তেলের দাম বাড়লে জনগণের পকেট কেটে তহবিল ভরায় সরকার

 

অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে জনজীবন বিপর্যস্ত। অথচ সরকার বারে বারে বাড়িয়েই চলেছে পেট্রল-ডিজেলের দাম। সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী কলকাতায় লিটার-পিছু পেট্রলের দাম হয়েছে ৮৬.৩৯ টাকা। ডিজেল ৭৮.৭২ টাকা প্রতি লিটার।

এমনিতেই অর্থনীতির বেহাল দশায় জনজীবন জেরবার। তার উপর করোনা অতিমারির ধাক্কা কর্মহীনতা অনেক বাড়িয়েছে। রোজগার কমে গেছে ব্যাপক ভাবে। এই পরিস্থিতিতে পেট্রল-ডিজেলের অস্বাভাবিক চড়া দামে পরিবহণ খরচ বেড়ে গিয়ে জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়তে থাকায় মানুষের দুর্দশা ভয়ঙ্কর চেহারা নিচ্ছে।

সরকার বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম বেড়েছে, ফলে তারা নিরুপায়। কিন্তু সত্যিই কি তাই? তথ্য তো বলছে, পেট্রল-ডিজেলের এই চড়া দামের আসল কারণ সরকারের চাপানো উৎপাদন শুল্ক ও সেস, যা ক্ষমতায় বসে ব্যাপক হারে বাড়িয়েছে নরেন্দ্র মোদি সরকার! ২০১৪ সালের মে মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দর ব্যারেল প্রতি ছিল ১০৮ ডলার, অর্থাৎ সেই সময়কার হিসাবে ৬৩৩০ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে দিনে দিনে কমেছে সেই দাম। কিন্তু পাশাপাশি দেশীয় বাজারে ক্রমাগত বাড়ানো হয়েছে এই দুই জ্বালানির ওপর উৎপাদন শুল্ক ও সেসের পরিমাণ। ২০১৪-র মে মাসে কেন্দ্রীয় সরকারি ক্ষমতায় বিজেপি যখন প্রথমবার বসে, তখন পেট্রল ও ডিজেলে উৎপাদন শুল্ক ছিল যথাক্রমে ৯.২০ টাকা ও ৩.৪৬ টাকা। গত সাড়ে ছ’ বছরে সেই শুল্ক বাড়ানো হয়েছে যথাক্রমে ২৫৮ শতাংশ ও ৮২০ শতাংশ! এই কারণেই গত এপ্রিলে, গোটা বিশ্ব যখন করোনা জ্বরে কাঁপছে, লকডাউনে ব্যাপক চাহিদা কমে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম শূন্যেরও নিচে নেমে যাওয়া সত্তে্বও এ দেশে পেট্রল ও ডিজেলের দাম ছিল লিটার পিছু যথাক্রমে ৭০ টাকা ও ৬২ টাকা। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম ব্যারেল পিছু ৫০.৯৬ ডলার বা ৩৭২৫.৯২ টাকা, অর্থাৎ ২০১৪ সালের তুলনায় অনেক কম হওয়া সত্ত্বেও ভারতে পেট্রল-ডিজেলের দাম আকাশ ছুঁয়েছে।

হিসাব বলছে, পেট্রল-ডিজেলের ওপর অস্বাভাবিক হারে শুল্ক ও সেস চাপিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এই ক’বছরে লুটে নিয়েছে ১৯ লক্ষ কোটি টাকা। উৎপাদন শুল্ক ও যুক্তমূল্য কর অর্থাৎ ভ্যাট ধরলে পেট্রোপণ্যের দামের তিনভাগের দু’ভাগই ঘরে তোলে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার। মানুষ প্রশ্ন তুলেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম বাড়ার অজুহাতে সরকার যদি দেশের বাজারে পেট্রল-ডিজেলের দাম বাড়ায়, তাহলে যখন অশোধিত তেলের দাম একেবারে তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছিল, তখন সেই অনুপাতে দাম কমানো হয়নি কেন? তা যদি করা হত, তা হলে অশোধিত তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও এখন জ্বালানি তেলের দাম খানিকটা হলেও কম থাকত। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, বাড়তি শুল্ক যদি সরকার তুলে নেয়, তা হলে ঠিক এই সময়ে পেট্রল-ডিজেলের দাম নেমে গিয়ে দাঁড়াবে লিটার পিছু যথাক্রমে ৬০.৪২ টাকা ও ৪৬.০১ টাকা। অর্থাৎ এই বাড়তি ট্যাক্সের বোঝা বইতে না হলে এখন দেশের মানুষ ২০১৪ সালের চেয়েও কম দামে পেট্রল-ডিজেল পেতে পারে। এতে দাম কমতে পারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের। একটু হলেও সুসহ হতে পারে দেশের খেটে-খাওয়া গরিব মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা।

অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও অতিমারির প্রকোপে বিপন্ন এ দেশের মানুষ তো এটাই চাইবে যে সরকার তাদের অসহনীয় দুরবস্থা ঘোচানোর চেষ্টা করুক, চেষ্টা করুক জিনিসপত্রের দাম যতটা সম্ভব কমিয়ে রাখার! একটি গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে দেশের মানুষের এমন আশা করাটাই তো স্বাভাবিক ও ন্যায্য! এবং সরকার চাইলেই এ কাজটা করতে পারে।

অথচ তা না করে সরকার বলছে, শুল্ক কমানো হলে নাকি ঘাটতি পড়বে রাজকোষে! রাজকোষ ঘাটতি নিয়ে এতই যদি দুশ্চিন্তা, তাহলে এই বিপন্ন সময়ে দিল্লিতে নতুন সংসদ ভবন বানানো সহ রাজকীয় সেন্ট্রাল ভিস্টার বিলাসবহুল প্রাসাদ তৈরিতে ২০ হাজার কোটি টাকা ঢালছে কেন সরকার? রাজকোষে বিপুল ঘাটতি হতে পারে জেনেও এই সরকারই তো লক্ষ কোটি টাকা ছাড় দিচ্ছে পুঁজিপতিদের! ঢালাও ছাড় দিচ্ছে করে, মকুব করছে ব্যাঙ্কঋণ। সর্বোপরি ব্যবসায় উৎসাহ দেওয়ার নামে বিপুল টাকা ভরতুকি দিচ্ছে তাদের। অথচ দেখা যাচ্ছে, পেট্রল-ডিজেলের শুল্ক কমানোর কথা উঠলেই রাজকোষ ঘাটতি অলংঘনীয় বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাদের কাছে!

আসলে সাধারণ মানুষ সম্পর্কে, তাদের দৈনন্দিন জীবনের অসহনীয় দুর্দশা সম্পর্কে পুঁজিবাদী সরকারগুলির দৃষ্টিভঙ্গি এমনই। দেশের আসল মালিক হাতে গোনা একচেটিয়া পুঁজিপতিদের রাজনৈতিক ম্যানেজার এইসব সরকার এভাবে তেলের দাম বাড়িয়ে, জনসাধারণের উপর করের বাড়তি বোঝা চাপিয়ে, সেই লুটের টাকা দিয়েই নগ্নভাবে মালিকদের সেবা করে। তাতে মূল্যবৃদ্ধির ভারে সাধারণ মানুষের পিঠ যদি নুয়ে পড়ে তো পড়ূক না! তাদের প্রতি ন্যূনতম দায়িত্ব পালন করার দায় নেই এই সরকারের। তাদের যাবতীয় দায়বদ্ধতা পুঁজিমালিকদের প্রতি। ঠিক এমন করেই জমিদারের লুটের স্বার্থে শোষণ বঞ্চনায় রিক্ত প্রজাদের পিঠে চাবুক চালাত অনুগত নায়েবরা। কালের নিয়মে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ ঘটেছে। ‘সংসদীয় গণতন্ত্র’ এই নামের আড়ালে কায়েম হয়েছে পুঁজিপতি শ্রেণির শাসন-শোষণ। দেশের জনসাধারণকেই এখন পাঁচ বছর অন্তর বেছে নিতে হয় ‘নিজেদের সরকার’কে, ক্ষমতায় বসে যে সরকার মালিকের মুনাফার স্বার্থ অটুট রাখতে শোষণের জালে আস্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলে শ্বাসরোধ করে মারে সেই জনসাধারণেরই। পেট্রল-ডিজেলের দামের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি পুঁজিমালিক-সরকারের এই অশুভ জোটের ছবিই স্পষ্ট করে তুলে ধরছে।

(গণদাবী-৭৩ বর্ষ ১৮ সংখ্যা_২২ জানুয়ারি, ২০২১)