ধর্মের কাঁটাতার নয় অমলিন বন্ধুত্বের নামই ভারতবর্ষ

গত ডিসেম্বরের ঘটনা৷ আগুনের লেলিহান শিখায় তখন দাউদাউ করে জ্বলছে দিল্লির সব্জি মাণ্ডি এলাকার বাড়িটি৷ বেরোবার সমস্ত পথ বন্ধ৷ ঘুমন্ত শ্রমিকরা আটকে পডেছেন ছ’শো স্কোয়ার ফিটের মরণকূপে৷ দমবন্ধ করা ধোঁয়া, বিধ্বংসী আগুন আর অসহায় মানুষের আর্তনাদ৷ সেই আসন্ন মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁডিয়ে বন্ধু মনু আগরওয়ালকে জীবনের শেষ ফোনটি করেছিলেন মুশারফ আলি, দিল্লির ভয়াবহ অগ্ণিকাণ্ডে নিহত শ্রমিকদের একজন৷ কাতর কণ্ঠে বলেছিলেন, তার কিছু হয়ে গেলে মনু যেন মুশারফের পরিবারকে দেখেন৷ ফোন কেটে যেতেই আরও দু’জনকে নিয়ে মনু ছুটে গিয়েছিলেন দিল্লির ওই অঞ্চলে৷ আশায় বুক বেঁধে ভেবেছিলেন, মুশারফ হয়তো অজ্ঞান হয়ে গেছেন বা দমকল কর্মীরা উদ্ধার করেছেন তাঁকে৷ না, বন্ধুকে মনু বাঁচাতে পারেননি৷ হাসপাতালে গিয়ে আগুনের গ্রাসে মৃত শ্রমিকদের তালিকায় পেয়েছেন বন্ধুর নাম৷ ফোন করে মুশারফের পরিবারের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন এই মর্মান্তিক দুঃসংবাদ৷ দু’দিন পর মুশারফের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছে উত্তরপ্রদেশের সেই প্রত্যন্ত গ্রামের মাটিতে, যে মাটির জলহাওয়ায় একসাথে বড হয়েছেন দুই কিশোর মুশারফ আলি আর মনু আগরওয়াল৷

আট বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছিলেন মনু৷ মুশারফের পরিবার সহ গ্রামের আরও কয়েকটি পরিবার সেদিন সাহায্যের হাত বাডিয়ে দিয়েছিল মনুদের দিকে৷ ধর্মীয় পরিচয় কোনও বাধার দেওয়াল তুলতে পারেনি৷  নিঃসহায় প্রতিবেশীর পাশে নির্দ্বিধায় দাঁডিয়েছিল গ্রামের গরিবগুর্বো মানুষগুলো৷ তারপর জীবিকার টানে শহরে চলে যেতে হয়েছে মুশারফ আলিকে৷ গ্রামেই বাসনপত্রের দোকান খুলেছেন মনু আগরওয়াল৷ বন্ধুত্বে কিন্তু ফাটল ধরেনি৷ অসহায় মৃত্যুর সামনে দাঁডিয়ে মনুকেই মনে পডেছে মুশারফের৷ আর বন্ধুর কবরের পাশে দাঁডিয়ে কান্নাভেজা গলায় মনু বলেছেন, আজ তার ঋণশোধের পালা৷ মুশারফদের ভালোবাসায় একদিন তিনি বাবাকে হারানোর যন্ত্রণা ভুলেছিলেন৷ আজ সর্বশক্তি দিয়ে তিনি মুশারফের পরিবারের পাশে দাঁডাবেন, রক্ষা করবেন মৃত্যুপথযাত্রী বন্ধুর শেষ অনুরোধ৷

এই আমাদের দেশ৷ মনু আগরওয়াল আর মুশারফ আলির অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্বের দেশ৷ এ মাটিতে দাঙ্গায় মৃত কিশোর ছেলের মৃতদেহের সামনে দাঁডিয়ে আসানসোলের ইমাম সমস্ত আক্রমণ থেকে বুক পেতে রক্ষা করেছেন হিন্দু প্রতিবেশীদের৷ কাশ্মীরি মুসলমান যুবককে ধর্মান্ধ গুণ্ডাদের হাত থেকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছেন পাড়ার হিন্দু বাসিন্দারা৷ মানবিকতার স্বাভাবিক আবেদনে সাড়া দিয়ে শহরের রাস্তায় অন্ধ বৃদ্ধকে মসজিদে পৌঁছে দিয়েছেন পথচলতি দুই হিন্দু যুবক, আবার কোনও গ্রামের ভাঙা মন্দির সারিয়ে তুলতে হাত লাগিয়েছেন হিন্দু–মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ৷ নরেন্দ্র মোদী–মিত শাহরা এই ভারতবর্ষকে চেনেন না৷ চেনেন না এ দেশের শহরে গ্রামে প্রান্তে প্রত্যন্তে জেগে থাকা এই মানবধর্মের আলোকে৷ ক্ষমতায় বসে ইস্তক সাধারণ মানুষকে মিথ্যে প্রচারে বিভ্রান্ত করে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষকে তারা শত্রু বানাতে চেয়েছেন, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, দলিত, প্রান্তিক মানুষের ওপর দিনের পর দিন নারকীয় দমনপীডন নামিয়ে এনেছেন, প্রতিবাদী কন্ঠকে নির্মমভাবে হত্যা করেছেন, উগ্র হিন্দুত্বের জোয়ারে মাতিয়ে রাখতে চেয়েছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণকে৷ এসব করে অতীতের বিভিন্ন ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর মতোই দেশের বেহাল অর্থনীতি, দারিদ্র, বেকারির মতো জ্বলন্ত সমস্যাকে চাপা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন তাঁরা৷ সেই অপচেষ্টা যে সফল হয়নি, দেশের সাধারণ মানুষের ন্যায়–ন্যায় বোধ, বিবেক, মনুষ্যত্বকে যে ধর্মের গিলোটিনে বলি দেওয়া যায়নি তা প্রমাণ করেছে আসমুদ্রহিমাচল ভারত৷ এনআরসি–সিএএ–র নামে ধর্মীয় বিভাজনের ঘৃণ্য রাজনীতির বিরুদ্ধে শাসকের লাঠি বন্দুক বেয়নেটের সামনে আজ রুখে দাঁডিয়েছে ‘নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান’–এর ভারতবর্ষ৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ২২ সংখ্যা)