দাবানলে পুড়ছে দেশ, বিক্ষোভের আগুন অস্ট্রেলিয়ায়

গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাপক এলাকা পুড়ছে দাবানলে। জ্বলে খাক হয়ে যাচ্ছে বনানী ও অসংখ্য বন্যপ্রাণী। এ পর্যন্ত মৃত পশুপাখির সংখ্যা ১০০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। মানুষও রেহাই পায়নি। এ পর্যন্ত ২৮ জনের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। অথচ এই ভয়ঙ্কর অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও পরিণামে আবহাওয়ার ক্ষতিকর পরিবর্তন সম্পর্কে দেশের প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন ও তাঁর সরকারের বিশেষ মাথাব্যথা নেই। পরিবেশ রক্ষায় সরকারের এই অবহেলার বিরুদ্ধে ১০ জানুয়ারি পথে নেমেছিল অস্ট্রেলিয়ার ছাত্রসমাজ। কয়েক লক্ষ ছাত্রছাত্রী সেদিন ‘ইউনি স্টুডেন্টস ফর ক্লাইমেট জাস্টিস’-এর ডাকে দেশ জুড়ে বিক্ষোভে মিছিলে সামিল হন। শুধু রাজধানী সিডনি শহরেই বিক্ষোভ দেখিয়েছেন ৩০ হাজার ছাত্রছাত্রী।

অস্ট্রেলিয়ায় দাবানল কোনও নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু এবারের অগ্নিকাণ্ড ব্যাপকতা ও ভয়াবহতায় পুরনো সমস্ত রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ওয়াকিবহাল মহল এর পিছনে অন্যতম কারণ হিসাবে জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষকে উচ্ছেদ করে তাদের জমি দখল করে মুনাফা লুঠের পুঁজিবাদী ষড়যন্ত্রকে দায়ী করছেন। এছাড়াও ব্যবসার প্রয়োজনে পরিণতির কথা না ভেবে জমি ও জল দূষিত করা, অতিরিক্ত জল লাগে এমন ফসলের ব্যাপক চাষ করা, পরিণতিতে ব্যাপক উষ্ণায়ন ইত্যাদি কারণের কথাও তাঁরা বলছেন।

হাজার হাজার বছর ধরে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষজনের মধ্যে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করতে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে শুকনো ঝোপঝাড়, গাছপালায় আগুন লাগানোর প্রথা প্রচলিত রয়েছে। প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে, প্রকৃতি থেকেই শিক্ষা নিয়ে সেই কাজটি তাঁরা করে আসছেন অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রিত আকারে। প্রকৃতির সন্তান এই আদিবাসীরা জীবনধারণের জন্য যেমন প্রকৃতির ওপর নির্ভর করেন, তেমনই পরম্পরাগত শিক্ষা ও রীতি মেনে প্রকৃতিকে সুরক্ষিত রাখেন। এঁদের কারণেই অস্ট্রেলিয়ায় দাবানল সাধারণত মারাত্মক আকার ধারণ করে না। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে পৃষ্ঠপোষক সরকারগুলির বদান্যতায় অবাধ মুনাফা লুটের পথে হেঁটে পুঁজিমালিকরা ক্রমাগতই কেড়ে নিচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের দখলে থাকা জমি। এই পরিস্থিতিতে এবারের দাবানল কোনও মতেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না সেখানকার মরিসন সরকার।

আমাদের দেশের ছবিটাও বিশেষ অন্যরকম নয়। অবাধে প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠের বন্দোবস্ত করে দিতে পুঁজিমালিকদের স্বার্থবাহী সরকারগুলি নতুন নতুন আইন এনে হাজার হাজার বছরের বাসভূমি থেকে আদিবাসীদের নির্বিচারে উচ্ছেদ করে জল-জঙ্গল-পাহাড় তুলে দিচ্ছে পুঁজিমালিকদের হাতে। অস্ট্রেলিয়ার মতো এদেশেও প্রকৃতি-পরিবেশের ভারসাম্য আজ ধ্বংস করছে পুঁজিবাদী সরকারগুলি।

আবহাওয়া-বিজ্ঞানীদের মতে, প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ ও তার ফলে বিশ্ব জুড়ে উষ্ণায়ন বা পরিবেশের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ঘটনা প্রকৃতি-পরিবেশে যে কুপ্রভাব ফেলছে, অস্ট্রেলিয়া তার ব্যতিক্রম নয়। গত তিন বছর ধরে অস্টে্রলিয়ায় খরা চলছে এবং বার বার দাবানলের ঘটনা ঘটছে। এর পিছনে অন্যতম কারণ, সেদেশের কয়লাশিল্প। অস্ট্রেলিয়ায় বিপুল পরিমাণে কয়লা উৎপাদিত হয়। বহু কোটি ডলারের মুনাফা জড়িয়ে রয়েছে কয়লাশিল্পের সঙ্গে। কিন্তু যে পদ্ধতিতে কয়লাশিল্পে কাজ চলে, তাতে কার্বন ডাই অক্সাইডের নিঃসরণ ঘটে বিপুল পরিমাণে যা পরিবেশের তাপমাত্রা বাড়িয়ে তোলার অন্যতম একটি কারণ। অবিলম্বে এই উৎপাদন পদ্ধতি পাল্টানো দরকার। কিন্তু পুঁজিমালিকদের স্বার্থবাহী মরিসন সরকার পরিবেশ ও বন্যপ্রাণীর এত বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সত্তে্বও উষ্ণায়ন রুখতে কয়লাশিল্পে কোনও রকম নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নিতে নারাজ। তিনি মানতেই রাজি নন যে অস্ট্রেলিয়ায় বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ ঘটে। সে দেশের উপপ্রধানমন্ত্রী তো আবার বলেই বসেছেন যে, উষ্ণায়নের ধুয়া আসলে বামপন্থীদের ষড়যন্ত্র। দেশের মানুষকে এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে ফেলে রেখে গত ডিসেম্বরে সপরিবারে হাওয়াই দ্বীপে ছুটি কাটাতে যেতেও বাধেনি প্রধানমন্ত্রী মরিসনের। এসবের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষুব্ধ অস্টে্রলিয়ার মানুষ। পুঁজিমালিকদের যথেচ্ছাচার ও তাদের স্বার্থ রক্ষায় প্রকৃতি-পরিবেশ ও দেশবাসীকে যমের দুয়ারে পাঠাতে দ্বিধাহীন প্রেসিডেন্টের নির্লজ্জতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন তাঁরা।

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ২৫ সংখ্যা)