তথ্য বিকৃত করে ইংরেজি হটানোর দায় থেকে সিপিএমকে বাঁচানোর চেষ্টা

এ রাজ্যে ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের প্রতি সাধারণ মানুষের আকর্ষণ এবং বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলির প্রতি অনীহা সম্পর্কে আলোচনায় সাধারণত সরকারি স্কুল থেকে ইংরেজি বিতাড়নের বিষয়টি এসে যায়৷ এই ধরনের আলোচনাকে কটাক্ষ করে ২৭ মার্চ জনৈক পত্রলেখক একটি বাংলা দৈনিকে বলেছেন, ‘ইংরেজি বিতাড়নের জন্য তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো একটি ‘তথ্যগত ভুল’৷ ‘প্রকৃত চিত্র’  তুলে ধরার জন্য ওই চিঠিতে তিনি যা যা বলেছেন, তা সত্যমিথ্যার একটি মিশেল, যার উদ্দেশ্য ইংরেজি হটানোর দায় থেকে সিপিএমকে রেহাই দেওয়া৷

ওই চিঠিতে তিনি বলেছেন, ১৯৮৪ সাল থেকে ইংরেজি বিদায় নেয়৷ তথ্যটি আদৌ সঠিক নয়৷ ইংরেজি বিদায় হয়েছিল ১৯৮১ সাল থেকে৷ যে কমিটির সুপারিশক্রমে ইংরেজি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় বলে চিঠিতে লেখা হয়েছে, সেই অধ্যাপক হিমাংশু বিমল মজুমদার কমিটি ১৯৭৫ সালে নয়, গঠিত হয়েছিল ১৯৭৪ সালে কংগ্রেস আমলে৷ কমিটি গঠিত হলেও বাস্তবে সেই কমিটির কাজ শুরু হয়েছিল জ্যোতি বসুর সরকারের আমলে ১৯৭৭ সালে এবং প্রথম সভাটি হয়েছিল তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ দে–র চেম্বারে ’৭৭ সালের ১৩ আগস্ট৷ উক্ত সভায় মন্ত্রীমহোদয় ঘোষণা করেছিলেন বামফ্রন্ট সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত– যেখানে বলা হয়েছিল,  (ক) পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজি পাঠদান বন্ধ, (খ) চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পাশ–ফেল প্রথা বিলোপ করে অটোমেটিক প্রমোশন প্রথা চালু করা৷ ওই বছরেই প্রাথমিক শেষ পরীক্ষাও(চলতি কথায় বৃত্তি পরীক্ষা)বন্ধ করে দেওয়া হয়৷

এদিকে সিলেবাস কমিটির সভা চলতে থাকে৷ কমিটিতে যাতে কোনও প্রতিবাদ না ওঠে, এবং অনায়াসে সিদ্ধান্ত অনুমোদন করিয়ে নেওয়া যায় সেই কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য অনেক দলীয় সমর্থককে যুক্ত করা হয়৷ এই সিদ্ধান্তের সর্বনাশা পরিণাম লক্ষ করে এস ইউ সি আই (সি) তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে এবং রাজ্যের বুদ্ধিজীবীরাও শিক্ষা বাঁচাতে পথে নামেন৷ কিন্তু সিপিএম সরকার কোনও প্রতিবাদকে গুরুত্ব না দিয়ে, সরকারি ক্ষমতার জোরে ১৯৮১ সাল থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজি পঠন–পাঠন ও চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পাশ–ফেল বিলোপ করে দেয়৷ বাস্তবে হিমাংশু বিমল মজুমদার কাজ শুরু করার আগেই বামফ্রন্ট সরকার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কমিটিকে দিয়ে তা পাশ করিয়ে নেয়৷

ওই চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, কংগ্রেস আমলে ১৯৫০ সাল থেকে প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি সম্পূর্ণ তুলে দেওয়া হয়৷ কিন্তু অভিভাবকদের বিপুল চাপের ফলে ১৯৬৪ সালে প্রাথমিকে আবার ইংরেজি ফিরে আসে এবং তা তৃতীয় শ্রেণি থেকে৷ এখানেও পত্রলেখকের ভুল হয়েছে৷ কংগ্রেস আমলে এক বার ইংরেজি তুলে দেওয়া হয়েছিল– এ কথা ঠিক, কিন্তু তা ১৯৫৬ সালে৷ এবং ১৯৬৪ সালে তা আবার ফিরে এসেছিল৷ দ্বিতীয়ত, অভিভাবকদের বিপুল আন্দোলনের চাপের ফলে তা ফিরে এসেছিল বলে চিঠিতে যা বলা হয়েছে– তা ঠিক নয়৷ কারণ কংগ্রেস আমলে ইংরেজি তুলে দেওয়া হলেও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে কোনও কড়াকড়ির বাধা ছিল না৷ যার ইচ্ছা পড়তে ও পড়াতে কোনও বাধা ছিল না৷ অভিভাবকরা বিপুল চাপ সৃষ্টি করেছিলেন এ কথাও ঠিক নয়৷ যেহেতু, ইংরেজি পড়াতে কোনও বাধা ছিল না– তাই তেমন কোনও আন্দোলনও তখন গড়ে ওঠেনি৷ কংগ্রেস সরকার নিজেরাই উপলব্ধি করে পুনরায় তৃতীয় শ্রেণি থেকে ইংরেজি পুনঃপ্রবর্তন করলেও সমস্ত বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণি থেকেই তা পড়ানো হত৷

জ্যোতি বসু সরকারের আমলে জোর করে সিপিএমের দলীয় সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ইংরেজি, পাশ–ফেল ইত্যাদি তুলে দেওয়া হয়েছিল৷ অন্যদিকে রাজ্যের শিক্ষাবিদ–বুদ্ধিজীবীদের যুক্তিপূর্ণ বক্তব্যকে তাঁরা আদৌ গুরুত্ব দেননি৷ ১৮ বছর আন্দোলনের পর এস ইউ সি আই (সি)–র আহ্বানে ১৯৯৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি একটি সফল বাংলা বনধ–এর কাছে এদের মাথা নোয়াতে হয়৷ তবুও তারা সঙ্গে সঙ্গে তাকে মর্যাদা দিয়ে ইংরেজি চালু করেনি৷ এরপর দলীয় সমর্থক অধ্যাপক পবিত্র সরকারকে দিয়ে এক সদস্যের কমিটি গঠন করে আরও একটি বছর সময় পার করে দেয়৷ সবশেষে ১৯৯৯ সালে (দ্বিতীয় শ্রেণির মধ্যভাগ থেকে) ইংরেজি চালু করা হয় এবং আরও আন্দোলনের চাপে ২০০৪–’০৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রথম শ্রেণি থেকে ইংরেজি চালু হয়৷ কিন্তু পাশ–ফেল চালুর ক্ষেত্রে তারা সম্পূর্ণ নীরব থাকে৷

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, কংগ্রেস আমলে ১৪ বছর, আর বামফ্রন্ট আমলে ১৫ বছর ইংরেজি পড়ানো বন্ধ ছিল৷ অনেকটা দেখানোর চেষ্টা–দুই আমলে প্রায় একই ছিল৷ কিন্তু বাস্তবে কী দেখা গেল? কংগ্রেস আমলে ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৩ অর্থাৎ ৮ বছর অফিসিয়ালি বন্ধ থাকলেও কড়াকড়ি না থাকায় ইংরেজি পড়ানো অব্যাহতই ছিল৷ কিন্তু বামফ্রন্ট আমলে ১৯৮১ থেকে ১৯৯৯ দীর্ঘ ১৯ বছর জবরদস্তি ইংরেজি পড়ানো বন্ধ করার ফলে সারা রাজ্যে বিপুল সংখ্যায় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল গড়ে উঠতে থাকল৷ শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যবসার বাজার রমরমা হয়ে ওঠে৷ বামফ্রন্টের অনেক নেতা–মন্ত্রী ও তার অনুগামীরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল খুলে ব্যবসা করতে শুরু করলেন৷ পাশাপাশি সরকারি ও সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়গুলি ধুঁকতে শুরু করল৷ শিক্ষার প্রভূত ক্ষতি করে এক বিশাল প্রজন্মকে পঙ্গু করে সমাজে দুই শ্রেণির নাগরিক সৃষ্টির পথ এরা শুধু প্রশস্ত করল তাই নয়, সাধারণ গরিব  ঘরের  সন্তানদের  চিরকালের মতো পঙ্গু করে দেওয়ার সর্বনাশা ব্যবস্থা কায়েম করল৷

এ এক ঐতিহাসিক অপরাধ৷ এই অপরাধ থেকে সিপিএমকে বাঁচাতে পত্রলেখক অনেক কমিশনের কথা বলেছেন– যেমন মুদালিয়ার কমিশন, কোঠারি কমিশন, ইংরেজি অধ্যাপকদের সম্মেলন, হিমাংশু বিমল মজুমদার কমিটি ইত্যাদি, যার মাধ্যমে তিনি দেখাতে চেয়েছেন–সব কমিশনের সুপারিশই প্রাথমিকে ইংরেজি পড়ানোর বিরুদ্ধে ছিল৷ কিন্তু যে কমিশনের কথা তিনি সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছেন বা তাঁর ভাবনার মধ্যেই আসেনি–তা হল ‘জনগণের কমিশন’, যে দরবারে সকলের বিচার হয় এবং সমস্ত কমিশন ও সরকারি শক্তিকে যে গণরায়ের সামনে নতশিরে দাঁড়াতে হয়৷১৯ বছরের আন্দোলনের চাপে সরকারকে বলতে হয়েছিল–‘ভুল হয়ে গিয়েছে’– এবং ইংরেজি ফিরিয়ে দেওয়ার কথা স্বীকার করতে হয়েছিল৷ কিন্তু এখনও পাশ–ফেল চালু হয়নি৷  এই অবস্থায় সরকারি সুক্লে এমন ছন্নছাড়া পঠন–পাঠনের প্রতি মানুষের আকর্ষণ কি বাড়তে পারে? ফলে শিক্ষার এই দুর্দশার জন্য সিপিএম সরকার কাঠগড়ায় উঠবেই৷ তা না হলে, বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন হবে না৷

(৭০ বর্ষ ৩৯ সংখ্যা ১৮ মে, ২০১৮)