নববর্ষ : মদ–মাদকের নেশায় ছারখার যৌবন

২৫ ডিসেম্বর থেকে ২ জানুয়ারি মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যবাসীকে আনন্দে মেতে ওঠার আহ্বান জানিয়েছিলেন৷ এমনিতেই রাজ্যে সরকারি পোষণে মেলা–খেলা–উৎসবের জোয়ার চলছে৷ সেই সঙ্গে বড়দিনকে আরও বড় করার ‘সম্মতি’ দিয়ে রাজ্যবাসীর আরও কাছের হয়ে ওঠার চেষ্টায় মাতলেন মুখ্যমন্ত্রী৷ মানুষের জীবনে আনন্দ করার পরিস্থিতি আদৌ আছে কিনা সে হিসাব নেওয়ার ফুরসত এত কিছুর মধ্যে নিশ্চয় তাঁর হয়ে ওঠেনি দরিদ্র মানুষ, বেকার যুবক, কাজ হারানো শ্রমিক, চাকরি খোয়ানো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, নামমাত্র মাইনের আশা–অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ– তাঁদের পরিবারকে নিয়ে কীভাবে উৎসবে মাতবেন, সে বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী কোনও দিকনির্দেশ দিতে পারেননি

বড়দিন উপলক্ষে প্রত্যেক বারের মতোই রাজ্যবাসীর একটা বড় অংশের ভিড় ছিল পার্কস্ট্রিটমুখী৷ শুধু তাই নয়, আনন্দে মাতোয়ারা প্রায় প্রতিটি পাড়া, প্রতিটি এলাকাই পরিণত হয়েছিল এক একটা মিনি পার্কস্ট্রিটে৷ নাচ–গান–খানাপিনা এ সমস্তই এর অঙ্গ৷ দলে–দঙ্গলে শিশু থেকে বয়স্ক মানুষ মেতেছিলেন ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ সম্বোধনে নববর্ষ বরণে৷ কিন্তু এর পাশাপাশি আর একটা ছবি ছিল, তা ঘন অন্ধকারের ছবি৷ আলোর রোশনাইয়ের মাঝেই ফুটপাতে, ঝুপড়িতে, রাস্তার ধারে, অন্ধকার গলিতে আবর্জনার মতো পড়ে থাকা বহু অসহায় মানুষের ছবি৷ খাবার দূরের কথা, শীতের রাতে গায়ে দেওয়ার মতো গরম কাপড়টুকুও জোটেনি তাদের৷

বেশিরভাগ পরিবারের মধ্যে যে গভীর হতাশার অন্ধকার, তা ভুলে থাকতে নির্ভেজাল আনন্দের পাশাপাশি এক অংশের মানুষ অন্যরকম আনন্দের সন্ধান করে থাকে, শারীরিক উত্তেজনাই যে আনন্দের উৎস৷ নাইটক্লাব ও পানশালা তাদের পছন্দের জায়গা৷ উদ্দাম হুল্লোড়বাজি আর মদ–মাদকের নেশার মেলবন্ধন ঘটে সেখানে৷ জীবনের অপ্রাপ্তি ভুলে বীভৎস মজার হাতছানিতে আকৃষ্ট হন যুবসমাজের একাংশ৷

নেশা মস্তিষ্কে আচ্ছন্ন করে, বুদ্ধিকে জড় করে৷ নেশা সর্বনাশা৷ নেশা মানে জ্যান্ত মানুষও মৃত৷ নববর্ষ উদযাপনের নামে দলে দলে নতুন যুবকদের হাতেখড়ি হয় নেশার এই সব প্রাঙ্গণে৷

নেশার দোসর অপরাধ৷ সকলেই সচ্ছল নয়৷ নেশার জিনিস জোগাড় করতে অর্থের দরকার, অর্থ সংস্থানের মরিয়া চেষ্টায় স্কুল–কলেজের ছাত্ররা এমনকী জীবনের পরোয়া না করে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে৷ নেশাখোর নেশার খরচ জোগাড়ের জন্য নানা অন্যায় ও অপরাধমূলক কাজে নেমে পড়ে, মাদক কেনা–বেচার সাথে যুক্ত হয়ে যায়৷ মাদকচক্রগুলি জাল বিস্তার করে চলে৷ নাইটক্লাব ও পানশালায় মাদকের সহজ শিকার কলেজ–ছাত্র ও যুবকদের নেশার দ্রব্য সরবরাহ করে মাদক–ব্যবসায়ী ও সাকরেদরা৷ এই নেশায় আসক্তদের বেশিরভাগই উচ্চবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়ে৷ নেশার খরচ মেটাতেই মরিয়া চেষ্টায় এরা চুরি, ছিনতাই এমনকী খুন পর্যন্ত করতে দ্বিধা করে না৷

বর্তমানে স্কুলগুলিতেও মাদক লজেন্সের রমরমা চলছে৷ এই লজেন্সে মেশানো থাকে এলএসডি এবং এমডিএমএ নামক মাদক৷ দু’টিই রেভ ড্রাগ– পার্টিড্রাগ বা ডেট টু রেপ ড্রাগ বলে প্রসিদ্ধ৷ স্কুল–কলেজের ছাত্রদের অনৈতিক জীবনে প্রবেশের নিষিদ্ধ দ্বার খুলে দেয় এই ড্রাগ৷ দুটি ড্রাগেরই প্রাথমিক প্রভাব স্ফূর্তি–মজা–উত্তেজনা, কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব মারাত্মক ও প্রাণঘাতী৷ এই সব মাদকে আসক্তদের মধ্যে চূড়ান্ত অবসাদ ও আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা যায়৷

নারকোটিক কন্ট্রোল ব্যুরো (এনসিবি) সদ্য কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে ড্রাগ পাচার চক্রের হদিশ পাওয়ায় হইচই পড়েছে৷ এই ব্যবসা আগেও ছিল, এখনও বহাল তবিয়তে চলছে৷ বর্তমানে ধরপাকড় এড়াতে ডার্ক–ওয়েব ব্যবসায় অনলাইনে ড্রাগ পাচার চলে৷ প্রশাসনের নাকের ডগায়, প্রভাবশালীদের প্রত্যক্ষ মদতে এই চক্র অত্যন্ত সক্রিয়৷ কোনও সরকারই ড্রাগপাচার কিংবা মাদকের রমরমা ব্যবহার বন্ধে কোনও উদ্যোগ নেয়নি৷

প্রধানত উচ্চবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরাই মাদকের শিকার হলেও এখন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরাও এর শিকার হচ্ছে৷ মাদকের নেশায় আসক্ত হয়ে বহু ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে এদের অনেকে৷ মনোবিদদের কাছেও আগের থেকে বেশি সংখ্যায় মাদকের শিকার ছাত্র–যুবককে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে হচ্ছে৷ সংখ্যাবৃদ্ধির ঘটনায় চিন্তান্বিত অভিভাবক, সমাজের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ৷ কিন্তু সংখ্যার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ঘটছে কেন? এ কি শুধুই উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তানদের খেয়ালের নেশা কিংবা প্রশাসনিক গাফিলতি? তা তো আছেই৷ কিন্তু এর প্রধান কারণ সমাজের এক গভীর অসুখ৷

পুঁজিবাদী তীব্র শোষণে মানুষের জীবন আজ চরম সংকটগ্রস্ত৷ অনিশ্চয়তা বাড়ছে, তীব্র বেকার সমস্যা যুবজীবনকে তছনছ করে দিচ্ছে৷ ক্ষোভ বাড়ছে তাদের মধ্যে, যুব সমাজকে বিপথগামী করতে পুঁজিপতি শ্রেণি এবং সরকারি মদতে মদ, গাঁজা, নানারকম ড্রাগের ব্যাপক প্রসার ঘটছে৷ চলছে ব্লু–ফিল্মের রমরমা৷ মূল্যবোধকে ধসিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ বাড়ছে হতাশা, আত্মকেন্দ্রিকতার মধ্যে আশ্রয় নিচ্ছে মানুষ৷ জীবনের স্বাভাবিক আনন্দ নেই৷ তাই চেষ্টা কৃত্রিমভাবে আনন্দ পাওয়ার৷ তার থেকেই মদ ও মাদকের মারাত্মক নেশাও সামাজিক ব্যাধির আকার নিচ্ছে৷

একে প্রতিহত করতে শুধু মাদক–ব্যবসায়ী কিংবা মাদকচক্রের চাঁইদের ধরপাকড় করলেই হবে না৷ যে পুঁজিবাদী সমাজ মানুষকে আজ এমন নেশার পথে ঠেলে দিচ্ছে বদলাতে হবে সেই শোষণমূলক সমাজটাকেই৷