দেশি–বিদেশি একচেটিয়া পুঁজিকে মোদি সরকারের নতুন উপহার

70 Year 32 Issue 30 March 2018

২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে আম্বানি–আদানির মতো একচেটিয়া পুঁজির মালিকরা কেন নরেন্দ্র মোদির নামে এত জয়ধ্বনি তুলেছিল তা গত কয়েক বছরেই দেশের মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়েছে৷ নোট বাতিল, জিএসটি চালুর পর একচেটিয়া পুঁজির হাতে মোদি সরকারের সর্বশেষ উপহার শ্রম আইন সংস্কারের নামে স্থায়ী চাকরির সুযোগকে পুরোপুরি তুলে দিয়ে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের অবাধ অধিকার দেশি–বিদেশি মালিকদের হাতে তুলে দেওয়া৷ এর দ্বারা শ্রমিকদের শেষ রক্তবিন্দুটুকুও নিংড়ে নেওয়ার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করে দিল বিজেপি এবং মালিকদের পায়ে এই ভেট চড়ানোর দ্বারা আদায় করতে চাইল আগামী ভোটে আবার তাদের আশীর্বাদ পাওয়ার গ্যারান্টি৷

দীর্ঘদিন ধরেই দেশের পুঁজিপতিরা দাবি করে আসছে, শ্রম আইনের সংস্কার চাই৷ শ্রম আইন সংস্কার কথাটার মানে কী? তার মানে কি এই যে, শ্রমিকদের নিয়োগ এবং কাজের শর্তে যে–সমস্ত অনিয়ম, অন্যায়, অমানবিক, বেআইনি বিষয়গুলি মালিকরা চাপিয়ে রেখেছে, সেগুলি সংস্কার তথা দূর করে সর্বাঙ্গসুন্দর তথা মানবিক ও ন্যায়সঙ্গত একটা শ্রম আইন তৈরি করা? মানবতা ও ন্যায্যতার দিক থেকে দেখলে, একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে প্রতিটি মানুষের অধিকার সমান– এমন ভাবনার দিক থেকে দেখলে, তাই হওয়া উচিত৷ কিন্তু একটি পুঁজিবাদী সমাজে, কল–কারখানা সহ উৎপাদনের উপায়গুলির মালিক যেখানে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি, উৎপাদনের উদ্দেশ্য যেখানে শ্রমিককে শোষণ করে অর্থাৎ তার ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে মুনাফা করা, সেখানে শ্রম আইন সংস্কার কথাটার মানে ঠিক উল্টো৷ তা হল, এখনও যতটুকু আইনি অধিকার শ্রমিকদের টিকে আছে, দীর্ঘদিনের লড়াই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে অধিকারগুলি শ্রমিকরা অর্জন করেছিল, যেমন স্থায়ী নিয়োগ, আটঘন্টা কাজের সময়, অবসরের পর প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুয়িটি, পেনশন, নানা ধরনের ভাতা প্রভৃতি, সেগুলিকেও কেড়ে নিয়ে শ্রমিকদের শোষণ করার, তাদের ইচ্ছামতো খাটিয়ে নেওয়ার এবং যখন খুশি ছেঁটে বাদ দেওয়ার একচ্ছত্র মালিকি অধিকার৷ এই অধিকারই শিল্পপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার নাম দেওয়া হয়েছে শ্রম আইন সংস্কার৷ তাই প্রধানমন্ত্রী বলছেন শ্রম আইন সংস্কার করতে হবে, শিল্পপতিরাও বলছেন শ্রম আইন সংস্কার করতে হবে৷ এদের মুখে এক সুর– শ্রমিক ছাঁটাই কর, শ্রমিকদের উপর আরও বোঝা চাপাও, আরও বেশি খাটাও, আরও শোষণ কর৷ সংস্কারের নামে শ্রমিকদের উপর মালিকদের জবরদস্তির ভয়ঙ্কর এই রূপটাই ধরা পড়েছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সাম্প্রতিক শ্রম আইন সংশোধনে৷

শ্রম আইনে কী সংশোধন আনল মোদি সরকার? ইন্ডাস্ট্রিয়াল এমপ্লয়মেন্ট (স্ট্যান্ডিং অর্ডার) আইনের সংস্কার (অ্যামেন্ডমেন্ট) করে সরকার এবার সমস্ত বেসরকারি সংস্থায় স্বল্প মেয়াদি চুক্তির ভিত্তিতে কর্মী নিয়োগ এবং তাদের ইচ্ছামতো ছাঁটাইয়ের অধিকার মালিকদের হাতে তুলে দিল৷ এই আইন অনুসারে এখন থেকে দেশের সমস্ত শিল্পক্ষেত্রেই মালিকরা নির্দিষ্ট মেয়াদের চুক্তিতে কর্মী নিয়োগ করতে পারবে৷ এই আইন অনুযায়ী, নিয়োগকর্তা এবং কর্মীর মধ্যে হওয়া চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে সংশ্লিষ্ট কর্মী আপনা থেকেই চাকরি হারাবেন৷ চুক্তি পুনর্নবীকরণ না হওয়ার ফলে কাজ হারালে তা ছাঁটাই হিসাবে গণ্য হবে না৷ তিন মাস চাকরি করলে দু’সপ্তাহের নোটিসে তাঁদের ছাড়িয়ে দিতে পারবে সংস্থাটি৷ আর তিন মাসের কম হলে ওই নোটিসও দিতে হবে না৷ নিয়োজিত কর্মীকে মেয়াদ শেষে আলাদা করে কোনও টাকা সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে দিতে হবে না৷ স্থায়ী কর্মীকে সংস্থা থেকে ছাঁটাই করতে হলে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে ‘সেপারেশন বেনিফিট’ হিসাবে তা দিতে হত৷ এতদিন পর্যন্ত শুধু বস্ত্র শিল্পের ক্ষেত্রেই এই আইন চালু ছিল৷ সেই আইন সংশোধন করে এখন শিল্পের সমস্ত ক্ষেত্রেই তা চালু করে দিল বিজেপি সরকার৷ এর ফলে দেশের শিল্পক্ষেত্রে স্থায়ী কাজ বলে আর কিছু থাকবে না৷ শোষণের খোলা ময়দানে শ্রমিকদের ছেড়ে দেওয়া হল৷

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আইন যে সকলের জন্য সমান নয়, মালিক ও শ্রমিক এই উভয়ের ক্ষেত্রে একেবারে বিপরীত, এই আইন সংশোধন তা স্পষ্ট করে দিল৷ যে আইন মালিকদের হাতে শ্রমিকদের উপর শোষণের বুলডোজার চালানোর অধিকার তুলে দিচ্ছে, মুনাফার পাহাড় গড়ে তুলতে সাহায্য করছে, সেই আইনই শ্রমিকদের দাসত্বের দিকে, অনাহারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, বেঁচে থাকাটাকেই কঠিন করে তুলছে৷ যে আইন মালিককে যথেচ্ছ শ্রমিক শোষণের অধিকার দেয়, সেই আইন শ্রমিককে তা প্রতিরোধের কোনও অধিকার দেয় না৷ এতে প্রমাণ হচ্ছে, পুঁজিবাদী সমাজে যত মিষ্টিমধুর কথা বলেই আইন পাশ করানো হোক, তা শেষ পর্যন্ত মালিক শ্রেণির স্বার্থকেই রক্ষা করে৷ প্রমাণ করছে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় দেশটার আসল মালিক পুঁজিপতি শ্রেণিই৷ শ্রমিকের জীবনের কোনও মূল্য এই ব্যবস্থায় নেই৷

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে ঘোষণা করে এসেছেন, ২০২৫ সালের মধ্যে ভারত তার আর্থিক বৃদ্ধিকে দ্বিগুণে পরিণত করে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছে দেবে৷ দেশের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অভাবে অভ্যন্তরীণ বাজার ধুঁকছে, হাজার হাজার কলকারখানা বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে, প্রতিদিন আরও বন্ধ হচ্ছে, দেশ বেকারে ছেয়ে গেছে, কৃষকরা দলে দলে আত্মহত্যা করছে, যুবসমাজ মদ ড্রাগে আসক্ত হয়ে পড়ছে– তা হলে কীসের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী অর্থনীতির দ্বিগুণ উন্নতির কথা বলে এলেন? শ্রম আইন সংস্কার দেখিয়ে দিল, তাঁদের আক্রমণের লক্ষ্য সেই শ্রমিক শ্রেণি৷ দেশের কোটি কোটি শ্রমিকের উপর শোষণ–লুণ্ঠনকে আরও তীব্র করার মধ্য দিয়ে তাদের অনাহারে অর্ধাহারে রেখে, তাদের জীবনকে দাসত্বের স্তরে নামিয়ে এনে তাঁরা এই উন্নয়ন ঘটাতে চান৷ অর্থাৎ শ্রমিকদের ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে তাঁরা পণ্যের উৎপাদন খরচ কমাতে চান৷ এই ভাবে ভারতীয় পুঁজিপতিদের মুনাফা আরও বাড়িয়ে তুলে সেই মুনাফা তথা পুঁজির জোরে ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণিকে বিশ্বশক্তি করে তুলতে চান৷ মহান কার্ল মার্কস বহু আগেই তাঁর অসাধারণ বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে দেখিয়ে গেছেন, মালিকের মুনাফা আসে শ্রমিককে তার ন্যায্য প্রাপ্য থেকে, তার পরিশ্রমের ফসল থেকে বঞ্চিত করে৷ তাই মালিক শ্রেণি সব সময়ই শ্রমিকদের বঞ্চনাকে নানা ভাবে বাড়িয়ে তুলতে চায়৷ শ্রম আইনের সংস্কারের লক্ষ্যও তাই৷ কিন্তু শ্রমিকদের চরম বঞ্চনার মধ্যে নিমজ্জিত করে বাজার সংকট থেকে রেহাই পাবে কি? বঞ্চিত কোটি কোটি শ্রমিকের সংকুচিত ক্রয়ক্ষমতা বাজারকেও আরও সংকুচিত করে আনবে, যা বাজার সংকট তথা পুঁজিপতিদের সংকটকে আরও তীব্র করবে৷

তা হলে প্রধানমন্ত্রী যে আর্থিক উন্নয়নের কথা গর্ব করে ঘোষণা করেছেন তা কি দেশের উন্নয়ন? সেই দেশে শ্রমিক কৃষক দরিদ্র সাধারণ মানুষের স্থান কোথায়? এ তো শুধু মালিকদের দেশ৷ এই সত্যটাকেই মালিক শ্রেণি নানা কথার প্যাঁচে, নানা মিথ্যা প্রচারে দেশের মানুষের কাছে আড়াল করে রাখে৷ তাই একদিকে বিজেপি অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরি, অন্য দিকে রামনবমীর হুজুগ তুলে মানুষের দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দিয়ে নীরবে এমন একটা কালা আইন পাস করিয়ে নিল৷ এই আইনের খড়গ কি শুধু মুসলমান শ্রমিকদের উপর নেমে আসবে, হিন্দু শ্রমিকদের উপর নেমে আসবে না? যাঁরা আজ বিজেপি নেতাদের উস্কানিতে অস্ত্র হাতে রাস্তায় নেমে রামনবমী পালন করছেন, তাঁরা কি বিজেপি সরকারের এই নীতি বাতিলের দাবিতে রাস্তায় নামতে পারবেন? তা যদি না পারেন, তবে তো অনিচ্ছায় হলেও বিজেপি নেতাদের পাতা ফাঁদেই পা দেওয়া হবে৷

শুধু এ দেশে নয়, বিশ্বজুড়ে সর্বত্রই মালিকরা শ্রমিক শ্রেণির উপর এ ভাবে ক্রমাগত বোঝা বাড়িয়ে চলেছে৷ কিন্তু মালিকরা এটা পারছে কী করে? পারছে আজ শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক শিবির নেই বলে৷ দেশে দেশে শ্রমিক আন্দোলনগুলি দুর্বল বলে৷ যত দিন সমাজতান্ত্রিক শিবির ছিল ততদিন এমনকী পুঁজিবাদী দেশগুলিও বাধ্য হয়েছিল রাষ্ট্রের গায়ে একটা কল্যাণকামী মোড়ক চাপাতে৷ মালিকরা বাধ্য হয়েছিল শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনাগুলির কিছুটা হলেও দিতে৷ সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অবর্তমানে আজ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি যেমন তার কল্যাণকামী আলখাল্লা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে তেমনই মালিকরাও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে৷ আমাদের দেশেও একদল মানুষ প্রতিবাদ দেখলে, মিছিল দেখলে মনে করতেন শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে, বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে৷ আজ মালিকদের এই বেপরোয়া আচরণ দেখে তাঁরা কী বলবেন? মধ্যবিত্তের যে অংশ নরেন্দ্র মোদির কঠোর প্রশাসক রূপ কল্পনা করে আহলাদিত হয়ে উঠেছিলেন তাঁরা আজ এই আক্রমণকে কী বলবেন? যুব সমাজের যে অংশ সমস্ত রকম সামাজিক আন্দোলনকে এড়িয়ে শুধুমাত্র নিজের স্বার্থ দেখার নাম করে পড়াশোনা করছেন, বড় বড় ডিগ্রি নিচ্ছেন, তাঁরা এবার যাবেন কোথায়? তাঁদের জন্য তো আলাদা আইন তৈরি হবে না৷ বাঁচতে হলে আজ সবাইকে নেমে আসতে হবে রাস্তায়, প্রতিবাদের রাস্তায়, মিছিলের রাস্তায়৷