দেশপ্রেমের ঢাক পিটিয়ে খিদের জ্বালা ভোলাতে পারল না বিজেপি

লোকসভা ভোটে অভাবনীয় সাফল্যের মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা বিধানসভা ভোটে বিরাট ধাক্কা খেল বিজেপি৷

এবারের লোকসভা ভোটে মহারাষ্ট্রে ২৮৮টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে ২০০–র বেশি এবং হরিয়ানায় ৯০টির মধ্যে ৭৯টি আসনে এগিয়েছিল বিজেপি৷ তাই সদম্ভে তারা ঘোষণা করেছিল, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দুটি রাজ্যেই সরকারে ফিরছে তারা৷ কিন্তু কোনও রাজ্যেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাও পায়নি বিজেপি৷ মহারাষ্ট্রে পেয়েছে ২৮৮টির মধ্যে ১০৫টি এবং হরিয়ানায় ৯০টির মধ্যে ৪০টি আসন৷ স্বাভাবিক প্রশ্ণ, এত অল্প সময়ে জনসমর্থনে এত ধস নামল, নাকি পরিবর্তনটা অনেক আগে থেকেই ঘটছিল?

এবারের লোকসভা নির্বাচনের মাস পাঁচেক আগেই চারটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে তিনটি রাজ্যে ক্ষমতা হারিয়েছিল বিজেপি– মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ে৷ তেলেঙ্গানাতেও ফল হয় শোচনীয়৷ স্বাভাবিক ভাবেই লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ভবিষ্যত নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠে যায়৷ সাধারণ মানুষের আলোচনায় উঠে আসে– লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি আর আদৌ ক্ষমতায় ফিরতে পারবে কি না?

এই আলোচনা ভিত্তিহীন ছিল না৷ কারণ ২০১৪ সালে ক্ষমতায় বসার আগে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলি কোনওটিই বিজেপি পূরণ করেনি৷ মূল্যবৃদ্ধি লাগামছাড়া হয়েছিল৷ কালো টাকা উদ্ধার দূরের কথা, হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাঙ্ক দুর্নীতিতে বিজেপি নেতাদের যোগসাজশ স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ বছরে দু’কোটি বেকারের কাজের সংস্থান দূরের কথা, লাখে লাখে শ্রমিক–কর্মচারী কাজ হারাচ্ছিল৷ ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে কৃষকদের আত্মহত্যা ক্রমাগত বাড়ছিল৷ বাড়ছিল রাজ্যে রাজ্যে কৃষক বিক্ষোভ৷ মধ্যপ্রদেশের মন্দসৌরে এমনই এক কৃষক বিক্ষোভে বিজেপি সরকার গুলি চালিয়ে ছ’জন কৃষককে হত্যা করে৷ ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ স্লোগানকে ব্যঙ্গ করে দেশজুড়ে নারী নির্যাতন বেড়েই চলছিল৷ নোট বাতিল সাধারণ মানুষকে চরম দুর্ভোগে ফেলেছিল৷ ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে শতাধিক সাধারণ মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছিল৷ তড়িঘড়ি জিএসটি চালু করায় ছোট ও মাঝারি কয়েক লক্ষ সংস্থা–শিল্প–ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছিল৷ ফলে বিজেপি শাসনের বিরুদ্ধে জনরোষ ক্রমাগত স্পষ্ট হয়ে উঠছিল৷ আতঙ্কিত হয়ে পড়ছিল শাসক শ্রেণি৷ কারণ কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ তখনও অটুট৷ অথচ রাজ্যে রাজ্যে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনগুলি বেড়েই চলেছে৷ তা হলে উপায় কী? উপায় ক্রমাগত জাতীয়তাবাদকে চাগিয়ে তোলা৷ তার জন্য শত্রু খাড়া কর পাকিস্তানকে৷ তাই পুলওয়ামা, বালাকোট৷ সরকার, প্রশাসন, পুঁজিপতিদের টাকার থলি আর তাদের পরিচালিত সংবাদমাধ্যম একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ল জাতীয়তাবাদের জিগির তুলতে৷ অসহায় মানুষ আরও একবার শাসক শ্রেণির পাতা ফাঁদে পা দিল৷ বিপুল ভোটে দ্বিতীয়বারের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের গদিতে বসলেন পুঁজিপতিদের নয়নমণি নরেন্দ্র মোদি৷

পুঁজিবাদী এই শাসনব্যবস্থায় পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থরক্ষার লক্ষ্য নিয়ে যে দলই সরকারি ক্ষমতায় বসুক, প্রতারণা ছাড়া জনগণকে তাদের আর কিছুই দেওয়ার নেই৷ গত সাত দশকের ভোট–রাজনীতির ইতিহাস তার প্রমাণ দিয়ে চলেছে৷ এবারও তাই ঘটল৷ উগ্র জাতীয়তাবাদের ঘোর কাটতেই মানুষ টের পেল বিজেপি তাদের আবার প্রতারিত করেছে৷ জাতপাত–ধর্ম–বর্ণে ভেদাভেদ বাড়িয়ে তোলা ছাড়া এই সরকারের ঝুলিতে আর কিছুই নেই৷ বেকারি, মূল্যবৃদ্ধির গায়ে স্পর্শও করতে পারেনি সরকার৷ কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম দেওয়ার কোনও ইচ্ছে সরকারের নেই৷ সরকারি মদতে সংখ্যালঘু এবং দলিতদের উপর আক্রমণ ঘটেই চলেছে৷ এই অবস্থায় দুটি রাজ্যেই মানুষের রায়ে প্রমাণ হল, গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রতি দেশের মানুষের সমর্থন স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না৷ সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক দেশপ্রেমকে অত্যন্ত চাতুরির সাথে ব্যবহার করে এই সমর্থন বিজেপি আদায় করে নিয়েছিল৷ অর্থাৎ কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এখন চুরি করা আয়ুতে টিকে আছে৷

এই অবস্থায় বুর্জোয়া সংবাদমাধ্যম আবার নেমে পড়েছে– বিজেপির প্রতি মানুষের এই ক্ষোভকে কংগ্রেসের পক্ষে টেনে নিয়ে যেতে৷ মুমূর্ষু কংগ্রেসকে অক্সিজেন জোগাতে নেমে পড়েছে পুঁজিপতিদের একটি অংশ৷ তাদের লক্ষ্য দেশে একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থা কায়েম করা৷ পুঁজিপতি শ্রেণিরই স্বার্থরক্ষাকারী বিশ্বস্ত দুটি দলকে পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাখতে চায় তারা৷ যখন একটি দলের অপশাসনে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে মানুষ, তখন অন্য দলটিকে প্রচার দিয়ে দিয়ে তারা মানুষের সামনে নিয়ে আসবে৷ আবার এই দলটি ক্ষমতায় গিয়ে যখন একই কাজ করতে থাকবে এবং ক্ষুব্ধ মানুষ একদিন তাকেও ক্ষমতা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে তখন ঠিক একই কায়দায় অন্য দলটিকে প্রচার দিয়ে সামনে নিয়ে আসবে৷ ইউরোপ আমেরিকার বনেদি পুঁজিবাদী দেশগুলিতে দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যবস্থাই সেখানকার একচেটিয়া পুঁজির মালিকরা কায়েম রেখেছে৷ এতে পুঁজিপতি শ্রেণি নিশ্চিন্তে জনগণের উপর তাদের শাসন শোষণ কায়েম রাখতে পারে৷

কিন্তু জনগণ কি নীরবে এই ব্যবস্থা মেনে নিয়ে শোষিত এবং প্রতারিত হতেই থাকবে? তারা কি পুঁজিপতি শ্রেণির এই স্থায়ী শোষণ–ত্যাচারের হাত থেকে মুক্তির উপায় খুঁজবে না? তারা কি ভেবে দেখবে না, কী সেই উপায় যা তাদের এই পুঁজিবাদী যাঁতাকল থেকে চিরতরে মুক্তি দিতে পারে? বাস্তবে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সমাজ শোষক ও শোষিত– এই দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত৷ এই ব্যবস্থায় দল মানেই কোনও একটি শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী দল৷ জনগণের স্বার্থরক্ষার নাম নিয়ে যে দলগুলি কেন্দ্রে ও রাজ্যে রাজ্যে শাসন চালাচ্ছে সেগুলি আসলে পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষাকারী দল৷ তাই এদের শাসনে জনগণের দুর্ভোগ বাড়তেই থাকে আর পুঁজিপতিরা নিশ্চিন্তে তাদের শোষণ চালিয়ে যায়৷

জনগণ যখন সংকটে হাবুডুবু খেতে থাকে তখনও তাদের মুনাফা বেড়েই চলে৷ এই অবস্থায় শোষিত মানুষের স্বার্থরক্ষাকারী শ্রেণিদল কোনটি তা চিনে নেওয়া জরুরি৷ কারণ শোষক শ্রেণির নানা অংশের স্বার্থরক্ষাকারী অনেকগুলি দল থাকলেও শোষিত শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী দল একটিই৷ সেই দলকে ক্রমাগত শক্তিশালী করার মধ্য দিয়েই একমাত্র শাসক শ্রেণির শোষণ এবং প্রতারণার রাজনীতিকে পরাস্ত করা সম্ভব৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ১৩ সংখ্যা)