দর্শন বলতে কী বুঝি? (৪)

ভাববাদী দর্শনের গোড়ার কথা হল, মানুষ যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুজগতের অংশ বিশেষ, সেই বস্তুজগত অন্তিম সত্য (অ্যাবসলিউট ট্রুথ) নয়। সেই বস্তুজগতের বাইরে বস্তুনিরপেক্ষ ভাবে ‘সত্য’ অন্য কোথাও বিরাজমান। এই দুনিয়াটা আসলে সেই ‘সত্য’ সেই পরম সত্যেরই একটা অভিব্যক্তি মাত্র। বস্তু বা বস্তুজগত কোনওটাই প্রকৃত সত্য নয়। প্রকৃত সত্য হচ্ছে (ইতিহাসের পর্যায়ভেদে এবং দার্শনিক বিশেষে) ব্রহ্ম বা শক্তি বা চেতনা বা এই ধরনের যে কোনও একটা কিছু। এই পরম সত্যটাই কেবলমাত্র স্বয়ম্ভু সত্তা– বাদবাকি সব মায়া, এই পরম সত্যেরই প্রতিফলন মাত্র। সংক্ষেপে বলতে গেলে এই বিশ্ব দুনিয়াটা আসলে আর কিছুই নয়, এটা আসলে একটা অখণ্ড চেতনা বা একটা চরম শক্তি বা একটা নিয়মশৃঙ্খলা পদ্ধতির বাইরের খোলসটুকু মাত্র। কাজেই এদিক থেকে দেখতে গেলে, আমরা যাকে বিজ্ঞান বা বস্তু সম্পর্কিত বিশেষ জ্ঞান বলি আসলে সে জ্ঞানটাও প্রকৃত জ্ঞান নয়। যেহেতু বিজ্ঞানের কাজ-কারবার আমাদের এই বস্তুজগতের যাবতীয় বিষয়বস্তু নিয়ে– যে বস্তুজগত খোদ নিজেই অন্য একটা ‘পরম সত্য’র অভিব্যক্তি মাত্র। মনে রাখা দরকার ভাববাদী দর্শন একদিনেই বা কোনও বিশেষ একজন মাত্র দার্শনিকের হাতেই এই পরিণতি লাভ করেনি। কয়েক হাজার বছর ধরে, একদিকে শ্রেণিবিভক্ত সমাজে অভিজাত সুবিধাভোগীদের একাধিপত্য, তাদের শ্রেণিগত প্রতিষ্ঠা ও প্রতিপত্তিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা,প্রচলিত সামাজিক অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক কাঠামোকে বজায় রাখার উপযুক্ত সামাজিক আচার ব্যবহার, রীতিনীতি-বিধিনিষেধকে ‘অলঙ্ঘণীয়’, ‘অপরিবর্তনশীল’ বলে তুলে ধরা এবং অন্য দিকে বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কহীন, বাস্তব জগতের দৈনন্দিন কাজকারবারের সঙ্গে সম্পর্কহীন জ্ঞানচর্চার ফলেই ভাববাদী দর্শন এই পরিণতিতে পৌঁছেছে।

কিন্তু অষ্টাদশ শতকে এসে এই ভাববাদী দর্শন এক নতুন রূপ নিতে শুরু করল। এতদিন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ভিত্তিতে দর্শন পরিচালিত হয়নি, বরঞ্চ বিজ্ঞানবিমুখীতাই ছিল ভাববাদী দর্শনের বৈশিষ্ট্য। যদিও কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটনের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার মানুষের চিন্তাজগতকে বারবার ধাক্কা মেরে গেছে এবং চিন্তাধারার কিছু কিছু পরিবর্তনও এনেছে, তবুও মূলত দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে ‘বিচ্ছিন্ন’, ‘যন্ত্র সম্পর্কিত’ ‘কারিগরি জ্ঞান’ হিসাবেই গ্রহণ করার ঝোঁকটা ছিল বেশি। আজকের মতো বিজ্ঞানের সমস্ত শাখার সমস্ত আবিষ্কৃত তত্ত্বকে বিশ্লেষণ করে তার অন্তর্নির্হিত যোগসূত্র খুঁজে বের করে দুনিয়াকে দেখবার চেষ্টা হয়নি।

কিন্তু সপ্তদশ শতকের শেষভাগে এবং অষ্টাদশ শতকে এসে যখন হাজার বছরের প্রচলিত সামন্ততান্ত্রিক রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে নব্যবণিক সম্প্রদায় মাথা তুলে দাঁড়ালো তখন প্রচলিত ভাববাদী দর্শন এবং তার আনুসঙ্গিক যুক্তিবোধ ও নীতিবোধের বিরুদ্ধে সব চাইতে শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে সে পেল বিজ্ঞানের বিভিন্ন নতুন নতুন শাখার নতুন নতুন আবিষ্কৃত নিয়ম এবং তত্ত্বকে। মধ্যযুগে সামাজিক ক্ষেত্রে সম্রাট নামক ব্যক্তি বিশেষ বা অভিজাত গোষ্ঠী বিশেষের নিরঙ্কুশ স্বৈরাচারী আধিপত্যের সমর্থনে প্রচলিত ভাববাদী দর্শন ঈশ্বর বা ‘অন্তিম শক্তির’ অবিসংবাদী আধিপত্যকেই শেষ কথা বলে মেনে নিয়েছিল এবং এই দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকেই সে-দিন রাজাকে ঈশ্বরের প্রতিভূ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। সেখানে এখন শিল্পভিত্তিক বণিকতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সমর্থনে বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত তত্ত্ব বা নিয়মের ভিত্তিতে এক নতুন ধারায় ভাববাদী দর্শন প্রবাহিত হতে শুরু করল।

বিজ্ঞানের কিছুটা অগ্রগতি হওয়ার ফলে মানুষের পক্ষে দুনিয়ার গতি-প্রকৃতি আগের চাইতে বেশি বোঝা সম্ভব হল। বিভিন্ন বৈজ্ঞনিক আবিষ্কারের ফলে দুনিয়া সম্পর্কে হাজার বছরের প্রচলিত আজগুবি কাহিনি এবং ধর্মীয় উপকথা অবাস্তব বলে প্রমাণিত হতে লাগল। এতদিন যে মধ্যযুগীয় ধারণা মানুষের মনে দৃঢ় বদ্ধমূল ছিল যে, এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডই এক পরম শক্তিমান অপার্থিব শক্তির ইচ্ছাধীন। হাজার বছরের প্রচলিত এই ধারণার ভিত্তিতে ফাটল দেখা দিতে আরম্ভ করল। কিন্তু তার পরিবর্তে কোনও সঠিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি সে দিন গড়ে উঠতে পারেনি। কারণ কী?

তার কারণ সেদিন বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার যতটুকু বিকাশ ঘটেছে তার সমন্বয় সাধন করে দুনিয়া সম্পর্কে কোনও সামগ্রিক ধারণা গড়ে তোলা সম্ভবপর ছিল না। যন্ত্রবিদ্যার অগ্রগতি, ক্রমবর্ধমান ভৌগোলিক জ্ঞান, ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসারের ফলে দেশে দেশে জিনিসপত্র, যন্ত্রপাতি ও এই সমস্ত বিষয় সংক্রান্ত জ্ঞান ও বিজ্ঞানের আদান-প্রদানের ফলে মানুষের নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে এতদিনকার ধারণা পাল্টে গেল। এতদিন পর্যন্ত বিজ্ঞানের অনগ্রসরতার ফলে প্রকৃতির অধীনে থাকতে হত বলে মানুষ নিজেকে এই দুনিয়ার অন্যান্য জড় ও সচেতনপদার্থের মতোই সেই সর্বশক্তিমান অপার্থিব শক্তির ক্রীড়নক ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারত না, এমন কি নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে ভাববার সময়েও সেই পরম শক্তিমান স্বয়ম্ভু সত্তারই সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারত না।

যন্ত্র বিজ্ঞান, কারিগরি বিদ্যা, ভৌগোলিক জ্ঞান ইত্যাদির সম্প্রসারণ এবং নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার মানুষের হাতে প্রকৃতিকে জয় করার, প্রকৃতির উপর তার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করার এক নতুন রাস্তা খুলে দিল। মানুষ নিজের শক্তি এবং নিজের ক্ষমতাকে উপলব্ধি করতে লাগল। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারাদির ফলে সর্বশক্তিমান সেই স্বয়ম্ভূ সত্তার ক্ষমতা পূর্বাপেক্ষা সঙ্কুচিত হল। এতদিন পর্যন্ত যে সমস্ত প্রাকৃতিক শক্তি বা বস্তুকে মনে করা হত ওই অপার্থিব চরম শক্তির অধীন, দেখা গেল সে সমস্তগুলিই কোনও না কোনও বিশেষ নিয়মের অধীন।

এই অবস্থায় এসে সেদিনকার দার্শনিকেরা অনেকেই ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করলেন এবং প্রচলিত ভাববাদী চিন্তাধারার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে নিজেদের বস্তুবাদী বলে জাহির করলেন। কিন্তু যেহেতু বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সমন্বয় সাধনের পথে দুনিয়া সম্পর্কে সঠিক সামগ্রিক বৈজ্ঞানিক ধারণা গড়ে তোলা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না, ফলে তাদের চিন্তাধারা অন্য এক পথে প্রবাহিত হল। এতদিন এক অপার্থিব শক্তির ক্রীড়নক হিসেবে নিজেকে তুচ্ছাতিচ্ছু করে রাখার বিপরীত প্রতিক্রিয়া হিসেবেই এখন দার্শনিকরা মানুষকে এই দুনিয়ার তুচ্ছ নগণ্য বস্তুর ঊর্ধ্বে স্থাপন করতে চাইলেন। যেহেতু দৈহিক দিক থেকে সেটা সম্ভব হল না– কারণ সেখানেও তাঁরা যান্ত্রিক নিয়ম শৃঙ্খলার অবিংসবাদী আধিপত্য দেখলেন, সেই হেতু ‘মন’ বা ‘চিন্তা’বা ‘ভাব’ (আইডিয়া)-কেই দৈহিক জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করে তুলে নিয়ে বসালেন সদ্য মৃত ঈশ্বরের পরিত্যক্ত সিংহাসনে।

অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর দর্শন চর্চার ইতিহাসে দেখা যাবে এই যুগে সর্বাধিক সংখ্যক পরস্পর বিরোধী দার্শনিক চিন্তাধারার জন্ম হয়েছে, চিন্তা জগতে একটা বিরাট হট্টগোলের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ এই যুগেই ভাববাদী এবং বস্তুবাদী এই দুই পরস্পর বিরোধী চিন্তাধারার সংঘর্ষ অন্তিম পর্যায়ে এসে দাঁড়ায়। এই যুগ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক ইতিহাসের দিক থেকে দেখতে গেলে একটার পর একটা দেশে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যুগ। সামন্ততন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে দেশে দেশে ধনিক শ্রেণির অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রকে ধ্বংস করে দেশে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সর্বশক্তিমান স্বয়ম্ভূ ঈশ্বরের ক্ষমতা খর্ব করে মানুষের আত্মপ্রতিষ্ঠা, হাজার বছরের প্রচলিত ‘ধর্মে’র অন্তঃসারশূন্যতার বিরুদ্ধে মানবতাবাদের বিজয় অভিযান, পৌরাণিক গল্প-গাথা আর ধর্মীয় উপকথার ভিত্তিতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে ব্যাখ্যা করার বদলে বিজ্ঞানের নব-আবিষ্কৃত তথ্য ও তত্ত্বগুলির সাহায্যে জগতকে জানবার ক্রমবর্ধমান আকাঙ্খা– এই সমস্ত সামাজিক আন্দোলনের একযোগে প্রতিফলন ঘটেছে দার্শনিক চিন্তাজগতে। আবার এই একই যুগেরই দ্বিতীয়ার্ধে দেশে দেশে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে সদ্যজাত সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রাম, বুর্জোয়া গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক ভাবনা-ধারণা ও আদর্শের অভ্যুত্থান, ডারউইন-ফ্রয়েড-মর্গান-মেন্ডেল প্রমুখ বিজ্ঞানীদের যুগান্তকারী আবিষ্কার– এই সব কিছুই প্রতিফলিত হয়েছে দার্শনিক চিন্তাজগতে। কোনও বিশেষ একজন দার্শনিকের বিশেষ দার্শনিক চিন্তার মধ্যে খুঁজলে দার্শনিক চিন্তাধারার এই বিকাশের ইতিহাস বের করা যাবে না। কিন্তু এ যুগের সমস্ত দার্শনিক চিন্তার ইতিহাস সামগ্রিকভাবে চোখের সামনে তুলে ধরলে দেখা যাবে যে, এ যুগের প্রথম দিকের কায়েমি স্বার্থের সমর্থক দর্শনের বিরুদ্ধে যে প্রগতিশীল, বিরোধী-শ্রেণিদর্শন জন্ম নিয়েছে সেই একই যুগের পরবর্তী অধ্যায়ে এসে পুর্ববতী অধ্যায়ের প্রগতিশীল দর্শনচিন্তা কায়েমি স্বার্থের সমর্থক দর্শনে রূপান্তরিত হয়েছে। যেহেতু দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করে দিয়ে কোনও যুগকে ধরা সম্ভব নয়, সেই হেতু নাম ধরে ধরে দার্শনিকদের ইনি এই দর্শনের সমর্থক, উনি ওই দর্শনের সমর্থক এভাবে চিহ্নিত করাও সম্ভব নয়। নির্ভেজাল ভাববাদী বা একান্তই বস্তুবাদী দার্শনিক চিন্তাপদ্ধতি খুঁজতে যাওয়া এ ক্ষেত্রে মূর্খতা মাত্র। মোটামুটিভাবে দার্শনিক চিন্তাধারা ভাববাদী এবং বস্তুবাদী– এই দুই ধারায় দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেলেও এ পর্যন্ত কোনও দার্শনিকই বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার আবিষ্কৃত তত্ত্বসমূহের সমন্বয় সাধনের পথে জগত সম্পর্কে কোনও সঠিক, সামগ্রিক বৈজ্ঞানিক ধারণা গড়ে তুলতে পারেননি। ফলে কি ভাববাদী, কি বস্তুবাদী, হয় ‘ঈশ্বর’, না হয় ‘বস্তু নিরপেক্ষ ভাব’, না হয় ‘যান্ত্রিক নিয়ম শৃঙ্খলা’ পদ্ধতি, না হলে ‘স্থান-কাল-পাত্র নিরপেক্ষ শাশ্বত সনাতন নীতি ও আদর্শ’– এ রকম কিছু একটাকে পরম বা চরম সত্য বলে ধরে নিয়েছেন এবং এঁদের এই যে কোনও একটা বিষয় বা বস্তুকে স্থায়ী বা নিত্য হিসেবে ঘোষণা করার মাধ্যমে কায়েমি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ব্যবস্থার স্বার্থই কখনও প্রত্যক্ষে কখনও পরোক্ষে সমর্থিত হয়েছে।

ভাববাদ ও বস্তুবাদের এই সংঘর্ষ শেষ সীমায় এসে পৌঁছল ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে। এক দিকে দেশে দেশে প্রচলিত ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির বিরুদ্ধে সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণির সংগঠিত আন্দোলন, বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার দ্রুততর অগ্রগতি, সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী ভাবনা ধারণা ও আদর্শের ব্যাপক প্রসার, সমস্ত রকম কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে শোষিত জনসাধারণের অভূত্থান– এই সমস্ত সামাজিক আন্দোলন দর্শনের অন্তর্বিরোধ আরও বাড়িয়ে তুলল এবং প্রচলিত সর্বপ্রকার ভাবনা ধারণা রীতিনীতি ও আদর্শের পরিবর্তে এক নতুন ভাবনা-ধারণা ও নীতিবোধ গড়ে তুলল।

এই নতুন রীতিনীতি ও আদর্শের অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বিজ্ঞানের সমস্ত শাখার সমন্বয়ের পথে ‘বস্তু’ ও ‘ভাব’-এর যথাযোগ্য মূল্যায়ন ও সম্পর্ক স্থাপন করে দার্শনিক কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলস এক বিপ্লবী দার্শনিক চিন্তাধারাকে জগত সমক্ষে উপস্থিত করলেন। দার্শনিক চিন্তাক্ষেত্রে ‘ভাববাদ’ ও ‘বস্তুবাদ’-এর এত দিনকার বিরোধ পরিণতি লাভ করল দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দর্শনে। এই প্রথম এমন ‘দর্শন’ এল যা কেবলমাত্র দুনিয়াকে ব্যাখ্যা করার কাজ করেই আর সন্তুষ্ট থাকতে চাইল না। এই প্রথম দুনিয়াকে পরিবর্তন করার কাজেও দর্শনকে লাগানো হল। কারণ এই প্রথম মানুষ বাস্তব বৈজ্ঞানিক প্রয়োগ ও পরীক্ষার ভিত্তিতে জগত সম্পর্কে, জীবন সম্পর্কে একটা সঠিক সামগ্রিক ধারণা গড়ে তোলার সুযোগ পেল।

দ্বন্দ্বমূলক এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার বিশেষ বিশেষ সত্যগুলির মধ্য থেকে জগত সম্পর্কে, জীবন সম্পর্কে যে সমস্ত সাধারণ সত্য আবিষ্কার করেছে, সে সম্পর্কে আলোচনা ইতিপূর্বেই হয়েছে।

দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ পূর্বতন সমস্ত দার্শনিক চিন্তাধারা থেকে পৃথক এবং উন্নত শুধুমাত্র এই কারণেই নয় যে, বিজ্ঞানের সর্বব্যাপক উন্নতির ভিত্তিতেই এই দর্শনের জন্ম, উপরন্তু এই দর্শনই একমাত্র দার্শনিক চিন্তাধারা যা কেবলমাত্র কাগুজে আলোচনা এবং নিছক যুক্তিতর্ক পদ্ধতির মধ্যে নিজেকে আটকে রাখেনি বরং সারা দুনিয়াকে শোষিত সর্বহারা শ্রেণির মানুষের হাতে তুলে দিয়েছে সমস্ত শাসন শোষণ অত্যাচারের কায়েমি আসন উপড়ে ফেলে দিয়ে শোষণহীন শ্রেণিহীন স্বাধীন মানুষের সুস্থ সমাজ গড়ে তোলার অমোঘ অস্ত্র।

(এই নিবন্ধটি ১৯৬২ সালে গণদাবী ১৫ বর্ষ ৬ সংখ্যা থেকে ৯ সংখ্যা পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। নিবন্ধটির গুরুত্ব বিবেচনা করে পুনঃপ্রকাশ করা হল। এ বার শেষ অংশ)