নরনারীর বৈবাহিক সম্পর্ককেও ধর্মীয় বিভাজনের যূপকাষ্ঠে বলি দিচ্ছে হিন্দুত্ববাদীরা

 

বিয়ে করার মধ্য দিয়ে জোর করে ধর্মান্তরণ আটকানোর নামে উত্তরপ্রদেশ সরকার ২০২০ সালে ‘প্রহিবিশন অফ আনলফুল কনভার্সন অফ রিলিজিয়ন অর্ডিন্যান্স, ২০২০’ নিয়ে এসেছে। উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকারের পথ অনুসরণ করে অন্য রাজ্যের বিজেপি সরকারও একই পথে হাঁটছে। আক্ষরিক অর্থে আইনটির লক্ষ্য বেআইনি ধর্মান্তরণে বাধা দেওয়া। সমস্যা হল, কাকে বিজেপি সরকার বেআইনি ধর্মান্তরণ বলছে। তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে হিন্দু-মুসলমান বিবাহিত নারী-পুরুষদের টার্গেট করা। একটি ধুয়া তুলে দেওয়া হয়েছে– মুসলমান যুবকরা নানাভাবে ভালোবাসার ফাঁদ পেতে হিন্দু মেয়েদের বিয়ে করছে, সে জন্য মেয়েটির ধর্মান্তর ঘটাচ্ছে। হিন্দুত্ববাদীরা এর নাম দিয়েছে ‘লাভ-জিহাদ’। অর্থাৎ তারা বলছে, প্রেম-ভালবাসাকে সামনে রেখে হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছে মুসলিম সমাজ।

উভয়ের সম্মতির ভিত্তিতে দুই ভিন্ন ধর্ম বা জাতের নারী-পুরুষের বিয়ে যে স্বাভাবিক, এই সহজ বাস্তবতাকে ভুলিয়ে দিতে চায় হিন্দুত্ববাদীরা। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ আবার ঘোষণা করেছেন, মুসলমান সম্প্রদায়ের যে ছেলে হিন্দু মেয়েকে বিবাহে উৎসাহ দেবে, সে আসলে মৃত্যুকে আহ্বান করবে।

উত্তরপ্রদেশে গেরুয়া শিবির এই ‘লাভ জিহাদ’-এর নাম করে সাধারণ নিরপরাধ মানুষকে চরম হেনস্থা করছে। মোরাদাবাদে পিংকি নামে ২২ বছরের এক হিন্দু তরুণী ২০২০ সালের জুলাই মাসে রশিদ নামক এক মুসলিম যুবককে ভালবেসে বিয়ে করে। তখনও ‘লাভ জিহাদ’ আইন পাশ হয়নি। গত ৫ ডিসেম্বর অন্তঃসত্ত্বা পিংকি তার স্বামী ও দেবরের সাথে বিবাহ রেজিস্ট্রি করার জন্য যাচ্ছিল। হিন্দুত্ববাদী বজরং দলের লোকেরা তাদের উপর আক্রমণ চালায়। শারীরিক নির্যাতন ও হেনস্থা করার পর তারা রশিদ ও তার ভাইকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়, পিংকিকে সরকারি হোমে পাঠানো হয়। সেখানে পিংকির গর্ভস্থ সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। পিংকি বারবার জানিয়েছেন যে তাঁকে জোর করে ধর্মান্তরিত করা বা বিয়ে করা হয়নি। এ-ও জানিয়েছেন যে তিনি বাপের বাড়ি যেতে চান না। প্রশ্ন উঠেছে, তবুও কেন অন্তঃসত্ত্বা জেনেও তাঁকে আটকে রাখা হল। জনমতের চাপে ছাড়া পেয়ে পিংকি এখন শ্বশুরবাড়িতে। তাঁর আফশোস যে, তাঁদের ভালবাসা শুধুই ভালবাসা, কোনও জিহাদ নয়, কিন্তু রাষ্ট্র সে কথা মানতে চায় না। তাই তাঁর গর্ভস্থ সন্তানকে এভাবে অকালে ঝরে যেতে হল।

উত্তরপ্রদেশে ওই অর্ডিন্যান্স পাশ হওয়া মাত্রই ধরপাকড় শুরু হয়ে যায়। অন্তত ১৫ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন বিভিন্ন জায়গা থেকে। এদিকে আইনজীবী ও প্রাক্তন বিচারপতিরা বলছেন কোনও ঘটনা নতুন আইনের নোটিশ জারির আগে ঘটে থাকলে তা ওই আইনের আওতায় পড়ে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অন্তত তিন-চারটি কেসে এফআইআর করা হয়েছে পুরনো ঘটনার ভিত্তিতে। আবার আঠারো বছরের একটি তরুণ তার বান্ধবীর সাথে স্রেফ পিৎজা খেতে গিয়েও গ্রেফতার হয়েছে। যদিও মেয়েটি বলেছে, ধর্মান্তরণ দূরস্থান, ছেলেটি তাকে বিবাহের প্রস্তাবও দেয়নি। ছেলেটিকে জেলে পোরা হয়েছে এই কথা বলে যে, মেয়েটির বাবা অভিযোগ করেছেন, তাঁর মেয়েকে বিয়ে এবং ধর্মান্তরণের উদ্দেশ্যে ছেলেটি ফুসলিয়ে নিয়ে গিয়েছে। ছেলেটির বিরুদ্ধে তফসিলি জাতি-উপজাতি এবং পকসো আইনের ধারাও দেওয়া হয়। অথচ মেয়েটির বাবা বলেছেন, তিনি ছেলেটির বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ করতে চাননি, পুলিশ তাকে দিয়ে বিবৃতি লিখিয়ে নিয়েছে। মেয়ের কথায় তিনি সম্পূর্ণ আস্থা রাখেন। এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে পুলিশ প্রশাসনের সাম্প্রদায়িক ও চূড়ান্ত উদ্দেশ্যমূলক আচরণ পরিষ্কার হয়ে যায়।

আরও একটি ঘটনা ঘটেছে লক্ষে্মৗতে। দুই ধর্মের দু’জন ছেলেমেয়ে হিন্দু ধর্মমতেই বিয়ে করার সময় হিন্দু যুব বাহিনীর প্রতিনিধিরা ও পুলিশ বাধা দেয় এবং বিয়ে বন্ধ করে দেয়। যদিও এই বিয়ের ক্ষেত্রে ধর্মান্তরণের কোনও বিষয় ছিল না এবং কেউ কারও উপর কোনওরকম জোর বা শক্তি প্রয়োগ করেনি। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, ছেলেমেয়েদের স্বাভাবিক প্রেম-ভালোবাসার অধিকার থাকবে না।

আইনসম্মত নয়

এই ‘লাভ জিহাদ আইন’-এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন বহু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সচেতন মানুষ। ১০৪ জন অবসরপ্রাপ্ত আমলা চিঠি পাঠিয়ে উত্তরপ্রদেশের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছেন, ‘আপনাদের এই কাজ কি অনাগত শিশুদের নির্বিচারে হত্যা করার সামিল নয় এবং আপনার রাজ্যের পুলিশ নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে দিয়ে কি এই কাজকেই ত্বরান্বিত করছে না? তাঁরা আরও বলেছেন, উত্তরপ্রদেশের পুরো পুলিশ বাহিনীকে খুব দ্রুততার সাথে শেখানো উচিত মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে কীভাবে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতে হয়। যে সংবিধানের বিধিগুলি ঊর্ধ্বে তুলে ধরার শপথ নিয়ে তারা সরকারে এসেছেন, মুখ্যমন্ত্রী সহ উত্তরপ্রদেশের সব রাজনীতিবিদদের নতুন করে তা জানতে হবে। এ ছাড়াও চারজন পূর্বতন বিচারপতি উত্তরপ্রদেশ সরকারের এই ধর্মান্তরণবিরোধী অর্ডিন্যান্সের তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন যে, এটা সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক এবং মানুষের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। তাদের মধ্যে একজন প্রাক্তন বিচারপতি এই অর্ডিন্যান্সের তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, মানুষের মধ্যে বিভাজন আনার উদ্দেশ্যে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদীরা এই আইন তৈরি করেছে।

সুপ্রিম কোর্টের পূর্বতন বিচারপতি মদন বি লোকুর বলেন, আইন সকলকে নিজের সাথী পছন্দ করার স্বাধীনতা দিয়েছে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, সুপ্রিম কোর্ট পূর্বেই রায় দিয়েছে– একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের পছন্দমতো জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করার অধিকার কোনও রাজ্য সরকারের নেই। তার পরেও উত্তরপ্রদেশ সরকার এমন সিদ্ধান্ত নেয় কী করে? দিল্লি হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি এবং ন্যাশনাল ল কমিশনের পূর্বতন চেয়ারম্যান বিচারপতি এ পি শাহ বলেছেন এই আইনের আসল উদ্দেশ্য নারীদের অবদমিত করা। তিনি আরও বলেছেন এই আইনের বিভিন্ন বিধিগুলি আসলে মানুষের স্বাধীনভাবে ধর্মাচরণের অধিকারকেও খর্ব করবে। সংবিধান নাগরিকদের জীবনের এবং স্বাধীনতার যে অধিকার সুনিশ্চিত করেছে, তার উপর আঘাত এনেছে এই আইন। তিনি আরও বলেছেন এই আইন মানুষের জীবনে বিরাট অমঙ্গল নিয়ে আসবে। এই প্রাক্তন বিচারপতি অত্যন্ত কঠোর ভাষায় উত্তরপ্রদেশ সরকারের সমালোচনা করে বলেছেন, কোনও একটি নির্বাচিত সরকার, সংবিধানের কাছে যার দায়বদ্ধতা রয়েছে, সেই সরকার এরকম একটি আইন পাশ করেছে বিশ্বাস করাই মুশকিল। সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি দীপক গুপ্ত এই আইনকে সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক বলে আখ্যা দিয়েছেন। বলেছেন, সরকারের কী প্রয়োজন মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের উপর হস্তক্ষেপ করার। ভারতের সংবিধান শুধুমাত্র মানুষের পছন্দমতো ধর্মাচরণের অধিকারকেই নিশ্চিত করেনি, তার নিজের বিশ্বাস অনুযায়ী চলার অধিকারকেও নিশ্চিত করেছে। একজন মানুষ নাস্তিক হতে পারেন, অজ্ঞেয়বাদী হতে পারেন, যা খুশি হতে পারেন। তিনি আরও বলেন সংবিধান যেমন মানুষের বিশ্বাস করার অধিকার নিশ্চিত করেছে, আবার বিশ্বাস পরিবর্তন করার অধিকারকেও নিশ্চিত করেছে।

কোর্ট একজনের পছন্দের জীবনসঙ্গীকে বেছে নেওয়ার পক্ষেই রায় দিয়েছে

একজন ২০ বছর বয়সী মেয়েকে তার স্বামীর সাথে থাকার স্বীকৃতি দিয়ে দিল্লি হাইকোর্ট ২৬ নভেম্বর এক রায়ে স্পষ্ট জানিয়েছে– একজন প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা যেখানে খুশি, যার সাথে খুশি থাকার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। একই রকম একটি রায় এলাহাবাদ হাইকোর্ট কয়েকদিন আগে দিয়েছে। এক বছর আগে প্রিয়াংকা খারাওয়ার এবং সালামৎ আনসারি বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন এবং বিয়ের আগে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। প্রিয়াংকার বাবা কানপুরে এফআইআর করেন। কোর্ট রায়ে বলে, ‘আমরা এদের হিন্দু বা মুসলিম হিসাবে দেখছি না। বরং দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হিসাবে দেখছি, যাঁরা নিজের পছন্দমতো বিয়ে করেছে এবং এক বছর ধরে সুখে স্বচ্ছন্দে সংসার করছে।’ নানা রাজ্যের হাইকোর্ট প্রায় একই মত ব্যক্ত করেছে।

এটা পরিষ্কার যে ‘লাভ জিহাদ’ আইন আন্তঃধর্ম বিবাহ এবং ধর্মান্তরণকে অপরাধমূলক কাজ হিসাবে চিহ্নিত করেছে এবং ‘অ্যালিওরমেন্ট’ (ফুঁসলানো) কথাটার একটা অযৌক্তিক সংজ্ঞা খাড়া করেছে। একজন অবসরপ্রাপ্ত আই পি এস অফিসার লিখেছেন– আমার ভয় হচ্ছে ভারতবর্ষ ধর্মের ব্যাপারে পাকিস্তানের হিন্দু রূপ ধারণ করছে। ভারতীয় মেয়েদের শুধুমাত্র তার স্বামী পছন্দ করার অধিকারই নেই, তাদের ধর্মবিশ্বাস পরিবর্তন করার অধিকারও আছে। মুসলমানরা ষড়যন্ত্র করে সহজ সরল হিন্দু মেয়েদের ধর্মান্তরিত করার জন্য শিকার করে, এই ধরনের ধারণাও অর্থহীন।

ধর্মের ভিত্তিতে যখন একটি রাষ্ট্রে নীতি নির্ধারণ করা হয়, তখন তাকে আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা যায় না। সেটা আসলে একটা ধর্মীয় রাষ্ট্র। এই নীতির বিরুদ্ধে ইউরোপে দীর্ঘ লড়াই হয়েছে। ভারতেও আসলে এই লাভ জিহাদ আইনের মধ্য দিয়ে হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের প্রাথমিক ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের কাজটি করা হচ্ছে। শুধু হিন্দু রাষ্ট্র নয়, আসলে নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণির ও কোনও অধিকারহীন নাগরিকে পরিণত করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে, যা বিজেপির নীতি-আদর্শের পরিপূরক। আসলে এই আইনের ধারণার মধ্যেই রয়েছে একজন হিন্দু মেয়ের তার নিজের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার যোগ্যতা নেই, তাই সে মুসলিম সন্ত্রাসবাদীদের খপ্পরে পড়ে এবং ধর্মান্তরিত হয়ে যায়। আবার বহু চরম দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদীরা মেয়েদের শুধুমাত্র গর্ভ হিসাবে দেখতে চান। তাদের বক্তব্য হিন্দু মেয়েদের বিয়ে করে তাদের গর্ভে মুসলমান সন্তানের জন্ম দেওয়া এবং মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা ও হিন্দুদের সংখ্যা কমানো এই বিয়ের মূল উদ্দেশ্য। মুসলমান বিদ্বেষের চেনা হাতিয়ারই বিজেপি ব্যবহার করছে। যাকে সর্বতোভাবে প্রতিহত করা দরকার।