নিউজিল্যান্ডের বর্বর হত্যাকাণ্ড ফের দেখাল সন্ত্রাসবাদের কোনও জাত–ধর্ম নেই

নিউজিল্যান্ডের এক মসজিদে সন্ত্রাসবাদী হামলায় প্রায় ৫০ জন সাধারণ মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু এবং আরও ৫০ জনের গুরুতর জখম হওয়ার ঘটনা দেখিয়ে দিল সন্ত্রাসবাদের ছোবল থেকে হিন্দু–মুসলমান–খ্রিষ্টান-বৌদ্ধ কোনও অংশের মানুষই মুক্ত নয়৷ একই ভাবে দেখাল সন্ত্রাসবাদীরও বিশেষ কোনও ধর্ম, বর্ণ বা জাত নেই৷ ইসলাম, খ্রিস্টান, হিন্দু কোনও ধর্মের সাথেই সন্ত্রাসবাদের কোনও সম্পর্ক নেই৷ ধর্মের নামটুকু ব্যবহার করে মাত্র৷ কোথাও সন্ত্রাসবাদী কৃষ্ণবর্ণ, কোথাও শ্বেত৷ সন্ত্রাসবাদ বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রের কুৎসিত লক্ষণগুলির একটি৷

ঘাতক বেন্টন ট্যারান্ট তার হত্যাকাণ্ডের ঠিক আগে অনলাইনে একটি ইস্তাহার প্রকাশ করে৷ তার ছত্রে ছত্রে রয়েছে মুসলিম আর শরণার্থীদের প্রতি প্রবল ঘৃণা ও অতি দক্ষিণপন্থায় চরম বিশ্বাস৷ স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, ২৮ বছরের এই তরুণ, যাকে তার ঠাকুমা ‘খুব ভাল ছেলে’ বলেছেন, সে এমন ঘৃণা আর বিদ্বেষের শিকার হল কী করে? তার ‘শ্বেতাঙ্গ আত্মপরিচয়’কে জাগিয়ে তোলার জন্য ট্যারান্ট এই ইস্তাহারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ধন্যবাদ দিয়েছে৷ ইস্তাহারে লিখেছে, ‘শ্বেতাঙ্গরাই সর্বশ্রেষ্ঠ’ এই মতাদর্শে বিশ্বাস করে সে৷ সে নিজেকে একজন ফ্যাসিস্ট বলে পরিচয় দিয়েছে৷ ভারতের নাম উল্লেখ করেও সে লিখেছে, ‘‘ইউরোপের মাটি থেকে এই দখলদারদের সরাতে হবে৷’’

সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ইউরোপ–আমেরিকা জুড়ে ইসলাম বিদ্বেষের ঢেউ তোলা হয়েছে৷ এশিয়া–আফ্রিকার গৃহযুদ্ধ–সন্ত্রাস বিদীর্ণ ভূখণ্ড থেকে বাঁচার আশায় ইউরোপে আশ্রয়প্রার্থী শরণার্থীদের বিরুদ্ধে উগ্রজাতীয়তাবাদকে চাগিয়ে তোলা হচ্ছে সর্বত্র৷ আমেরিকার ৯/১১ হামলার পর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘‘আপনারা হয় আমাদের সঙ্গে, নয় তো সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে৷’’ অর্থাৎ আমেরিকার পক্ষে কেউ না থাকলেই সে সন্ত্রাসবাদী৷ সেই বুশেরই যোগ্য উত্তরসূরী ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ ট্রাম্প মেক্সিকান অভিবাসীদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘শুনতে খারাপ লাগলেও ওরা হানাদারই৷ সব ধরনের অপরাধী ঢুকছে দক্ষিণের সীমান্ত দিয়ে৷’’ এই ট্রাম্পই ‘অভিবাসীদের আড়ালে দুষ্কৃতী ঢুকবে’ এই অজুহাতে সাতটি মুসলিম দেশের নাগরিকদের আমেরিকায় ঢোকা নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন৷ ৯/১১–র টুইন টাওয়ার হামলার পর আমেরিকা এর পুরো দায় ইসলাম ও ১৩০ কোটি মুসলমানের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল৷ এই ভাবেই আমেরিকার নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি জাতিবিদ্বেষকে ছড়িয়ে দিয়েছে দেশে দেশে৷ বিশ্বজুড়ে সংগঠিত সন্ত্রাসবাদের ইতিহাসও তাই৷ সবগুলির পিছনে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদ শিরোমণি আমেরিকা এবং অন্য সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির কখনও প্রত্যক্ষ কখনও পরোক্ষ মদত৷ ইতিহাস বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই আফগানিস্তানে সোভিয়েতের প্রভাব মোকাবিলার জন্য গঠন করেছিল আল কায়দা ও তালিবানদের, জন্ম দিয়েছিল ওসামা বিন লাদেনের মতো মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের৷ এই আলকায়দা ও তালিবানকেই মার্কিনীরা পরবর্তীকালে ব্যবহার করে সন্ত্রাস ও ইসলামকে সমার্থক করে তোলে৷ আবার সেই সন্ত্রাসকে ব্যাপক প্রচার দিয়ে তাকে গুরুতর শত্রু হিসাবে তুলে ধরে তাকে দমনের নামে দেশে দেশে হামলা চালানোর এবং সে দেশগুলির সম্পদ দখলের সুযোগ করে নেয় তারা৷

পুঁজিবাদ আজ চরম সংকটগ্রস্ত, মানুষকে দেওয়ার মতো তার আর কিছুই নেই, বরং সংকট থেকে বাঁচতে সংকটের সমস্ত বোঝা সাধারণ মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা বাঁচতে চাইছে৷ ফল হিসাবে বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে প্রবল বিক্ষোভে সাধারণ মানুষ ফেটে পড়ছে৷ সেই বিক্ষোভ যাতে নিজ নিজ দেশের শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির বিরুদ্ধে শ্রেণিসংগ্রামের আকারে ফেটে পড়তে না পারে, যাতে সমস্ত সংকটের জন্য দায়ী পুঁজিবাদকে মানুষের বিক্ষোভের আগুন থেকে আড়াল করা যায়, তাই পরিকল্পিত ভাবে ‘সন্ত্রাসবাদের’ জন্ম দিয়েছে শাসক পুঁজিপতি শ্রেণি এবং এই ভাবে পুঁজিবাদী শোষণকে আড়াল করে সন্ত্রাসবাদকেই প্রধান সমস্যা হিসাবে তুলে মানুষের দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে৷ একই ভাবে মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলিতে নৈরাজ্য সৃষ্টির ষড়যন্ত্র সফল করতে আমেরিকা ও তার স্যাঙাৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি একদিকে নানা ভাবে আই এস–এর মতো নানা উগ্র মৌলবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী গড়ে ওঠার সুযোগ করে দিচ্ছে, অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে তাদের বাড়বাড়ন্তে সাহায্য করে চলেছে৷

দি ডেইলি টেলিগ্রাফ, ১২ জুন ২০১৪ তারিখে লিখেছিল, ‘আরব বসন্ত’ সিরিয়ায় এসে ধাক্কা খাওয়া মেনে নিতে পারেননি মার্কিন নেতারা৷ একই ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক ও রাজতন্ত্রশাসিত আরবের দেশগুলো সিরিয়ার সরকারকে উৎখাতের জন্য পরিচালিত জেহাদে বিপুল অর্থ জুগিয়েছে৷ এই অর্থের সবচেয়ে বড় ভাগ একসময় পেয়েছে আই এস৷

একই রকম ভাবে শরণার্থীদের বিরুদ্ধে ইউরোপ এবং আমেরিকা জুড়ে যে বিদ্বেষ ফেটে পড়ছে সেই বিদ্বেষের জন্মদাতাও সাম্রাজ্যবাদীরা৷ একদিকে মার্কিন দখলদারির নীতির ফলেই মধ্য প্রাচ্য এবং আফ্রিকার দেশগুলিতে চরম নৈরাজ্য তৈরি হয়েছে৷ যুদ্ধ, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, মৃত্যু সেখানকার জীবনের অঙ্গে পরিণত হয়েছে৷ লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহারা হয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে পাড়ি দিচ্ছে অজানা পথে৷ অন্য দিকে সমস্ত পুঁজিবাদী দেশের মতোই আমেরিকাতেও অর্থনৈতিক মন্দা, বেকার সমস্যা, জীবনযাপনের ব্যয় বৃদ্ধি এমন চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে যে, মানুষের বিক্ষোভ সেখানে ফেটে ফেটে বেরোতে চাইছে৷ ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ মুভমেন্ট তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত৷ স্বাস্থ্য–শিক্ষা সহ অনেক মৌলিক অধিকারই আজ আমেরিকাবাসীদের নাগালের বাইরে৷ এই বিক্ষোভ ঠেকানো ও শোষিত মানুষকে বিভক্ত করার জন্য একচেটিয়া পুঁজিপতিরা ট্রাম্পের মতো এক প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তিকে জিতিয়ে এনেছে৷ ট্রাম্প দেখালেন, আমেরিকানদের বেকারত্বের কারণ পুঁজিবাদ নয়, অভিবাসীরা৷ তাদের জন্যই শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানরা কাজ পাচ্ছে না৷ এই উগ্র আমেরিকান জাতীয়তাবাদ প্রচার করে তিনি আমেরিকায় বসবাসকারী বিভিন্ন দেশের বিরাট সংখ্যক অভিবাসীদের বিরুদ্ধে, এরই সাথে সাথে কালোদের বিরুদ্ধে, হিস্পানিকদের (আমেরিকায় বসবাসকারী স্প্যানিশ ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী) বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের খেপিয়ে তুললেন৷ এক কথায় মানুষের পিছিয়ে পড়া চিন্তাকে ভয়ানক মাত্রায় উত্তেজিত করেই ট্রাম্পের আগমন৷ আমেরিকার সমস্ত রকম অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটের মূল যে সেখানকার সংকটগ্রস্ত পুঁজিবাদ, এর দ্বারা সেটাই পিছনে চলে গেল৷ এরই ফলে ফ্যাসিস্ট এবং বর্ণ বৈষম্যবাদী শক্তিগুলি মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রত্যক্ষ সমর্থনে নতুন করে মাথা তুলছে আমেরিকা জুড়ে৷

এই উগ্র জাত্যাভিমানকে ইউরোপের শাসক শ্রেণির একাংশও মদত দিয়ে চলেছে৷ তাই ইউরোপ জুড়েও জাতিবাদী ও ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলি আবার মাথাচাড়া দিচ্ছে৷ যুব সমাজের একাংশের মধ্যে এর প্রভাব পড়ছে৷ বেন্টন ট্যারান্ট তেমনই এক যুবক৷ এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, সে ট্রাম্পকে তার গুরু মেনেছে৷

গোটা বিশ্বের মতো ভারতের শাসক শ্রেণিও পুঁজিবাদী সংকটের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকে বিপথগামী করতে একই ভাবে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, ধর্মীয় কূপমণ্ডুকতা, উগ্র জাতীয়তাবাদের বীজ বুনছে৷ শোষিত মানুষের মধ্যে ঐক্যকে ধ্বংস করতে ঘৃণা ছড়াচ্ছে৷ ইসলাম এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের উপর নানা আক্রমণ নামিয়ে আনছে৷ ভারতের প্রধানমন্ত্রী আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে এখানে খুবই মিল৷ তাই ট্রাম্প বিজেপি–সংঘ পরিবারের খুবই প্রিয়পাত্র৷ অথচ কাজের খোঁজে ভারতীয়রা পৌঁছায়নি এমন কোনও দেশ নেই৷ বিজেপি নেতারা একবারও ভেবে দেখেন না, তাঁদের জাতিবাদী কার্যকলাপ অন্য দেশে কর্মরত লক্ষ লক্ষ ভারতীয়দের একই বিপদে ফেলতে পারে৷

আশার কথা, বিশ্বের দেশে দেশে শুভবুদ্ধির মানুষ এই সন্ত্রাসবাদী হামলার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন৷ তীব্র নিন্দা করেছেন এই হত্যাকাণ্ডের৷ ভারতে একটি সন্ত্রাসী হামলাকে সামনে রেখে যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গোরা ভোটের বাজার গরম করতে প্রতিবেশী দেশের সাথে সংঘর্ষের মনোভাবে উস্কানি দিচ্ছেন, যুদ্ধ যুদ্ধ পরিবেশ গড়ে তুলতে চাইছেন তখন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী দেশের সব ধর্মের সব বর্ণের মানুষের মধ্যে ঐক্য–প্রচেষ্টার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন৷ মুসলিম এবং অভিবাসীদের বিরুদ্ধে এই বিদ্বেষকে কোনও রকম প্রশ্রয় না দিয়ে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডের্ন আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ালেন৷ এই হামলাকে ‘নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে অন্ধকারময় দিন’ হিসাবে চিহ্ণিত করে বললেন, ‘‘যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন তাঁরাই আমরা৷ এ দেশকে নিরাপদ বাসভূমি হিসাবে যাঁরা বেছে নিয়েছেন, নিউজিল্যান্ড তাঁদেরই৷ যে হামলা চালিয়েছে সে আমাদের কেউ নয়৷’’ উগ্রজাতিবাদী শক্তিগুলির বিরুদ্ধে এই প্রচেষ্টাকেই দেশে দেশে শক্তিশালী করতে হবে৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৩২ সংখ্যা)