তেলের দাম বৃদ্ধির দায় জনগণের ঘাড়ে চাপানো চলবে না, প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে বাস চালাও

রাজ্য সরকার ১ জুলাই থেকে ৫০ শতাংশ যাত্রী নিয়ে বাস চলাচলের ছাড়পত্র দিয়েছিল। কিন্তু দশ-বারো দিন পেরিয়ে গেলেও কার্যত বেসরকারি বাস চলছে না। যাত্রীরা চরম নাজেহাল। কী করে তারা কর্মস্থলে যাবে বা গন্তব্যে পৌঁছাবে, কীভাবেই বা বাড়ি ফিরবে সবটাই প্রশ্ন চিহ্নের সামনে। যেটুকু বাস চলছে তাতেও চলছে যথেচ্ছ ভাড়া আদায়। বাস মালিকরা ইচ্ছামতো কম বাস চালিয়ে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করছে যে, যাত্রীরা বাদুড়ঝোলা হয়ে যাতায়াত করছেন, অথচ দ্বিগুণ-তিনগুণ পর্যন্ত ভাড়া দিতে বাধ্য হচ্ছেন। বাস মালিকরা যাত্রীদের কার্যত ব্ল্যাকমেল করে ভাড়াটা বাড়িয়ে নিতে চাইছে।

এই সঙ্কট সমাধানে সরকারের কোনও হেলদোল নেই। সরকার বাস নামাতে এবং ন্যায্য ভাড়ায় চালাতে বাস মালিকদের উপর কোনও নির্দেশ জারি করছে না। সরকারি কর্তাদের গয়ংগচ্ছ ভাব– যেন বাস মালিকরা চালালে চালাতে পারে, না-ও পারে, যাত্রীরা তাতে উঠতে পারে, নাও পারে। কিন্তু যাত্রীদের তো কর্মক্ষেত্রে না গিয়ে উপায় নেই! তাদের তো বাড়ি বসে থাকলে পেটে ভাত জুটবে না!

এমনিতেই লকডাউনের জেরে গরিব, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত অংশের আয় মারাত্মক ভাবে কমে গেছে। কোটি কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। আরও কয়েক কোটি মানুষের বেতন কমে গেছে। এরই পাশাপাশি সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধিতে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা আরও বিপন্ন। ইতিমধ্যে অভাবের তাড়নায় আত্মহত্যার ঘটনা বাড়তে শুরু করেছে। বাস বন্ধ থাকায় কাজ হারিয়ে ঢাকুরিয়ায় এক বাসচালক বাসের মধ্যেই আত্মহত্যা করেছেন। কলকাতা সহ রাজ্যের সর্বত্র কাজে যাওয়ার জন্য মরিয়া যাত্রীদের অটো-টোটো-ট্রেকার ইত্যাদিতে বিপজ্জনকভাবে গাদাগাদি করে উঠতে হচ্ছে। একদল ধুরন্ধর এটাকেই দেখিয়ে সওয়াল করছেন, মানুষ যখন বেশি টাকা দিচ্ছেই– সরকার বাস ভাড়াটা বাড়িয়েই দিক! অথচ এই ভাবে পরিবহণের খরচ বাড়লে ছোটখাট সংস্থার কর্মচারী, দোকান কর্মচারী, হকার, পরিচারিকা সহ অসংগঠিত ক্ষেত্রের কত শ্রমিকের দরিদ্র-নিম্নবিত্ত পরিবারকে আধপেটা খেয়ে থাকতে হবে, এ খবর তাঁদের না জানার কথা নয়!

ভাড়া বৃদ্ধির পক্ষে বাস মালিকদের যুক্তি, পেট্রল ডিজেলের দাম মারাত্মক হারে বাড়ছে, বাড়ছে যন্ত্রাংশের দাম, বাড়ছে রোড ট্যাক্স, বাড়ছে পুলিশি জরিমানার পরিমাণ। এই যুক্তি তারা আগেও দিয়েছে, এবারেও দিচ্ছে। তাদের দাবি, ভাড়া বাড়াতে হবে এবং কম যাত্রী নেওয়া যাবে না। যাত্রী স্বার্থ রক্ষা করেই এই সমস্যার সমাধানে সরকার জ্বালানির দাম কমাতে রাজ্যের নেওয়া ট্যাক্স কমাতে পারত, তেল কোম্পানিগুলির বিপুল মুনাফা এবং তেলের উপর কেন্দে্রর ট্যাক্স কমানোর জন্য রাজনৈতিক স্তরে চাপ সৃষ্টি করতে পারত। বাস চালানোর জন্য ভর্তুকি দিতে পারত, প্রয়োজনে বাস অধিগ্রহণ করে চালাতে পারত, পুলিশি জরিমানা নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। এগুলি হলে জ্বালানির দাম বৃদ্ধিজনিত আর্থিক চাপটা দুর্দশাগ্রস্ত জনগণের ঘাড়ে চাপত না। অন্যদিকে উপযুক্ত সংখ্যক সরকারি বাস ও ট্রাম চালিয়ে যাত্রীদের দুরবস্থা কমাতে পারত। তাহলে বাসমালিকের মর্জি অনুযায়ী ভাড়া নেওয়া, তা নিয়ে যাত্রীদের সাথে বাস কন্ডাকটরদের বচসা থেকে হাতাহাতি প্রতিদিনকার ঘটনা হত না।

মুখে সরকারি কর্তারা যতই বলুন ভাড়া বাড়ানো হবে না, কার্যত তাদের আচরণ ঘুরপথে ভাড়া বৃদ্ধিতেই ইন্ধন দিচ্ছে। এস ইউ সি আই (সি) এ বিষয়ে বারবার পরিবহণ দপ্তরে স্মারকলিপি দিয়ে আরটিএ অনুমোদিত চার্ট অনুসারে ভাড়া নেওয়ার দাবি জানিয়েছে। কিন্তু সরকার মালিকদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে এই বার্তাই দিচ্ছে যে, যেমন পারো লুটে নাও। বুর্জোয়া শাসকদলগুলি চরিত্রগতভাবেই খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের থেকে মালিকদের প্রতি বেশি দায়বদ্ধতা অনুভব করে। বাস মালিকদের ক্ষেত্রেও তাই। তাদের কাছ থেকে কেন্দ্র এবং রাজ্যের শাসকদল নানা সুবিধাও নেয়। এছাড়াও রাজ্যের প্রাক্তন এবং বর্তমান শাসকদলের বেশ কিছু নেতা-বিধায়ক এমনকি মন্ত্রীও বাস ব্যবসায় ফুলে ফেঁপে উঠেছেন। বিজেপির বর্তমান কিছু নেতা-বিধায়কও বাস ব্যবসায় আছেন। তাই তাঁদের সকলের স্বার্থ এ ক্ষেত্রে এক। ফলে সরকার ও পরিবহণ মালিকদের গোপন বোঝাপড়ার ভিত্তিতে যাত্রী-শোষণ চলছে।

সিপিএম সরকারের আমলেই রাজ্যের সর্বত্র সরকারি বাস পরিষেবাকে দুর্বল করে বেসরকারি মালিকদের হাতে গণপরিবহণকে তুলে দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। কলকাতার পুরনো সরকারি বাস-ট্রাম রুটগুলির পরিকল্পনা এমনভাবে ছিল যাতে সস্তায় শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাত্রীরা যেতে পারতেন। সিপিএম সরকার তাদের মেয়াদের শেষদিকে সেগুলি কার্যত তুলে দিয়ে গেছে। এখন সে ধ্বংস প্রক্রিয়া আরও এগিয়েছে। কলকাতা সহ শহরতলিতে এখন যতটুকু সরকারি বাস চলে তার বড় অংশই এসি। উঠলেই সেখানে ২০-২৫ টাকা ভাড়া। সিপিএম সরকারই ট্রাম পরিষেবাকে দুর্বল করতে শুরু করেছিল, তৃণমূল আমলে তা কার্যত উঠে গেছে বললেই চলে। তেলের এই ব্যাপক দামবৃদ্ধির প্রভাব থেকে মানুষকে বাঁচাতে পরিবেশবান্ধব ট্রামের আধুনিকীকরণ এবং ব্যাটারি চালিত নন-এসি সাধারণ বাসের উপর জোর দেওয়ার চেষ্টা সরকারের নেই। তাদের লক্ষ্য বাড়তি ভাড়ার বাস চালিয়ে মুনাফা লোটা। এর সুযোগ বেসরকারি বাসমালিকরা নিচ্ছেন। পুরো বাস পরিষেবাটাই বেসরকারি মালিকদের মর্জিমাফিক চলছে। সরকারেরই যেখানে গণপরিবহণের জন্য কোনও দায় নেই, বেসরকারি মালিকদের ক্ষেত্রে তো এই প্রশ্নটাই বৃথা! দু’পক্ষই অফিস টাইমের সময়টুকু ছাড়া বাস চালাতে অনাগ্রহী। কলকাতার মতো একটা মেট্রোপলিটন শহর এবং শহরতলিতেও ভোরে এবং একটু রাত হলেই বাস অমিল।

কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের ভূমিকাও অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। তারা গত বছরেই ২০ লক্ষ কোটি টাকা ত্রাণ প্যাকেজ দিয়েছে পুঁজিপতিদের। তারাই বিপুল হারে তেলের দাম বাড়িয়ে চলেছে শুধু তাই নয়, এই দামবৃদ্ধির পুরো বোঝাটা জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে। জনস্বার্থের প্রতি এতটুকু দায়বদ্ধতা অনুভব করলে কেন্দ্রীয় সরকার গণপরিবহণে ভর্তুকির ঘোষণা করে সাধারণ মানুষকে সুরাহা দেওয়ার অন্তত চেষ্টা করত। কিন্তু তারা যাদের দাসত্ব করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গদি ভোগ করছেন, সেই ধনকুবের মালিকদের ছাড়া আর কারও প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা নেই। বরং কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার চেষ্টা করছে যাত্রী এবং পণ্যের গণপরিবহণের পুরো ব্যবস্থাটাকেই বৃহৎ কর্পোরেট কোম্পানির হাতে তুলে দিয়ে একচেটিয়া পুঁজিমালিকদের মুনাফার ব্যবস্থা করতে। রেলে তারা এই কাজ শুরু করেছে। সড়ক পরিবহণের উপরও তাদের কর্পোরেট প্রভুদের কৃপা দৃষ্টি যথেষ্ট। এর মধ্যে মার খাচ্ছে জনস্বার্থ।

গণপরিবহণের মতো একটা অত্যাবশ্যক পরিষেবাকে মুনাফার দৃষ্টিতে কোনও সভ্য দেশের সরকার দেখাতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গে এ নিয়ে বারবার আন্দোলন হয়েছে। ১৯৫৩ সাল থেকেই এ নিয়ে বারবার আন্দোলনে ফেটে পড়েছে মানুষ, গুলির সামনে দাঁড়িয়েছে, শহিদ হয়েছে। ১৯৮৩ সালে কলকাতা এবং পুরুলিয়ায় পুলিশ গুলি চালিয়েছে। পুরুলিয়ায় শহিদ হয়েছেন কমরেডস হাবুল রজক, শোভারাম মোদক এবং কলকাতায় স্থানীয় যুবক দুলাল দাস। ১৯৯০ সালে বাস ভাড়াবৃদ্ধি প্রতিরোধ আন্দোলনে শহিদ হয়েছেন মাধাই হালদার। ১৯৯০-এর পর থেকে বিশ্বায়নের স্লোগানে সুর মিলিয়ে কেন্দ্র এবং রাজ্যে ক্ষমতাসীন সব দলের সরকারই পরিষেবা ক্ষেত্র থেকে হাত গুটিয়ে নিয়ে সেগুলিকে বৃহৎ মালিকদের মুনাফার মৃগয়া ক্ষেত্রে পরিণত করতে চাইছে। গণপরিবহণেও তাদের একই চেষ্টা চলছে।

গত বছর লকডাউনের পর বাস চালু হলে ভাড়া নিয়ে সরকার এমনই এক ‘নির্লিপ্ত’ ভূমিকা নিয়ে বাসমালিকদের জনগণের পকেট কাটার সুযোগ করে দিয়েছিল। কিন্তু সাধারণ যাত্রীরা তা মানেননি। তাঁরা মালিকদের এই যথেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। ফলে বহু রুটেই ভাড়া কমাতে মালিকরা বাধ্য হয়েছিল। এবারও সরকার ও বাস মালিকদের এই যোগসাজশ ভাঙতে যাত্রীসাধারণকে নিতে হবে সক্রিয় ভূমিকা। এস ইউ সি আই (সি) পরিবহণমন্ত্রীর কাছে দাবি জানিয়েছে, যাত্রীদের কাছ থেকে বাসে বাড়তি ভাড়া আদায় রুখতে সরকারকে পদক্ষেপ করতে হবে। আরটিএ দপ্তরে এই দাবি জানানো হয়েছে। দল এ নিয়ে লাগাতার আন্দোলনের কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। ভুক্তভোগী মানুষকে এই আন্দোলনে এগিয়ে আসতে হবে। গড়ে তুলতে হবে যাত্রী কমিটি। বাসমালিক এবং সরকারের যথেচ্ছাচার রুখতে এটাই একমাত্র পথ।

গণদাবী ৭৩ বর্ষ ৩৯ সংখ্যা