নবজাগরণের পথিকৃৎ বিদ্যাসাগর (৮)

ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বি–শত জন্মবার্ষিকী আগতপ্রায়৷ সেই উপলক্ষ্যে এই মহান মানবতাবাদীর জীবন ও সংগ্রাম পাঠকদের কাছে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে শিক্ষাগ্রহণের জন্য৷

(৮)

নারী মুক্তি আন্দোলনে বিদ্যাসাগর

উনিশ শতকের বাংলার সমাজে বহু কুপ্রথা চালু ছিল যাতে দুর্ভোগ সহ্য করতে হত মূলত মেয়েদেরই৷ তখন ‘বাল্যবিবাহ প্রথা’ চালু ছিল৷ মেয়েদের ৬–৭ বছর বয়সে বিয়ে দিতে হত৷ না হলে সমাজে ওই মেয়েদের স্থান থাকত না৷ সেই পরিবারকে একঘরে করে সমাজচূ্যত করা হত৷ একঘরে হওয়ার ভয়ে মা বাবা ৬–৭ বছরেরও কম বয়সেই বালিকার বিয়ে দিত৷ পাত্র না পাওয়া গেলে এমনকি অশীতিপর বৃদ্ধের সঙ্গে বিয়ে দিয়েও সমাজে ঠাঁই পেতে হত৷

চালু ছিল বহুবিবাহ প্রথা৷ পুরুষরা একাধিক বিয়ে করতে পারত৷ একেক পুরুষ ৭০–৮০টি করেও বিয়ে করতেন৷ সব স্ত্রীর খোঁজও রাখতেন না, অধিকাংশ মেয়েরাই থাকত বাবার বাড়িতে৷ পিতৃগৃহেও ওই মেয়েদের অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হত৷ স্বামী মারা গেলে এই সব মেয়েদের জীবন হয়ে উঠত আরও করুণ৷ ওই বালিকা–বিধবাদের মাথার চুল কেটে দেওয়া হত, একবেলা খেতে দেওয়া হত৷ তাও আবার নিরামিষ৷ সমস্ত বারব্রততে উপোস করতে হত৷ অকল্যাণের ভয়ে কোনও শুভ কাজে বা বাড়ির আনন্দ অনুষ্ঠানে এই বালিকাদের যোগ দিতে দেওয়া হত না, ঘরে আটকে রাখা হত৷ এই সব অসহায় বালবিধবাদের সারাজীবন কাটত দীর্ঘশ্বাস আর বঞ্চনার মধ্য দিয়ে৷ অথচ পুরুষদের ছিল যা খুশি করার অধিকার৷ কোনও নিয়মকানুনও তাদের মানতে হত না৷ এ ভাবে নিষ্ঠুর পুরুষতান্ত্রিক হিন্দু সমাজ নারীজন্মকে করে তুলেছিল চরম দুর্দশার৷

নারীজীবনের এই দুর্দশা ও চোখের জল ছেলেবেলায় যেমন বিদ্যাসাগরের কোমল মনে ব্যথা দিয়েছিল, তেমনি কর্মজীবনেও নারীর দুঃখময় জীবন তাঁকে কাঁদাত৷ জীবনে তিনি যেমন অগণিত বালবিধবার চোখের জল দেখেছেন, তেমনি বহুবিবাহ প্রথার ফলে মেয়েদের অসহায় কান্নাও দেখেছেন অনেক৷

এরকম কত মেয়েকে নিরুপায় হয়ে ভিক্ষে করতে হয়েছে, আত্মহত্যা করতে হয়েছে, অবমাননাকর পথে জীবন রক্ষা করতে হয়েছে তা বিদ্যাসাগর খোঁজ নিয়ে দেখেছেন৷ এ সম্পর্কে তিনি হুগলি জেলার ১৩৩ জন ব্রাহ্মণের বিবাহ সংখ্যার একটি তালিকা তৈরি করে দেখান যে, হিন্দু সমাজে বহুকাল থেকে প্রচলিত চার বর্ণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য হওয়ায় কুলীন ব্রাহ্মণেরা তার সুযোগ নিয়ে কীভাবে কৌলিন্য প্রথাকে হীনস্বার্থে ব্যবহার করেছেন৷ তার মধ্যে কয়েকটি উদাহরণ হল এই রকম–

ভোলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বয়স–৫৫, স্ত্রী সংখ্যা–৮০৷ ভগবান চট্টোপাধ্যায় বয়স–৬২, স্ত্রী সংখ্যা–৭২৷ মধুসূদন মুখোপাধ্যায় বয়স–৪০, স্ত্রী সংখ্যা–৫৬৷ এইরকমই ছিল কৌলীন্য প্রথার নির্মম জঘন্য ইতিহাস৷ এই পরিসংখ্যান প্রকাশ্যে এনে বিদ্যাসাগর চেয়েছিলেন সমাজে এই কুপ্রথা যারা নীরবে মেনে নিতেন সেইসব মানুষের মধ্যে বহুবিবাহের বিরুদ্ধে মানসিকতা গড়ে তুলতে৷ এই উদ্যোগের মাধ্যমে নারীমুক্তি আন্দোলনকে সংগঠিত রূপ দিয়েছিলেন তিনি৷

তাঁর আগে সমাজে নানা কুপ্রথার দ্বারা অবমানিত নারীদের মুক্তির ভাবনা দেখা গিয়েছিল কিছু ব্যক্তি ও সংগঠনের মধ্যে৷ বিচ্ছিন্নভাবে তাঁরা চেষ্টাও শুরু করেছিলেন৷ বিক্রমপুরের রাজা রাজভল্লভ নিজের বিধবা মেয়ের বিবাহের জন্য চেষ্টা করেছিলেন৷ কিন্তু পণ্ডিতদের বাধায় এগোতে পারেননি৷ বিদ্যাসাগরের আন্দোলনের প্রায় একশো বছর আগে ঘটেছিল এই ঘটনা৷ রামমোহন রায়ের ‘আত্মীয় সভা’তেও বাল্যবিবাহের কুফল নিয়ে আলোচনা হত৷ এরপর ‘ইয়ং বেঙ্গল’ আন্দোলনেও নারীমুক্তির কথা উঠেছিল৷ তাঁদের মুখপত্র ‘বেঙ্গল স্পেকটেটর’–এ বিধবা বিবাহ নিয়ে লেখালিখিও হয়েছে৷ কিন্তু কোনওটাই দানা বাঁধতে পারেনি৷

কঠোর জীবনসংগ্রামের মধ্য দিয়ে সেই বিচ্ছিন্ন ও খণ্ডিত চিন্তাগুলিকে তিনি পূর্ণাঙ্গ ও সামগ্রিক সমাজচিন্তায় পরিণত করেন৷ সমাজ জুড়ে সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্বকারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তিনি৷ সমাজপ্রগতির অভিমুখে সেদিনের সামাজিক চাহিদার মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠেন তিনি৷ সেই জন্যই তাঁকে বলা হয় ভারতীয় সমাজবিপ্লবের অগ্রদূত বা পথিকৃৎ৷

তিনি বুঝেছিলেন নারীদের দুঃখের হাত থেকে রক্ষা করার পথে সমাজ যেমন বাধা, তেমন নারীর কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনও একটি বাধা৷ নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার না ঘটালে তাঁর চেষ্টা সফল হবে না বুঝে তিনি একই সঙ্গে নারীশিক্ষার প্রসারে উদ্যোগী হন৷ এর জন্য তাঁকে বহু বাধার সামনে দাঁড়াতে হয়েছে, অনেক ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে৷

বিধবাদের যন্ত্রণা দেখে তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল, পুরুষের স্ত্রী মারা গেলে যদি বিবাহ করাটা শাস্ত্র বিরুদ্ধ না হয়, তা হলে নারীর ক্ষেত্রে তা শাস্ত্র বিরুদ্ধ হবে কেন? তাই রাতের পর রাত জেগে কঠোর অনুশীলন করে সমস্ত শাস্ত্র তিনি পড়তে শুরু করেছিলেন৷ নারীর দ্বিতীয়বার বিবাহ করার কোনও বিধান শাস্ত্রে আছে কি না তা খোঁজার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠছিলেন৷ কারণ, শাস্ত্রের প্রমাণ পেলে কুসংস্কারগ্রস্তদের মুখ বন্ধ করা সহজ হবে৷ অবশেষে শাস্ত্রীয় প্রমাণ মিলল৷ প্রবল উৎসাহে সেই প্রমাণ সহ বিধবা বিবাহের পক্ষে প্রচার শুরু করলেন তিনি৷ ‘বিধবাবিবাহ প্রবর্তিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ নামে দু’খানি বই লিখলেন৷ প্রবল আলোড়ন পড়ে গেল হিন্দু সমাজে৷ সমাজের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষকে তিনি পক্ষে টানতে চাইলেন৷ এক একজনকে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে আবেদনপত্রে সই করালেন৷ বিরুদ্ধপক্ষেরা পাল্টা সই করে বিরোধিতা করলেন৷ তিনি এই গোঁড়া ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদেরও নিজের যুক্তি বোঝাতে চাইলেন৷ শাস্ত্রীয় পণ্ডিতদের নিযে একটা বিচারসভা ডাকলেন৷ সব শাস্ত্রীয় প্রমাণ দেখিয়ে বললেন, ‘শাস্ত্রীয় প্রমাণ আমি যা জানি দেখিয়েছি, তা মানা না মানা আপনাদের ইচ্ছে৷ তা ছাড়া শাস্ত্রে আছে এই আমার প্রধান যুক্তি নয়৷ আমার আবেদন আপনাদের হূদয়ের কছে, বুদ্ধির কাছে৷’

শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতরা বললেন, ‘আপনার কথা ঠিক, কিন্তু প্রত্যেক লোক যদি হূদয়ের উচ্ছ্বাস বা বুদ্ধির কৌশল অনুসারে চলে, তা হলে তো সমাজ দু’দিনে উচ্ছন্নে যাবে৷ এই জন্যই শাস্ত্র, যা শাসন করে৷’

বিদ্যাসাগর বললেন, ‘শাস্ত্রও যুগে যুগে বদলেছে৷ কারণ শাস্ত্রের চেয়ে মানুষ বড়৷’ বিদ্যাসাগরের কাছে মানুষ বড় হলেও এইসব পণ্ডিতদের কাছে মানুষের চেয়ে শাস্ত্র বড়৷ যুক্তি দিয়ে সত্য নির্ধারণ করা এঁদের বিচারের বিষয় নয়৷ তাই কোনও যুক্তিতেই বিদ্যাসাগর এঁদের পক্ষে আনতে পারলেন না৷ তিনি যাতে বিধবা বিবাহ আইন চালু করতে না পারেন সেই চক্রান্তে মেতে উঠলেন তাঁরা৷ তাঁর নামে ব্যঙ্গ করে ছড়া লেখা হল, তাঁকে হত্যার চক্রান্ত কর হল৷ মানুষের তৈরি অন্যায় বিধান এভাবে নারীর উপর নির্দয় অত্যাচার করবে তা বিদ্যাসাগর মেনে নিতে পারেননি৷ প্রবল বাধার বিরুদ্ধে তাঁর বলিষ্ঠ ও একাগ্র চেষ্টায় ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই ‘বিধবা বিবাহ আইন’ চালু হল৷ তখন তাঁর বয়স ৩৬ বছর৷ আইন চালু হল বটে কিন্তু তাকে কাজে লাগাতে গোঁড়া হিন্দু সমাজের মাথারা প্রবল বাধা দিল৷ অনেক কষ্ট করে বিধবা বিবাহ করতে কাউকে রাজি করালে তাকে ভয় দেখানো হত, শারীরিক নির্যাতন করা হত, এক ঘরে করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হত৷ বিদ্যাসাগর এই সব বাধার বিরুদ্ধে নিজে পাত্র–পাত্রী ঠিক করে, সব খরচ নিজে বহন করে দাঁড়িয়ে থেকে বিধবা বিবাহ দিতে শুরু করলেন৷ বিয়ের পর অনেকের সংসার চালানোর খরচও তিনি বহন করতেন৷ এজন্য তিনি সর্বস্বান্ত হয়েছেন, দেনায় ডুবে গিয়েছেন, তবু পিছিয়ে যাননি৷ এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘বিধবা বিবাহ প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম৷ এ জন্মে যে ইহা অপেক্ষা অধিকতর আর কোনও সৎকর্ম করিতে পারিব, তাহার সম্ভাবনা নাই৷ এ বিষয়ের জন্য সর্বস্বান্ত হইয়াছি এবং আবশ্যক হইলেপ্রাণান্ত স্বীকারেও পরান্মুখ নহি৷’ অর্থাৎ এ জন্য মরতেও তিনি রাজি ছিলেন– এমনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ছিল তাঁর৷

বিধবাদের বিবাহের জন্য বিদ্যাসাগরের সহানুভূতি ও সাহায্য নিয়ে একদল সুবিধাবাদী লোক তাঁকে ঠকাতে শুরু করেছিল৷ তারা টাকার লোভে বিধবাকে বিয়ে করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিত, কেউ বা টাকা নিয়ে আর বিয়ে করত না, আবার কেউ বিয়ে করে কয়েক দিন পরে সেই বিধবাকে ছেড়ে পালিয়ে যেত৷ তখন ওই অসহায় মেয়েটির সব খরচ বিদ্যাসগরকেই বহন করতে হত৷ এমনি করেই অসহায় নারীর চোখের জল মোছাতে তিনি ঋণ করে করে সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছিলেন৷

বাল্যবিবাহ প্রথা, বহুবিবাহ প্রথা ও পণ প্রথার মতো নিষ্ঠুর সামাজিক প্রথার উচ্ছেদ করতেও তিনি চেষ্টা করেছিলেন৷ এই সব কুপ্রথার বলি হয়ে মেয়েদের যে দুঃখ যন্ত্রণা সহ্য করতে হত তা তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতেন৷ অতি দুঃখে তাই লিখেছিলেন–‘যে দেশের পুরুষ জাতির দয়া নাই, ধর্ম নাই, ন্যায় অন্যায় বিচার নাই, হিতাহিত বোধ নাই, সৎ অসৎ বিবেচনা নাই, কেবল লৌকিকতা রক্ষাই প্রধান কর্ম ও পরম ধর্ম, আর যেন সে দেশে হতভাগা অবলা জাতি জন্মগ্রহণ না করে৷’

বাল্য বিবাহেরও তিনি বিরোধী ছিলেন৷ নিজেরে মেয়েদের তাই তিনি বেশি বয়সেই বিয়ে দিয়েছেন৷

একদিন শিবনাথ শাস্ত্রী বড় মেয়ে হেমলতাকে নিয়ে বিদ্যাসাগরের বাড়ি যাচ্ছেন৷ হেমলতার বয়স তখন ১৬ বছর৷ ৬–৭ বছরে মেয়েদের বিয়ে না দিলে তখন খুব দুর্নাম হত৷ অথচ হেমলতার তখনও বিয়ে হয়নি৷ পথে হেমলতা বলল–‘আচ্ছা বাবা, এত বয়সেও তুমি আমার বিয়ে দাওনি, এজন্য পণ্ডিতমশায় তোমায় কিছু বলবেন না তো৷’ 

শিবনাথ বললেন, ‘বিদ্যাসাগর সবরকম কুসংস্কারের বিরোধী, অতএব তোমার দুর্ভাবনার কোনও কারণ নেই মা৷’

বিদ্যাসাগরের বাড়িতে পৌঁছানো গেল৷ নানা কথাবার্তার পর শিবনাথ পথে হেমলতা যা বলেছিল, সে কথা খোলাখুলি বললেন বিদ্যাসাগরকে৷ কথা শুনে উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠলেন বিদ্যাসাগর৷ তারপর হেমলতাকে বললেন–‘কি গো, তুমি কি ভাবো, বেশি বয়সে মেয়ের বিয়ে দেবার ব্যাপারে তোমার বাবাই খুব বাহাদুর৷ তুমি বুঝি জানো না, বিয়ের সময় আমার মেয়েদের বয়স তোমার থেকেও বেশি ছিল৷’

আশ্বস্ত ও মুগ্ধ হলেন হেমলতা৷

(চলবে)

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ৬ সংখ্যা)