দুর্নীতির প্রমাণ মুছতেই কি মেডিকেলে আগুন

৩ অক্টোবর সকালে এশিয়ার প্রাচীনতম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হেরিটেজ বিল্ডিং তথা এমসিএইচ বিল্ডিংয়ে অবস্থিত মূল মেডিসিন স্টোরে আগুন লাগে৷ আগুন লাগার পরে খুব স্বাভাবিকভাবেই ওই বিল্ডিংয়ে থাকা রোগীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়৷ ওই স্টোরের পাশেই রয়েছে আইসিসিইউ, যেখানে অসংখ্য মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসা চলছে৷ চারতলা ওই ভবনের অন্যান্য তলাতে মেডিসিন, হেমাটোলজি এবং কার্ডিওলজি বিভাগের তিনশোরও বেশি রোগী তখন উদ্বেগ ও আতঙ্কে ছটফট করছেন৷ অনেকের মনেই ভেসে উঠছিল আমরি হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক রোগীর মৃত্যুর ঘটনার সেই ভয়াবহ স্মৃতি৷ ফলে শারীরিক অক্ষমতা সত্ত্বেও অনেকেই ওই জতুগৃহ থেকে নিরাপদ স্থানে বেরিয়ে আসতে চাইছিলেন৷ রোগীদের আত্মীয়স্বজন, স্থানীয় সহৃদয় মানুষজন, স্বাস্থ্যকর্মী ও ডাক্তার–নার্সদের প্রচেষ্টায় অনেককেই বাইরে বের করে এনে অন্য বিভাগে স্থানান্তর করা সম্ভব হয়েছিল৷

কিন্তু এই আগ্নিকাণ্ড যে মূল স্টোরে ঘটল, তুলো, গজ–ব্যান্ডেজ, স্পিরিটের মতো দাহ্য পদার্থে ঠাসা সেইস্থানে আগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা কি আদৌ ছিল বা কাজ করেছিল? রোগীদের আত্মীয়স্বজনের মনে এই প্রশ্নটিই বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে, কারণ তাঁদের কেউই দমকল এসে পৌঁছবার আগে স্টোরের আগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থার কোনও কার্যকারিতা দেখতে পাননি৷ পরে তদন্তে এ–ও উঠে এসেছে– ওই বিশাল স্টোরের ভিতরে মাত্র একটি আগুন নেভানোর যন্ত্র দেখতে পাওয়া গেছে৷ ওই ভবনের অন্যান্য তলায় যে সব আগুন নেভানোর যন্ত্র রয়েছে, তার সবগুলিই মেয়াদ–উত্তীর্ণ অথবা এমনভাবে অন্য জিনিসের আড়ালে রাখা যে সেগুলির কাছে পৌঁছনো যায় না৷ স্মরণ করা দরকার, মাত্র কয়েক বছর আগে জনগণের কয়েক কোটি টাকা খরচ করে ওই হাসপাতালে আগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হয়েছিল৷ কিন্তু বিপদের মুহূর্তে দেখা গেল (ক) আগুন নেভানোর যন্ত্রগুলি অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে (খ) যন্ত্র চালানোর মতো লোক নেই (গ) জল সরবরাহের যে পাইপলাইন বানানো হয়েছিল, যার গুণগান কিছুদিন আগে পর্যন্ত খুব শোনা যাচ্ছিল– ওই দিন তা কাজ করেনি৷

মানুষের নিরাপত্তার কথা বলে জনগণের যে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে, আদতে তা কাজে লাগছে কতটুকু– সেদিনের এই ঘটনা আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল৷

প্রাথমিক তদন্তে এছাড়া আরও অনেক তথ্যই উঠে আসছে, যা নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে৷ যেমন ওই দিন স্টোরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীর জায়গায় ডিউটিতে ছিলেন অন্য একজন৷ এর পাশাপাশি প্রশ্ন উঠেছে ওষুধের বরাত দেওয়া থেকে শুরু করে স্টক মেলানোর মধ্যেকার বিস্তর ফারাক নিয়েও৷ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে ওই হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যানের মন্তব্য৷ তিনি বলেছেন, এই আগ্নিকাণ্ড কোনও গাফিলতির ফলে ঘটেনি৷ এটা ঘটেছে অন্তর্ঘাতের ফলে৷ স্বাস্থ্যকর্তাদের নানা জনের নানা মন্তব্য বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি করেছে৷ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, আগ্নিকাণ্ডের আগের দিনই ওষুধ স্টোরের বহু হিসাব নিয়ে অভিযোগ উঠেছিল৷ তার দু–এক দিনের মধ্যে পুরো হিসাব দেখানোর কথা বলা হয়েছিল ওষুধ স্টোরের কর্তাদের৷ ঠিক তার পরদিনই আগুন লেগে সব পুড়ে যাওয়াটা কি শুধুই দুর্ঘটনা প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনের দাবি জানিয়ে ওইদিনই মেডিকেল সার্ভিস সেন্টার এবং সার্ভিস ডক্টর্স ফোরামের পক্ষ থেকে উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের দাবি জানিয়ে ডেপুটেশন দেওয়া হয়েছে রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তরের শীর্ষকর্তা প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি, ডিএইচএস, ডিএমই এবং মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপালের কাছে৷

কেউই চায় না এএমআরআই হাসপাতালের মর্মান্তিক আগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনা আবার কোনও হাসপাতালে ফিরে আসুক৷ চিকিৎসা করে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পরিবর্তে হাসপাতালে ভর্তি অসুস্থ মানুষ আগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারাক৷ তাই প্রকৃত সত্য জনসমক্ষে উঠে আসা দরকার৷ এই দাবিতে চিকিৎসকদের আন্দোলন লাগাতার চলবে বলে সংগঠনগুলির নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন৷

(৭১ বর্ষ ১১ সংখ্যা ১২ – ১৮ অক্টোবর, ২০১৮)