুর্জোয়ারা বেশিদিন এই ঘোষণার প্রতি মর্যাদা দিতে পারল না৷ তারাও কায়েম করল পুঁজির শোষণ এবং পুঁজির আধিপত্য৷ জনগণ তাদের শোষণের জাঁতাকলে পড়ল৷ এই বুর্জোয়াদের হাতেই যেহেতু সম্পদের মালিকানা, ফলে তারাই সম্পদের জোরে হয়ে উঠল সরকারের মূল নিয়ন্ত্রক৷ বুর্জোয়া ব্যবস্থা কায়েমের পর থেকেই এরাই সরকারের আসল পরিচালক৷ বাইরে নির্বাচন এবং গণতন্ত্রের একটা ঠাটবাট থাকলেও, জনগণ ভোট দিলেও বাস্তবে পুঁজিপতিরাই ঠিক করে দেয় জনগণ কাকে ভোট দেবে৷ আধুনিক ইলেক্ট্রনিক প্রচারমাধ্যম বা টিভি চ্যানেলগুলি আসার আগে মানুষ যতটা প্রভাবহীন ভাবে নিজের বিচার বিশ্লেষণ বা পছন্দ অনুযায়ী ভোট দিতে পারত, তা আজ অনেকটাই সঙ্কুচিত৷ এখন টিভি চ্যানেলগুলি, প্রিন্ট মিডিয়াগুলি ২৪ ঘন্টা সেই সব প্রার্থীদের বা দলের ধারাবাহিক প্রচার দেয় যারা মিডিয়াকে টাকা দেয় বেশি৷ পুঁজিপতিদের টাকার থলি এ কাজে ব্যবহূত হয়৷ পুঁজিপতিরা তার প্রথম পছন্দের দলের প্রার্থীদের জিতিয়ে আনতে টাকা বিনিয়োগ করে৷ এটা তার ব্যবসার অন্যতম অঙ্গ৷ তারা তাদের দ্বিতীয় পছন্দের দলকেও প্রধান বিরোধী দল হিসাবে রাখতে টাকা দেয়৷ রাজনৈতিক দলকে হাতে রাখা, সাংসদ–বিধায়কদের পক্ষে রাখা, তাদের দিয়ে ব্যবসার স্বার্থে  নানা আইন করানো, দেশের ভিতরে বা অন্য দেশে ব্যবসার বাজার পেতে সরকারকে কাজে লাগানো ও পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে কোনও আন্দোলন হলে সরকারকে দিয়ে পুলিশের সাহায্যে দমন করানো ইত্যাদি নানা কারণে পুঁজিপতিরা তাদের স্বার্থের রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করে বা মদত দেয়৷ মিডিয়ায় পুঁজিপতিদের পছন্দের প্রার্থীদের পক্ষেই অবিরাম প্রচার চলে৷ সেসব শুনে শুনে জনগণও কে জিতবে, কে হারবে, হারলে ভোট নষ্ট–এ সব চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বুর্জোয়াদের তুলে ধরা প্রার্থীকেই ভোট দিয়ে বসে৷ ফলে নির্বাচনে বিভিন্ন দল বা প্রার্থী যে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে তা শুধু ভোট কেনাতেই ব্যবহূত হয় না, জনগণকে প্রভাবিত করবার ক্ষেত্রে মিডিয়ার পেছনেও ব্যয় করা হয়৷ লক্ষ করার বিষয়, গোটা নির্বাচনী প্রচারে বুর্জোয়াদের দ্বারা বিজ্ঞাপিত কোনও দলই জনজীবনের মৌলিক সমস্যা সমাধানের বিষয়ে আলোকপাত করে না৷ আর জনগণও দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় দেখছে, ভোট দেওয়া, সরকার গঠন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে তাদের কোনও সমস্যারই সমাধান হয় না৷ এর থেকে জনগণের একাংশ সিদ্ধান্ত করে বসে, যখন তাদের প্রাপ্তি শূন্যই, তখন ভোট বিক্রি করে পাঁচশো–হাজার টাকা যা পাওয়া যায় সেটাই লাভ৷ বলা বাহুল্য এই মানসিকতা বড় বড় দলগুলিকে ভোট কেনার সুযোগ করে দিচ্ছে৷ বুর্জোয়া দলগুলিও এই প্রবণতায় ইন্ধন দিয়ে জনগণের নৈতিক মান অবনমিত করছে৷ এই হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ দেশ ভারতের নির্বাচন৷ শুধু ভারতের বললে ভুল হবে, সব পুঁজিবাদী দেশেই ভোটের চিত্র কমবেশি এমনই৷ এই প্রবণতা গণতন্ত্রকে প্রহসনে পরিণত না করে পারে?

এসব বন্ধের নামে বিভিন্ন সময়ে নির্বাচনী সংস্কার করা হলেও, মডেল কোড অফ কন্ডাক্ট তৈরি হলেও, বাস্তবে তা বন্ধ হওয়ার পরিবর্তে বেড়েই চলেছে৷

লেনিন বলেছিলেন, নির্বাচন শেষবিচারে একটা বুর্জোয়া রাজনীতি৷ এর মধ্যে দিয়ে বুর্জোয়ারা পার্লামেন্টারি চৌহদ্দির মধ্যেই জনগণকে আটকে রাখে৷ এক দলকে পছন্দ না হলে, আরেক দলকে আনো, তাকে আবার না পছন্দ হলে অপর একদলকে আনো৷ এটাকে বুর্জোয়ারা একটা বিরাট গণতন্ত্র হিসাবে দেখালেও বাস্তবে বুর্জোয়াদের পছন্দের দলগুলিকেই এম সি কিউ–এর মতো তুলে ধরা হয় এবং তার পক্ষে প্রচারের ঝড় তুলে জনগণের পছন্দ রূপে জিতিয়ে আনা হয়৷ সরকার গঠন হয়৷ স্বাভাবিকভাবেই সরকার বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থকেই রক্ষা করে যায়৷ সরকারের পর সরকার পাল্টায়, কিন্তু জনজীবনের সঙ্কট সমাধানের পরিবর্তে তীব্রতর হয়৷ এই আবর্তনই স্বাধীনতার ৭০ বছরে ধরে ভারতে হয়ে চলেছে৷

ইভিএম ব্যবহার করেও নির্বাচনে রিগিং আটকানো যাচ্ছে না৷ গত ডিসেম্বরে গুজরাটে যে বিধানসভা নির্বাচন হল, তাতেও বহু কেন্দ্রে মোট ভোটারের থেকে বেশি ভোট পড়তে দেখা গেছে৷ ওলপাড কেন্দ্রে মোট ভোটার ২,৪২,০১৪৷ ভোট পড়েছে ২,৪৪,৫২১৷ ২৫০৭টি ভোট বেশি পড়েছে৷ মাণ্ডবী কেন্দ্রে বেশি পড়েছে ৩৪৩৮টি ভোট৷ সুরাট–পূর্ব কেন্দ্রে বেশি পড়েছে ৯৩২টি ভোট৷ এরকম ১৪টি বিধানসভা কেন্দ্রের নাম সংবাদে প্রকাশিত হয়েছে যেখানে ছাপ্পা ভোটের জন্য মোট ভোটারের থেকে বেশি ভোট পড়েছে৷

বুর্জোয়া গণতন্ত্র আজ এভাবে প্রহসনে পরিণত হয়েছে৷ মানুষকে এর বাইরে ভাল কিছু দেওয়ার তার আর নেই৷ সে নিজেই বিপন্ন বুর্জোয়াদের দ্বারা৷ মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের খেদোক্তি তাকেই স্পষ্ট করে দেখাচ্ছে৷