নবজাগরণের পথিকৃৎ বিদ্যাসাগর (৫)

ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী আগতপ্রায়৷ সেই উপলক্ষে এই মহান মানবতাবাদীর জীবন ও সংগ্রাম পাঠকদের কাছে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে শিক্ষাগ্রহণের জন্য৷

(৫)

বিদ্যাসাগর ১৮৬৪ সালে নিজে ‘ক্যালকাটা ট্রেনিং স্কুলের’ দায়িত্ব নিয়ে প্রথমে সেটিকে ‘হিন্দু মেট্রোপলিটন স্কুল’ এবং পরে কলেজে পরিণত করেন৷ কলেজের অনুমোদন পেতে তাঁকে শাসক ব্রিটিশের প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়৷ ব্রিটিশরা কিছুতেই মানতে চায়নি যে ব্রিটিশ অধ্যাপক ছাড়া কলেজে ইংরেজি পড়ানো যেতে পারে৷ এই বদ্ধমূল ধারণা ভাঙতে বিদ্যাসাগর সমস্ত দেশীয় শিক্ষক দিয়ে কলেজ চালিয়ে সেদিন ব্রিটিশদের যোগ্য প্রত্যুত্তর দিয়েছিলেন৷ কলেজের ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছিল৷ যা দেখে সাহেবরা বলতে বাধ্য হয়েছিল, the Pundit has done wonder’৷ পরে বিদ্যাসাগর কলেজে ‘ল’ ক্লাস খোলেন৷ ১৮৮৩, ১৮৮৫ এবং ১৮৮৬ সালের পরীক্ষায় মেট্রোপলিটনের ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে৷

মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন স্থাপন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বিদ্যাসাগরচরিতে’ বলেছেন, ‘‘সংস্কৃত কলেজের কর্ম ছাড়িয়া দিবার পর বিদ্যাসাগরের প্রধান কীর্তি মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন৷ বাঙালির নিজের চেষ্টায় এবং নিজের অধীনে উচ্চতর শিক্ষার কলেজ স্থাপন এই প্রথম৷ আমাদের দেশে ইংরাজি শিক্ষাকে স্বাধীনভাবে স্থায়ী করিবার এই প্রথম ভিত্তি বিদ্যাসাগর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হইল৷ যিনি দরিদ্র ছিলেন, তিনি দেশের প্রধান দাতা হইলেন৷ যিনি লোকাচার–রক্ষক ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, তিনি লোকাচারের একটি সুদৃঢ় বন্ধন হইতে সমাজকে মুক্ত করিবার জন্য সুকঠোর সংগ্রাম করিলেন এবং সংস্কৃত বিদ্যায় যাহার অধিকারের ইয়ত্তা ছিল না, তিনিই ইংরাজিবিদ্যাকে প্রকৃত–প্রস্তাবে স্বদেশের ক্ষেত্রে বদ্ধমূল করিয়া রোপণ করিয়া গেলেন৷’’

বিদ্যাসাগর কলেজটিকে তাঁর শিক্ষা পদ্ধতি অনুযায়ী গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন৷ ছাত্র–শিক্ষক সবাইয়ের প্রতি তাঁর যেমন গভীর ভালবাসা ছিল তেমনি শিক্ষার ব্যাপারে তীক্ষ্ণ নজর ছিল৷ মেট্রোপলিটন কলেজের শিক্ষক কালিকৃষ্ণ ভট্টাচার্য লিখেছেন–‘তিনি শিক্ষক ও অধ্যাপকদের পিছনে দাঁড়িয়ে তাঁদের পড়ানো শুনতেন, দোষ দেখলে তার শোধন করে দিতেন৷ ছাত্রদের যাতে সম্মান রক্ষা হয়, সে বিষয়ে শিক্ষক ও অধ্যাপকদের বলে দিতেন৷ তিনি শিক্ষকদের বলতেন–‘একজন ছাত্র একটি বিষয়ে বলতে না পারলে অন্য ছাত্রকে সেটি জিজ্ঞেস করতে নেই৷ এতে পূর্বের ছাত্রের অবমাননা হয়৷ যাতে ওই ছাত্রটিই প্রকৃত উত্তর বলতে পারে তেমন করে আভাস দিয়ে তার মুখ দিয়েই উত্তর বের করতে হবে৷’

তখনকার দিনে পড়া না পারলে ছাত্রদের প্রচণ্ড মারধর করা হত৷ মেট্রোপলিটনে নিয়ম ছিল, কোনও মাস্টারমশাই ছাত্রদের সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করতে পারবেন না৷ ছাত্রদের কোনও শারীরিক শাস্তি দেওয়াও চলবে না৷ তিনি বিশ্বাস করতেন, বয়সে ছোট হলেও কারও আত্মমর্যাদা বা সম্ভ্রমবোধে আঘাত করা উচিত নয়৷ শাস্তি দিলে ছাত্রদের ব্যক্তিত্ব নষ্ট হবে, আত্মমর্যাদায় লাগবে৷ লেখাপড়ায় আনন্দ খুঁজে না পেয়ে নিরুৎসাহিত হয়ে উঠবে৷ আবার ছাত্রদের বলতেন, শিক্ষকরা যা বলবেন বা পড়াবেন তা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে৷ মেট্রোপলিটন কলেজ ছিল তাঁর প্রাণ৷ ছাত্ররা ভাল ফল করলে তাদের যেমন পুরস্কার দিয়ে উৎসাহিত করতেন, তেমনি শিক্ষকদের দারিদ্র দেখলে সাহায্য করতেন৷ ছাত্ররাও বিপদে পড়লে সাহায্য করতেন৷

একবার নিচু ক্লাসের একজন মাস্টারমশাই ক্লাসের মধ্যে চেয়ারে বসে ঘুমোচ্ছেন৷ বিদ্যাসাগরের চোখে পড়ে গেল৷ মহাবিরক্ত হয়ে মাস্টারমশাইকে জাগিয়ে দিলেন তিনি৷ নির্ঘাত চাকরি চলে যাবে৷ মুখে কথা নেই, বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন মাস্টারমশাই৷ বিদ্যাসাগর জিজ্ঞাসা করলেন–‘আপনি দিনের বেলা ঘুমোচ্ছেন কেন? আপনি কি কাল রাতে ঘুমোননি?’

ভয়ে ভয়ে মাস্টারমশাই বললেন–‘আমাকে অনেক খাটতে হয়৷ মস্ত সংসার, দু–তিনটে টিউশন করে চালাতে হয়৷ তাই ক্লান্ত হয়ে পড়ি৷ আজ বসে পড়াতে গিয়ে বিপদে পড়েছি৷’ বিদ্যাসাগর জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি টিউশন করে কত টাকা পান?’ টাকার অঙ্ক বললেন মাস্টারমশাই৷ বিদ্যাসাগর বললেন, ‘আপনি এখন থেকে এই টাকাটা এখান থেকে পাবেন৷ আজ থেকেই টিউশনগুলি ছেড়ে দিন৷’

মাস্টারমশাই অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন৷ বিদ্যাসাগরের দয়া দেখে তাঁর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল৷

সব রকম সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত ছিলেন তিনি৷ পড়াশোনার ক্ষেত্রে ধর্মীয় বাছবিচার তাঁর ছিল না৷ কলেজের একটি ছাত্র ব্রাহ্ম সমাজে যোগ দিয়েছে৷ ফলে বাবা তার কলেজের মাইনে টাইনে বন্ধ করে দিলেন৷

ছাত্রটি এল বিদ্যাসাগরের কাছে৷ সব কথা খুলে বলল৷

বিদ্যাসাগর জিজ্ঞেস করলেন–‘তুমি কোন কলেজে পড়’?

–‘আমি আপনারই মেট্রোপলিটন কলেজে প্রথম বার্ষিক শ্রেণিতে পড়ি৷’

বিদ্যাসাগর বললেন–‘বাপু, আমি তো ব্রাহ্ম নই, আর ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে আমার কোনও যোগই নেই৷ যা হোক, তুমি ভাল বুঝে যে ধর্ম ধরেছ তার উপর আমার কিছুই বলার নেই৷’

ছাত্রটিকে বিদ্যাসাগর প্রত্যেক মাসে দশ টাকা সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলেন৷ মাসে মাসে বিদ্যাসাগরের কাছে ওই টাকা নিয়ে আসত ছাত্রটি৷

ছাত্র, শিক্ষক সকলের প্রতি এমনিই ছিল তাঁর সহানুভূতি৷ এই সব ঘটনার ২৫ বছর পরে তিনি যখন মৃত্যুশয্যায় তখন সবাই জিজ্ঞেস করলেন–আপনার শেষ ইচ্ছা কী?

বিদ্যাসাগরের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল৷ বললেন–‘এখন জীবনের শেষ হওয়া ভাল৷ তবে কলেজের একটা ব্যবস্থা করে যেতে পারলাম না, এই যা দুঃখ৷ আর একটি মর্মান্তিক দুঃখ এই– যাঁরা আমার কলেজের জন্য জীবনাতিপাত করেছে তাদের জন্য চাকরি–জীবন অন্তে গ্রাসাচ্ছাদনের কোনও ব্যবস্থা করে যেতে পারলাম না৷’

ভাবতে অবাক লাগে, একজন মানুষ একই সঙ্গে শিক্ষা প্রসারের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, শিক্ষক তৈরির জন্য বিদ্যালয়, শিক্ষার পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তক রচনা, ভাষার উন্নতি, নারীশিক্ষার প্রসার, গরিব ছাত্রদের লেখাপড়ায় সাহায্য–এতগুলি কাজ প্রবল বাধার বিরুদ্ধে কীভাবে করেছিলেন সেদিন তো এমন মহান শিক্ষাবিদ কেউ ছিলেনই না, এমনকী পরবর্তীকালেও এ দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে এমন মহান আধুনিক মানুষ দেখা যায় না৷   (চলবে)

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ২ সংখ্যা)