Breaking News

ত্রিপুরায় পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থীদের দাঁড়াতেই দিল না বিজেপি

মাত্র ছ’মাসেই বাইরের চকচকে রঙ ধুয়েমুছে ভেতরের খড়–মাটি বেরিয়ে পড়তে দেখে অবাক ত্রিপুরার মানুষ৷ আগের সরকারের আমলে ত্রিপুরায় গণতন্ত্র ছিল না– এই অভিযোগ তুলে বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারা গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবে৷ গণতন্ত্রের জন্যই ভোটের আগে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল বিজেপি নেতাদের ত্রিপুরার মানুষকে গণতন্ত্র দেওয়ার জন্য তাবৎ বিজেপি নেতারা হামলে পড়েছিলেন সেখানে৷ কিন্তু ত্রিপুরাবাসী বুঝতে পারেননি এমন গণতন্ত্র তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে!

সম্প্রতি ত্রিপুরায় নির্ধারিত সময়ের ৯ মাস আগেই পঞ্চায়েত নির্বাচন করে ফেলল বিজেপি৷ কেন ৯ মাস আগে? কারণ ‘গণতান্ত্রিক’ বিজেপি বিগত নির্বাচনে বিজয়ী পঞ্চায়েত সদস্যদের পদত্যাগে বাধ্য করেছে৷ তারপর ৩০ সেপ্টেম্বর রাজ্যের ৩৩৮৬টি পঞ্চায়েত আসনে উপনির্বাচন ঘোষণা করেছে৷ মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন পার হতে দেখা গেল, মাত্র ১৬১টি আসনে ভোট করতে হবে৷ অর্থাৎ ৯৬ শতাংশ আসনই বিজেপি ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ দখলে নিয়েছে৷ জেলা পরিষদের ৭টি আসনেরও দখল নিয়েছে একই কায়দায়৷

বিজেপির এ হেন ‘গণতান্ত্রিক’ আচরণের কারণ কী? ছ’মাস আগে রাজ্যের ক্ষমতার দখল নিলেও পঞ্চায়েতগুলি ছিল আগের সরকারের আমলের৷ ফলে গ্রাম স্তর পর্যন্ত ‘জনসেবায়’ অসুবিধা হচ্ছিল বিজেপি সরকারের নেতা–মন্ত্রীদের৷ জনসেবায় আর ন’টা মাস অপেক্ষা করতেও তর সইছিল না৷ ফলে ‘আভি হঠাও’৷ পদত্যাগ করো, না হলে এমন ‘গণতান্ত্রিক’ হব যে টের পাবে গণতন্ত্রের ভয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন নির্বাচিত সদস্যরা৷

‘ত্রিপুরায় মনোনয়ন দিতে কেউ যায়ইনি’, বলেছেন পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা রাহুল সিংহ৷ কথাগুলি এ রাজ্যের মানুষের খুবই চেনা৷ কোথায় আর কখন বলা হচ্ছে, এটা না বলে দিলে যে কেউ গুলিয়ে ফেলবেন যে কথাগুলি সিপিএম নাকি তৃণমূল কিংবা বিজেপির৷ ভোটবাজ এই সব দলগুলি যখন যেখানে ক্ষমতায় বসেছেন তাঁদের মুখ দিয়ে তখন একই কথা বেরিয়ে এসেছে৷ সব শাসকের ভাষাই এক৷ পতাকার রঙ আর দলের নাম ছাড়া রাজনীতিতেও খুব ফারাক পাওয়া যাচ্ছে কি?

পশ্চিমবাংলায় তৃণমূলের কিংবা ত্রিপুরায় বিজেপির বিরোধী কাউকে দাঁড়াতে দেওয়া হচ্ছে না দেখে তাকে ‘গণতন্ত্র ধ্বংসকারী’ বলে এখন চোখে জল রাখতে পারছেন না যে সিপিএম নেতারা, ক্ষমতায় থাকার সময়ে তাঁরা নিজেরা কী করেছেন? পঞ্চায়েতে বিরোধীদের প্রার্থী হতে না দেওয়া, প্রার্থী হয়ে গেলে জোর করে তুলে নিতে বাধ্য করা, প্রার্থী হলে প্রচার করতে না দেওয়া, বাড়িতে থান কাপড় পাঠিয়ে দেওয়া, ভোট দিতে না দেওয়া, ছাপ্পা ভোট দেওয়া, গণনার সময় গণ্ডগোল করা, বিরোধীদের মারধর করা, মেরে হাত–পা ভেঙে দেওয়া, খুন করা, বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, পুকুরে বিষ দেওয়া – কী না করেছেন তাঁরা৷ আর মুখে বলেছেন, ‘বিরোধীরা প্রার্থী দিতে না পারলে কী করব? আমরা কি তাঁদের হয়ে প্রার্থী দিয়ে দেব?’ বিধানসভা নির্বাচনে ২৩৫ আসনে জয়ী হওয়ার পর ‘আমরা ২৩৫, ওরা ৩০৷ ওদের কথা শুনব কেন’– মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের এমন ঔদ্ধত্য তো আজও সবার স্মরণে আছে৷

সিপিএম নেতাদের দেখানো পথেই তৃণমূল নেতারা পশ্চিমবাংলার পঞ্চায়েত নির্বাচনে সিপিএমের নজির ছাপিয়ে গিয়ে ৩৪ শতাংশ আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দখল করেছেন৷ তৃণমূল নেতাদের গলাতেও সিপিএম নেতাদের একই সুর বাজতে শুনেছে রাজ্যের মানুষ– ‘বিরোধীরা প্রার্থী দিতে পারেনি তো আমরা কী করব৷’ বাস্তবে বিরোধীরা প্রার্থী দিতে গেলে তাঁদের ‘রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা উন্নয়নের’ মুখোমুখি হতে হয়েছে৷ তাতে কারও হাত–পা ভেঙেছে, মাথা ফেটেছে, কারও বাড়ি পুড়েছে, কারও বা প্রাণ গিয়েছে৷ এই ‘উন্নয়নে’র ধাক্কাতেই এ যাবত কালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের প্রাণ গিয়েছে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে৷ ত্রিপুরায় অবশ্য বিজেপির ‘গণতন্ত্র রক্ষায়’ এত ঝামেলা পোহাতে হয়নি৷ গণতন্ত্র রক্ষায় বাধা দেওয়ার মতো অবশিষ্ট আর কেউ তিন দশক ক্ষমতায় থাকার পর সিপিএমে নেই৷ ফলে প্রায় বিনা যুদ্ধেই ‘জয়লাভ’ হয়েছে বিজেপির৷

এই বিজেপিই পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের গা–জোয়ারি দেখে মায়াকান্না জুড়েছিল৷ যেন তারা গণতন্ত্রের কতবড় পূজারি৷ (এদের নেতাই পার্লামেন্টের সিঁড়িতে গড় হয়ে প্রণাম করে বলেছিলেন, গণতন্ত্রের মন্দির৷) কত বড় ভণ্ড এরা, ত্রিপুরার মানুষ তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন৷ মাত্র ছ’মাসেই তাদের গণতন্ত্রের পর্দা ফেঁসে গেছে৷ আসলে অন্য যে রাজ্যগুলিতে ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি সেগুলির মতো ত্রিপুরাতেও তাদের নেতারা বুঝেছেন, সাধারণ মানুষকে দেওয়ার মতো তাঁদের কিছুই নেই৷ জনজীবনের কোনও সমস্যার গায়ে ছোঁয়ার ক্ষমতাও তাঁদের নেই, সমাধান তো দূরের কথা৷ যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে সেগুলি নিতান্তই ফাঁপা প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছু নয়৷ জনগণ অতিদ্রুত তা ধরতে পারছে৷ যত দিন যাবে মানুষের ক্ষোভ ততই বাড়তে থাকবে৷ তাই মানুষ যাতে প্রতিবাদে টুঁ শব্দ করতে না পারে, তার টুঁটি চেপে ধরো, গায়ের জোরে সব কিছুর দখল নাও৷ তারই লক্ষণ দেখা গিয়েছিল ক্ষমতায় এসেই লেনিন মূর্তি ভাঙার মধ্যে৷ ক্ষমতায় এসেছেন তাঁরা সুশাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে৷ তার সঙ্গে তো লেনিন মূর্তি ভাঙার কোনও সম্পর্ক নেই৷ এর পিছনেও কাজ করেছে মানুষকে সন্ত্রস্ত করে দেওয়ার চেষ্টা৷ রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর এই লক্ষ্যেই বিরোধী দলের কর্মীদের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছে৷ পুলিশও ক্ষমতাসীন দলের দাসত্ব করে নিজ চরিত্র বজায় রেখেছে৷ প্রবল ত্রাসের মধ্যে বিরোধীরা যতটুকু মনোনয়নপত্র তুলতে পেরেছিল তা পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূলের মতোই কেড়ে নিয়েছে বিজেপি৷ একই ভাবে বিডিও অফিস ব্যারিকেড করে বিরোধীদের ঘেঁসতেই দেয়নি৷

তবুও পশ্চিমবঙ্গের কিছু মানুষ, যাঁরা এক সময় কংগ্রেসের অপশাসন দেখে চোখ–কান বন্ধ করে সিপিএমকে সমর্থন করেছিলেন, পরে আবার সিপিএমের অপশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে একই রকম ভাবে তৃণমূলকে সমর্থন করেছিলেন– তাঁদেরই একাংশ আজ আবার তৃণমূল অপশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে ভাবছেন বিজেপিই বোধহয় তাঁদের জন্য গণতন্ত্র এনে দিতে পারবে৷ তাঁরা এই দলগুলির চরিত্র, নেতা–কর্মীদের চরিত্র বিচার করে দেখছেন না, যেমন আগেও দেখেননি৷ যখন যে শাসকের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়েছেন তখন তাকে কে পরাস্ত করতে পারবে– শুধু এই কথাই ভেবেছেন৷ একবারও ভাবেননি, যে দলকে নিয়ে আসছি তার শ্রেণিচরিত্র কী? অর্থাৎ দলটি শোষক না শোষিত, কোন শ্রেণির স্বার্থরক্ষার কাজ করছে? সেই দল কি শোষিত সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষা করবে, নাকি আগের শাসক দলগুলির মতোই জনস্বার্থের কথা মুখে বলতে বলতে ক্ষমতায় গিয়ে জনস্বার্থকে পদদলিত করবে, প্রতারিত জনগণের ক্ষোভের কন্ঠকে রোধ করতে গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরবে৷ এসব কোনও কিছুই তারা ভাবেননি৷ যদি ভাবতেন তবে দেখতেন, এই দলগুলি কোনওটিই সাধারণ মানুষ তথা শোষিত শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী দল নয়৷ যে চূড়ান্ত শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আমরা বাস করি, তার রক্ষক পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থবাহী দল এরা৷ আজ মৃত্যুর দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ানো এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যখন পচে গলে গেছে, আপাদমস্তক দুর্নীতির পাঁকে ডুবে রয়েছে, তখন তার স্বার্থ রক্ষাকারী দলগুলির পক্ষে নীতিনিষ্ঠ হয়ে চলা সম্ভব নয়৷ তাই পুঁজিপতিদের অর্থ ও মদতে পুষ্ট বিজেপি কংগ্রেস তৃণমূলের মতো দলগুলির কোনওটিই বাস্তবে গণতন্ত্রের পূজারি হতে পারে না৷ যে কোনও প্রকারে ক্ষমতার দখল নিয়ে একদিকে জনগণের সম্পদ লুঠ করে ভোগ–বিলাসের জীবনযাপন করা, অন্য দিকে পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থে মেহনতি মানুষের উপর তাদের উৎপীড়নের রাস্তা পরিষ্কার করাই এই দলগুলির লক্ষ্য৷ সিপিএম–এর রাজনীতি এর ব্যতিক্রম নয়৷ মার্কসবাদের নামাবলি গায়ে জড়িয়ে গরিব মানুষের স্বার্থ রক্ষার কথা বলতে বলতে এরাও শুরু থেকেই মালিক শ্রেণির তাঁবেদারি করেছে৷ তাই ত্রিপুরায় দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পরও সেখানেও বিজেপির আক্রমণের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর মতো নৈতিক জোর তারা খুঁজে পায় না৷ মানুষ এইভাবে দলগুলির শ্রেণি চরিত্র বিচার করেন না বলেই বারে বারেই ঠকতে হয় আর হতাশ হয়ে বলতে হয়, ও সব দলই সমান, কিংবা যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ৷ এই দলগুলি যে আসলে জাতেই রাবণ, তা ধরতে পারেন না৷ এক দলের অত্যাচারে ক্ষিপ্ত হয়ে গভীর বিচার–বিশ্লেষণ না করেই বড় বড় কথায় ভুলে পুঁজিপতি শ্রেণিরই আশীর্বাদপুষ্ট আর একটি দলকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিলে এভাবেই তাদের ঠকতে হয়৷ ঠিক যেমন বিজেপির বাকচাতুর্যে ভুলে ত্রিপুরার মানুষ আজ টের পাচ্ছেন– বিজেপি কেমন গণতান্ত্রিক দল!

(৭১ বর্ষ ৯ সংখ্যা ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)