‘দেশকে ভালবাসছি বলে মালিকের পদলেহন করা কোনও মহৎ কর্ম নয়’

মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা থেকে

৫ই আগস্ট এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, এ যুগের বিশিষ্ট মার্কসবাদী চিন্তানায়ক ও দার্শনিক, সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের ৪৪তম স্মরণদিবস৷ এই উপলক্ষে তাঁর রচনার একটি অংশ প্রকাশ করা হল৷

ভারতবর্ষের এই শোষক ও শোষিত দুই ভাগে বিভক্ত সমাজ, বিভক্ত জাতি– এই শ্রেণিবিভক্ত জাতির পটভূমিকায় সমস্ত আন্দোলনগুলোর গতিপ্রকৃতি নির্ণয় করতে হবে৷ এখানে একটা কথা আমি যুবকদের বলব যে, ‘দেশপ্রেম’, ‘দেশাত্মবোধ’, ‘দেশের ডাক’, ‘দেশের স্বার্থ’, ‘দেশের ঐক্য’– এইসব কথাগুলোর সাহায্যে দেশের প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণি, বুর্জোয়ারা বেশিরভাগ সময়ই যুবকদের দেশপ্রেমের সুযোগ নিয়ে বিপথে পরিচালিত করে থাকে৷ এখানে একটা কথা সর্বদা মনে রাখতে হবে, দেশকে ভালবাসা একটা মহৎ কাজ সন্দেহ নেই– কিন্তু দেশকে ভালবাসছি বলে মালিকের পদলেহন করা কোনও মহৎ কর্ম নয়৷ দেশের স্বার্থের নামে মালিক শ্রেণির স্বার্থকে রক্ষা করে চলা, আর নিজে ভাবতে থাকা যে আমরা দেশকে খুব ভালবাসি, আমরা দেশসেবক– এটা কোনও মহৎ কর্ম নয়৷ এটা দেশের প্রতি চরম শত্রুতা, না জেনে হলেও চরম বিশ্বাসঘাতকতা এবং শেষ পর্যন্ত দেশের চরম অনিষ্টই এর দ্বারা সাধিত হয়৷ তাই আমি বলছি, ‘আমাদের দেশ’, ‘আমাদের জাতি’– যার সমস্যা নিয়ে আমরা আলোচনা করছি তা একটা অবিভাজ্য জাতি নয়, তা শ্রেণিবিভক্ত জাতি– যার একদিকে মালিকশ্রেণি, অপর দিকে মজুরশ্রেণি৷ তাই এখানে ‘জাতীয় ঐক্য’, ‘জনগণের ঐক্য’, ‘যুবকদের ঐক্য’– এই কথাগুলির দু’টি মাত্র সংজ্ঞা হতে পারে, দু’টি অর্থে এই কথাটা বাস্তবিকভাবে ব্যবহার করা চলে, তা হল– হয় মালিকশ্রেণির স্বার্থে যুবকদের, জনগণের, দেশের মানুষের ঐক্য– আর না হয় মজুরশ্রেণির, শোষিতশ্রেণির স্বার্থে দেশের যুবকদের, দেশের জনসাধারণের, শোষিত মানুষের ঐক্য৷ ‘দেশের ঐক্য’ – এই কথাটার শ্রেণিবিভক্ত সমাজে মাত্র এই দু’টি সংজ্ঞা হতে পারে বিজ্ঞানসম্মতভাবে৷ আর বাকি সব ব্যাখ্যা দেশের নামে লোককে ধাপ্পা দেওয়ার বুর্জোয়া চালাকি মাত্র৷ তাই শ্রেণিচরিত্রের এবং শ্রেণিস্বার্থের উল্লেখ না করে শুধু ‘দেশের সংহতি’ ও ‘দেশের স্বার্থ’ কথাগুলো বললে চলবে না,  ‘দেশের জন্য লড়ছি’– এরকম ভাবে বুঝলেও চলবে না, চলতে পারে না৷ ‘প্রিসাইজলি’ (যথার্থভাবে) আপনাদের বুঝতে হবে যে, ‘দেশের স্বার্থ’ বেশিরভাগ মানুষের স্বার্থের অর্থে কোন শ্রেণির স্বার্থের সাথে ঐতিহাসিকভাবে ওতপ্রোতভাবে জড়িত৷ যদি শোষিত শ্রেণির স্বার্থের সাথে, শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থের সাথে, কৃষক–খেতমজুরদের স্বার্থের সাথে, নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বার্থের সাথে দেশের স্বার্থের প্রশ্নটি মিলিত হয়ে গিয়ে থাকে, তবে এদেরই স্বার্থে দেশের আন্দোলন, যুবশক্তিকে পরিচালিত করা, যুবসমাজকে সুসংগঠিত করাই হবে দেশের কাজ করা৷ তাই ‘দেশের স্বার্থ’ কথাটার সাথে যুবকদের এই সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার, এই বিচার থাকা দরকার যে, তাঁরা ভারতবর্ষের এই শ্রেণিবিভক্ত সমাজে দেশের স্বার্থ বলতে যে স্বার্থের ঝান্ডা নিয়ে চলতে চাইছেন সেটা শোষক শ্রেণির স্বার্থ, না শোষিত শ্রেণির স্বার্থ৷ এই বিচারটি সমাধা না করে ভাসাভাসাভাবে ‘দেশ’ ‘দেশ’ করলে আমরা বার বার মালিক শ্রেণির চক্রান্তে পা দেব, তাদের হাতে শিকার হব, ইচ্ছা না থাকলেও হয়তো তাদেরই স্বার্থ সংরক্ষণ করে বসে থাকব৷ এমন ঘটনা আগেও বহু বার ঘটেছে এবং ভবিষ্যতে আরও ঘটবে৷

আমি এই সমস্ত ঘটনার মধ্যে বিস্তারিতভাবে যেতে চাইছি না৷ কিন্তু, আমি এই দৃষ্টিভঙ্গিতে সমস্ত জিনিসটা যুব সম্প্রদায়ের কাছে রাখতে চাইছি এইজন্য যে, শুধু পশ্চিমবাংলা বলে নয়, ভারতবর্ষ বলে নয়, গোটা পৃথিবীর সমস্ত আন্দোলনেই যুবসমাজ– শুধু মধ্যবিত্ত বা শিক্ষিত সম্প্রদায়ের যুবকদের কথা নয়– শ্রমিক–চাষি যুবক, ছেলে–মেয়ে নির্বিশেষে সকল যুবক–যুবতীদের সম্মিলিত শক্তিই এই আন্দোলনের আসল প্রাণশক্তি৷ বুড়োরা, হিসেবিরা, সনাতনপন্থীরা কোনও দিন সমাজে তুফান তুলতে পারেনি, সমাজের পরিবর্তন আনতে পারেনি, সামাজিক সমস্যা শেষপর্যন্ত সমাধান করার জন্য আন্দোলনে এগিয়ে আসেনি, বা আন্দোলন পরিচালনা করেনি৷ যারা সমাজকে পাল্টেছে, যারা সভ্যতাকে গড়ার জন্য বিপুল আন্দোলনের সৃষ্টি করেছে, তারা সব দেশেই যুব সম্প্রদায়৷ আর, এই যুব সম্প্রদায় শুধু মধ্যবিত্ত শিক্ষিত যুব সম্প্রদায় নয়, শোষিত শ্রেণির যুবসমাজ৷

– যুব সমাজের প্রতি, ১৯৬৭৷ রচনাবলি, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা–৫০

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৫০ সংখ্যা)